বাড়ি
সে দিন অফিস-ফেরতা মার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। যেমন যাই, হপ্তায় এক-দু’বার। বাইরের ঘরে পাতা আদ্যিকালের সোফাটায় সবে বসেছি, নজরে পড়ল মাতৃদেবীর মুখখানি একেবারে তোলো হাঁড়ি। ঠোঁটে কুলুপ, ভুরুতে মোটা মোটা ভাঁজ। অন্য দিন তো চৌকাঠ পেরনো মাত্র মা কলকল করে ওঠে, আজ হলটা কী!
চোখের ইশারায় প্রমিতাকে জিজ্ঞেস করলাম, -কেসটা কী রে? শাশুড়ির সঙ্গে ফের লাঠালাঠি?
প্রমিতা হেসে ফেলল, -না গো দিদি। আজ বাংলা-বিহার নয়। ইণ্ডিয়া-পাকিস্তান।
-মানে?
-দুপুরে আজ কালবৈশাখী হল না…তখন ঝড়ে-পড়া কয়েকটা আম কুড়িয়েছিল মা। আমাদেরই এলাকা থেকে। দোতলার ওরা দেখতে পেয়েই ব্যাস। চিৎকার হল্লা গালিগালাজ।
মেজাজটা টকে গেল। ওফ্, সেই অনন্ত অশান্তি! প্রায় তিন যুগ আগে সূচনা হয়েছিল বিবাদের, বাড়িওয়ালা উচ্ছেদের মামলা করেছিল বাবার নামে। তার পর কত কোটি কিউসেক জল যে বয়ে গেল গঙ্গা দিয়ে। নদীর দু’পাড়ে ভাঙনও তো কম হল না। গত হলেন সূর্য চাটুজ্যে, ওপরের জেঠিমাও। আমার বাবাও বছর ষোলো আগে পরপারে। আমরা মেয়েরাও বিয়ে-থা হয়ে ছিটকে গেছি যে যার মতো। মৃত্যুও থাবা বসিয়েছে আমাদের জেনারেশানে। সূর্যজেঠার ছোট ছেলে মন্টুদার প্রয়াণ ঘটল অকালে, আমার বড় ভাইটিও অসময়ে মায়া কাটাল পৃথিবীর। কিন্তু সেই মামলাটি এখনও মহাকালের গর্ভে। এবং যুদ্ধ থামারও কোনও লক্ষণ নেই। আদালতে কব্জা করতে না পেরে এখন বাঁকা পথ ধরেছে ও পক্ষ। কখনও করপোরেশনের জল বন্ধ করে দেয়, তো কখনও ওপর থেকে আবর্জনা ঢালে দেদার। গোদের ওপর বিষফোঁড়া, বাক্যবাণ তো হানছেই অহরহ।
ধুন্দুমারও বাধে। মাঝে মাঝেই। ঝগড়া বাধানোর কত রকম ফন্দি-ফিকির যে আছে। ভাড়াটের কাজের লোকরা চিরটাকাল বাড়ির পিছন-ভাগের বাথরুমখানা ব্যবহার করে এসেছে, অকস্মাৎ এক সকালে সেটি তালাবন্ধ! মুরোদ থাকে তো ভাঙ, ফৌজদারি ঠুকে দেব! উঠোনের মাঝ বরাবর পাঁচিল উঠে গেল রাতারাতি। ভাড়া তো নিয়েছ একতলার ঘর, উঠোনের জমিদারি ভোগ করবে কেন!
দু-দু’বারই ঝামেলাটা থানা-পুলিশ পর্যন্ত গড়িয়েছিল। কাজের কাজ অবশ্য কিছুই হয়নি। এ পক্ষের নালিশ শুনে ও পক্ষকে কোমল ধমক দিয়ে, চা সন্দেশ-টন্দেশ সাঁটিয়ে, গোঁফে তা দিতে দিতে যবনিকার অন্তরালে চলে গেছেন দারোগাবাবু। বাড়িওয়ালা-ভাড়াটের লড়াইয়ে উকিল-পুলিশদেরই তো পোয়াবারো।
কাঁহাতক আর হাঙ্গামা হুজ্জোত ভাল লাগে? তাও আবার তুচ্ছ তুচ্ছ কারণে? আমাদেরও তো বয়স হচ্ছে, না কী?
বেজার মুখে মাকে বললাম, -কেন যে ওদের আমে হাত দিতে যাও?
-কোন সুবাদে ওদের আম? মা ঝেঁঝে উঠল সহসা। -সমু আম খেয়ে উঠোনের ওপাশটায় আঁটি ছুড়ে ছুড়ে ফেলত। তার থেকেই তো চারা গজিয়েছিল।
-প্রমাণ করতে পারবে? গাছটা যখন পাঁচিলের ওপারে, রাইটও ওদেরই।
-তা, ডালপালাগুলোও ও দিকে সরিয়ে নিয়ে যাক। সে লক্ষ্মীছাড়ারা এ দিক পানে ধেয়ে আসে কেন? আমাদের এ দিকে আম পড়লেও ওদের নৈবেদ্য সাজিয়ে দিতে হবে এমন কোনও লেখাজোকা আছে নাকি?
-ছেলেমানুষের মতো কথা বোলো না। বাড়িতে কি আম কম আসে? রোজই তো বাজার থেকে…
-বাজারের আম, বাজারের আম। বাড়ির আম, বাড়ির আম। দুটোর স্বাদ কি এক হয়?
-তা হলে আর মুখ ভেটকে বসে আছ কেন? খিস্তি খেউড়গুলোও হজম করে নাও।
-নিচ্ছি তো। কাউকে কি শোনাতে গেছি? তুই-ই তো গায়ে পড়ে…
এই হল আমার মা। কোনও যুক্তির ধার ধারে না। যারা কুচ্ছিত ভাষায় অপমান করে তাদের সঙ্গে কথা পর্যন্ত বলে যেচে যেচে। গালাগালির মূল হোতা মন্টুদার বউটা। কিন্তু তার বিরুদ্ধে একটা শব্দ উচ্চারণ করো, ওমনি মা ঝামরে উঠবে- আহা রে! কচি বয়সে স্বামী হারিয়েছে, শোকাতাপা মেয়েটার কথা গায়ে মাখতে আছে! বলতে বলতে আঁচলে চোখও মুছে নেবে টুক করে। আর দোতলার কোনও সুসংবাদে? মা তো একেবারে আহ্লাদে গদগদ। শুনেছিস ঋতু, ঝন্টুর একটা কী ফুটফুটে নাতি হয়েছে! ইস্, সূর্যবাবু, গীতাদি বেঁচে থাকলে কী খুশিই না হতেন! গত অঘ্রানে ঝন্টুদার বউ নিজে এসে মাকে মেয়ের বিয়েতে নেমন্তন্ন করে গেল, মার তো আনন্দে পাগলপারা দশা। দুল দেবে, না আংটি, নাকি পিওর সিল্ক, ভেবে ভেবে কূল পায় না। টুকটুকির বিয়ের দিন দিব্যি ড্যাং ড্যাং করে দোতলায় উঠে গেল মা। এ দিকে আমরা ভাইবোনরা তো কাঁটা হয়ে আছি, পাঁচ জনের সামনে মাকে না ছ্যার ছ্যার করে কিছু শুনিয়ে দেয় মন্টুদার বউ। কিংবা মন্টুদার ছেলেরা। অঘটন যদিও কিছু ঘটল না, প্রজাপতির মতো উড়তে উড়তে ফিরে মা জানাল তাকে নাকি বড়ই খাতির-যত্ন করেছে সবাই।
মাস তিনেকের মধ্যেই অবশ্য নমুনা মিলল খাতির-যত্নের। দোতলা থেকে মাছের আঁশ পড়ছে ঝুরঝুর, নেমে আসছে আনাজের খোসা, খাবারের উচ্ছিষ্ট। সঙ্গে নোংরা স্যানিটারি ন্যাপকিনও। মার দৃষ্টি তো প্রায় গেছে, সেই ন্যাপকিন আবার আঙুলে তুলে প্রশ্ন করছে, এটা কী ফেলল দ্যাখো তো প্রমিতা! ওপরের বারান্দায় তখন যুবতী বউদের খিলখিল হাসি, যেন আচ্ছা জব্দ করেছে শ্বশুরবাড়ির ভাড়াটে বুড়িটাকে।
মানছি, আমরা কম ভাড়ায় থাকি। মামলার কারণে সে টাকাও জমা পড়ে রেন্ট কন্ট্রোলে। আমাদের ওপর বাড়িওয়ালার রাগ থাকতেই পারে। তা বলে ওই স্তরের অসভ্যতা? এ পাড়ায় তো আরও অনেক পুরনো ভাড়াটে আছে, বাড়িওয়ালাকে তারাও কিছু পাঁচ দশ হাজার ঠেকায় না, আজ তারা বাড়ি ছাড়লে গৃহস্বামীরা কালীঘাটে পুজো দিয়ে আসবে। কিন্তু ভাড়াটের সঙ্গে এ ধরনের লাগাতার নোংরামি করে চলে কোন বাড়িওয়ালা? নেহাত জেদাজেদির পর্যায়ে চলে গেছে, নইলে মা বউদি ভাইঝিকে নিয়ে রমু তো কবেই উঠে যেত।
প্রমিতা চা বানাতে গেছে ভেতর বারান্দায়। গলা উঁচিয়ে ডাকল,-দিদি, একবারটি শুনে যাও।
পায়ে পায়ে কাছে গেলাম,-কী রে?
-জানো তো, পরশু দুপুরে ওপরে নগেন দত্ত এসেছিল।
-সে আবার কে?
-ওই যে গো, মোড়ের রাঘববাবুদের বাড়িটা ভেঙে যে ফ্ল্যাট বানাচ্ছে। প্রমিতা গলা নামাল,
-লোকটা অনেকক্ষণ ছিল দোতলায়। নামার সময়ে আমাদের পোরশানটা টেরিয়ে টেরিয়ে খুব দেখছিল।
দক্ষিণ কলকাতার এ অঞ্চলটায় জমি ফ্ল্যাটের এখন বিস্তর দাম, প্রোমোটাররাও তাই পুরনো বাড়ি ভেঙে অ্যাপার্টমেন্ট বানানোর জন্য ছোঁকছোঁক করছে সর্বক্ষণ। এ বাড়ির ওপরও নজর পড়েছে তা হলে? স্বাভাবিক, এ বাড়িরও বয়স তো কম নয়। সূর্যজেঠার বাবা বাড়িটা বানিয়েছিলেন সেই উনিশশো আঠাশ সালে। আর আমার বাবা-জেঠারা ভাড়া নিয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে। যখন লোকজন দুদ্দাড়িয়ে কলকাতা ছেড়ে পালাচ্ছে। তার পর তো বাবা-জেঠাদের সংসার হল, সংসার বড় হল, চাকরিসূত্রে জেঠারা একে একে চলেও গেল অন্যত্র, একমাত্র বাবাই যা সপরিবার রয়ে গেল পাকাপাকি। এর পর এ বাড়ি হয়তো মুছেও যাবে কালের নিয়মে।
প্রমিতা কাপে চা ঢেলেছে। চিনি নাড়তে নাড়তে জিজ্ঞেস করল,
-আমাদের ফ্লোর এরিয়া কত আছে গো দিদি? হাজার দেড়েক স্কোয়্যার ফিট হবে না?
-তা হবে।
-বাড়ি ভাঙা হলে সমপরিমাণ জায়গার ফ্ল্যাট আমরা পাব না? রাঘববাবুদের ভাড়াটে তো পাচ্ছে।
-দাঁড়া। আগে তোদের ওপরওয়ালা রাজি হোক। তাদের সঙ্গে দরে বনুক।
-বনবে গো বনবে। মোটা প্রণামি পেলে ওপরওয়ালাও গলে জল হয়ে যায়।
ও বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার সময়েও কথাটা পাক খাচ্ছিল মাথায়। রাস্তায় নেমে এক বার ঘুরে দেখলাম বাড়িখানাকে। ইস্, কী জীর্ণ দশা! রঙের বালাই নেই-ই, চতুর্দিক থেকে প্লাস্টার খসে খসে পড়ছে। নিজেরাও সুরত্ ফেরাবে না, আমাদেরও হাত ছোঁয়াতে দেবে না। বছর দুয়েক আগে রমু ঘরগুলো চুনকাম করাল, তাই নিয়েও দোতলা থেকে যা খিস্তির ফোয়ারা ছুটেছে।
নাহ্ প্রোমোটারের হাতে গেলেই বেশ হয়। তখন ফ্ল্যাট তো একটা জুটবেই, সঙ্গে সঙ্গে যাবতীয় অশান্তির অবসান। তোমরাও সুখে থাকো, আমরাও স্বস্তি পাই। নগেন না খগেন, তাকে বলে একটা ফ্ল্যাটকেই যদি দুটো করে নেওয়া যায়, একটাতে রমু থাকল, অন্যটায় তুলতুলিকে নিয়ে প্রমিতা। সমু মারা যাওয়ার পর রমুই সংসারটা দেখে, নিজে বিয়ে-থা করেনি, বউদি-ভাইঝির কোনও অযত্নই সে করে না। তবু পায়ের নীচে নিজের ফ্ল্যাটের শক্ত মাটি থাকলে প্রমিতাও বুঝি একটু বেশি নিশ্চিন্ত হয়।
হা হতোস্মি, কোথায় কী! পরের সপ্তাহে গিয়ে দেখি প্রমিতার মুখ ভার, মা ফিকফিক হাসছে। সোফায় বসতে না বসতেই মাতাঠাকুরানির সে কী উচ্ছ্বাস,
-অ্যাই জানিস তো, মন্টুর বউ এতদিনে একটা বুদ্ধিমতীর মতো কাজ করেছে।
ধন্দ মাখা মুখে বললাম,
-কী রকম?
-এক বজ্জাত প্রোমোটার বাড়ি ভেঙে ফ্ল্যাট বানানোর টোপ দিতে এসেছিল, তাকে ঘেঁটি ধরে বের করে দিয়েছে।
শুনে খুশি হব, না ব্যথিত বুঝে উঠতে পারছিলাম না। মা ফের বলল,
-তোরা তো শুধু বউটার নিন্দেমন্দই করিস, দ্যাখ একটা কত বড় প্রলোভন জয় করল।
-ও কথা বলবেন না মা। প্রমিতা ঝনঝন বেজে উঠেছে,
-শুনিয়ে শুনিয়ে কী বলছিল কানে যায়নি আপনার?
-আমি অত খেয়াল করিনি। মা নির্বিকার।
প্রমিতা উত্তেজিত ভাবে বলল,
-কী বলে চেল্লাচ্ছিল জানো? হারামজাদা ভাড়াটে ফোকটে ফ্ল্যাট পেয়ে যাবে, এমন ডিলে আমি ইয়ে করে দিই। ভাবো দিদি, কেমন নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গ করার পলিসি! ঝণ্টুদা-মণ্টুদা দু তরফেই তো ছেলের বিয়ে হয়ে গেছে, বাচ্চা-কাচ্চা হচ্ছে, দোতলায় এখন না হোক আট-নটা প্রাণীর বাস। নিশ্চয়ই অসুবিধে হয়। তবু তো এঁটে যাবে না। ভাড়াটেকে বাম্বু দেওয়া যাচ্ছে, এতেই প্রাণে মলয় বইছে!
-তাতে তোমার এত জ্বালা ধরে কেন বাছা? মা ফুট কাটল, ওদের সুবিধে অসুবিধে ওরা বুঝবে, তোমায় ভাবতে হবে না।
ফোঁস ফোঁস মন্তব্য, টুকুস টুকুস টিপ্পনির চাপান উতোর শুরু হয়ে গেছে। হাওয়া গরম ক্রমশ। আমি আর বেশিক্ষণ বসলাম না। বেরিয়ে আজও এক বার ঘুরে দেখলাম বাড়িটাকে। আমার কুমারীবেলার গন্ধমাখা বাড়িটা ধূলিসাৎ হয়ে যাবে ভেবে বুঝি বা একটু স্মৃতি মেদুরই হয়ে পড়েছিলাম সে দিন, আজ মোটেই তেমনটা লাগছে না। বরং বিরক্তিই জাগছে যেন। মনে হচ্ছে ছিরিছাঁদহীন এক বুড়ো গায়ে ছেঁড়াখোড়া আলখাল্লা চাপিয়ে মাড়ি বার করে ভেংচাচ্ছে আমাকে। তর্জনী নাচিয়ে বলছে, নেহি মিলেগা শান্তি, নেহি মিলেগা।
দিন আষ্টেক পর আবার গেলাম মায়ের ডেরায়। ফোনে মা এত্তেলা পাঠিয়েছিল, ইডলি বানাচ্ছি, খেয়ে যা। সে দিন উত্তেজনার লেশমাত্র নেই, গৃহে অপার শান্তি বিরাজমান। শাশুড়ি-বঁধূ দু’জনেই সুহাসিনীম্, সুমধুরভাষিণীম্। বাড়ি ভাঙাভাঙি তো দূরস্থান, দোতলার প্রসঙ্গই উঠল না। রমুও ফিরেছে চটপট, তুলতুলিরও টিউটোরিয়াল নেই, সকলে মিলে জমিয়ে আড্ডা মারলাম সারা সন্ধে।
সময় গড়াচ্ছে নিজের মনে। গোটা গ্রীষ্মকালটা কলকাতাবাসীদের এ বার তাপে ভাজা ভাজা করলেন সূর্যদেব। কপাল ভাল, মৌসুমি বায়ু বেশ জলদি জলদি পৌঁছে গেল। আষাঢ়ের গোড়াতেই বৃষ্টির কী ধুম! সারাটা দিন আকাশ পাঁশুটে বর্ণ, কাড়ানাকাড়া বাজাচ্ছে মেঘবাহিনী, টিপটিপ ঝিরঝির ঝমঝম কত বিচিত্র ধারাই যে ঝরছে অবিরাম।
এ বারও বর্ষায় ও বাড়ির অবস্থা বেশ কাহিল। রেনপাইপ ভেঙে উঠোন বারান্দা জলে কাদায় থইথই, স্নানঘরের ফুটো চাল দিয়ে ঝুপুর ঝুপুর বৃষ্টি ঢুকে পড়ছে, পাঁচিলের ওপারে গাছ আগাছা বেড়ে মশককুলের বংশবৃদ্ধি ঘটছে দ্রুত। আর রুটিন মাফিক ঝরে-পড়া পচা আবর্জনায় ঘরের আশপাশ তো ম ম করেই।
তা, রেনপাইপে তো আর হাত ছোঁয়ানোর অনুমতি নেই। ও পারের মশানিধনও নিষিদ্ধ। বোধহয় ওপরওয়ালা আশায় আশায় আছে এ বার ষাঁড়ের শত্রু বাঘে খাবে, ম্যালেরিয়ায় টাঁসবে ভাড়াটের গুষ্টি। এ সবের মধ্যেই আমার নির্বিরোধী ভাইটি হঠাৎ একটা দুঃসাহসিক কাণ্ড করে বসল। ঝটাক্সে বদলে ফেলল কলঘরের টিনের চালখানা। কত আর বৃষ্টিতে ভিজে চৌবাচ্চা থেকে গায়ে জল ঢালা যায়!
প্রথম এক-দু’দিন বাড়িওয়ালা চুপচাপ, তার পরই নতুন করোগেটেড টিনের আচ্ছাদনে ধাঁই ধপাধপ ইট। ছোটখাটো ঢেলা নয়, আস্ত আস্ত থান ইট। নিয়ম করে পড়ছে রোজ, সন্ধে নামার পরে। হঠাৎই বুদুম করে একটা আওয়াজ হয়, তার পর ক্ষণিক নৈঃশব্দ্য, কয়েক সেকেণ্ড পর দোতলার বারান্দায় চাপা খিলখিল হাসি। মা এক দিন নরম করে গলা উঠিয়েছিল, কেন বাবা ও রকম করছ? কষ্টের পয়সায় সারানো চালাটা ভেঙে যাবে যে। অমনি যুবককণ্ঠে ওপর থেকে হরিধ্বনি, বলো হরি, হরি বোল। বুড়িটা এ বার খাটে তোল।
রমু বেচারি নার্ভাস হয়ে পড়েছে রীতিমত। সে চিরকালই সাংসারিক ঝামেলা পাশ কাটিয়ে কাটিয়ে চলতে চায়। ও বাড়ি যেতে সেই রমুর গলাতেই অন্য সুর,
-আর তো পারা যায় না রে দিদি। এ বার একটা এস্পার-ওস্পার করতেই হয়।
-কী করবি? থানায় যাবি?
-দূর দূর, দারোগাবাবুদের ডিম খাইয়ে কী হবে। ভাবছি দোতলার সব কটাকে এক দিন বাঁশপেটা করে আসব।
বুঝলাম, উদাসীন রমু খেপেছে বিস্তর। শান্ত করার জন্য ঠাট্টা জুড়লাম,-তার পর লাল গামছায় মুখ ঢেকে হাতকড়া পরে কোর্টে উঠবি, তাই তো?
-কপালে বোধহয় সেটাই নাচছে। জানিস, কাল তুলতুলিটা এক চুলের জন্য বেঁচে গেছে। উঠোনে কী জন্যে যেন নেমেছিল, ওমনি ছাদ থেকে মিসাইলের মতো একখানা ফাঁকা মদের বোতল। একটা টুকরো যদি ছিটকে এসে বিঁধে যেত…!
-আমরা তো সন্ধের পর কলতলা যাওয়া ছেড়েই দিয়েছি। প্রমিতা বলে উঠল,—অমূল্য বালতি করে জল তুলে রাখে, ভেতর বারান্দার ছোট বাথরুমটাতেই।
-হুম। বড় একটা শ্বাস টেনে খানিকটা হাওয়া ভরে নিলাম বুকে। মাথা নেড়ে বললাম, কিন্তু এটা তো কোনও পার্মানেন্ট সলিউশান নয়।
-সমাধানের তো একটাই রাস্তা। রমুর স্বর গুমগুমে,
-সূর্য চাটুজ্যের শয়তান নাতিগুলোরই জয় হোক। আমরা মানে মানে কেটে পড়ি।
-পালাবি?
-উপায় কী? টিনের চালটা ভেঙে গেলেই যে ওরা থামবে তার কোনও গ্যারান্টি আছে? প্লাস রোজ রোজ খ্যাচোর খ্যাচোর, টেনশান। বাড়ি ফিরলেই এই কমপ্লেন, ওই কমপ্লেন…। আমি কাজকর্ম করব, না থানাপুলিশ করে বেড়াব? রমু মাথা ঝাঁকাচ্ছে, বাড়িটা প্রোমোটারের হাতে দিতে পারছে না বলে আমাদের ওপর আক্রোশ আরও বাড়ছে। যত রকম ভাবে পারে এখন হ্যারাস করবে। তার চেয়ে সুখের চেয়ে স্বস্তি ভাল, বাইপাসের দিকে একটা ফ্ল্যাট বুক করে ফেলি। লোন-টোন নিয়ে হোক, যে করে হোক। তার পর পজেশান পেলে চলে যাব।
-উঠে যাব আমরা? বাড়ি ছেড়ে? বহু ক্ষণ নিশ্চুপ বসে থাকা মা হঠাৎই প্রায় আর্তনাদ করে উঠেছে,
-কেন যাব?
-ওরা আর তিষ্ঠোতে দিচ্ছে না, তাই।
-ওরা চাইলেই চলে যেতে হবে? কে ওরা? ওরা কে? মার গলা আরও চড়ে গেল,
-কদ্দিন আছে ওরা এই বাড়িতে? ছোঁড়াগুলো তো এই সে দিন জন্মাল! ওদের বউগুলোই বা কত দিন এসেছে, অ্যাঁ? তিন বছর? চার বছর? পাঁচ বছর? আমি আছি পাক্কা ঊনষাট বছর। সেই বিয়ে হয়ে আসা ইস্তক। ঝন্টু-মন্টুর বউরা যত দিন এ বাড়িতে আছে, তার চেয়ে ঢের বেশি দিন।
-আশ্চর্য, এ যে কমলাকান্তর মতো যুক্তি! দুধ আমি খেয়েছি, অতএব গরুও আমার! রমু ঠোঁট বেঁকাল,
-বি প্র্যাকটিকাল মা। ঊনষাট বছর বসবাস করলেই বাড়ি ভাড়াটের হয়ে যায় না।
-আলবত হয়। লক্ষ বার হয়। এটাই তো আমার ভিটেমাটি। এ বাড়িতেই বউ হয়ে আমি প্রথম পা রেখেছিলাম, এখানেই আমার ছেলেমেয়ে হয়েছে, এখানেই এত কাল সংসার করলাম, এ বাড়িতেই তোর বাবা মরেছে, আমার সমু মরেছে…।
মার গলা মাঝপথেই আটকে গেল। স্বরযন্ত্র স্তব্ধ, কিন্তু কণ্ঠনালীর ওঠানামা চলছেই। ক্ষীণ হয়ে আসা দু’চোখ বেয়ে গড়িয়ে এল জল।
এ কি শুধুই অশ্রু? নাকি ঊনষাট বছর ধরে এ বাড়ির একতলার ভিতে ইট-কাঠে কড়ি-বরগায় জানলা-দরজায় চারিয়ে যাওয়া অদৃশ্য এক শিকড়ের রস? বুঝতে পারছিলাম না। যুক্তি দিয়ে বিচার করলে মার কথাগুলো হয়তো নেহাতই হাস্যকর। নিছকই এক বৃদ্ধার প্রলাপ। তবু যে কেন গলার কাছে একটা ডেলা জমাট বাঁধে। নাহ্, শিকড়টাকে এখন উপড়ে ফেলা অসম্ভব। মন্টুদার ছেলেরা বোমা মেরেও পারবে না।
কথাসাহিত্যিক
১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দের ১০ই জানুয়ারি ভারতের বিহারের ভাগলপুরে মামারবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। যদিও তার পিত্রালয় ছিল মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুর শহরে, তবে কলকাতা শহরে তার স্কুল ও কলেজ জীবন কাটে। তিনি কলকাতা শহরের যোগমায়া দেবী কলেজ থেকে স্নাতক হন।[২]কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষালাভের সময় তিনি বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হন। বিভিন্ন স্থানে চাকরি করার পর তিনি সরকারী চাকরিতে যোগদান করেন। লেখিকা হিসেবে সম্পূ্র্ণ রূপে সময় দেওয়ার জন্য তিনি ২০০৪ খ্রিষ্টাব্দে তার চাকরি থেকে ইস্তফা দেন। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি দক্ষিণ কলকাতার ঢাকুরিয়া অঞ্চলের বাসিন্দা ছিলেন। ২০১৫ সালের ১২ই মে রাত ১০টা ৪৫ মিনিটে তার বাড়িতে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে সুচিত্রা ভট্টাচার্যের জীবনাবসান হয়।