| 23 এপ্রিল 2024
Categories
গল্প সাহিত্য

না লেখা চিঠি আবার

আনুমানিক পঠনকাল: 7 মিনিট

বুনো রাত। আরণ্যক রহস্য। মিশ কালো। যেন এলায়ে পড়েছে গভীর কালো দোয়াতের কালি। স্তব্ধ প্রহরে মাঠের ক্ষত চিহ্নের ওপরে হিংস্র নোখের ছোপ ছোপ। ডোরাকাটা দাগ ফেলে গেছে শুকনো মাটিতে। বনভূমির পিচের পাকা সড়কের ওপরে গাড়ির হেডলাইটের আলো পড়লে রাস্তা জেগে ওঠে, না হলে রাত জাগা চলমান মানুষের মনে হতে পারে রাস্তা পাশ ফিরে শুয়েছে। স্তব্ধতা ও হিংস্রতার জন্য এই বনভূমি বড়ই বেহিসেবী।

মাঝে মাঝে হঠাৎ জঙ্গল নিজের ভাষায় কথা বলে। বনভূমির নিজস্ব গন্ধ, কাঠ পুড়ে যাওয়ার গন্ধ, বাতাসে শ্বাসরোধকারী রহস্যের মধ্যে বনকর্মী ও প্রহরী মধ্যরাত্রির বাঁকা চাঁদ খুঁজে যায়। আকাশে চাঁদ না থাকলে একা প্রহরীর বা দলবদ্ধ বনকর্মীদের বড়ই একা মনে হয়। কখনো কখনো আকাশে বহুদূরে বিদ্যুৎ চমকালে বনকর্মীদের মনে হয় কোথাকার কোনো বৌদ্ধিক আদিম নগরে বা ধ্বংসপ্রায় সভ্য শহরে এক অনন্তকালের বৃষ্টি নেমেছে। কাল্পনিক বৃষ্টির সংবাদে বনভূমির দানবীয় বৃক্ষগুলি আদিম দেবতার মতন বাতাসে কেঁপে ওঠে। ভেঙ্গে যায় স্তব্ধতার প্রহর। চঞ্চল হয়ে ওঠে বুনো প্রাণ। রক্তে তুফান তুলে জাগতিক মায়া প্রাণ চিৎকার করে ওঠে, ক্ষণেক শব্দ স্রোতে খান খান হয় নির্বাক চরাচর।

চিঠিতে লেখা আছে সংলাপ। ভাস্কর বিদ্যার্থীর অক্ষরের দাগ। কিছুটা এলোমেলো শব্দের মোলায়েম স্পর্শ। রামবিলাসকে ভাস্কর বিদ্যার্থী বারে বারে সাবধান করে দিয়েছে,-

সামলে নিবি চিঠি, থলিয়ার একেবারে নিচে গুছিয়ে রাখবি। না হলে, গোপন চিঠি বড়ই চঞ্চল হয়, বাতাসে ভেসে আত্মগোপন করতে চায়। কোথাও সুবিধে মতন জায়গা বুঝে কেটে পড়তে চায়। চিঠি হারিয়ে যেতে বড়ই ভালোবাসে। একবার কোথাও লুকিয়ে পড়লে খুঁজে বার করতে হিমশিম খেতে হয়।

রামবিলাস অবাক হয়ে তাকিয়ে, সংকোচ বোধ করেছিল। ভাস্কর বিদ্যার্থী আবার বলেছিল, আমি ওসব জানি না। তোকে চিঠি দিলাম, পৌঁছে দিবি। রাত্রি অথবা দিনে যাবি কি না সে আমি কি করে বলব? তুই কি ভাবে যাবি সেটা তোর ভাবনার বিষয়। কিন্তু তুই তো জানিস গোটা পথটাই তোকে জঙ্গলের মধ্য দিয়ে যেতে হবে। একবার চিঠি হারিয়ে গেলে তা আর পাওয়া যায় না।

রামবিলাস বলল, হারাবে কেন? থলিয়ার ভিতরে ভরে নিয়ে যাব। ভয় নেই আপনার। আমি চিঠি ঠিক মাইজির হাতে দিয়ে দেব।

রামবিলাস কে ভাস্কর বিদ্যার্থী রসিকতা করে, দেখিস চিঠিটা বালুচরে আদিম কোনো দাগ না হয়ে যায়?

রামবিলাস খুশি হয়ে, তা হলে তো বাবু খুব ভালো। আমার হারানোর ভুলে একটা নদীর জন্ম হবে? আমরা কথায় কথায় বলে উঠি, মানুষ জেগে উঠেছে। আপনার কথা যদি সত্যি হয়, তাহলে বলতে পারব নদী জেগে উঠেছে । মানব সভ্যতার ইতিহাসে সে এক অন্য কথা হবে।

ভাস্কর বিদ্যার্থী ভাবছিল, এই সব ছেঁদো কথা, কথার কথা। বলতে হয় তাই বলা, না হলে এই বয়সে কেউ আকাশ, নদী,ফুল, এমনকি ব্যস্ত ইন্টারনেটের যুগে একজন বৃদ্ধ সরল, মানুষকে টাকার লোভ দেখিয়ে তার দারিদ্রতার সুযোগ নিয়ে তাকে চিঠি দিয়ে পাঠাবে কেন? গভীর রাত্রির বন জঙ্গলে পথে ঠেলে দেয়? এ কি কোনো বিবেচক মানুষের কাজ? তার কাছে ফোন আছে অথচ মহাশূন্যে টাওয়ার নেই। চিঠি লিখে একজন বৃদ্ধ পত্রবাহকের হাত দিয়ে চিঠি পাঠানো কোন শ্রেণির বিলাসিতা? মানসিকতা তার প্রথাগত ধারণা কে বিরোধ করলেও আসলে প্রতিটি কজেই সে প্রথাগত ধারণাকে মান্যতা দেয়। সে বাইরের খোলসে হাংরি হাংরি হলেও আসলে ভাস্কর বিদ্যার্থী নিজেই বুঝতে পারে, আচ্ছাদনে মানুষ যাই হোক না কেন, অন্তরে চিরাচরিত একটি ক্ষত বা দাগ ছাড়া কিছুই নয়।

রাত্রির গভীর অন্ধকারে অনেক কথা জমা থাকলেও কোনো কথাই কথা হয় না। জঙ্গল বরাবর ছিঁড়ে দিয়ে গেছে কালো মসৃণ রাস্তা। হাতির নাদি পড়ে থাকে রাস্তার মাঝ বরাবর। নগরের বাবুরা আসে, জঙ্গলের রোমাঞ্চে বিস্মিত হয়ে, নরম পানীয়র বোতল ফেলে দিয়ে যায় । দামি ক্যামেরায় ছবি তুলে ফিরে যায়। গাছের পাতায় হিস হিস শব্দ। সেই শব্দের মধ্যে নগরের মানুষদের প্রতি তীব্র এক বিরক্তি যেন।

রামবিলাস হাঁটছিল। কিছুক্ষণ পরে পরেই ভ্রমণ বাহিনীর সাফারি জিপ রাস্তা ছুঁয়ে যাচ্ছে। বুনো অন্ধকারে গাড়ির হেড লাইটের আলো যেন রামবিলাসের বুকের গভীরে ধাক্কা মারছে। যে অন্ধকারে হাঁটতে হাঁটতে অন্ধকারকে ভালবেসে ফেলে সে অন্ধকারের মধ্যে নিরাপত্তা খুঁজে পায়। বুনো অন্ধকারকে গাড়ির হেড লাইটের আলো যদি আচমকা ছিঁড়ে ফালা ফালা করে দেয়, তাহলে তার গোপন গভীরে এক প্রকার যন্ত্রণা হবেই।

রামবিলাস হাঁটছিল । হাতে থলিয়া। থলিয়ার ভিতরে জলের বোতল । কিছু শুকনো খাবার। ধারালো অস্ত্র। আর ভাস্কর বিদ্যার্থীর চিঠি। রামবিলাসের হাতে ভাস্কর চিঠি দিয়ে বলেছিল, 

চিঠি মানুষের ভাষা বহন করে, মানুষের মনের কথা বহন করে। মানুষের প্রেম, ভালবাসা ঘৃণা, মানুষের চাওয়া পাওয়া, আনন্দ দুঃখ জন্ম মৃত্যুর সংবাদ বহন করে। চিঠি বড়ই চঞ্ছল। আবার গৌতম বুদ্ধের মতন স্থির ও তপস্বী।

রামবিলাস বলল, চিঠি প্রাপকের হাতের স্পর্শের জন্য চঞ্চল হয়ে ওঠে বাবু। আপনি আছেন তাই আমার কাজ আছে। কাজ পাই। না হলে আমাদের উপায়ের সর্বনাশ করে দিয়েছে, টাওয়ার। টাওয়ার আমাদের পেশার শত্রু।

ভাস্কর বিদ্যার্থী যেন অনুশোচনা করে বলল,

তুই যেতে পারবি? তুই এখন ভালো করে দেখতে পাস না? কোথায় কোন পথ দিয়ে হেঁটে যাবি? বুঝতে পারছি না? আমি জানি তুই দিক ভুল করবি না, কিন্তু একদিকে তো একটি পথ থাকে না। থাকে অনেক পথ। কোন পথ নেওয়ার বদলে কোন পথ নিয়ে নিবি সেটাই ভাবছি রে রামবিলাস।

রামবিলাস বলেছিল, না বাবু, এতকাল জঙ্গলের পথ দিয়েই তো চিঠি দিয়ে এলাম আর ফিরে এলাম। রাত্রেও গেছি দিনের বেলাতেও গেছি। ভুল হবে কেন বাবু? কত মানুষের কত চিঠি। আপনি কি জানেন আমার চিঠি দেওয়া আর নেওয়া নিয়ে কত গল্প আছে? কত সব চিঠি দূরের নক্ষত্র হয়ে গেছে। কত চিঠি এই জঙ্গলেই হরিণ হয়ে বিচরণ করছে। কোনোটা আবার ছোটো ছোটো মাটির ঢিবি হয়ে গেছে। কোনোটা আবার বনবাংলো, আবার কোনোটা বনের মোরগ।

ভাস্কর বিদ্যার্থীর বলল, তুই এই কথা আমাকে প্রায়ই বলিস। আমি তোকে বাধা দিই না। কেন জানিস? তোকে দিয়ে অনেক চিঠি পাঠিয়েছি কিন্তু সব চিঠিই ঠিক ঠিক জায়গায় তুই পৌঁছে দিয়েছিস। কোনো চিঠিই তো বনের মোরগ হয়ে যায়নি অথবা হরিণ বা বনবাংলো। আমি জানি তুই খেয়ালের কথা বলছিস। এরকম খেয়ালের কথা বলে তোর না পাঠানো চিঠিগুলি অজুহাত পেয়ে যায়। কোথায় কোনখানে তুই ফেলে দিয়েছিস কে জানে? হারিয়ে যাওয়া চিঠিগুলির পক্ষে এটাই তোর যুক্তিহীন যুক্তি।

রামবিলাস অন্ধকার হাতরে হাতরে এগিয়ে চলেছে আরণ্যক মাটির পথ চিনে চিনে। গভীর অন্ধকারে রাত্রির পথ গভীর শীতল হয়ে যায়। সব পথ তরল হয়ে যায়। গাছ গাছালির সাথে রাস্তা মিশে যায়। ঘন কালো জলরঙ ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে খাতার সাদা পাতা যেমন হারিয়ে যায়। রামবিলাস হেঁটে চলেছে একটুও দিগভ্রান্ত না হয়ে। বাবুর চিঠির পথ সব সময়ই অনেক দূরের হয় । অনেক দূরে।

নুপাই গঞ্জ অতিক্রম করে দোয়ানি গ্রাম, প্রাচীন ইদগাঁর ওপারে ঝানু পাহাড়ির উপত্যকা, তারপরে হাঁটা পথে বাঁক নেবে কানা নদী, ফসলের মাঠ, শস্য গুদাম, কানাই ডিকরির গরুর গাড়ির চাকা বানানোর উঠোন। উঠোনের পাশে এলায়ে আছে কালো মাটির রাস্তা, রাস্তা পার হলে বর্ণহীন শুকনো ক্যানভাসের মতন পরাবাস্তব একটি মাঠের মধ্যে গ্রাম জীবনের ভেঙ্গে যাওয়া বিশ্বাসের কিছু চিহ্ন।

সেই মাঠ পার হতে গেলে অতীত কালের কিছু কান্না, হাওয়ায় ভেসে বেড়ানো ডাকঘর, কাদাখোঁচা পাখির সমাবেশ। রামবিলাসের এই সব বিবরণ ও পথের টুকিটাকি তার যেন মুখস্ত। পায়ে পায়ে গতির সাথে নিসর্গ যেন মৃত মানুষের মতন সরে সরে যায় । যতক্ষণ চিঠি তার লক্ষ্যস্থল পর্যন্ত না পৌঁছে যাচ্ছে ততক্ষণ নিসর্গ জীবনহীন। চিঠি প্রাপকের হাতে তুলে দিয়ে, রামবিলাস ছুটির অবকাশ যাপন করতে করতে ফিরে যায়। বুনো পথ তখন নাগরিক সরণি বা এভিনিউ হয়ে যায়।

এই সব বিবরণের সাথে সাথে রামবিলাস বনভূমি ভেঙ্গে হেঁটে যায়, হিংন্স্র জন্তু জানোয়ার ভয়ানক নিঃশ্বাস ছেড়ে পাশ কাটিয়ে যায়। কোনো দিনই তাকে আক্রমণ করে না। যেন তাকে চেনে। বহুদিনের পরিচিত। শুধু হাতি সামনে দাঁড়ালে অন্ধকার আরও গাঢ় হয়। তখন সে বুঝতে পেরে দাঁড়িয়ে যায়,একেবারে প্রস্তরে রূপান্তরিত হয়ে যেতে চেষ্টা করে। শব্দহীন গতিহীন, জীবনহীন। হাতি নড়েচড়ে বিষ্ঠার কাদা ফেলে চলে যায় জঙ্গলের অন্য প্রান্তে। একসাথে দুই তিনটি হাতি এলে ভয়ের কিছু নেই। নিজেরা নিজেদের নিয়ে মশগুল থাকে। কিন্তু একা হাতি ভয়ংকর হয়ে ওঠে। দলছুট হাতি অরণ্যের সবচাইতে ভয়ংকর প্রাণী।

একধারে ফেউ ডেকে গেলে বুঝে নিতে হবে ভোর হয়ে আসছে আর চূড়ান্ত আদিমতা ছিঁড়ে তখন ময়ূর ডেকে উঠবে। রামবিলাস টের পায় এক জেলা থেকে অন্য জেলায় সে দিক বদল করে আর কিছুক্ষণ পরে এগিয়ে যাবে না ধরা না ছোঁয়া এক নিসর্গের ভিতরে। ক্রমশ তরল হতে থাকা চেতনা ও উপলব্ধির মধ্যে উড়তে থাকে রাতজাগা বাদুর।

তার মনে হয় কে সে? কোন রাষ্ট্রে সে থাকে? নিজেকে তার মনে হয় সে একটি স্বৈরাচারী রাষ্ট্রীয় যন্ত্রের শিকার। নিজের নাম পরিচয় ভুলে একাকী কোনো একটি গোপন স্থলে রাইফেল হাতে বসে থাকে, একটি ভাঙ্গা পাহাড়ের গুহার সামনে। আঁখের ক্ষেতের মধ্যে সে হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে যায়। আঁখ গাছের ধারালো পাতায় তার পিঠ কেটে রক্তের দাগ। অনেকটা দূরে চলে যাওয়ার পরে সে বুঝতে পারে ধান মাঠের কোথাও একটি জায়গায় তারা ভেঙ্গে পড়েছে।

সেই আকাশের তারাটি মহাকাশের কোনো একটি জীবন্ত তারার ভিতরে মৃত বিপ্লবী। যে রাষ্ট্র বদলের স্বপ্ন দেখেছিল। নিজেই ভাবতে বসে যায়, রাষ্ট্রযন্ত্র কোনো সময় বা কোনো কালেই মানব জাতির কল্যাণ করে না। শাসকের দল মানুষের কথা বলে ক্ষমতায় এলেও মানুষের আশা আকাংখার বিরুদ্ধে কাজ করে । মানুষই মানুষের বিরুদ্ধে ভয়ংকর হয়ে ওঠে। রাষ্ট্র ক্ষমতা আসলে কতগুলি ক্ষমতালোভী মানুষের যৌথ খামার। যারা মানুষের কথা না ভেবে নিজেদের ক্ষমতা ভোগের কথা ভাবে।

দিনের আলো ক্রমশ পরিষ্কার হয়ে আসছে। গহিন অরণ্যের সমস্ত কিছু বিবরণ এখন চোখে পড়া যায়। যদিও গাছের নিচে অন্ধকার বন্যতা ভেঙ্গেm আলোর সঙ্গে মিশে যেতে পারে নি। গাছের নিচের ছায়ার ঘুম ভাঙ্গতে বেলা হয়। আবার বেলা একটু পড়ে এলেই বুনো গাছ সন্ধ্যা আঁকড়ে ধরে। বুনো গাছ নগরের গাছ গাছালি থেকে অনেক বেশি অলস হয়। নগরের গাছগুলিতে কোনোই অলসতার চিহ্ন থাকে না।

রামবিলাস অতীতের ফেলে আসা সমস্ত বিবরণ পার হয়ে নগর জীবন পিছনে ফেলে চলে এল যেখানে, সেখানে শুধুই বিষণ্ণতা ছড়িয়ে আছে। সুদূর বিস্তৃত সীমানাহীন জমি। বিষাদ বর্ণ। শব্দহীন। চাষের চিহ্ন নেই। গ্রামহীন এক প্রান্তর, জনমানবহীন। একটি লোক ছায়ার মতন হেঁটে যাচ্ছে। লাঠিতে ভর দিয়ে ঝুঁকে পড়ে, মাথা নিচু করে অনেকটা একাকী মাটির সঙ্গে কথা বলতে বলতে এমন ভঙ্গীতে। অথচ আশেপাশে তো কেউ নেই।

রামবিলাস কাছে এসে লোকটির ছায়া ধরতে চেষ্টা করছিল। যতবার কাছে আসছিল লোকটির ছায়া ভৌতিক ভাবে সরে যাচ্ছিল। একেবারে রোদের মধ্যে শূন্যে ভেসে থাকা যেন মানুষের অনুভূতি আর যান্ত্রণা ও বেদনার মতন। লোকটির যতই কাছে সে যাচ্ছিল, লোকটি অদ্ভুতভাবে দূরে সরে যাচ্ছিল। আর এমন ভাব করছিল যেন কিছুতেই ছোঁয়া না লাগে। রামবিলাস ভাবছিল এতকাল সে তো জেনে এসেছে সে মোটেই অচ্ছুৎ নয়। আর অচেনা অপরিচিত ছায়া কি করে জানবে তার পরিচিতি? এই যে মানুষটা সে ক্রমশ ছায়ার সাথে মিশে যাচ্ছে । লোকটির এবং তার ছায়ার কাছে রামবিলাস এগিয়ে এসে বলল, শুনছেন ভাই? শুনছেন?
লোকটি বিস্মিত হয়ে বলল , -কে আপনি?
পত্রবাহক। চিঠি দিই। চিঠি নিই।
শুভ নাম?
রামবিলাস।
আপনার ?
নাম? সে তো জীবিত মানুষদের থাকে। মৃত মানুষের নাম মনে রাখে জীবন্ত মানুষ। মৃতরা মৃতদের নাম মনে রাখে না, আমিও চিঠি দেওয়া নেওয়ার কাজ করতাম। প্রাপকের হাতে চিঠি পোঁছে দেওয়ার জন্য এই পথ অতিক্রম করতে গিয়ে বিষণ্ণতার শিকার। এখানে শীতকালে খুব বরফ পড়ে। আমার হাতে যে চিঠিটি ছিল পৌঁছে দেওয়ার জন্য, সেই চিঠিটি শীতকালের ঠাণ্ডায় জমে বরফ হয়ে গেল। গ্রীষ্মে বরফ গলে যাওয়ার সাথে সাথে চিঠিটিও গলে যায়। চিঠি কিন্তু আর ফেরত আসে নি। আমি খুঁজে পাইনি। 

সেই থেকে আপনি এখানে?

সেই থেকে মানে? কবে থেকে? আমার সময় সম্পর্কে কোনো ধারণাই নেই। আমার কোনো নাম নেই। কাল নেই। অবয়বহীন অস্ত্বিত্বহীন চিঠি না পৌঁছে দেওয়ার শোকে হাওয়ার সাথে ভেসে বেড়াচ্ছি।

আপনাকে আমি কিন্তু পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি। কেমন জানি দেখতে আপনাকে? একেবারেই আমাদের মতন নয়। আপনাকে দেখলেই আমার বেশ অনেকগুলি না পাঠানো চিঠির কথা মনে পড়ছে। কত বার্তা, কত সংবাদ, কত আনন্দ, কত দুঃখ, কত জন্ম মৃত্যুর সাংবাদ প্রেরকের হাতে না পৌঁছে দেওয়ার বেদনার মতন। আপনাকে দেখে আমার তাই মনে হচ্ছে।

আপনাকে দেখেও আমারও তাই মনে হচ্ছে। একেবারে অবিকল আপনি যে ভাবে বললেন সেই মতন।
আপনি কি বলতে চান?
আপনাকে আমার মতনই দেখতে লাগছে।
রামবিলাস শিউরে উঠল। নিজের মনে নিজেই বলে উঠল, লোকটাকে মরা মাছের মতন দেখতে।একাবারে চাঁদা মাছ যেমন ফ্যাকাশে হয়। সেই রকম। মরা সকালের আলোর মতন। মাছের আঁশের রঙের মতন। লোকটা কি বলতে চাইছে ? আমি ওর মতন দেখত? রামবিলাস উচ্চকণ্ঠে বলে উঠল,

কি বলতে চাইছেন আপনি?
আপনাকে এখন আমার মতনই দেখতে লাগছে।
মানে?
আমার মতন। একেবারে আমার মতন। মৃত।
মৃত? মৃত !
আপনিও।
আমিও?
হ্যাঁ আপনিও। এই বিষণ্ণ প্রাণহীন, জনমানবহীন, পৃথিবীর বাইরে এখানেই আমরা পত্রবাহকেরা থাকি। আপনিও এখন থেকে এখানেই থাকবেন রামবিলাস। আপনি মৃত। এখানে যারা আসে, যারা এই মৃত্যুর দেশ অতিক্রম করতে যায় তাদের সবার আমাদের মতন পরিণতি হয়। আপনি আর কোনোদিনই জীবন্ত পৃথিবীতে ফিরতে পারবেন না। আসুন আমরা ওদিকটায় এগিয়ে যাই। ওদিকটা মৃত্যুর মতন গভীর সাদা।

মৃত্যুর মতন গভীর সাদা !

চলুন এগিয়ে যাই। আপনার চিঠি আর কোনোদিন পৌছবে না। সামনের শীতকালে চিঠিটি জমে বরফ হয়ে যাবে আর আগামী গ্রীষ্মকালে জল হয়ে গড়িয়ে যাবে কাকচক্ষুর মতন একটি নদীর মতন। আসুন। আপনার শরীরের আর কোনো অস্তিত্ব নেই।

এই তো আমার আমিকে বেশ উপলব্ধি করতে পারছি। আমি তো বেশ আমার শরীরকে বেশ হাতে পাচ্ছি।

চলুন। কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। আমাকে অনুসরণ করুন। আমরা পত্রবাহকেরা ব্যবহারে ব্যবহারে গলে যাই। তারপরে বিষণ্ণ এই দেশে বাতাসের মতন ভেসে বেড়াই।

ভাস্কর বিদ্যার্থী অপেক্ষা করে করে যখন বুঝতে পারল পত্রবাহক রামবিলাস আর ফিরবে না। তখন সে রাম বিলাসের পুত্র বিনোদকে ঠিক করল চিঠিটি পুনরায় লিখে পাঠাবে সেইখানে, যেখানে রামবিলাসের যাওয়ার কথা ছিল। ভাস্কর চিঠিটি আবার লিখতে বসল। গভীর রাত্রি। বাদুর ডানা মেলে উড়ে যাচ্ছে ফলের বাগানে। বিনোদ বলেছে, গভীর অরণ্যর পথ পার হয়ে তাকে যেতে হবে । সে সকালেই দিনের আলোতে যাত্রা করবে। চিঠি সে কাল সকালেই নেবে।

কাজেই ভাস্কর বিদ্যার্থীকে আবার চিঠি লিখতেই হবে। লিখে শেষ করে হবে আজকে রাত্রেই। ঘরের বাইরে বাঁকা চাঁদের আলো চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে। শব্দহীন গভীর রাত্রি। ব্যবহারকারী আর ব্যবহৃত মানুষগুলি ঘুমিয়ে আছে।

কাগজ টেনে নিয়ে ভাস্কর বিদ্যার্থী চিঠি লিখতে বসল। দীর্ঘ চিঠি। লিখতে শুরু করার আগে হোল্ডার কলমের নিব কালির দোয়াতে চোবাতে গিয়ে বুঝতে পারল দোয়াতের ভিতরে আর ছিটেফোঁটা কালি নেই। ব্যবহারে ব্যবহারে দোয়াতের সব কালি ফুরিয়ে গেছে।

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত