| 10 নভেম্বর 2024
Categories
গল্প সাহিত্য

লাশযাত্রা

আনুমানিক পঠনকাল: 9 মিনিট

Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.comউদ্দীনের বাবার বয়স বিরাশি’র মতো। তবে, এতোটা বয়স্ক মনে হতো না। এই ধরেন, ৭৫/৭৬ মনে হয়।তবে, হার্টে নাকি কী সবভেজাল আছে। কিছুদিন ধরে পেশাবের সমস্যাটাও বেড়েছে। উদ্দীন কাজ করে একটি গারমেন্টস কারখানায়। বাবার পরীক্ষানিরীক্ষা নিয়মিত করার চেষ্টা করে।মাঝে মাঝে বিভিন্ন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারও দেখিয়েও আনে। তবে গত দু’মাস বাবাকে সেকরোনা নিরাপত্তার কথা ভেবে ঘর থেকে বের হতে দেয় নাই। ডাক্তার দেখানোও হয়নি এরমধ্যে। নিজেও সতর্কভাবেই নিত্যডিউটি সেরে ফিরে খুব ক্লান্ত থাকে। বাবাকে দূর থেকে দেখতে হয়। কাছে যাওয়া নিরাপদ নয়। সেদিন বাবাকে বলেই বেরিয়েছিলোকাজে যাচ্ছে। হাসপাতালে ঢুকেই ফোন পায়, তাঁর বাবার বুক ব্যথা হচ্ছে। সে আবার রওনা দেয় বাসার পথে। এখন ঢাকায়গাড়ির চাপ কম, ২০ মিনিটেই পৌঁছে গেল। সে তার বাবাকে পাঁজাকোলা করে বেবিট্যাক্সিতে ঢুকিয়ে কাছের একটা ক্লিনিকে নিয়েযায়। কিন্তু ক্লিনিকের ইমারজেন্সি ঘরে ঢুকানোর সময় হঠাৎ এক লম্বা শ্বাস টেনে থেমে যান উদ্দীনের বাবা শমশের সাহেব। শের-এর মতোন মানুষটা এভাবে বিনা লড়াইয়ে বিড়ালের মতো চলে যাবে তা উদ্দীন বুঝতে পারেনি। যাই হোক নিষ্ফল ক্ষোভ সংবরণকরে ডেথ সার্টিফিকেট নিয়ে বাবার লাশ নিয়ে ফিরলো বাসায়। পরিবারের সদস্যদের কান্নার রোল কিছুটা স্তিমিত হলে উদ্দীনছোট ভাইয়ের সাথে আলাপ করে কী করা যায়। করোনার সময় লাশ নিয়ে পরিবারের সবাই কীভাবে যাবে এতদূর সেই কুড়িগ্রাম।তা’ও আবার শহর থেকে অনেক ভেতরে উলাপুর গ্রামে। 

ঠিক হলো, সবাই যাবার দরকার নেই।শুধু উদ্দীন আর তার ছোটভাই ফখর একটা লাশ পরিবহনের গাড়ি নিয়ে যাবে। যততাড়াতাড়ি যাওয়া যায় ততোই মঙ্গল। 

কথা মতো দুই ভাই রওনা দিলো বাবার লাশটি নিয়ে।ভাগ্যিস একটা ফ্রিজার আছে, নয়তো এই গরমে লাশের অনেক ক্ষতি হয়েযেতো, তবে অনেক বেশি খরচা হয়ে গেল। শহর থেকে বেরোতেই পুলিশ আটকায়। উদ্দীন পুলিশকে সব কিছু খুলে বলে, কিন্তুতারা বলে কোভিড সার্টিফিকেট লাগবে। উদ্দীন বলে সে জানে তার বাবার কোভিড হয়নি। পুলিশের বড় অফিসারের কাছেগিয়েও উদ্দীন সুরাহা করতে পারে না। তখন সে ড্রাইভারকে গাড়ি ঘুরাতে বলে। গাড়ি একসময় পৌঁছায় এক জেনারেলহাসপাতালের সামনে। উদ্দীন গিয়ে অনেক খোঁজ খবর করে টেস্ট করার জন্যে একটা টিকেট কাটে। তারপর স্যাম্পলকালেকশনের রুমে যেতে দেখে বিরাট লম্বা লাইনে রোগীরা অসহায় দাঁড়িয়ে। 

উদ্দীন তার ভাই ফখরকে গাড়ির কাছে থাকতে বলে লাইনে দাঁড়ায়। এতসব ঘটনায় তৃষ্ণার্ত হয়ে পড়েছে।অথচ সে রোজারেখেছে। ভীষণ ক্লান্ত অবসন্ন হয়ে কেবল ঘড়ি দেখছে। অবশেষে বিকেল ৪টার দিকে যখন সে একজন টেকনোলজিস্টের সামনেএসে দাঁড়ালো, টেকনোলজিস্ট বলে হা করেন। তখন উদ্দীন বলে, ভাই রোগী তো লাশগাড়িতে। এতে টেকনোলজিস্ট রেগেমেগেঅস্থির। সে অনেক করে বুঝালো, কিন্তু টেকনলজিস্ট কিছুতেই লাশের স্যাম্পল নেবে না। এই নিয়ে শুরু হলো বিতণ্ডা। একসময়সব কর্মচারী এসে উদ্দীনকে মারতে উদ্যত হয়। তারপর সিকিউরিটি এসে তাকে তাড়িয়ে দেয় ভিক্ষুকের মতোন। হতাশ বিধ্বস্ত মননিয়ে উদ্দীন লাশগাড়ির কাছে ফিরে এলে  ফখরকে জড়িয়ে ধরে সে কী হাউহাউ করে কান্না। লাশগাড়ির চালক বললো, “ভাইজান কাঁইদেন না। এখন তো ৫টা বাজে প্রায়। আমরা একটু রাত হইলে রওনা দেব রাত ১০টার পরে পুলিশ আর অতোচেকটেক করে না, আমি দ্যাখসি”। উপায়ান্তর নাই যখন অগত্যা রাত বাড়ার অপেক্ষায় দুই ভাই লাশের গাড়ি নিয়ে হাসপাতালেরগেইটের বাইরে রাস্তায় বসে থাকে। কিছু বিস্কুট আর পানি একটা বাজেমালের দোকান থেকে কিনে চিবাতে চিবাতে ঝিমায়।একসময় চোখও লেগে আসে। তারপর তার বাবা হঠাৎ গাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে আর তাদের দুভাইকে ডেকে বলে চল, আমরাগাড়ি রেখে উড়ে উড়ে চলে যাই। ফখর বিস্ময়ে বলে-

— উড়ে উড়ে 

বাবা বলে 

— হ্যাঁ। কেন, আমি তোদের ছোটবেলায় কতো উড়িয়েছি। ভুলে গেলি?

— না বাবা ভুলিনি।

উদ্দীন বলে

— চলেন তাইলে, দেরী করে আর কী লাভ!

তারপর বাবা তাদের দুই ভাইকে দুই হাতে ধরে হাল্কা পায়ে রাস্তাকে ধাক্কা দিয়ে উড়তে শুরু করলো।উদ্দীন বিস্ফারিত চোখেদেখছে তারা চিলের মতো ঘুরে ঘুরে উড়ে যাচ্ছে দূর থেকে দূরে। যেন হাজার হাজার বছর তারা পাখি ছাড়া আর কিছু নয়। উড়েযাচ্ছে তো উড়েই চলেছে। হঠাৎ একটা অনেক উঁচু বিল্ডিং পাশ কাটানোর সময় উদ্দীনের কাঁধে ধাক্কা লেগে গেল। বাবার হাতফসকে উড্ডীন নীচে পড়তে থাকলো। ভয়ে তার চোখ বন্ধ করে ফেললো। এমন সময় কে যেন তাকে দুই কাঁধে চেপে ধরলো।একটা ঝাঁকি খেয়ে থেমে গেলো অধ:পতন। চোখ মেলে দেখে, লাশগাড়ির চালক আবুল মিয়া তাকে ঘুম ভাঙানোর চেষ্টায়ঝাঁকাচ্ছে। সহসা চোখ ফেরালো সে বাবার দিকে। না, লাশ গাড়িতেই আছে। ফখরও জেগেছে। আবুল মিয়া বলে “চলেনভাইজান, আল্লার নাম লই রওনা দিই”। উদ্দীন ভুতে পাওয়া বিভ্রান্তের মতো গাড়িতে উঠে বসে। আবার তাদের যাত্রা শুরু হলোপিতৃভূমির পথে। আবুল মিয়া 

ঠিকই বলেছে, পুলিশ দুয়েকজন আসছে বটে, তবে তেমন তোড়জোড় নেই।ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসে ঢাকার সীমানা ছেড়ে।আবুল মিয়া একটা বিড়ি ধরায় এবার। গুনগুন করে সুব ভাঁজে ‘এই পথ যদি না শেষ হয়…’

একসময় গাড়ি এসে পৌঁছে ফেরীঘাটের কাছে। এখানে বিশাল লম্বা লাইন।সামনে ঈদ, তাই সবাই ঘরে ফিরছে। এরা সবম্যাঙ্গোপিপল। এদের কোনো ডরভয় নেই। করোনা নিয়ে ভাবার সময় এদের নেই। পুলিশের জ্বালাত বাধ্য হয়ে নাকমুখে কাপড়েরপট্টি একটা রেখেছে, তবে প্রায় সময়ই সেটা দাঁড়ি ঢাকার কাজ করছে। আরে ওসব পরে থাকলে বিড়িটা টানবে কোন পথে? একফাঁকে গাড়ি থেকে বেরিয়ে রাস্তার একপাশে প্যান্ট খুলে দাঁড়াত উদ্দীন। তলপেট টনটন করছে। উত্তেজনায় পেশাব করার কথাইভুলে গিয়েছিল। এখন যেই হোসপাইপ ছেড়েছে, থামার নামই করছে না। ওদিকে আবুল মিয়া হরন দিয়ে ডাকছে। দুইবার চিৎকারকরে ভাইজান ভাইজান ডাকও দিয়েছে। সে বললো, তোমরা আস্তে আগাও। আমি আসছি। এখন তার কাছে ত্যাগই পরম শান্তিরপথ, তার পাশে এক যুবক এসে প্যান্টের চেইন খুলে দাঁড়িয়ে গেল। উদ্দীন তাকিয়ে দেখে মাস্কের মাঝখানে একটা ফুটা করে কীসুন্দর বিড়ি টানছে! উদ্দীনের হঠাৎ খুব বিড়ি টানতে ইচ্ছা হলো। সে একটা বিড়ি চেয়ে নিলো তার কাছ থেকে। তারপর দুই জনবিড়ি টানতে টানতে বৃক্ষের গোঁড়ায় ইউরিয়া ছড়ানো শেষ করে যার যার গাড়ির দিকে রওনা দিলো। গাড়ি কিছুদূর গিয়ে আবারলাইনে দাঁড়ানো। উদ্দীন একটু সামনে এগিয়ে দেখতে গেল পরিস্থিতি। যেতে যেতে আরো দুইটা লাশগাড়ি তার চোখে পড়লো।ওদের সাথে আলাপ করে জানলো একজন হাসপাতালে মরেছে বলে কোভিড সার্টিফিকেট পেয়েছে। তবে নেগেটিভ। তাই সমস্যানাই। অপরজন জানালো, আল্লা যা করে করবে, সার্টিফিকেটের জন্য তো অলরেডি ১ দিন নষ্ট করলাম। কোনো উপায় পাইনি।তাই রাতের অন্ধকারে নিয়ে যাই। উদ্দীন বুঝলো, তার সমব্যথী আরও অনেক আছে। মনটা একটু স্থির হয়। একসময় ফেরীতেউঠলো তাদের গাড়ি। রাত ৩টা। আবুল মিয়া বলে ভাইজান, আহেন সেহেরি খাইয়া লই। উদ্দীনের পেটে খিদা লাগে না। ফখরবলে, কালকের দিল কেমন যাবে জানি না ভাইজান, চলেন কিছু খাই। আবুল মিয়া অর্ডার করে তাদের খাওয়ালো। খাবার বিলওআবুল মিয়াই দিলো। 

ফেরা পার হয়ে আবার পথে নামলে গাড়ি। কিছুদূর যেতে রাস্তার পাশে হৈহল্লা শুনে এরা সব ঘাবড়ে গেল।ডাকাত পড়েছে কিনাকে জানে। জটলার সামনে পৌঁছালে দেখে পথ বন্ধ। আবুল মিয়া নেমে খোঁজ নিতে গেল। একটু পর ফিরে এসে জানায়, হেরামুদ্দারের কবর দেওল লই লাগছে’। কবরস্থান কমিটির সেক্রেটারি নাকি কোভিড রোগীকে এইখানে করব দিতে দেবে না, তাইতারা ইউনিয়ন চেয়ারম্যানের সার্টিফিকেট নিয়ে আসতে বলে। কিন্তু মৃত ব্যক্তির পরিবারের লোকজন তা আনতে গেলেচেয়ারম্যান  কোভিড টেস্টের রিপোর্ট দেখাতে বলে। ওদের রোগী মারা গেছে বাড়িতে। কোভিড পরীক্ষা করতে শহর যাওয়া, তারপরলাইন ধরে টেস্ট করার চেষ্টা করতে হলে অনেকদূর নিয়ে যেতে হবে লাশ। অনেক সময়ও যাবে। তাই তারা এখনই লাশ কবরস্থকরতে চায়। এসব দেখে দুই ভাই আরও শঙ্কিত হয়ে পড়ে। একটু পড়ে লোকাল পুলিশ এসে প্যাঁদানি দিয়ে ওদের রাস্তা থাকেতাড়াত বটে, কিন্তু সমস্যার সমাধান হয় না। রাস্তা পরিষ্কার হতেই গাড়ি আবার ছুটলো এর মধ্য সূর্য উঠেছে। উদ্দীন আকাশেরদিকে তাকিয়ে খুব বিস্ময়ের সাথে দেখে কমলা থালার মতো গোল এই আলোর রাজার আগমনে ধরিত্রী কেমন সুন্দর হয়েসেজেছে! আবুল মিয়া আবার সুর ভাঁজে ‘আওয়ারাহুঁ…আওয়ারাহুঁ…’ উদ্দীন আনননা হয়ে পড়ে। ফখর এখনও ঘুম। ছোট ভাই, ৫ বছরের ছোট, কতো কোলেপিঠে তাকে নিয়েছে একদিন! 

সকাল সাড়ে আটটা নাগাদ আবার থামাতে হলো গাড়ি।আবার উত্তাপ ছড়িয়েছ প্রধান সড়কে! এবারে সমস্যা ভিন্ন। আবুলমিয়া এতোক্ষণে দক্ষ গোয়েন্দা হতে গিয়েছে—

— ভাই হেগো এ্যাক বেডা কোবিট পজিটিব লইয়া ঢাকাত্তুন পলাইয়া শশুরবাড়ি আইছিল।গেরামের মাইনষে খবর পাইয়া তারেতাড়াইবার চায়। বদলে হওয়ার শালারা তারে বাঁচাইতে লাডিশোডা লইয়া আইছে। অহন দুই পাট্টি মাইরপিট কইরা একজনেরমাথা ফাটছে।

উদ্দীন কেমন যেন ভাষাশূন্য হয়ে পড়ে। কী এক অদ্ভুত দেশ।সত্যিই কবি তো এমনি লেখেনননি ‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজেপাবে নাকো তুমি…’। কিন্তু সকল দেশের চাকরাণী থেকে চাক বাদ দিয়ে কেন যে শুধু রাণী লিখলো এটা কিছুতেই মাথায় আসেনা। আবুল মিয়া আবার গাড়ি চালাতে শুরু করলো। কিছুদূর যেতে দেখা গেল দুইটা লোক একটা মৃতদেহ অনেক কষ্টে কাঁধে করেবয়ে নিয়ে যাচ্ছে কোথাও। উদ্দীন গাড়ি থামাতে বলে। তারপর এদেরকে হাঁক দিয়ে ডাকে। বলে “ভাই, এভাবে নিচ্ছেন কেন? একটা খাঁটিয়ায় তুলে নিতে পারতেন না? আত্মীয় পরিজন আর কেউ নেই বুঝি?” জবাবে সামনের জন বলে, “ আসছে তোহগলতেই, আইলো না কেউই, মসজিদের খাইট্টা চাইলাম, ইমাম হুজুর দিলে না। কয়, এই রুগির করনা হইছে, এইডারে খাইট্টাদিলে পরে অন্য মাইনষে মারা গেলে দেওল যাইবো না। কইলাম, হুজুর তাইলে আইনে একটু জানাজা পড়াই দেন, তারপর আমরামজ্জিদের কব্বরখানায় কব্বর দিয়া দিই। হুজুরে কয় হে জানাজাও পড়াইবে না, কব্বরও এখানে হইবো না। পাড়ার লোক গুলারেকইলাম, ভাই তোমরা ২/৪ জন আমগো সাথে আহো, দূরে 

টিলার পাড়ে লইয়া যাই জানাজা পইড়া কব্বর দিমু। হগ্গলতে পলাইয়া গেল। অহন আর কী করা। নিজের জন্মদাতা বাপ, আমরাদুই ভাই কোনোকরম কান্ধে পিঠে লইয়া আইছি।উউই টিলার পাড়ে কব্বর দিমু নে” পেছনের জন হু হু করে কেঁদে ওঠে। সামনের জন হঠাৎ বলে ওঠে চল “ কান্ধে লাশটা ভারী হইয়াযাইতাছে, পা চালাইয়া চল”। ওরাও হাঁটা দিলে, আবুল মিয়াও গাড়ি টান দিলো। উদ্দীন কেমন উদাস হয়ে গেল। মনের ভেতরে হুহু করে, কিন্তু কান্নাটা বুকের তলায় আটকে থাকে। এইভাবে আরও ২/৪টা ঘটনা দেখে টেখে অবশেষে তারা কুড়িগ্রাম পৌঁছে যায়। তখন তার মনে হয়, গ্রামে খবরই দেওয়া হয়নি। তার বাবার ছোট ভাই আনজীর চাচাকে খবর দিতে হবে। কবর খোঁড়ার কাজ, জানাজা এসবের ব্যবস্থা করা লাগবে তো। ফখরকে বললো চাচাকে ফোন করতে। ২/৩ বার চেষ্টার পরে চাচাকে ফোন করে জানালো যে বাবা আর নেই। তারা দুভাই লাশ নিয়ে আসছে। চাচা বলে “তাহলে আছরের নামাজের পর জানাজা দিই, কী কস্?” ফখর বলে, “ভাইজান কাছে আপনি কেমনে ভাল মনে করেন করতে”। 

যাক্, চাচাকে বলা হয়েছে। উনি লোক ডেকে কবরের ব্যবস্থা করে রাখবেন। কোনো টেনশন নেই। আবুল মিয়া গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছেযেন অনন্ত কাল। উদ্দীন বলে, 

—আবুল ভাই কতোক্ষণ লাগবে।

— এই তো আর ঘন্টা দেড় দুই। 

উদ্দীন ভাবলো, ফেসবুকে একটু খবরটা জানিয়ে রাখা দরকার. আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধবরা না জানলে কেমন জানি লাগে।ফেসবুকে ছোট করে লিখলো “আমার বাবা গতকাল সকাল সাড়ে ১০টায় নিজগৃহে হার্ট এটাকে মারা গিয়েছেন”। স্ট্যাটাস দেবারসাথে সাথেই রিয়েকশন কমেন্ট আসতে লাগলো। ঘনিষ্ট জনেরা ফোন করতে লাগলো।ফোনে নানান প্রশ্নের জবাব দিতে দিতেউদ্দীনের কাহিল লাগে। এদিকে বাড়ির চেনা গলির মুখে এসে যখন পৌঁছালো গাড়ি, উদ্দীনের মনে একটা আশঙ্কা ক্রমে শঙ্কায়রূপ নিলো, তারপর একসময় শঙ্কাটা আতঙ্কে পরিণত হলো। তার মনে হলো, তার বাবাকে যদি এখানে কবর দিতে না দেয়! সেভাবতে পারছে না সামনে তার জন্যে কী অপেক্ষা করছে!

গলি দিয়ে কিছুদূর যেতেই তার বাল্যবন্ধু কাজল দৌড়ে আসে লাশগাড়ির সামনের সীটে উদ্দীনকে বসে থাকতে দেখে। কাজলকেসংক্ষেপে বলে বাড়িতে যেতে অনুরোধ করে।কাজল খুব সরল, মানুষের উপকার করে বেড়াতে ভালোবাসে। সে দৌঁড়াতে দৌড়াতেছোটে লাশগাড়ির পেছনে পেছন। আর চিৎকার করে জানান দেয় সকলকে “হামাকো শমশের চাচা নাই গো” “হামাকো শমশেরচাচা নাই গো” বলতে বলতে। গাড়ি এগিয়ে চলে। উদ্দীনের বাল্যকালের সেই জঙ্গুলে জায়গা গুলো কমে এসেছে। চারপাশে নতুননতুন ঘর উঠেছে। অনেক শিশু কিশোর উৎসুক নয়নে বেরিয়ে এসে, কেউ কেউ গাড়ির পেছনে ছুটতে থাকে। চেনা বাঁশঝাড় আরবেতবন কিছু এখনো টিকে আছে দেখে উদ্দীনের মন উৎফুল্ল হয়ে ওঠে। এখানে সেই কৈশোরে মিতুয়ার সাথে প্রথম প্রেমের স্বাদপেয়েছিল। ঘন্টার পর ঘন্টা কোনদিকে যে চলে যেতো! মিতুয়ার নাক খুব ঘামতো, সে অদ্ভুত এক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকতো সেইঅপরূপার দিকে। যেদিন তার বিয়ে দিয়ে দিলো তখন, উদ্দীনের মাত্র ১৭ বছর বয়স। কতো কপাল ঠুকেছে সেই জারুল গাছেরগায়ে, যার তলায় সে মিতুয়ার সাথে সঘন গহনে মেতে থাকতো। কেমন আছে মিতুয়া? বড় জানতে চায় মন। এখনও কি তার নাকঘামে? সেই হাসি কি এখনো অধরে লেগে থাকে? এইসব ভাবতে ভাবতে ভাবতে আরও শৈশবে ফিরে যায়, যখন সে হবুল, পরশআর কালু’র সাথে বেতপাতার বাঁশি বানিয়ে খেলতো, যখন তারা এর ওর বাড়ির আমগাছগুলোতে উঠে কাঁচা পাকা আম খেয়েনিতো, পুরনো জমিগারবাড়ির সামনের বিশাল পুকুরটা সাঁতরে এপার ওপার করেছে। হঠাৎ গাড়ি কষে ব্রেক করতে স্বপ্নরাজ্য থেকেফিরে এলো সে। দেখে, তাদের বাড়ির উঠানে এসে গাড়ি থেমেছে। দেখে উঠানে তার চাচা আনজীর সাহেব গম্ভীর বিষণ্ন মুখেবসে আছেন। পাড়ার গন্যমান্য কয়েক জনও বসেছেন। বাড়ি থেকে বেশ কিছু চেয়ার বাইরে উঠানে রাখা হয়েছে। উদ্দীন আরফখর তাদের চাচার পাশে বসলে, চাচা ডুকরে কেঁদে ওঠে। একটু সামলে নিয়ে চাচা বললেন, কবর খোঁড়া হয়েছে। এখন সময় হলেজানাজা। উদ্দীন বলে, লাশের গোসলের ব্যবস্থাও করা দরকার। চাচা বললেন, দেখছি। এইসব আলাপ চলতে চলতে চেয়ারম্যানসাহেব এসে হাজির হয়। উদ্দীনকে সাহস জোগানোর কিছু কথা বলে। তার শমশের ভাইয়ের সাথে কিছু স্মৃতিও তর্পন করেন।তারপর হঠাৎ প্রশ্ন করেন, তোমার বাবা করোনায় মরেনি তো? উদ্দীন বলে, চাচা বুক ব্যথা হয়ে হঠাৎ মারা গেলেন, জ্বর কাশি তো ছিল না। চেয়ারমজান একটু গম্ভীর হয়ে গেলেন। অনেক ক্ষণ মৌন থাকার পরে হঠাৎ বলে উঠলেন, না না, তারপরও করোনাছিল কিনা জানা দরকার। পরীক্ষা করানো দরকার। উদ্দীন বললো, এখন কোথায় করবো এই পরীক্ষা এই গণ্ডগ্রামের ভেতর।চেয়ারম্যান বললেন, তুমি গাড়ি নিয়ে রংপুর মেডিকেল কলেজে চলে যাও। পরীক্ষা করিয়ে রিপোর্ট নিয়ে আসো। অনেক বুঝানো হলো, কিন্তু চেয়ারম্যান অনড়। 

অগত্যা উদ্দীন ফখরকে নিয়ে আবার গাড়িতে উঠলো। আবার ফিরতি যাত্রা রংপুর মেডিকেলের পথে। এসব করতে করতে রংপুরপৌঁছাত আগেই এক জায়গায় থেমে তারা ইফতার করলো সামান্য পানি আর মুড়ি খেয়ে। তারপর, যখন মেডিকেল কলেজেরসামনে পৌঁছালেন তখন সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা। পাহাড়াগার বললো আজ আর কিছু হবে না, কাল আসতে হবে। আবার দীর্ঘ রাত্রিযাপনের প্রস্তুতি নিতে যাচ্ছিল উদ্দীন। কিন্তু ড্রাইভার আবুল মিয়া বলে, ভাইজান, চলেন রাইতের বেলাত আমরা তিনজনেমিইল্ল্যা কবর দিয়া আহি। 

ঠিক হলো, কবর তো খোঁড়াই আছে। তারা এখন রওনা দিলে গভীর রাতে পৌঁছাবে।গ্রামের সবাই ঘুমিয়ে থাকবে তারা গোপনেলাশ কবর দিয়ে গাড়ি নিয়ে চলে আসবে। কবর দেবার আগে আবুল মিয়া জানাজা পড়াবে আর তারা দুইভাই জানাজা পড়েবাবাকে কবরস্থ করে দেবে। গাড়ি আবার যেতে থাকলো, ক্লান্তি আর অবসাদ উদ্দীন আর ফখরকে জেঁকে বসেছে। ড্রাইভারআবুল মিয়ার অনেকক্ষণ টানা গাড়ি চালানোর অভ্যাস আছে, তবুও মাঝে মাঝে ঝিমুনি আসছে। ২ বার থেমে গ্রাম্য দোকানথেকে কড়া রং চা খেয়েছে। উদ্দীনরা দুজনেই বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। 

হঠাৎ উদ্দীন দেখে তার বাবা গাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে তাকে ডেকে বলছে, বাবা আমাকে ছেড়ে দে, আমি আকাশে উড়ে যাই।ধড়ফড় করে জেগে উঠে বুঝতে পারে সে স্বপ্ন দেখছিলো। তাদের গ্রামের গলি এসে গেছে। আবুল মিয়াকে বলেন একদম আস্তেচালান যাতে কেউ টের না পায়। শব্দ যতো কম হয় ততোই মঙ্গল।তারপর ধীরে এগিয়ে যেতে থাকে তাদের বাড়ির দিকে। বাড়িরউঠানে এসে থামলে আবুল মিয়াকে উদ্দীন বলে আরেকটু সামনেই মসজিদ, মসজিদের পাশে কবরস্থান। তারা ধীরে এগিয়েগেলো সেখানে। লাশ বের করে কাঁধে নিয়ে খুঁড়ে রাখা কবরটির সামনে রাখে। তিনজন অজু করে আসে তারপর নীচুস্বরেজানাজা পড়তে থাকে। এমন সময় গ্রামে চৌকিদার চিৎকার করে ওঠে, এই কে কে, কে ওখানে? জোর বাঁশি বাজাতে থাকে লোকজন লাঠিসোটা নিয়ে বেরিয়ে আসে। তার চাচা, চাচাতো ভাইয়েরাও আসে। পাড়ার লোকের হল্লার ভেতর জানাজা শেষ করেআবুল মিয়া। সালাম ফিরাতেই গ্রামবাসী বলে, পরীক্ষার রিপোর্ট ছাড়া এই লাশ এখানে কবর দেওয়া যাবে না। ওরা অনেকবুঝালো যে বাবা মারা গেছেন দুই দিন হয়ে গেল, আজকে টেস্ট হয়নি। কাল গিয়ে যদি স্যাম্পল দিতেও পারে রিপোর্ট দিতে ৩/৪দিন লেগে যায়। গ্রামবাসীরা স্বর একটু নমনীয় হতে হতেই চেয়ারম্যানের লাঠিয়ালরা এসে হাজির। রিপোর্ট না আনা পর্যন্ত কবরদিতে তারা দেবে না। উদ্দীন আর ফখর ধপ মাটিতে বসে পড়ে অসহায়ের মতো, মাথায় হাত দিয়ে বসেই থাকে। তার চাচা আরচাচাতো ভাইয়েরাও তার পাশে বসে থাকে। লাঠিয়ালরা দাঁড়িয়ে আছে একপাশে। এমন সময় কবরের পাড় থেকে বাবার লাশহঠাৎ উঠে দাঁড়ায়, তারপর ধীরে উড়তে শুরু করে। সবাই ভয়ে এদিক ওদিক পালাতে চায় ভয়ে। লাশটি যেন তার দুই ছেলেআলতো ছুঁয়ে দিয়ে মসজিদের গম্বুজের দিকে উড়ে যায়। উদ্দীন বাবা বাবা বলে চিৎকার করে কেঁদে ওঠে। তার কানে যেন বাবাফিস ফিস করে বলে কাঁদিস না, আমাকে যেতে দে। তারপর আস্তে আস্তে বাবার শাদা চাদরে ঢাকা উড়ন্ত লাশ একথোকা শাদামেঘের ভেতরে হারিয়ে যায়। কবরের পাড়ে দুই ব্যর্থ সন্তান নিষ্পলক চেয়ে থাকে সেই মেঘের দিকে। মেঘ উড়ে চলেছে হাওয়ারউচ্ছাসে। কিছুক্ষণ পরে ঘন অন্ধকারে কেউ আর কাউকে দেখে না।

 

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত