| 29 মার্চ 2024
Categories
গল্প সাহিত্য

ইরাবতী ছোটগল্প: উনুন | মাহমুদুল হক আরিফ

আনুমানিক পঠনকাল: 3 মিনিট
বৃষ্টি হলে, রেল স্টেশনের বিপরীত দিকের বুড়ো অশ্বত্থ গাছটা যতটা সতেজ হয়ে ওঠে, ঠিক ততটাই গাছের নিচের ছাপড়া ঘরগুলো ভেজা শালিকের মতো জুবুথুবু হয়ে যায়। বৃষ্টির ফোঁটা, ইট চাপা দেয়া পলিথিনের ছাউনির ছাদে এসে তীরের গতিতে বিঁধতে থাকে, তাথৈ তাথৈ, নৃত্য করে দূরন্ত-দুর্নিবার। রাস্তায় উপচে পড়া ড্রেনের জল নাকে অসহনীয় দুর্গন্ধ বাড়ায়। টানা দীর্ঘ বৃষ্টির পর রাবেয়া বেগমের মাটির উনুনটি মোমের মতো গলে মিশে যেতে চায় মাটিতেই। খান’ছয়েক পাকা ইট দিয়ে উনুনটি আবার সে খাড়া করে। খড়িগুলো আধ ভেজা; আগুন জ্বালানোর অবিরাম চেষ্টারত রাবেয়া বেগমের চুলোয় আগুন খানিক ধোঁয়া ওঠে। আবার জ্বলতে জ্বলতে ধপ করে নিভে যায়। বাঁশের চুঙ্গা ফুঁকলে আগুনের ফুলকি ধোঁয়ায় মেলায়। অনেক চেষ্টায় যখন উনুনে আগুন জ্বলে— আরেক প্রস্থ বৃষ্টি, সংশয় তৈরি করে ‘আজ কখন রান্না হবে! এ এক লড়াই। বৃষ্টির দিনে আগুন বাঁচিয়ে রান্নাবান্না করার লড়াইটা- রাবেয়ার কাছে যে কোন যুদ্ধক্ষেত্রের চেয়ে কম নয়!
ঘরের বারান্দায় বসে এই লড়াইটি একটু সময় বাদে বাদে প্রত্যক্ষ করছিল নীরুপমা, তাও প্রায় ঘন্টা তিনেক হয়ে গেল। রেল স্টেশনের কাছেই নীরুপমার তেতলা বাড়ি, ছোট্ট সংসার। বৃষ্টির দিনে স্বামী মুনসুরের চাহিদা অনুযায়ী কসা মাংস, খিচুড়ি আর বেগুন ভাঁজা; অনেক আগেই রান্না সারে সে। বৃষ্টির দিনে দিনের আলোর নমনীয়তা নীরুর খুব পছন্দ। বৃষ্টি ঝরার দৃশ্য তাকে আরো বিনম্র করে। মোবাইলে বৃষ্টি ঝরার দৃশ্য তুলতে ইচ্ছে হয়— কিন্তু স্থির চিত্রে বৃষ্টি ধরা দেয় না। আসলে বৃষ্টির কোন আলোকচিত্র হয় না! আপাত দৃশ্যমান বৃষ্টির ছবি, ছবিকে ধোকা দেয়। শুধু সমতলে আছড়ে পড়লে বৃষ্টির স্বচিত্র চিহ্ন মেলে। বৃষ্টি যখন মাটিতে নেমে এসে ভেঙ্গে পড়ে, ছিটকে যায়, হোক সে নরম মাটি— স্পষ্টত: চোখে ধরা দেয়। চতুর্নবতি তার গতি, সুর সংগীতের মহলের মতো বিস্তার লাভ করে হৃদয়ে! এ কেবল উড়তে উড়তে, উড়তে থাকা পতনের রিনঝিন অনুভব।
বৃষ্টি আজ যখন ধরে আসে, তখন এক কাপ চা হাতে নীরু বারান্দায় গিয়ে দেখতে পায়— রাবেয়া আর উনুনের দ্বৈরথ। রাবেয়া চাইছে বৃষ্টি থামুক, একটু আগুন। নীরু চাইছে বৃষ্টি ঝরুক, মিষ্টি মিষ্টি উদলো হাওয়ায় বৃষ্টি কানের কাছে টিপ টিপ টিপ আওয়াজ করুক। আহ্! কী বিপরীত চাওয়া। নীরুর মন চায়, ছাদে ভিজতে, কবিতা পড়তে, অথবা অরুণ ভাদুড়ীর গলায় ‘ঐ ঘিরে আসে বাদলেরও মেঘ সঘন ঘন বরষায়’ গান শুনতে শুনতে বৃষ্টির সাথে তুমুল যোগাযোগটা ঘরের অভ্যন্তরে আরো জমাট, নিমগ্ন করতে। বৃষ্টি, প্রকৃতিকে বিহ্বল করে রাখে ঝাপসা কুয়াশায়। স্যাঁতসেঁতে গাছগুলো রঙ পল্টায় নতুন পোশাকে। এক কাপ চা, চাল ভাজা সিমের আঁটি অথবা ছোলাবুট বাদাম; মুখে বারো ভাজার স্বাদ পেতে চায় এ যেন মেঘলা আবহাওয়ার ঘনিষ্ঠতা বাড়ায়। 
বৃষ্টির দিনে চৌরঙ্গীর মোড়ের রাস্তার উত্তর পাশের অশ্বত্থ গাছের নিচে ভাসমান আশ্রয়ে থাকা রাবেয়া বেগমের দিকে আবারও চোখ যায় নীরুর। দেখতে পায় একটা উনুন রক্ষার লড়াই! লড়াইটা ভিন্ন ধাঁচের। বৃষ্টি মানে তার কাছে অনাসৃষ্টি! বৃষ্টি এলে উনুনে শুকনো খড়ি বা পাতার সংকট প্রকট হয়ে ওঠে। বারবার এ দৃশ্য দেখতে ভালো লাগে না তার। ওদিকে তাকাতে চায় না আর! মনোযোগ ভিন্ন দিকে নেয়।
আইরিশ কবি সিমাস হিনি’র ঘুড়ি কবিতাটির অনুবাদ পড়তে শুরু করে নীরু…
অন্য জীবন অন্য সময় অন্য দেশ থেকে উড়ে আসে বাতাস, 
আমাদের জীবনকে ছুঁয়ে হালকা নীল, স্বর্গীয় অনুভূতি 
ডানা ঝাপটায়, একটি শাদা ডানা, ফুরফুরে বাতাসের বিপরীতে।
আর হ্যাঁ, এটি একটি ঘুড়ি! যেন এক বিকেলে 
আমরা সকলেই বেড়িয়ে পড়ি
কাঁটা-ঝোপঝাড় আর বুনো ঘাসের ভেতর
আমরা দাঁড়াই, আকশ থেকে নীল ছেঁকে নিতে থামি কিছুটা 
ওই অ্যানাহোরিশ পাহাড়ের বিপরীতে 
ওই মাঠের পেছনে আমাদের লম্বা লেজের ধূমকেতু ভাসাতে। 
ঘুড়িটা ভাসে, আমি হেঁচকা টানে দিক ঘুরিয়ে দেই, গোত্তা খায় তীর্যকভাবে, 
ঘুড়িটা নিজে নিজেই বাতাসে ভেসে বেড়ায় যতক্ষণ-না
আমাদের উল্লাস, নিচ থেকে অনেক উপরে ছড়িয়ে পড়ে।
ঘুড়িটা উড়ছে তো উড়ছেই, আমার হাত দু’টো যেন এক নাটাই
হালকা ফুলের পাপড়ির মতো ছড়িয়ে দেয় নিজেকে অবিরাম 
ঘুড়িটা আকাশ বেয়ে উঠতে থাকে উপরে এবং আরো উপরে 
বুক ফুলিয়ে, পায়ে শেকড় না জড়ানো পর্যন্ত দীর্ঘ-লয়ে 
বালকদের অবাক চোখ ও পুলকিত অন্তরে উড়তে থাকে ঘুড়িটা
যতক্ষণ না সুতো কেটে যায় এবং বিচ্ছিন্ন হয়, প্রাণহীন-
ঘুড়িটা পাক খেতে খেতে পড়ে যায়, যেন একা, একটি পতিত হাওয়া। 
দিলারা পিঙ্কি’র অনুবাদটি বেশ ঝরঝরে লাগে, কিন্তু কবিতাটি পড়ে মন বিষন্ন হয় নীরুর। কবিতাটি বুকে জড়িয়ে এক সময় ঘুমিয়ে পরে নীরুপমা। কলিং বেলের শব্দে ঘুম ভাঙ্গে। হাওয়ায় হাই তোলে। আড়মোড়া ভেঙ্গে প্রাধান দ্বারের দিকে এগিয়ে যায়। দাঁড়িয়ে থাকা মুনসুর ঘরে প্রবেশ করে। ঢুকতে গিয়ে পায়ের ব্যালেন্স একটু এলোমেলো হয়। মুনসুরকে ধরে ফেলে নীরু। বলে, ‘তুমি আজও!’
বৃষ্টি হল তো তাই…!
একদিন বলবে, ভরা জোৎস্না, একদিন বলবে আজ রোদ, আরেকদিন বলবে, স্কুল বেলার বন্ধু! তোমার অজুহাত আর শেষ হলো না! আজ আবার বলছ বৃষ্টি! এভাবে আর কতকাল। যে দিকে চোখ যায় আমি চলে যাব। খানিক সময় ঘরটা থমথমে হয়ে ওঠে।
মনসুর একটু সময় নেয়, খুনসুটি করার চেষ্টা করে, কোনো লাভ হয় না। বরাবরের মতো প্রতিশ্রুতি দেয় আর আনন্দ জল স্পর্শ করবে না। নীরু এবার একটু মুডে ফেরে। 
মুনসুর বলে, আজ তোমার কেমন কাটলো? 
নীরু আজকের দিনটির বিস্তারিত বর্ণনা দেয়। রাবেয়ার উনুনের আগুনও উঠে আসে বর্ণনায়। মুনসুর বলে, বলো কী! উনুন জ্বালাতেই এক ঘন্টা! নীরুর ঘরের গৃহকর্মী এককাপ চা বানিয়ে আনে। মুনসুর চায়ের পেয়ালা হাতে নিয়ে বলে, আচ্ছা নীরু আমাদের চুলো জ্বালাতে কত সেকেন্ড লাগে?
নীরু বলে, এক সেকেন্ডও না। 
মুনসুর মোবাইলের ক্যালকুলেটরে হিসেব কষে, এক মিনিট= ৬০ সেকেন্ড, তাহলে এক ঘন্টা, ৬০x৬০= ৩৬০০ সেকেন্ড। আজকে ওই মহিলার সাথে তোমার চুলো জ্বালানোর ব্যবধান তিন হাজার ছয়শ’ সেকেন্ড। আগুন হলো সভ্যতার সবচেয়ে বড় উপাদান, সভ্যতার সাথে ঐ নারীর ব্যবধান তাহলে কত হাজার গুণ!
নীরু মনে মনে বলে আনন্দ জলের অ্যাকশন শুরু হয়ে গেছে। আজ আর কত কী বলবে কে জানে। মুনসুর চায়ে চুমুক দেয়… নীরু বারান্দায় গিয়ে দেখে অশ্বত্থ গাছের নিচে দাউদাউ উনুন জ্বলছে। উনুনের আলোর আঁচ রাবেয়ার মুখে।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত