| 29 মার্চ 2024
Categories
প্রবন্ধ ফিচার্ড পোস্ট সাহিত্য

শুধু কবিতার জোরে একশো বছর

আনুমানিক পঠনকাল: 6 মিনিট

বাংলা ভাষায় কবি হওয়া সবচেয়ে সহজ ও কবি থাকা সবচেয়ে কঠিন। রবীন্দ্রনাথের পক্ষেও। একজন কবিকে তাঁর নতুনত্বে চিনে নিতে পারে বাংলা–‌পাঠক খুব দ্রুত। এতে প্রমাণিত হয় বাংলা–‌পাঠক স্বভাবত কবিতামুগ্ধ। আবার, সেই কবির নতুনত্ব বাংলা–‌পাঠকের কাছে খুবই তাড়াতাড়ি একঘেয়ে লাগতে শুরু করে। এতে প্রমাণিত হয়, বাংলা–‌পাঠকের কাছে কবিতা নিতি–‌নিতি নৌতুন হতে হবে।

তাও যদি–‌বা সম্ভব, কবি হয়ে টিকে থাকা প্রায় অসম্ভব। প্রথমত, তাঁর একটি নিজস্ব পত্রিকা থাকতে হবে, বা তাঁকে কোনও পত্রিকার নিজস্ব হতে হবে, দ্বিতীয়ত, তাঁর একটি নিজস্ব ‘‌দর্শন’ থাকতে হবে, তৃতীয়ত, তাঁর রাজনীতি বা অরাজনীতি ‌অনড়‌ হতে হবে কারণ বাংলা পাঠকও রাজনীতিতে আছেন ও বাংলা পাঠক খুব সঙ্গত মনে করেন না যে একজন কবির রাজনৈতিক বিশ্বাস পাল্টাতেই পারে। চতুর্থত, একজন কবির প্রতিপক্ষ কে তা প্রকাশ্য হতে হবে, মানে কাকে তিনি কবি মনে করেন না সেটার ওপর নির্ভর করবে তিনি নিজে কেন কবি। এর ব্যতিক্রম যে একেবারে নেই তা নয়। কিন্তু কবিতাচর্চা নিয়ে এটাই আমাদের আধুনিক সামাজিক আচরণ। সে–‌আধুনিকতাকে গুপ্ত কবি পর্যন্ত পেছিয়ে নিলেও বা কৃত্তিবাসের কবিরা পর্যন্ত এগিয়ে আনলেও।

একটু বিস্ময় ঠেকে বইকি, বিশেষ করে এমন একটি সমাজে যেখানে কবিতা আমাদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনের সব কিছুতে জড়িয়ে থাকে। পৃথিবীর আর–‌কোনও ছোট বা বড় দেশে কবিতা সেখানকার মানুষজনের পক্ষে এতটা অনিবার্য বলে তো খবর পাই না, অথবা, হয়তো, কবিতা নিয়ে আমাদের মত এমন অনৈক্যমত্য, এমন দলাদলি, এমন কূটকচালি, এমন ঈর্ষাদ্বেষ।

এটা আজকের ব্যাপার নয়। মধুসূদনের মতো কবি, ঈশ্বর গুপ্ত ও ভারতচন্দ্রকে নিন্দে না করে নিজের মহৎ চেষ্টার স্বাবলম্বন প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি। রবীন্দ্রনাথ যত কম বয়সেই হোক, মধুসূদনকে বর্জন না করে বিহারীলালের বা হেমচন্দ্রের মতো কবিতে তাঁর অনুসরণীয় ঐতিহ্য খুঁজে পাননি। রবীন্দ্রনাথের কবিতার ন্যূনতা খুঁজে বের না করে তাঁর বয়োজ্যেষ্ঠ, সমকালীন ও অনেক কম–‌বয়সি কবিরাও নিজেদের কাব্যভাষা খুঁজে পাননি— এমনকী রবীন্দ্রনাথের কবিতার বৈচিত্র‌্য ও প্রাচুর্যেও তাঁরা ভয় পাননি। বুদ্ধদেব, বিষ্ণু দে, সুধীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ পর্যন্তও না। এঁরা তো স্বভাবকবি নন, যথেষ্ট বিদ্বান ও পরিশ্রমী কবি সবাই। এঁরা ইউরোপীয় কাব্যপাঠে অভিজ্ঞ। কিন্তু এঁরাও তাঁদের রাবীন্দ্রিক সমকালে এমন কাণ্ডজ্ঞান দেখাননি যাতে বোঝা যায় যে তাঁরা অন্তত বোধ করতেন যে রবীন্দ্রনাথ উচ্চতায় অভ্রংলিহ, তাঁর বিস্তার বসুমতীতুল্য ও তাঁর সৃষ্টিক্ষমতা নিসর্গের মতোই রহস্যময়।

কবিতাপাঠ ও কবিতাগ্রহণের এই ইংরেজিশিক্ষিত অভ্যেস বাংলা কবিতার ক্ষতি করেছে। কবিতা ছাড়া আমাদের দিন কাটে না অথচ আমাদের কবিরাও, কবিতা পড়তেই শেখেননি। ফলে, আমাদের পাঠাভ্যাসে এ প্রায় অভাবনীয় যে একজন নাম–‌না–‌জানা কবির কোনও রচনা, বা এমনকী রচনাংশও, আমাদের মুগ্ধতায় তরঙ্গিত করে তুলবে। আমি যাকে চিনি না বা জানি না সে কী করে এমন লিখবে যা আমাকে মুগ্ধ করে রাখবে, আমার মধ্যে প্রত্যাশার অপেক্ষা রুয়ে দেবে?‌ যেন, কবিতার কোনও কঠিন বাস্তব অথচ অজানা উৎস নেই, যা আমার নিজের অভিজ্ঞতা ও অনুভবের ও বিদ্যাচর্চার বাইরে। এমন কবিতাপ্রাণ একটা জাত, শ্বাসকষ্ট উঠলেও যাকে সেই শ্বাসের টানে–‌টানে কবিতা পড়তে হয় বা বলতে হয়, তার কাছে কবিতা কী করে যে এমন সম্প্রদায়িক হয়ে থাকে। আমার সন্দেহ:‌ এটা ইংরেজি শিক্ষার ফল। যখন ইংরেজরা আসেনি, তখনও বাংলা কবিতাচ্ছন্ন ছিল। কী নিয়ে যে পাঁচালি লেখা হত না— তার হদিশ কেউ দিতে পারে না আর সমাজের সব মানুষ একসঙ্গে বসে সেই পাঁচালি শুনত।

ইংরেজরাই কি শিখিয়ে ফেলল আমাদের— ধুত, কবিতা হলেই কবিতা হয় না কি?‌ আসলে তো জানতে হবে কবির ওই কবিতাটা লেখার মতলবটা কী?‌ কারা ওকে উসকেছে?‌ ও কাদের দলে ও কাদের কথা বলতে চায়।

সুভাষদা বেশ কয়েকবার আমাকে বোঝাতে চেয়েছেন যে কাব্যচর্চার কোনও জিজ্ঞাসা থেকে তাঁর কবিতার ছন্দ, উপমা, উচ্চারণ, বাগভঙ্গি নিরূপিত হয়নি, এগুলো নিরূপিত হয়েছে মিছিল–‌মিটিং থেকে। নিশ্চয়ই আরও অনেককে বলেছেন এমন কথা, লিখেওছেন। আমরাও এ–‌কথাটা বেশ মেনে নিয়েছি। সুভাষদার কাব্যচর্চা সম্পর্কে তাঁর নিজের ও আমাদের এই সব ধারণা ও রটনা তাঁর কবিতার ভিতর ঢুকতে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে উঠেছে কালক্রমে। তাঁর প্রথম বই ‘‌পদাতিক’‌–‌এর কবিতাগুলি এখন বিশ–‌বছর কম একশো বছর পর যদি আমরা পড়ি— সংস্কারমুক্ত চিত্তে সমস্ত রকম পূর্বধারণা ভুলে ও তাঁর সমকালীনদের কবিতার সঙ্গে তা হলে এ–‌বিষয়ে কোনও সন্দেহের ফাঁকও তৈরি হয় না যে ‘‌পদাদিক’‌–‌এর কবিতার বাচনের বিশিষ্টতা ও ব্যক্তিগত উচ্চারণ তৈরি হতে পারে নিতান্ত ও আত্যন্তিক কঠিন ব্যক্তিগত অনুশীলনে ও বারবার সংশোধনে, কোনও মিটিং–‌মিছিলের বা আড্ডার সংগ্রহ থেকে নয়। সুভাষদা কোনও সহজরসের কবি ছিলেন না।

আমার কথার প্রমাণ হিসেবে কয়েকটি মাত্র উদাহরণ দিচ্ছি এইটুকু বুঝে নিতে যে এমন বাচনগুলি, কবিতা কাকে বলে, তার একটি চিরস্বীকৃত সংজ্ঞার উদাহরণ না হলে এই দুইদশকন্যূন একশো বছর বেঁচে থাকত না। সংজ্ঞাটি হচ্ছে— স্মরণীয়তা, চিরস্মরণীয়তা, পুনরাবৃত্তিবহন ক্ষমতা। প্রবাদ বা মুখের কথা থেকে কবিতা হয় না, কবিতাই প্রবাদ ও মুখের ভাষা হয়ে ওঠে এক চিরজীবিতায়। এই নিরিখে সুভাষদা আধুনিক বাংলা কবিতায় অতৃতীয় দ্বিতীয়, প্রথমতম নিশ্চয়ই রবীন্দ্রনাথ, কবিতা ও গান মিলিয়ে। যেহেতু আমি ইংরেজ রাজত্বকে আমাদের শিল্প–‌সংস্কৃতির অভূতপূর্ব নতুন আকার সৃষ্টির ইতিহাসের অচেতন কার্যকারণ বলে স্বীকারই করি না, তাই সুভাষদার কবিতার উচ্চারণের প্রবাদ হয়ে ওঠার ঘটনার সাযুজ্য খুঁজতে পারি— ‘‌চৈতন্যচরিতামৃত’‌–‌এ বা ভারতচন্দ্রের রচনায়। কবিতা এমনই স্বাদেশিক ও স্বভাষিক এক বাচন, যা সূর্যাস্তহীন সাম্রাজ্যেরও অন্তরালে শতাব্দ–‌সহস্রাব্দকে গেঁথে গেঁথে চলতেই থাকে। এবার কিছু প্রমাণ না দিলে আমার এই কথাগুলি নিতান্তই ব্যক্তিগত মনে হবে। আমি শুধু ‘‌পদাতিক’‌ থেকেই কিছু চরণ বা চরণাংশ বাছছি, যা, প্রায় একশো বছর ধরে বেঁচে আছে।

‘‌দলে টানো হতবুদ্ধি ত্রিশঙ্কুকে’‌, ‘‌তিল তিল মরণেও জীবন অসংখ্য জীবনকে চায় ভালোবাসতে’‌, ‘‌আজো হাসি তাই মুখভঙ্গির অভ্যাসে’‌, ‘‌সবাই আমরা নিজবাসভূমে পরবাসী’‌, ‘‌সেলাইয়ের সেই সুতোয় লুকোয় লজ্জা’‌, ‘‌সেই কথাটাই বাধে না নিজেকে বলতে/‌শুনবে যে–‌কথা হাজার জনকে বলতে’‌, ‘‌রাত্রি কিন্তু রাত্রিরই পুনরুক্তি’‌, ‘‌চোখ বুঁজে কোনো কোকিলের দিকে ফেরাব কান’‌, ‘‌উঁচু আঙুরের ঈষৎ আশাও করি না’‌, ‘‌জনান্তিকেই বুলি কপচানো খাসা তো?‌’‌, ‘‌নখাগ্রে নক্ষত্রপল্লী;‌ ট্যঁাকে টুকরো অর্ধদগ্ধ বিড়ি’‌, ‘‌সদলে বসন্ত তাও পদত্যাগপত্র পাঠাবে না?‌’‌ ‘‌ডায়মন্ডহারবার থেকে ধুরন্ধর গোয়েন্দা হাওয়ারা একত্রিশে চৈত্রেই চম্পট’‌, ‘‌আদালত সচ্চরিত্র’‌, ‘‌ইতিহাস স্পষ্টবক্তা’‌, ‘‌সাবাস বল্লভভাই!‌ প্রকাশ্যেই নেড়ে দিলে গান্ধীর চিবুক’‌, ‘‌আর কত দিন থাকবে ধোকার টাটি?‌’‌, ‘‌স্বপ্নের ভাড় সামনেই ওল্টানো’‌, ‘‌অর্ধেক চাঁদের মত কী করুণ চ্যাপ্টা’‌, ‘‌পর্দায় সর্দার হাওয়া কসরৎ দেখায়’‌, ‘‌বসন্ত সত্যিই আসবে?‌ কী দরকার এসে?‌’‌ ‘‌বড়ই ধাঁধাঁয় পড়েছি মিতে!‌’‌— আমি শুধুই ‘‌পদাতিক’‌ বইটি থেকে বেছেছি।

ওই বই থেকেই অন্য পাঠক অন্য রকম বাছতে পারেন।

কারণ, কবিতাই যখন প্রবাদ হয়ে ওঠে, তখন প্রবাদ–‌বলা বা ছড়াকাটার সময় যেমন, তেমনি কবিতার ভিতরেও নানা উপলক্ষ, নানা ভঙ্গি, নানা গোপনতা, নানা ইঙ্গিত, নানা মুখঝামটা, নানা ঘাড় ঘোরানো, নানা গোপন ঢুকে পড়ে। কবিতাটি দুরন্বয়ী, শিলীমুখবহুল ও পুঙ্খতাকণ্টকিত হয়ে ওঠে। টি–‌এস এলিয়ট কবিতার কবিতা–‌হয়ে–‌ওঠার জন্য যে ‘‌সর্বজনীনতা’‌ বা ‘‌ইউনিভার্সালাইজেশন’‌–‌এর তত্ত্ব বলেন— এগুলো তারই উপকরণ। সুভাষদার কবিতাতেও তাই ঘটেছে।

‘‌পদাতিক’‌–‌এর কবিতাগুলি যখন কাগজে–‌পত্রে ছাড়া–‌ছাড়া ভাবে বেরোচ্ছে, তখনই, বাংলার প্রতিষ্ঠিত ও উত্তরাবীন্দ্রিক আত্মসন্তুষ্ট আধুনিকতা, দুই মহাযুদ্ধের মাঝের, বা তার কিছু আগেরও, ইউরোমেরিকার কাব্যরীতি অনুবাদ করে ফেলছেন ও একটু অপ্রস্তুত লক্ষ্য করে ফেলছেন এই নতুন কবির কাব্যদক্ষতা তাঁদের করায়ত্ত নয়। ‘‌পদাতিক’‌–‌এর শতবর্ষ–‌বিশেষ সংস্করণের পরিশিষ্টে এমন কৌতুককর ঘটনার বিবরণ আছে যে সুভাষদার পাঠানো একটি কবিতার (‘‌অতঃপর’‌)‌ ছন্দটা ধরতেই পারছেন না বুদ্ধদেব বসু, আবু সয়ীদ আইয়ুব, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত। সুধীন্দ্রনাথ অবিশ্যি পেরেছিলেন।

‘‌পদাতিক’‌ আমার কাছে প্রায় ‌দুর্বোধ্যতম কাব্য— তার প্রতিটি কবিতার প্রতিটি চরণ, কোনও–‌কোনও সময় অর্ধচরণও, কোনও এমন ঘটনার ইঙ্গিত, বেশির ভাগই রাজনৈতিক, যার প্রাসঙ্গিকতা বোঝা যায় না অথচ যার কবিত্ব স্বতঃপ্রমাণিত। অথচ যে–‌কবি এমনই কবি যিনি তাঁর কাব্যচর্চা শুরুই করেছেন— সরাসরি রাজনীতি নিয়ে, কোনও আবডাল না রেখে। অথচ, তাঁর প্রতিটি চরণেই হাজার আবডাল।

কবিতাকে এমন আবডালময় কাঁটাগাছ অথচ নিশ্চিত কবিতা করে তোলার ক্ষমতাই, এমন দুর্বোধ্যতা তৈরির, ধাঁধা তৈরির ক্ষমতাই সুভাষদাকে জন্মক্ষণেই অমরতা দিয়েছে।

সুধীন্দ্রনাথ দত্তের দুর্বোধ্যতা নতুন শব্দে নিহিত ধ্বনির করতালি বা মৃদঙ্গরোল। ছন্দটা ধরতে পারলেই রক্তে দোল লাগে। বিষ্ণু দে–‌র দুর্বোধ্যতা তো অপ্রস্তুত প্রশংসার প্রাচুর্যে, আলস্য কাটাতে পারলে প্রসঙ্গান্তর থেকে এপিকে পার্শ্বপ্রবেশ হয়। জীবনানন্দের দুর্বোধ্যতা তো অপরিচিত আঞ্চলিক শব্দের সারারাতব্যাপী নিশির ডাক— স্বরান্তরহীন সেই নিশির ডাকে গা ছমছম করে। বুদ্ধদেব বসুর দুর্বোধ্যতা তো তাঁর অনশ্বর যৌবনের সাহসে ও অনাধ্যাত্মিকতায়। অরুণ মিত্রের দুর্বোধ্যতা তো মাটির দুর্গ বানানোর গোপন কুশলতায়।

এঁদের প্র‌ত্যেকের থেকে দশ–‌বিশ বছরের ছোট এই তরুণ কবির প্রত্যেকটি চরণের লক্ষ্য আলাদা— একই চরণে যে খেলাচ্ছলে লক্ষ্য বদলে ফেলে। অথচ, যা দিয়ে কবিতা তৈরি হয় সেই শব্দ, ধ্বনি, শব্দের ও ধ্বনির সঙ্ঘাত, ও ছন্দের নির্ভুল উচ্চারণ, উপমার গোপনতায় তার এমনই প্রৌঢ় দক্ষতা যে কার ক্ষমতা আছে তার কবিত্ব অস্বীকার করে। এমন টাটকা, তাজা, সরল, স্বাভাবিক ও প্রায় শিশুপ্রতিভার মতো ক্রীড়াময়। অথচ কত সাবধানি। ‘‌পদাতিক’‌–‌এর দ্বিতীয় কবিতা, ‘‌মে–‌দিনের কবিতা’‌র তৃতীয় স্তবকের শেষ চরণে লিখছেন ‘‌উজ্জ্বল দিন দিক–‌অন্তে’‌। তখনও মাত্রাবৃত্তে শেষ পর্ব সমমাত্রারই হয়। এখন তো আমরা অনায়াসে ‘‌দিগন্তে’‌ পড়তে পারি।

সুভাষদা নিজে এ–‌সব সবচেয়ে ভাল জানতেন।

তাই ‘‌পদাতিক’‌–‌এর কবিতাতে ব্র‌্যাকেট আর কোলনচিহ্নের বহুল ব্যবহার— পাঠককে একটু টেনে আনা। বহু বছরের পর যখন তাঁর দ্বিতীয় কাব্য ‘‌চিরকুট’‌ বেরোল তাতে কোনও ব্র‌্যাকেট নেই, আর কোলনচিহ্নও নেই।

আর ‘‌ফুল ফুটুক’‌ থেকে কবিতার মধ্যে এসে গেল জায়গা–‌ছাড়া, দুই শব্দের মধ্যে, দুই চরণের মধ্যে, দুই অর্ধস্তবকের মধ্যে, তখন মুখের কথাই কবিতা ও প্রবাদ হয়ে উঠছে।

এখন না–‌হয় বড় প্রকাশকের তত্ত্বাবধানে সুভাষদার ‘‌কবিতাসংগ্রহ’‌ সঙ্কলিত হচ্ছে প্রায় যোগ্যতম সম্পাদনায়— যত তথ্য পারা যায় তত তথ্য ওই নির্দিষ্ট খণ্ডের পরিশিষ্টে সাজানো। এ–‌কাজ শুরু করেছিলেন অধ্যাপক সুবীর রায়চৌধুরি। তাঁর অকাল ও আকস্মিক মৃত্যুর পর যে–‌দায়িত্ব বর্তায় সৌরীন ভট্টাচার্য–‌এর ওপর। তিনিই বাকি তিন খণ্ড সম্পাদনা করেছেন। শঙ্খ ঘোষ ছিলেন নিরন্তর সহায়। তাই, সুভাষদাকে এখন কবি হিসেবে সাজিয়ে–‌গুছিয়ে ভাবা যায়। পাতা উল্টোলেই তাঁর কালানুক্রমিকতা চোখে না পড়ে পারে না।

কিন্তু এই কালানুক্রমিকতা এখন প্রমাণিত হয়ে যাওয়ায় একটা অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে। ‘‌পদাতিক’‌ ‌থেকে ‘‌ফুল ফুটুক’‌ পর্যন্ত পাঁচটি কাব্যগ্রন্থ কবিতা সংগ্রহের প্রথম খণ্ড অর্থাৎ ১৯৩৮ থেকে ১৯৫৭। ‘‌দ্বিতীয় খণ্ড’ ‘‌যত দূরেই যাই’‌ (‌১৯৬২)‌ থেকে ‘‌ছেলে গেছে বলে’‌ (‌১৯৭২)‌ পর্যন্ত এক দশকের পাঁচটি কাব্যগ্রন্থ নিয়ে। তৃতীয় খণ্ড ‘‌পাবলো নেরুদার কবিতাগুচ্ছ’‌ (‌বৈশাখ ১৩৮০)‌ থেকে ‘‌চইচই–‌চইচই’‌ (‌ফাল্গুন ১৩৮৯)‌ এই দশ বছরের সাতটি কবিতার বই নিয়ে।’‌ চতুর্থ খণ্ড ‘‌হাফিজের কবিতা (‌ফেব্রুয়ারি ১৯৮৪)‌ থেকে ‘‌অমরুশতক’‌ (‌জানুয়ারি ১৯৮৮)‌ এই চার বছরের চারখানি বই নিয়ে।’‌ ‘‌যারে কাগজের নৌকো’‌ (‌১৯৮৯)‌.‌.‌.‌ থেকে ‘‌মিউয়ের জন্য ছড়ানো ছিটানো’‌ এই চারখানি বই নিয়ে পঞ্চম খণ্ড’‌।

সুভাষদার কাব্যসন্ধান বোঝার পক্ষে এমন সম্পূর্ণ সম্পাদিত সঙ্কলন নতুন করে এই প্রশ্নগুলিকে নিরুত্তর করে দিচ্ছে। মৌলিক কবিতা রচনা এত ছাড়া–‌ছাড়া কেন?‌ তাঁর রচনাব্যস্ততার সময় থেকে তাঁর নীরবতার সময় দীর্ঘতর। তার কারণ কী?‌ এত অনুবাদ কেন ও অনুবাদ–‌নির্বাচনের মধ্যে ক্রমেই দুর্বোধ্য বৈচিত্র‌্য বাড়ছে কেন?‌ সুভাষদার কবিতাগুলির প্রথম প্রকাশের পত্র–‌পত্রিকা ও সন–‌তারিখ না থাকায় এমন একটা জরুরি প্রশ্নের উত্তর মেলে না— প্রাতিষ্ঠানিক বাংলা সাহিত্য অগত্যা কবে থেকে সুভাষদাকে স্বীকার না করে পারল না?‌

একশো বছর শুধু কবিতার জোরে বেঁচে থেকে সুভাষদা তাঁর বেঁচে–‌থাকার দম দেখালেন। এবার আমাদের খুঁজতে হবে সেই বেঁচে–‌থাকার অমোঘ ম্যাজিকটা।

একটা ম্যাজিকের কথা না–‌বলে শেষ করা ঠিক হবে না।

সুভাষদা শেষ দিকে কেমন একটা পারিবারিক পরিবেশের কবিতা লিখে আমাদের বুঁদ করে দিতেন। তিনি তো চিরকেলে বারমুখো। ঘরমুখো হলেন কবে থেকে?‌

জেল থেকে বেরিয়ে গীতাদিকে নিয়ে বজবজে গেলেন— শ্রমিক আন্দোলন করবেন বলে। তখন কিছু কবিতা লিখেছিলেন, যেগুলো ‘‌ফুল ফুটুক’‌–‌এ আছে। সেই–‌কবিতাগুলি যখন প্রথম বেরোয় এদিক–‌ওদিক, তখন এমন একটা নিন্দে কানে আসছিল— ‘‌পাগল বাবরালির চোখের মত আকাশ’‌, ‘‌সালেমনের মা’‌, ‘‌ব্যঞ্জন হেড়িয়া গ্রামের ঘুটঘুটে রাত্তির’‌, ‘‌চড়িয়ালের রাস্তা’‌— এগুলো তো ‘‌লোকাল’ ও ‘‌পার্সোন্যাল’‌ কাব্যচিত্র। কবিতা কোথায়?‌

অমর কবিদের এ–‌সব জিজ্ঞেস করতে নেই। অমরতাকে চিনে নিতে হয়। নইলে তাঁরাই চিনিয়ে দেন:‌

চলে গেছে একশত বর্ষের

বহু প্রার্থিত সেই দিন।

ফুরোয় নি কাজ— (‌শতকিয়া)।‌‌‌‌‌‌‌‌

 

 

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত