Irabotee.com,শৌনক দত্ত,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,iraboti,irabotee.com in,netaji,নেতাজী,subhas-chandra-bose-set-an-example

সুভাষ ছিলেন হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের দূত । উদয়ন বন্দ্যোপাধ্যায়

Reading Time: 3 minutes
ভারতে যুবশক্তির আইকন হিসেবে যাঁর আসন চিরস্থায়ী সেই সুভাষচন্দ্রকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করার চিন্তা একপ্রকার বাতুলতা। বাঙালি তথা ভারতীয়রা সারাজীবন ধরে যে যে বীরত্বের স্বপ্ন দেখে গেছেন, এক জীবনে সুভাষচন্দ্র তা করে দেখিয়েছেন। শুধু স্বাধীনতা সংগ্রামী হিসেবেই নয়, এক অনবদ্য ছাত্র থেকে তাঁর উত্তরণ ঘটেছিল এক অসামান্য দেশপ্রেমিকে। এ কথা এ জন্যই বলা কারণ দেশপ্রেম কাল-নিরপেক্ষ। প্রাক স্বাধীনতা পর্বে তার রূপ একপ্রকার, আবার স্বাধীনোত্তর পর্বে অন্য। সময়ের সঙ্গে রাজনৈতিক বাতাবরণে তা ভিন্ন রূপ পরিগ্রহ করে। এই মুহূর্তে আমাদের দেশে দেশপ্রেমের একটি বিকৃত কাঠামোকে হাজির করা হচ্ছে। সেখানে মানুষের থেকে গরুর প্রাণের দাম বেশি।
 
 
 
 
সুভাষচন্দ্র যে অর্থে দেশপ্রেমিক ছিলেন তার ভাব ও উপাদানগুলি ছিল পৃথক ভাবে চিহ্নিত। তিনি দেশ বলতে কোনও সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর কথা ভাবেননি। সমস্ত ধর্ম, ভাষা, জাতি নির্বিশেষে তামাম ভারতবর্ষের মুক্তি ও সমৃদ্ধিই ছিল তাঁর স্বপ্ন। সেই লক্ষ্যেই তিনি জীবন বাজি রেখে ছুটে বেড়িয়েছেন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। ভারতের স্বাধীনতার দাবিকে করে তুলেছেন আন্তর্জাতিক ইস্যু। আপস নয়, নিরন্তর সংগ্রামই যে পথ সে কথা নিজের জীবনে বারংবার প্রমাণ করতে চেয়েছেন। তার জন্য যে কোনও রকমের ঝুঁকিপূর্ণ কাজেই তিনি ছিলেন পিছুটানহীন। রবীন্দ্রনাথ হয়তো এ কারণেই ভেবেছিলেন যে তাঁর সুভাষই হলেন প্রকৃত ‘দেশনায়ক’। গাঁধীজি কখনও তাঁকে ভেবেছেন পুত্রপ্রতিম, কখনও বা পেট্রিয়ট অব দ্য পেট্রিয়টস।
 
 
 
 
প্রকৃতপক্ষে সুভাষচন্দ্রের অসম সাহসী মনোভাবই তাঁকে ভারতীয় যুবসম্প্রদায়ের আইকন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। এই সাহস ছিল তাঁর মজ্জাগত। আজকে চারদিকে সেই সাহসের বড় অভাব। আমরা স্পষ্ট ভাবে কোনও কিছু বলতেই আজকাল পাঁচ বার ভাবি। বিপদের চিন্তাই বেশি উদ্বেগে রাখে। আমি আর আমার সন্তান যেন থাকে দুধেভাতে, তার জন্য যে কোনও আপসেই আমরা আগ্রহী। সামান্য কলাটা-মুলোটার জন্যও আজ এ দল কাল ও দল করা আমরা কী ভাবে বুঝবো সুভাষচন্দ্রের মাহাত্ম্য?
 
অমিত শাহ কিংবা নরেন্দ্র মোদীই বা কী ভাবে সুভাষচন্দ্রকে আত্মস্থ করবেন? নরেন্দ্র মোদী আন্দামান গিয়ে রস আইল্যান্ডের নাম রাখলেন সুভাষচন্দ্রের স্মৃতিতে। অথচ, মূল পোর্ট ব্লেয়ার রইল সাভারকারের স্মৃতি জড়িয়ে। অনেকটা চাঁদ সদাগরের মতো বাঁ হাতে ফুল দেওয়ার স্টাইল আর কি! অমিত শাহ নেতাজির জন্মদিনের এক দিন আগে পশ্চিমবঙ্গে জনসভা করতে এসে এক বার সুভাষচন্দ্রের আবেগ উস্কে দিয়ে বাঙালিকে ছোঁওয়ার চেষ্টা করলেন। তাঁদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। স্বাধীনতা সংগ্রামীদের স্মৃতিকে ব্যবহার করে যদি কিছু ভোট পাওয়া যায় ক্ষতি কী? গুজরাতে ওই জন্য সর্দার পটেলের দীর্ঘ স্ট্যাচু, নেহরুর সঙ্গে তাঁর বিরোধ ঘিরে ভুলভাল ইতিহাস চর্চার আয়োজন। পশ্চিমবঙ্গে নেতাজির আবেগ। অথচ তাঁর জন্মদিনটি সারা ভারতে ‘দেশপ্রেম দিবস’ হিসেবে পালনের দাবিটি নিতান্তই উপেক্ষিত।
 
 
এমনকি, সুভাষচন্দ্রের রাজনৈতিক দর্শনচর্চারও কোনও প্রয়োজন আছে বলে এই ক্ষুদ্র রাজনীতির কারবারিরা মনে করেন না। অমিত শাহ ‘নাগরিকত্ব বিল’ নিয়ে অনেক কথা বলেছেন। হিন্দু আবেগে সুড়সুড়ি দিয়েছেন। বলেছেন, বাংলাদেশ থেকে যে হিন্দুরা ভারতে এসেছেন তাঁদের প্রত্যেককে নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। এই সর্বনাশা ঘোষণা যে সেই দেশে বসবাসকারী ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের কি পরিমাণ অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিতে পারে সে বিষয়ে অমিত শাহদের কোনও ধারণাই নেই। এখন আমাদের প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে নানা অর্থনৈতিক ও সামাজিক, সাংস্কৃতিক সম্পর্কের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি সমৃদ্ধ দক্ষিণ এশিয়া গড়ে তোলার সময়। সেই সব দেশের ধর্মীয় সংখ্যাগুরুর মতলবী অংশটিকে উৎসাহ দেওয়া এই ভাবে কর্তব্য হতে পারে না যে তোমরা সংখ্যালঘুদের তাড়িয়ে দিলে আমরা স্থান দেব।
 
 
 
 
আসলে অমিত শাহ সুভাষচন্দ্রের জীবনদর্শন, তাঁর রাজনৈতিক জীবনের প্রেক্ষাপট সম্পর্কে কিছুই জানেন না। সুভাষবাবু বাঙালি আর স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলেন এটুকুই তাঁর জানা আছে। মনে রাখা প্রয়োজন যে সুভাষচন্দ্র ছিলেন হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের দূত। তাঁর শ্রেষ্ঠ সহযোগীরা প্রত্যেকেই মুসলিম। এই ভেদভাবহীন মানসিকতা তিনি পেয়েছিলেন তাঁর রাজনৈতিক গুরু দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের কাছ থেকে। দেশবন্ধু যখন কংগ্রেস ছেড়ে স্বরাজ্য দল নির্মাণ করলেন মতিলাল নেহরু ছিলেন তাঁর প্রধান সহযোগী। সুভাষচন্দ্র তাঁর গুরুর পথেই পা বাড়ালেন।
 
 
 
 
দেশবন্ধুর উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ হল ‘বেঙ্গল প্যাক্ট’। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে বাংলায় হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বাতাবরণ নির্মিত না হলে কোনও দিনই অভিন্ন জাতীয় চেতনা গড়ে উঠবে না। সেই লক্ষ্যেই সরকারি চাকরিতে মুসলিমদের জন্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে চেয়েছিলেন। বেঙ্গল প্যাক্ট-এর মাধ্যমে তিনি একটি আদর্শ অসাম্প্রদায়িক বাতাবরণ নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন যা উভয় সম্প্রদায়ের শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষের কাছেই গ্রহণযোগ্য হতে পারত। তিনি চেয়েছিলেন, হিন্দুরা যেমন মসজিদের সামনে ধর্মীয় সঙ্গীতে রাশ টানবে, মুসলিমরাও তেমনই হিন্দু আবেগের কথা ভেবে প্রকাশ্যে গো হত্যা করবে না। গোমাংস ভক্ষণের বিষয়টি একান্তই ব্যক্তিগত পরিসরে রাখার পক্ষপাতী ছিলেন দেশবন্ধু। বাংলার মুসলিম সমাজ এই প্যাক্ট নিয়ে দেশবন্ধু ও তাঁর সহযোগীদের ধন্যবাদ জানালেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক ভাবে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ও বিপিন পালের নেতৃত্বে বাংলার রক্ষণশীল হিন্দু সমাজ এর বিরোধিতা করে। দেশবন্ধু কংগ্রেস নেতৃত্বকেও বোঝাতে চেয়েছিলেন। পারেননি। সঙ্গে পেয়েছিলেন যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত, বীরেন্দ্রনাথ শাসমল, কিরণশঙ্কর রায় ও সুভাষচন্দ্রকে। শেষ চেষ্টাও তাঁর সফল হয়নি। জীবন দেশবন্ধুকে বেশি সময় দেয়নি। ‘মৃত্যুহীন প্রাণ’ তিনি দিয়ে গিয়েছিলেন তাঁর প্রিয়তম শিষ্য সুভাষচন্দ্রকে। নেতাজি শেষ যুদ্ধেও তাঁর হৃদয়ে ধরে রেখেছিলেন সেই অসাম্প্রদায়িক বিচারধারা। অনেকেই মনে করেন স্বাধীনতার লগ্নে তিনি উপস্থিত থাকলে হয়তো দেশভাগ এড়ানো যেত। যাঁরা নেতাজিকে নিয়ে ভোটের ময়দানে ঝাঁপাচ্ছেন তাঁরা আগে কতটা যোগ্য তাই নিয়ে দু’বার ভাবুন।
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
(লেখক রাজনৈতিক ভাষ্যকার ও বঙ্গবাসী কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক)

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>