| 20 এপ্রিল 2024
Categories
ফিচার্ড পোস্ট সাক্ষাৎকার

রবীন্দ্রনাথ বাঙলা গানের সর্বনাশ এবং সর্বস্ব-সুধীর চক্রবর্তী

আনুমানিক পঠনকাল: 15 মিনিট

[সুধীর চক্রবর্তীর জন্ম ১৯৩৪। বাঙলা সাহিত্যের অধ্যাপক। বর্তমানে অবসর গ্রহণ করেছেন। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে দুবছর তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগে অতিথি অধ্যাপক হিশেবে ছিলেন। শ্রীচৈতন্য কলেজের স্নাতোকত্তর বাঙলা বিভাগে অতিথি অধ্যাপক হিশেবেও ছিলেন। বারো বছর ধরে সম্পাদনা করছেন বার্ষিক সংকলন ‘ধ্রুবপদ’। গবেষনা কর্ম, মৌলিক রচনা ও সম্পাদনার কাজে খ্যাতিমান। ভালবাসেন গান আর গ্রাম। কৃষ্ণনগর এবং কলকাতায় উভচর বাসিন্দা। রবীন্দ্র্রসংগীত, বাঙলা গান, লোকধর্ম ও সমাজ নৃতত্ত্ব, নিম্নবর্গের সংস্কৃতি, গ্রাম্য মেলা মহোৎসব, মৃৎশিল্প, চালচিত্রের চিত্রকলা, লালন ফকির প্রভৃতি নানা বিচিত্র বিষয়ে তাঁর প্রণিধানযোগ্য বই আছে। তিনি ১৯৯৩ সালে পেয়েছেন শিরোমণি পুরস্কার, ১৯৯৫ সালে পেয়েছেন দীনেশ চন্দ্র্র সেন পুরস্কার, ১৯৯৬ সালে পেয়েছেন নরসিংহদাস পুরস্কার, ২০০২ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পেয়েছেন সরোজিনী বসু স্বর্ণপদক এবং ২০০৭ সালে পেয়েছেন বিশিষ্ট অধ্যাপক খেতাব। ‘বাউল ফকির কথা’ বইয়ের জন্য ২০০২ সালে পেয়েছেন আনন্দ পুরস্কার এবং ২০০৪ সালে পেয়েছেন সর্বভারতীয় সাহিত্য অকাদেমী সন্মান। সাক্ষাৎকারটি তারা মিউজিক চ্যানেল এর সাপ্তাহিক মিউজিক স্পেশাল ‘আমার রবীন্দ্রনাথ’ অনুষ্ঠানে নিয়েছেন সাংবাদিক ও লেখক রঞ্জন মুখোপাধ্যায়। এই পর্বে রবীন্দ্রনাথ কে নিয়ে এক নতুন আলো দেখিয়েছেন সুধীর চক্রবর্তী। আর সেই আলাপচারিতার অনুলিখন করেছেন অজিত দাশ।]

আপনার ‘রবীন্দ্রনাথ অনেকান্ত’ বইটি খুব বিখ্যাত। আমি একাধিকবার বইটি পড়েছি। বইটিতে আপনি একেবারেই একটি আলাদা মন্তব্য করেছেনঃ ‘রবীন্দ্রনাথ একই সাথে বাঙলা গানের সর্বনাশ এবং সর্বস্ব’ এরকম মন্তব্য পূর্বে কারো মুখে কখনো শুনিনি এবং কারো লেখায় পড়িনি। এটা একান্তভাবে আপনার নিজস্ব অনুভূতি থেকে লিখা। বাঙলা গানের সর্বনাশ যখন আমি পড়লাম একেবারেই চমকে উঠেছিলাম। একটা ধাক্কা খেয়েছিলাম। তারপর অবশ্য আপনি চমৎকার একটি ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। 

কথাটা রবীন্দ্রনাথের শতবর্ষের পরে পরেই আমি প্রথম লিখি। রবীন্দ্রনাথের উপর আমার প্রথম যে বইটি বের হয় সেটির নাম ‘গানের লীলার সেই কিনারে’। বইটি এখন আর কোথাও পাওয়া যায়না, তবে সামনে নতুন একটি সংস্করণ বের হবে।  সেই বইটিতেই এই কথাটা আছে রবীন্দ্রনাথ বাঙলা গানের সর্বনাশ এবং সর্বস্ব। সর্বনাশ এই অর্থে রবীন্দ্রনাথেরপর এতটা পরিব্যাপ্তি নিয়ে আমরা আর গান লিখতে পারিনি। রবীন্দ্রনাথের সমকালেও পরিব্যাপ্ত গীতিকার ছিলেন।

আমি একটু বোঝানোর চেষ্টা করি। রবীন্দ্রনাথের জন্ম হলো ১৮৬১ সালে। দুবছর পরেই দ্বিজেন্দ্রলাল এর জন্ম। ১৮৬৫ সালে রজনীকান্ত। ১৮৭১সালে অতুল প্রসাদ সেন। ১৮৯৭ সালে দিলীপ কুমার রায়। ১৮৯৯ সালে কাজী নজরুল ইসলাম। এটাকে বাঙলা গান রচনার বৃত্ত হিশেবে ধরে নিলে এবং গোল করে যদি একটা নেকলেস কল্পনা করা হয় তাহলে সেই নেকলেসের মূল যে নীলকান্তমণি সেটাই হলো রবীন্দ্রনাথ। আর চারপাশে অন্যান্য গীতিকারদের জন্যই তাঁর শোভাটা বেড়েছে। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, অতুল প্রসাদ সেন, রজনী কান্ত সেন এঁদেরকে ধরে যদি রবীন্দ্রনাথকে ধরা হয় তাহলে বোঝা যায় তিনি কোন নীলকান্তমণি হলেন আমাদের কাছে। রবীন্দ্রনাথ বাঙলা গানে যে ফর্ম এনেছিলেন তা পূর্বে বাঙলা গানে কখনো ছিল না। গানের কথা এবং সুরের সাযুজ্যের বিষয়টাও রবীন্দ্রনাথ তুলছিলেন প্রথম। গানের রূপায়নের ক্ষেত্রে তান বর্জিত যে ব্যাপারটা তিনিই  সৃষ্টি করেছেন ফলে বাঙলা গানের অবস্থানটা যেখানে পৌঁছালো তার সঙ্গে নিয়ে এলেন সঞ্চারীর অসামান্য ব্যবহার। কিন্তু বাঙলা গানের যে প্যাটার্ন তাতে স্থায়ীর পর অন্তরা তারপর আভোগ। সেই রামপ্রসাদই বলি, বাউলই বলি সর্বত্র একই।  রবীন্দ্রনাথ অন্তরার পর আভোগ এই দুটোর মাঝখানে সঞ্চারী এনে এই দুইটার মধ্যে একটা ভেরিয়েশন তৈরি করলেন। হারমোনিয়াম বাজিালে দেখা যায় অন্তরা , আভোগ তো একই কিন্তু এর মধ্যে কোথাও একটা তফাৎ রয়ে যায়। এটা দ্বিজেন্দ্রনাথ কিংবা অতুল প্রসাদের গানে সে অর্থে নেই। তিনি যে গানের ভাবটাকে পাল্টাচ্ছেন তা কিন্তু নয়। গানের যে ধারা স্থায়ী দিয়ে শুরু  করলেন অন্তরায় এসে যে ভাবটা দাঁড়ালো তারপর সঞ্চারীতে এসে তা অন্যদিকে চলে গেল। এই যে ধারা তৈরি করে দিলেন রবীন্দ্রনাথ পরবর্তীকালে দেখা যায় আধুনিক বাঙলা গান কিন্তু এই ফর্মটাকেই ধরে রেখেছে। রবীন্দ্রনাথেরপর আমরা সেরকম করে আর বাঙলা গান লিখতে পারিনি। আর এটাই হচ্ছে বাঙলা গানের সর্বনাশ। এখনো কোথাও কোনো অনুষ্ঠানে গিয়ে দেখা যায় শুরুতেই রবীন্দ্রনাথের গান দিয়ে অনুষ্ঠান  শুরু  হয়। হেমন্ত মুখপাধ্যায়কেও দেখেছি গান গাইবেন আধুনিক কিন্তু কোথাও একটা রবীন্দ্রনাথের গান দিয়ে শুরু করেন। এটাই হল সর্বনাশ। তিনি এমন ভাবে সামনে দাঁড়িয়ে আছেন যে তাঁকে উলঙ্ঘন করা যায় না। রবীন্দ্রনাথের সময়কালে তাঁর সামনে বঙ্কিম এর উপন্যাসের একটা মডেল ছিলো, গদ্যের একটা মডেল ছিলো বিদ্যাসাগর, অক্ষয় দত্ত, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। নাটকেরো একটা মডেল ছিলো। গানের কোনো মডেল ছিল না। সেই জন্য তিনি বলেছিলেন, ‘প্রাণহীন এদেশেতে গানহীন যেথা চারিধার’। 

এই যে রবীন্দ্রনাথের গানের এই ধারা, এটাতো একটা টেকনিক্যাল সাইটের কথা আপনি বলেছেন। এটা সত্যি সত্যি ভাববার। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের গান আপনাকে ব্যক্তিগত ভাবে কি দিয়েছে?

আমার রবীন্দ্রনাথ হচ্ছে সেই সার্বিক রবীন্দ্রনাথ যিনি চারদিক থেকে গানকে দেখেছেন। আমাদের জীবনের সুখে, দুঃখে, সান্ত¡নায়, আনন্দ, উৎসবে, আমাদের ব্যাক্তিগত শোকে।

আপনার ব্যক্তিগত শোকে, নিঃসঙ্গতায়, আনন্দে রবীন্দ্রনাথ কিভাবে এসেছে?

আমিতো রবীন্দ্রনাথের গান গাইতে পারতাম। এখন আর পারিনা। গানের অভিজ্ঞতা দুরকম হয়। যারা শুনছেন তাদের একরকম হচ্ছে। যারা পড়ছেন তাদের আরেক রকম হচ্ছে। কিন্তু যে গাইছে সে কিন্তু গান গাওয়ার মধ্য দিয়ে গানের আরেকটা জন্ম দেখতে পায়। যে গানটা আমি বার বার শুনেছি, পড়েছি, শিখেছি সেই গানটা গাইতে গিয়ে একেকটা বয়সে একেকটা স্তর ধরা পড়ে । আমার বন্ধু নিত্যপ্রিয় ঘোষ একটা বই করেছেন পঁচিশটি রবীন্দ্র্রসংগীত । তাতে অনেকেই পঁচিশটি বেছে দিয়েছে।  আমিও পঁচিশটি বেছে দিয়েছি। আর কেন পঁচিশটি বেছে দিয়েছি সেটাও সেই বইয়ে বুঝিয়ে দিয়েছি। আর যে গানগুলি বেছে দিয়েছি সেগুলি বেশিরভাগই গায়নের অভিজ্ঞতা থেকেই বুঝিয়ে দিয়েছি। রবীন্দ্রনাথের গানকে দুতিন ভাবে পাওয়া যায়। এটা কিন্তু সবার গানে পাওয়া যায় না। এই গানগুলি যখন শিখেছি তখন একটা শব্দ এদিক ওদিক হওয়ার কোনো কারণ নেই। আবু সয়ীদ আইয়ুবের সঙ্গে আমার একটা সময় কিছু কথাবার্তা হয়েছিলো। তিনি একটা চরম কথা বলেছিলেন, ‘রবীন্দ্রনাথের গানতো বাণী প্রধান তাই আমাকে যদি কেউ তাঁর যন্ত্রে রবীন্দ্রনাথের গান বাজিয়ে শোনায় আমি চিনতে পারব না’। তিনি যেটা বুঝাতে চেয়েছিলেন সেটা হলো রবীন্দ্রনাথের সমকালীন অন্যান্য গীতিকারের গান কিন্তু পড়া যায় না। কিন্তু কবিতা হিশেবে রবীন্দ্রনাথের গান পড়া যায়।

আপনি যখন রবীন্দ্রনাথের গান পড়েন এবং গান করেন দুভাবেই কি আলাদা করে রবীন্দ্রাথকে পান? নাকি দুটোর অভিজ্ঞতা একইরকম?

এখন বেশিরভাগ রবীন্দ্রনাথের গান পড়ি। যদিও গানের সুরটা জানা থাকে। পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভিতরটাও গাইতে থাকে। আর নির্বাচনটা সেদিক থেকে হয়। সুর দিয়ে গানের বাণী ঠিক চলে আসে। একটা মজার ঘটনা বলি। অমিয়নাথ সান্যাল বলে একজন বিশিষ্ট সংগীততাত্ত্বিক আমাদের কৃষ্ণনগর থাকতেন। বয়স্ক মানুষ। এম. বি. বি. এস. পড়েছেন তখনকার দিনে। কিন্তু হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা করতেন। তিনি  বলতেন আমি তো চিকিৎসা করবো হোমিওপ্যাথি তাই এম বি বিএস পড়ে স্বাস্থ্যটা শিখে নিয়েছি। রবীন্দ্রনাথেরগানের প্রসঙ্গে একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম রবীন্দ্রনাথেরগানে বাণী ও সুর সমান সমান বিষয়টা একটু আমাকে বুঝিয়ে দিবেন? তিনি  আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ভাল কাপ ডিশ সেটের চা খেয়েছন?’ আমি বললাম ‘হ্যা খেয়েছি। কারণ আমরা তো পরাধীন ভারতের লোক। আমাদের বাড়িতে কাপ ডিশ সেট ছিলো’। সেই মুহুর্তে তিনি একটি কাপে চা খেয়েছিলেন সেটায় জল ভর্তি করলেন তারপর ডিশে ফেললেন। ডিশ উপচে পড়ে গেল। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, ‘কি বুঝলেন? এই সেটটা ভাল না উপচে পড়ে গেল’। এবার ভিতর থেকে একটা জাপানি সেট নিয়ে এলেন। ডিশে জল ভর্তি করলেন সমান সমান হলো। এবার বললেন, ‘কথা ও সুরে সমান সমান ব্যাপারটা বুঝেছেন?’ আমি বললাম, ‘হ্যাঁ বুঝেছি’। তারপর তিনি বললেন, ‘এখনো বুঝেননি। এরপরের কথাটা হলো কাপের গায়ে যদি ফুল আঁকা থাকে ডিশের গায়ে হাতি আঁকলে চলবেনা। প্রজাপতি আঁকতে হবে’। একেই বলে বিউটিফিকেশন। গানে বাণী ও সুর সমান সমান এটা শেষ কথা নয়। তার মধ্য দিয়ে নন্দনের একটা বিভা দেখা যাচ্ছে। আমি ব্যক্তিগত ভাবে রবীন্দ্রনাথের গানে এই বিভা বিশেষভাবে পাই।

রবীন্দ্রনাথ বলতে আপনার যে গানগুলির কথা মনে পড়ে এরকম দু-চারটি গানের কথা বলুন?

আমার যে গানটার কথা বেশি মনে পড়ে, আমি একসময় অনর্গল এই গানটা গাইতাম সেটা হলো ‘কেন সারাদিন ধীরে ধীরে বালু নিয়ে খেলো নদী তীরে’। এটা অসামান্য একটা গান। রবীন্দ্রনাথ যেন দূর থেকে একটা সত্তাকে দেখছেন। অর্থাৎ নিজের কাছ থেকে আলাদা হয়ে একটা অন্য সত্তাকে সামনে রেখেই যেন গানটা রচনা করেছেন। আমার নিজের মনে হয় আমিই সেই লোকটা। একটা বিখ্যাত গান আছে, ‘একলা বসে একে একে অন্যমনে পদ্মের দল ভাসাও জলে অকারণে’। যেন একজনকে ভাবছেন যে আপন মনে বসে পদ্মের দল ভাসিয়ে দিচ্ছেন জলে। রবীন্দ্রনাথের এরকম কতগুলি গান আছে যেগুলিতে তিনি নিজ সত্তাকে বাইরে নিয়ে গিয়ে দেখছেন। আর এটা কিন্তু যোগীর লক্ষণ। আমি রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে নিজেকে বাইরে নিয়ে গিয়ে দেখার শিক্ষাটাই পেয়েছি। এখানে ক্ষিতিমোহন সেন এর একটি উক্তির কথা বলব। তিনি অশোকতরু বন্দোপাধ্যায়কে বলেছিলেন, আমি তো রবীন্দ্রনাথকে অনেক ঘনিষ্ঠভাবে দেখেছি। তোমরা তো দেখোনি তাঁকে। তিনি অন্য আর যাই করুন যখন গান লিখতেন তখন মনে হতো নগ্ন রবীন্দ্রনাথ। গান লিখার সময় তিনি কিছুই আর ঢেকে রাখতেন না। ওই সময়ে যেন তার কোনো কান্ডজ্ঞান থাকতো না।    

আপনার দীর্ঘ জীবনে আনন্দ এসেছে, দুঃখ এসেছে, প্রেম এসেছে। যৌবনে একরকম। এখন আরেক রকম। আপনিও পরিবর্তন হচ্ছেন। আপনার সঙ্গে নিশ্চয়ই আপনার রবীন্দ্রনাথও বদলে যাচ্ছে। সেটা কী রকম?

যখন ক্লাশ সেভেন এইটে পড়ি তখন আমার বড়দা আমাকে প্রতিমাসে বাড়িতে এসে রবীন্দ্রনাথের একটি বই দিতেন। বলতেন তুমি এটা যদি মুখস্থ করতে পার তাহলে তোমাকে পরের মাসে আরেকটি এনে দিব। তখনকার ব্যাপার তো মুখস্থ করেই ফেললতাম। পরের মাসে দেখি আমাকে একটা চৈতালি দিলেন, তারপর নৈবদ্য দিলেন, তারপর কথা ও কাহিনী। আমি রবীন্দ্রনাথের মধ্যে ঢুকে পড়ছি। আমার বড়দা আমাকে কৌশলে রবীন্দ্রনাথের মধ্যে ঢুকিয়ে দিচ্ছে। এই যে পড়ে ফেলছি। মুখস্থই হয়ে যাচ্ছে কিন্তু। ফলে ক্লাশ টুয়েলভ-এ যখন আমি রবীন্দ্রনাথ পড়াতাম আমার বই লাগতো না। আর এখন পর্যন্ত শ্যামা, চিত্রাঙ্গদা, শাপমোচন আমি অনর্গল গেয়ে দিতে পারি। তার কারণ হচ্ছে রিহার্সাল থেকে এগুলি ভিতরে ঢুকে গেছে। তখন তো গীতবিতান ছিলো না। পঙ্কজ কুমার মল্লিক রেডিওতে ডিক্টেট করতেন, লিখুন ‘তোমার পতাকা যারে দাও তারে বহিবারে দাও শকতি’। বলেই বলতেন ‘শক্তি’ নয়  ‘শকতি’। এইভাবে গানটাকে ডিক্টেট করতে লেগে যেত দশমিনিট। তারপর প্রথমে একটু করে স্থায়ী, অন্তরা গেয়ে ছেড়ে দিতেন। তারপর দিন শুরু করতেন সঞ্চারী থেকে। গানটাকে কিন্তু তিনি বুঝাতেন। আমরা মফস্বলে থাকি। সেই গানটাকে শুনছি আর বুঝছি। কিন্তু গানকে যে এভাবে গাওয়া যায়, বোঝা যায় এখন সেরকম কোনো ব্যবস্থা নেই। আমাদের সবচেয়ে সুবিধে ছিলো যেটাকে রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলা যায়, ‘অভাবেরই অভাব ঘটেছে’। আমরা অভাবের মধ্যে দিয়েই বড় হয়েছি। এই যে গীতবিতান ছিলো না, স্বরবিতান ছিলো না, আমরা প্রতিটি অক্ষরকে আঁকড়ে ধরে শিখেছি। এই গানগুলি যখন শিখেছি তখন একটা শব্দ এদিক ওদিক হওয়ার কোনো কারণ নেই।

রবীন্দ্রনাথকে সন্ধান, সেটা আপনার কোন বয়স থেকে  শুরু  হলো? এবং কেন  শুরু  হলো? 

আমি যখন ফার্স্ট ইয়ারে  পড়ি তখন স্পেশাল বেঙ্গলি বলে একটি সাবজেক্ট ছিলো। আমি সেই স্পেশাল বেঙ্গলি নিয়েছিলাম। বলতে গেলে সাহিত্যের প্রথম অন্বেষা সেখান থেকে শুরু। স্পেশাল বেঙ্গলিতে ছন্দ পড়তে হতো। ছন্দের প্রচুর উদাহরণ রবীন্দ্রনাথ থেকেই নিতে হত। বলতে পারেন যে একাডেমিকভাবেই রবীন্দ্রনাথ আমার কাছে এসেছে। কিন্তু ওই যে একটা আয়োজন তৈরি হয়ে গেল আর ছোটবেলা থেকে অভ্যেস। সঞ্চয়িতা বইটা অবশ্য বাড়িতেই ছিলো। এই থেকে আস্তে আস্তে রবীন্দ্রনাথ পড়া  শুরু  করে দিলাম। এবং সত্যি কথা যে রবীন্দ্রনাথকে আমি সাহিত্যের চেয়ে গানের ভিতর দিয়েই বেশি পেয়েছি। আমি ওয়েস্টবেঙ্গল স্টেট ইডতনি ভার্সিটিতে পড়াতাম। শ্রীচৈতন্য কলেজে বোর্ড অব স্টাডিজ এর মেম্বার ছিলাম। এই দুই জায়গাতেই রবীন্দ্রসংগীত পাঠ্য করেছি।

শ্রীচৈতন্য কলেজে পঁচিশখানা গান বেছে নিয়ে ছাত্রদেরকে পড়িয়েছি। সুরবিহীন রবীন্দ্রনাথের গান কবিতার মতো করে পড়িয়েছি। এই বিষয়ে আমার একটি লেখাও আছে। এবং এটা আমার জীবনের অন্যতম একটি আদর্শ বলা যায়। আমার যুক্তিটা হলো এই, চর্যাপদ পড়বে, শ্রীকৃষ্ণকীর্তন পড়বে, ময়মনসিংহ গীতিকা পড়বে, শাক্ত পদাবলী পড়বে, বৈষ্ণব পদাবলী পড়বে কিন্তু রবীন্দ্রনাথ পড়বে না। সে কী রকম এম এ পড়া। একটা স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিলে বাঙলায় রবীন্দ্রনাথের গান পড়া হলো না। এটা বলছি এ কারণেই যে, আমরা যখন পঞ্চাশের দশকে কলেজ কিংবা ইউনোভার্সিটিতে পড়তাম রবীন্দ্রনাথ যে গান লিখতেন আর সেই গান দিয়ে যে তাঁকে বোঝা যায় অর্থাৎ গান দিয়ে দ্বার খোলাবো ব্যাপারটা। কোনো অধ্যাপক ক্লাশে কোনোদিন বলেননি যে রবীন্দ্রনাথ গান লিখতেন। আমি একদম শপথ করে বলছি। আমরা অনেক বিখ্যাত অধ্যাপকের কাছে পড়েছি। শশীভূষণ দাশগুপ্ত, প্রমথনাথ বিশী, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, ভবতোষ দত্ত। সেই পঞ্চাশের দশকে। আমি তখন রবীন্দ্রনাথেরগান শুনছি, পড়ছি। তখন আমরা সুচিত্রা, কণিকার একদম যৌবনের গান শুনছি। সেই সময়ে আমার দুঃখ এটাই—ক্লাশে কোনোদিন রবীন্দ্রনাথ গান লিখেছেন এ কথা কেউ কখনো বলেননি। ছবির কথা তো ছেড়েই দিলাম।  আশ্চর্য বিষয় পঞ্চাশের দশকেও রবীন্দ্রনাথ আবিষ্কৃত হননি। ওই একটা জেদ তৈরি হয়েছিলো তখন থেকে। রবীন্দ্রনাথকে নিঃসন্দেহে সম্পূর্ণ আলাদাভাবে একটি প্রতিষ্ঠা দেওয়া যায় তাঁর গানের মধ্য দিয়ে। আমার জীবনে যদি কোনো আদর্শ থাকে তাহলে সেটা হলো রবীন্দ্রনাথের গান সিলেবাসে চলে আসুক, সব স্তরে চলে আসুক। তাহলে মানুষের চেতনায় তো আসবে রবীন্দ্রনাথ একজন গীতিকারও বটে। একটা বিষয় লক্ষ্য করলে দেখা যাবে আমাদের দেশে সাহিত্য পুরষ্কার কোনো গীতিকারকে দেওয়া হয় না। অথচ আমাদের সবচেয়ে বড় গীতিকার আমাদের দেশেই আছেন। এখন পর্যন্ত কোনো সাহিত্য পুরষ্কার কিংবা একাডেমী পুরষ্কার কোনো গীতিকারকে দেওয়া হয়েছে বলে আমি শুনিনি। গানটাকে যদি আমরা এরকম স্তরে নিয়ে যাই তাহলে আমাদের সংগীতপ্রীতি বিষয়টা কী রকম হবে এটা আমার মনে প্রশ্ন জাগে। প্রকৃতই কি আমাদের সংগীত প্রীতি আছে? এই জেদ থেকেই আমি চেষ্টা করেছি। ছোট জায়গা হলেও চেষ্টা করেছি। বছর বছর তারা সিলেবাসে পড়াচ্ছে কিন্তু আমিতো চলে এসেছি। কিন্তু ওখানকার সিলেবাসে তো রবীন্দ্রনাথেরপঁচিশখানা গান নির্বাচিত হয়েছে। বছর বছর পাল্টেও যেতে পারে। অন্যরকম পঁচিশটা অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। নতুন ছেলেমেয়েরা অন্যভাবে পড়বে। অধ্যাপকরা নতুন করে পড়াবে।

আপনার যৌবনে যখন বিয়ে করেননি আপনি রবীন্দ্রনাথের গান করেছেন। এরকম কি কখনো হয়েছে আপনার গান শুনে মুগ্ধ হয়েছে মেয়েরা?

আমি তো প্রথমে বিবেকানন্দ কলেজে পড়াতাম। গান শুনে ছাত্রীরাও মুগ্ধ হতো। দেখা যায় ছুটির পর যে বাসে করে ফিরব কলকাতায় তখন ছাত্ররা দল বেঁধে এসে আমাকে বাসে উঠিয়ে দিত। আর ছাত্রীদের তখন অতটা আত্ম প্রকাশের সুযোগ ছিল না। তারা যে তাদের কথা জানায়নি একথা ঠিক নয়। এবং বলতে বাধা নেই যিনি আমার পত্নী তিনি তো আমার ছাত্রীই ছিলেন। আমার গান শুনে মুগ্ধ হয়েছিলেন। এখন তার মনে খুব খেদ যে আমি আর গান করতে পারি না। তাঁকে প্রচুর গান শুনিয়েছি জীবনে। রবীন্দ্রনাথ নিজেই বলেছেন, ‘ভয় হয় পাছে সুর ভুলি পাছে ছিন্নতার জয় হয়’। তিনি নিজেই তার জীবন সম্পর্কে এরকম আশঙ্কা করেছেন। 

এই যে গান আপনাকে ছেড়ে গেল। আপনি যে এখন আর গাইতে পারেন না। এত ভাল গাইতে পারতেন। তাতে করে রবীন্দ্রনাথকে পাওয়া কি কিছুটা কমে গেল আপনার কাছে।

না সেটা কমে যায়নি। কিন্তু গানটাতো আমি গাইতে পারি। ভিতরে ভিতরে গাই। হয়ত প্রকাশ্যে আর গাই না। কিন্তু গানটা যখন অন্য কেউ গায় তখন আমিও তো গাই। আমাকে ছেড়ে রবীন্দ্রনাথেরগান যায়নি। সুরটা ছেড়ে গেছে। আমি শুনেছি যে কৃষ্ণা চট্রোপাধ্যায় শেষ দুবছর কোনো গানই করতে পারেননি। এরকম হয়। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ আমাকে ছেড়ে গেছেন বলে আমার কোনোদিন মনে হয়নি। এখনো না। আজ সকাল বেলায়ই রবীন্দ্রনাথেরএকটা গান নিয়ে লিখতে লিখতেই আমি চলে এসেছি কলকাতায়।

রবীন্দ্রনাথেরগান নিয়েই কিন্তু আপনি অধিকাংশ সময় ভেবেছেন। রবীন্দ্রনাথেরসাহিত্য কি আপনাকে অতটা স্পর্শ করেনি?

নিশ্চয়ই করেছে। তবে যেটা করেছে সেটা প্রবন্ধ সাহিত্য। আমার জীবনের পক্ষে যেটা দিশারী সেটা হলো রবীন্দ্রনাথের পল্লীগ্রাম এবং লোক সংস্কৃতিকে চিনবার চোখ। রবীন্দ্রনাথের আগে কেউ বুঝতে পারেনি। আমাদের দেশের এই যে লোকায়ত জীবন, অবতলের জীবন তিনিই প্রথম দেখতে পেয়েছেন। নইলে কেন লালন ফকিরের গানের খাতা জোগাড় করে সেটাকে প্রবাসীতে ছাপবেন। কেন তিনি ইন্দিরাদেবী চৌধুরানীকে দিয়ে তার স্বরলিপি করে প্রবাসীতে ছাপবেন।

সেই রবীন্দ্রনাথ আপনার রবীন্দ্রনাথ যিনি পদ্মায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন। যিনি একা থাকছেন। কখনো শিলাইদহে। কখনো সাহজাদপুরে। চাষীদের সঙ্গে মিশছেন।

তাঁর কাছে সার্বক্ষণিক বোষ্টমী এসে বৈষ্ণব তত্ত্ব শিখাচ্ছেন। শিবু সাহার কীর্তন শুনছেন সারারাত ধরে। তিনি রাত জাগতে পারতেন না। বলছেন কাল সারারাত শিবু সাহার কীর্তন শুনলাম। উনার কাছে গগন হরকরার লোক আসছে। লালন ফকিরের লোক আসছে। তিনি তো চিঠিতে লিখেছেন। শান্তিদেব ঘোষের  বাবাকে। কালীমোহন ঘোষকে। ‘তুমিতো দেখেছ লালন ফকিরের শিষ্যরা এলে আমি ঘন্টার পর ঘন্টা কত কথা বলতাম। ওরা খুব গরীব। পোষাকের জিল্লা ছিল না। কিন্তু অন্তর খুব সমৃদ্ধ। এবং তারা যে গভীর কথা বলতো সরল ভাষায় আমিতো কল্পনাও করতে পারিনা’। তিনি ছাত্রদের প্রতি সম্ভাষণে লিখেছেন, ‘গ্রামের চারদিকে যাও। দেখ কোথায় কারা কি করছে। তাদের প্রয়োজনকে ধরার চেষ্টা কর’। আমার রবীন্দ্রনাথ হচ্ছে প্রধানত এই রবীন্দ্রনাথ। 

আমি কি তাহলে একথা বলতে পারি যে, আপনার রবীন্দ্রনাথ অনেকটা ছিন্নপত্রাবলীর রবীন্দ্রনাথ? এবং আপনি কী পান সেই রবীন্দ্রনাথ থেকে? 

ছিন্নপত্রাবলীর রবীন্দ্রনাথ হচ্ছেন একজন আশ্চর্য নিঃসঙ্গ রবীন্দ্রনাথ। সঙ্গে স্ত্রী রয়েছেন। প্রথম পুত্র সন্তানের জন্ম হয়ে গেছে। তাদের নিয়ে বজরায় রয়েছেন। ছিন্নপত্রাবলীতে দেখবেন তিনি সীমাহীন প্রকৃতির দিকে তাকাচ্ছেন। যেটা আগে কোনোদিন দেখতে পাননি। তিনি তো সেই জোড়াসাঁকোর বাড়িতে জানলা খুলে একটুখানি দেখতেন। আর পদ্মায় ঘুরে সেখানে একটি পরিব্যাপ্ত দেখা দেখতে পেয়েছেন। পদ্মার চারপাশে সেই বিশাল প্রকৃতিকে দেখেছেন। সেখানকার জন জীবনকে দেখেছেন। যেখান থেকে ছোট গল্প উঠে এসেছে। অনেক গান উঠে এসেছে। তিনি খুব গানের আসর বসাতেন। এবং চিত্তরঞ্জন দাশের বোন অমলা এসে রবীন্দ্রনাথের কাছে থাকতেন। তিনি রবীন্দ্রনাথের স্ত্রীকে কাকিমা বলে ডাকতেন। দুইজনে এত বন্ধুত্ব। বজরায় বসে গল্প করছেন। রবীন্দ্রনাথ দূর থেকে দুজনকে দেখে একটা গান লিখেছিলেন – ‘ওলো সই ওলো সই আমার ইচ্ছে করে তোদের মত মনের কথা কই’। অমলার সূত্রে সাহানা এসে গেল। চিত্তরঞ্জন দাশের ভাগনী। রবীন্দ্রনাথের জীবনে প্রথম দিক থেকে গানের ধারক কিন্তু তাঁরাই। তখন কোথায় শান্তিনিকেতন। কোথায় জোড়াসাঁকো।

রবীন্দ্রনাথেরগানের বেশিরভাগ সময় কিন্তু দেখেছি ধারক কিন্তু মহিলারা… 

আমরা ছোটবেলা থেকে দেখেছি শান্তিনিকেতনের কালচারকে এফেমিনেট কালচার বলার চেষ্টা করা হতো। কলকাতার লোকেরা এটা বলার চেষ্টা করতেন। এবং আমি একটা কথা সবচেয়ে বেশি বলি রবীন্দ্রনাথের সবচেয়ে বেশি অনুরাগী কিন্তু বাঙলাদেশে ছিলো। তারাই শান্তিনিকেতনে এসেছিলো বেশি। এখানে কোথাও একটা কলকাতার সাথে গোলমাল ছিলো রবীন্দ্র্রনাথের। রবীন্দ্রনাথের গান বেশিরভাগই তখন মহিলারা গেয়েছেন। আর পুরুষ কে ই বা গাইবেন তখন। শান্তিদেবকে ধরেছেন। শৈলজা বাবুকে ধরেছেন। শৈলজা বাবু কেমিস্ট্রি পড়াতে এসেছিলেন শান্তিনিকেতনে। রবীন্দ্রনাথ শৈলজ বাবুকে বললেন তুমি কেমিস্ট্রি রাখো, সংগীত ভবনের অধ্যক্ষ হও। শৈলজা বাবু তখন বললেন, ‘আমার পদবী তাহলে কি হবে’? রবীন্দ্রনাথ বললেন, ‘মিউজিক্যাল কেমিস্ট’ হবে। এই যে শৈলজা বাবুকে দেওয়া। ডতনি  আসলে দিনু বাবুর পরে ঠিক ঠিক লোককে খুঁজছিলেন। কাকে দিয়ে তাঁর গানগুলিকে বাঁচানো যায়। রবীন্দ্রনাথ সুর দিয়ে ভুলে যেতেন দীনু বাবু সেটা ধরে রাখতেন। কোথাও কোথাও অভিযোগ আছে দিনু বাবু রবীন্দ্রনাথেরগানে কোথাও হয়ত সুর জুড়ে দিয়েছেন। দিনু বাবু একটু মোটাসোটা লোক ছিলেন এবং গরমকালে দার্জিলিং যেতে ভালবাসতেন। তার জন্য তাঁকে একটা এলাউয়েন্স দেওয়া হত। একবার বোধহয় রথিবাবু সেটা দেননি। তখন তিনি জোড়াসাঁকো চলে গেলেন অভিমানে। এবং প্রায়ই খোঁজ করতেন রবীন্দ্রনাথ কিছু বলছেন কিনা? দিনু বাবুর মৃত্যুর পর স্বরলিপি নিয়ে অনেক গোলযোগ হয়েছে। দিনু বাবুর স্বরলিপি একরকম আরো কিছু স্বরলিপি আছে সেগুলি আরেকরকম। সুভাষ চৌধুরী আমাকে বলেছিলেন, ‘আমাদের বক্তব্য ছিলো যে দুটো স্বরলিপিই ছাপা হোক’।

এখনো আপনি রবীন্দ্রনাথেরগান নিয়ে লিখছেন। ভাবছেন। আগামী চার পাঁচ বছরের মধ্যে রবীন্দ্র্রনাথকে নিয়ে আর কী কাজ করতে চান?

সেটা একটু বড় কাজ। আর্নল্ড আড্রিয়ান বাকে বলে একজন ডাচ ভদ্রলোক ছিলেন। রবীন্দ্রনাথের জীবিত কালে তিনি শান্তিনিকেতনে এসেছিলেন। দিনুবাবুর কাছে রবীন্দ্রনাথের গান শিখেছিলেন। পরবর্তীতে তিনি রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে একটি বই লিখেছিলনে ‘টুয়েন্টি সিক্স সংস অব টেগোর’। অর্থাৎ তিনি প্রথম ইংরেজীতে রবীন্দ্রনাথেরগান অনুবাদ করেছেন। তার সাথে ফিলিপস টেরন বলে এক ভদ্রলোক গানগুলিকে ফরাসী ভাষায় অনুবাদ করেছিলেন। এটা একটা বই পাওয়া যায়। সেই দুর্লভ বইটি আমার সংগ্রহে আছে। আড্রিয়ান বাকে রবীন্দ্রনাথের সাথে দুয়েকবার বিদেশেও গেছেন। এবং খুব ভাল রবীন্দ্রনাথেরগান গাইতেন। বাঙলাতেও গাইতেন, ইংরেজীতেও গাইতেন। আমার বন্ধু শিশির কুমার দাশ লন্ডনে পড়াতেন। আড্রিয়ান বাকে’র সাথে তাঁর ঘনিষ্ঠতা ছিলো। শিশির আমাকে একবার একটি গল্প বলেছিলো, ‘লন্ডনের রাস্তায় আমরা দুজন বাসের জন্য দাঁড়িয়ে আছি। আকাশে প্রচন্ডবললাম,  মেঘ। বাকে হঠাৎ ‘মেঘের পরে মেঘ করেছে গাইতে লাগলো। আমি ‘সাহেবদের দেশে এ কি তুমি রবীন্দ্রনাথেরগান গাইছো, এরা জীবনে কোনোদিন শুনেছে এসব গান’। 

আপনি অধ্যাপক ছিলেন। আপনার কর্মজীবনে নিশ্চয়ই রবীন্দ্রনাথ জড়িয়ে ছিলেন। কিন্তু  সেই কর্মজীবনের চেয়েও আমি জানতে চাইব আপনার সাংসারিক জীবন, আপনার প্রাত্যহিক জীবন, আপনার নিজস্ব দুঃখ, বেদনা। কোনো জায়গায় আপনি অপমানিত হলেন, কোনো জায়গায় আপনি বাধাগ্রস্ত হলেন, এমন কিছু কেউ বললো,  আপনি আঘাত পেলেন। তখন আপনার জীবনে রবীন্দ্রনাথ এসে কি দাঁড়িয়েছে?

আমার জীবনের ব্যক্তিগত একটা দুঃখ আছে।  আমার  বড় মেয়ে জন্ম প্রতিবন্ধী।  তাকে নিয়ে আমাদের অনেক দুঃখ আছে। রবীন্দ্রনাথেরকাছ থেকে এই সান্ত¡না পাই যে উনার মত সর্বংসহা লোক  প্রায় কেহ নেই। এই একটা লোক যিনি তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের সুঃখ, দুঃখ, বেদনা আড়াল করে রেখেছিলেন। একটা ঘটনা আমি পড়েছিলাম। সেটা হলো একদিন রাতে ডতনি  শান্তিনিকেতনে হঠাৎ ছাদের উপরে দাঁড়িয়ে ‘অন্ধজনে দেহো আলো মৃতজনে দেহো প্রাণ’ গানটি বার বার গাইছেন। যিনি শুনছিলেন তিনি পরদিন সকালে খাবারের সময় জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘গতকাল অনেকক্ষণ ধরে একটা গান গাইছিলেন কেন?’ রবীন্দ্রনাথ বললেন ‘সন্ধ্যাবেলা একটা দুঃসংবাদ শুনলাম। শুনে মনে খুব কষ্ট হতে লাগলো। গানটা বার বার গাওয়ার পর সেটা সরে গেল’। যিনি এই খবরটা দিয়েছেন তিনি ফুটনোটে লিখেছেন সেদিন তিনি তাঁর ছোট মেয়ের বিবাহ বিচ্ছেদ এর খবর পেয়েছিলেন। জীবনে চরম দুঃখের সময়ে গানের মধ্য দিয়ে তাঁর মোক্ষ। আমিতো সেই রবীন্দ্র্রনাথকে চিনি। যে লোকটা আপনার বা অন্য কারো রবীন্দ্রনাথ নয়। শুধু আমার রবীন্দ্রনাথ । কারণ আমার কাছে রবীন্দ্রনাথ সাজিয়ে রাখার কোনো রবীন্দ্রনাথ নয়। তিনি অসুস্থ মেয়ে রেণুকাকে নিয়ে গেছেন আলমোরায় যদি শরীরটা একটু ভাল হয়। যক্ষ্মা রোগ সারে। তাকেই তিনি গান করে শুনাচ্ছেন। রেণুকা বলছে, ‘বাবা পিতা নোহসি বল’। যখন রেণুকাকে নামানো হচ্ছে পার্বত্যভূমি থেকে সঙ্গে সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ নেমে আসছেন হেঁটে। তাঁর কাছ থেকে আমি যে সান্ত¡না পাই আর ভাবি যে এই রবীন্দ্রনাথ তো আমার রবীন্দ্রনাথ। সব রকমের দুঃখ, কষ্ট তিনি পেয়েছেন। আমিও তো একটা বৃহৎ পরিবারের সন্তান। এখনো দাদা রয়েছেন বেঁচে এবং অনিবার্যভাবে তাদের মৃত্যু যদি আমাকে দেখতে হয়, তখন রবীন্দ্রনাথেরভাষায়ই বলি, ‘দীর্ঘ আয়ু দীর্ঘ অভিশাপ’।  সুভাষ মুখপাধ্যায় কবিতা লিখেছেন, ‘উঠেছে নতুন এক হাওয়া পরে এসে আগে চলে যাওয়া’। এই যে আমার প্রিয় এক লেখক ছিলেন সমীর সেনগুপ্ত তিনি হঠাৎ ছেড়ে চলে গেলেন। আমাকে তাঁর শোকসভায় গিয়ে কথা বলতে হলো। এটা তো কথা ছিলো না। তাঁকে নিয়ে আমার অনেক পরিকল্পনা ছিলো। তাঁর কথা আমি বিভিন্ন জায়গায় লিখেছি। তাঁকে নিয়ে আমার একটা পরিকল্পনাও ছিলো। আমি বলি কোনো মানুষের মৃত্যু মানে দেহের নয়, মেধার মৃত্যু। রবীন্দ্রনাথেরমতো দুঃখ তো আমরা কেহ পাইনি। এতটা অপমান তো কেউ আমাদের করেনি। তিনি তাঁর মেয়ের জামাইদের কাছে নিদারণ অপমানিত হয়েছেন। ১৯১৩ সালে একটা লোক কতটা উচ্চতায় পৌঁছে গেছেন আর সেই লোকটাকে কতজন কামড়াচ্ছে নেপথ্যে। কথাগুলি তাঁর কানে যেত। শুনতেন তো সবই।  আমার মনে হয় জোব্বা পড়ে যতই ঘুরুন আর যাই করুন, যতই ‘আমার মুক্তি আলোয় আলোয়’ বলে হাঁটুন রাস্তা দিয়ে ভিতরে যে ভয়ানক সন্তাপ, গানের মধ্যে খুব আছে। আমি এখন সেই গানগুলি খুঁজছি। এবং ভাবছি এখান থেকে রবীন্দ্রনাথকে ভেবে দেখা যায় কিনা। যেমন এরকম একটা গান ‘আমার যেদিন ভেসে গেছে চোখের জলে’।  মাঝখানে গীতবিতানে আলো বিষয়ক গানগুলি খুঁজেছি। ‘জগতে আনন্দ্রযজ্ঞে আমার নিমন্ত্রণ / ধন্য হল ধন্য হল মানবজীবন’। আর কারো নিমন্ত্রণ নেই শুধু তাঁর নিমন্ত্রণ হলো হঠাৎ করে। অলক্ষিত একটা নিমন্ত্রণ তাঁর কাছে কোথা থেকে এলো। আর কারো কাছে তো আসেনি। ‘আহবান আসিলো মহোৎসবে / অম্বরে গম্ভীর ভেরীরবে ’। এই আহবান এলো কোথা থেকে? সত্যিকার অর্থে এরকম দেখার চোখ, এতটা অনুভব আমি কোনো গীতিকার এর মধ্যে দেখিনি। পশ্চিমবঙ্গ সরকার গতবছর রবীন্দ্র্ররচনাবলীর একটা সংস্করণ বের করেছিলো। তাতে রবীন্দ্রনাথের গানগুলি একটা কালনুক্রম অনুসারে সাজানো হয়েছিলো। আমি একজন সংগীত জিজ্ঞাসু হিশেবে বলছি, লালন ফকিরের গান যদি পড়ি তাহলে কোনটা কোন বয়সে লিখা বোঝা যায় না। রামপ্রসাদের গান যদি পড়ি তাহলে সাধনার কোন স্তরে কোন গান লিখা বোঝা যায় না। এবং আমাদের সময়কার লোক কাজী নজরুল ইসলামের গানের কোনো কালানুক্রম নেই। একটা গান শুনলেন। খুব ভাল লাগলো। কিন্তু কোন সময়ে লিখা, কোন বয়সে লিখা এটা বোঝার উপায় নেই। রবীন্দ্রনাথেরগানের ক্ষেত্রে আমার সবচেয়ে বড় আবিষ্কার হচ্ছে এটাই। আমি যখন কোনো গান শুনি সঙ্গে সঙ্গে বইটা ওল্টে দেখি। এবং আশ্চর্য বিষয় যে, তিন দিন ধরে একই রকম গান ভিন্নভাবে লিখেছেন। আবার গীতবিতানে কিন্তু এই কালটাকে তিনি মুছে দিয়েছেন। চীন সমুদ্রের মধ্যে একটা ঘটনা আছে। হঠাৎ করেই রাতেরবেলা খুব ঝড়  শুরু  হয়েছিলো। ক্যাপ্টেন সহ জাহাজের সবাই যখন খুব আতংকিত। ডতনি  তখন গান করছেন দাঁড়িয়ে ‘শ্রাবণের ধারার মত পড়ুক ঝরে পড়ুক ঝরে’ তারপর গাইলেন ‘বীণা বাজাও’, তারপরে ‘পূর্ণ আনন্দ্র’ কিন্তু যখন দেখলেন ঝড় থামছেনা তখন রচনা করলেন ‘ভুবনজোড়া আসনখানি হৃদয়মাঝে’। উত্তাল সমুদ্রের মাঝখানে দাঁড়িয়ে যেখানে জাহাজের সমস্ত লোক আশংকিত তখন তিনি ভুবনজোড়া আসনখানি কোথা থকে দেখলেন? একটা পরিব্যাপ্ত শান্ত সমতার আসন দেখলেন কী ভাবে। কাজেই খুব বড় প্রস্তুতি যাঁর নেই তাঁর পক্ষে এরকম রচনা সম্ভব নয়।

যদি সত্যি রবীন্দ্রনাথ আপনার সামনে আসে তাহলে আপনি কি জানতে চাইবেন তাঁর কাছে?

একটা কথা জানতে চাইব তিনি কী রকম করে গানগুলিতে সুরগুলি দিতেন। কারণ আমরা গানে সুর দেওয়ার যে কৌশলগুলি দেখি, গানের বাণী লেখা হলো, তারপর হারমোনিয়ামে একটা কোনো রাগ রাগিনী ঠিক করে তার একটা নিজস্ব ধাঁচে ফেলা। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের গান এরকম করে আরম্ভ হচ্ছে না। দ্বিজেন্দ্রলাল রায় বলেছিলেন, আপনি যে কী রাগ রাগিনী দিয়ে কী রকম করে সুর দেন তাহা আমি বুঝিতে পারি না’। এটা আমরাও বুঝতে পারিনা। রবীন্দ্রনাথের সমকালের গীতিকারাও বুঝতে পারেননি। এবং তিনি  যে বলতেন আমি রাগরাগিণীর অতীত একটা কিছু করতে চেয়েছি। সিদ্ধ রাগ এবং শুদ্ধ স্বরের বাইরে তিনি নতুন স্বরগাম তৈরি করেছেন। এটা খুব আশ্চর্য। আমার মনে হয় রবীন্দ্রনাথের প্রতিটি গানকে যদি আমরা মিউজিক্যাল এনালাইসিস এর মধ্যে ফেলি যেমন ‘আলোর অমল কমলখানি কে ফোটালে’। খুবই অকিঞ্চিৎকর কথা। রবীন্দ্রনাথ কিন্তু আলো শব্দটা এমনভাবে উচ্চারণ করতেন উচ্চারণের মধ্য দিয়ে আলোর ব্যাপ্তিটাকে ফুটিয়ে তুলতেন। আমার খুব দুঃখ রবীন্দ্রনাথের জীবিতকালে যাঁরা তাঁর চারপাশে গান বাজনা খুব ভালবাসতেন তাঁরা কেউ জানতে চাইলেন না তিনি কী ভাবে গানগুলিতে সুর দিতেন। এমন ঘটনা আছে বাথরুমে গাইতে গাইতে তাঁর গানের সুর এসেছে তিনি চাকরকে বলছেন শীঘ্রই দিনুকে ডাকো। দিনু বাথরুমের বাইরে দাঁড়িয়ে সুর তোলে নিচ্ছেন আর রবীন্দ্রনাথ ভিতরে গেয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু দিনুবাবু তো একবার জানতে চাইলেন না ‘আপনি কী রকম করে এরকম সুর দিচ্ছেন’। কিছু কিছু লোক নিন্দ্রার্থে বলে ফেলে যে দিনুবাবু নিজেও কোথাও কোথাও রবীন্দ্রনাথেরগানে সুর জুড়ে দিয়েছেন। দিলে দিনুবাবুর গানও আমাদের কাছে থাকতো। তাতে বোঝা যায় দিনু বাবুর সাধ্য কী সেই গানে সুর দেওয়ার। এবং এটা খুব স্বাভাবিক ব্যাপার একটু মোচড় যে দেননি তা নয়। তা হতেই পারে। রবীন্দ্রনাথ কোনো গানের স্বরলিপি করেননি। একটা গানের স্বরলিপিই করেছেন ‘এ কি সত্য সকলি সত্য’। রবীন্দ্রনাথ আসলে যেভাবে সুর দিতেন তাতে তাঁর গানের কোনো স্বরলিপি হয় না। আমরাতো পরম্পরাভাবে শিখেছি। একটা গানের রেন্ডারিং দেখে বুঝতে পারা যে অমিয়া ঠাকুর কী রকম করে গাইলেন, ঋতু কী রকম করে গাইলেন এবং কণিকা কী রকম করে গাইলেন। শিখবারতো এইটাই।

একটা গান কি আপনি ব্যাখ্যা করবেন আমাদের কাছে। যে এই গান আপনাকে কী দিয়েছে? বা কোনো সময়ে এ গানটা কী ভাবে এসেছে?

আমার সবচেয়ে একটা প্রিয় গান কেউ যদি আমার কাছে বলে, কী গান গাইব বলুন তো ? আমি প্রত্যেককে একটি গান গাইতে বলবো ‘এইত ভাল লেগেছিলো আলোর নাচন পাতায় পাতায়’। এই গানটার মধ্যে রবীন্দ্রনাথের একটা ক্যাজুয়াল চিন্তা ভাবনা আছে। গানটার উৎস হলো ক্ষিতিমোহন সেনের মেয়ে অমিতা সেন যিনি কিনা অমর্ত্য সেনের মা। তিনি তখন বালিকা। শান্তিনিকেতনে ধুলোয় বসে একটা কৌটোর মধ্যে ধুলু নিয়ে খেলা করছে। গানটার মধ্যে সে বিবরণটাও আছে। হঠাৎ করে জীবনের আশ্চর্য আনন্দ্র তিনি সেই দৃশ্যের মধ্যে দেখলেন। সেই বালক কিংবা বালিকাটিকে তো আমাদের মধ্যে আর পাব না। ‘আলোর নাচন পাতায় পাতায়’ এই দেখবার চোখটাই তো আমাদের তৈরি হলো না। এবং লক্ষ্য করবেন ওই গানটিতে কিন্তু স্থায়ী অন্তরা সঞ্চারী নেই। যেমন কৃষ্ণকলি গানটি কিন্তু কবিতা ছিলো । কাজেই ফর্মটা আগে তৈরি হয়ে গিয়েছিলো। ‘নীল নব ঘনে আষাঢ় গগণে’ আগে কবিতা ছিলো পরে সুর দিয়েছেন। কিন্তু এই গানের মধ্যে দেখবেন গল্পের মত এগিয়ে যাচ্ছে গানটা। বিবরণটা পর পর এগিয়ে যাচ্ছে। এই গানটা রবীন্দ্রনাথের অনেক পরিণত বয়সের গান। আরেকটা গানের কথা বলি ‘এসেছিলে তবু আস নাই জানায়ে গেলে’। সত্তর বছর বয়সে লিখেছেন। সত্তর বছর বয়স না হলে এই গান লিখা যায়না। কেননা ‘তখনো পাতায় পাতায় বিন্দ্রু বিন্দ্রু ঝরে জল’। এই বিন্দু বিন্দু শব্দটি সুর দেওয়া এটা যৌবনের বয়সে হবে না। আমি রবীন্দ্রনাথের গানকে এখন যেভাবে অবলোকন করি বা পর্যবেক্ষণ করি সেটা হলো পূর্ণ মানুষের দেখা গান, দেখা জগৎ। রবীন্দ্রনাথের শেষ বয়সের গানগুলিকে আলাদা করে লক্ষ্ করলে দেখা যায় গানে সুরের মটিভেশনের মধ্যে সাংঘাতিক ম্যাচিউরিটি। আমি অনেক সময় বুঝিয়ে দেই ক্যারাম খেলেছেন তো একটা সময় দেখা যায় সবগুলি গুটি ঠিক ঠিক চলে যাচ্ছে। একেবারে কঠিন এঙ্গেল গুলি ঠিক ঠিক হয়ে যাচ্ছে। ক্রিকেট খেলাতেও দেখা যায় পর পর চার মেরেই যাচ্ছে এবং নিখুঁতভাবে মারছে। সেরকম ম্যাচিউরিটি তৈরি হয় যখন মানুষ একটা পর্যায়ে এসে পৌঁছায়। তখন যেটা ধরে সেটাই হয়ে যায় ।  শৈলজা বাবুর ‘যাত্রা পথের আনন্দ্রগান’ পড়লে দেখা যায় পর পর ষোলখানা গান লিখেছেন ষোল দিনে। প্রতিদিন রবীন্দ্রনাথ বলতেন ‘আমাকে তোমরা একটু ছুটি দাওনা, আমাকে তোমরা বড় বিরক্ত কর’ এই কথা বলেই একটা গান লিখে ফেললেন। এই যে ভিতরে এত দ্রুতি। এটা ম্যাচিউরিটির ফলেই হয়েছে।

আমার রবীন্দ্রনাথ এই কথাটা আপনাকে কী বলে?

আমার রবীন্দ্রনাথ আমাকে বলে যে দীর্ঘজীবন হলো আশীর্বাদ।  যদিও আগে বলেছি রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘দীর্ঘ আয়ু দীর্ঘ অভিশাপ’ আমি বলব তা না। দীর্ঘ জীবনকে আশীর্বাদ স্বরূপ নিয়ে যেন প্রতিটা  দিন এবং প্রতিটা ক্ষণকে ফলবান মনে করতে পারি। এবং নিজের কাজের মধ্য দিয়েই যেন  প্রতিদিনকে আমরা সৃষ্টির কাজে নিয়োজিত করতে পারি। আপনি আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন ‘এত লিখলেন কী করে? আমি বলব ‘আমি তো লিখেই বেঁচে আছি’।

 

 

 

 

কৃতজ্ঞতা: কথাবলি

 

 

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত