Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com

প্রত্যাশার বৃত্ত ~ সুধীর চক্রবর্তী

Reading Time: 6 minutes

গানের আধুনিকতা আমরা প্রথম পেয়েছি রবীন্দ্রনাথের গানে। ‘ঘাটে বসে আছি আনমনা যেতেছে বহিয়া সুসময়’ এত সংক্ষিপ্ত প্রগাড় গানের সম্পূর্ণতা, মাত্র এক পংক্তির সীমায় বাঁধা, আমরা কখনও শুনিনি। কিংবা ‘চিরসখা ছেড়ো না’-র মতো মিতবাণীর প্রসারিত দ্যোতনা। এ তো গেল বাক বা বাণীর সংহত আধুনিক উৎসারণ। সেই সঙ্গে সুরও কি নয় আধুনিক? ‘ও যে মানে না মানা’ গানে আঁখি পেরানোর বিনতি যে ‘না না না’ উচ্চারণে, তাতে তিন রকমের স্বর বিন্যাস কি আমরা কখনও বাংলা গানে শুনেছি আগে? শুনিনি, তার কারণ কথার আভা বুঝে সুরের আভাসন, যা খাঁটি কম্পোজারের জাত লক্ষণ, তা রবীন্দ্রনাথ এবং দ্বিজেন্দ্রলালের গানের নির্মানে প্রথম পেয়েছি আমরা। তাঁদের আগে বাংলা গানের প্রবণতা ছিল রাগের ছাঁচে ভাবের ঢালাই করা, তাতে সংগতি থাক কি না-ই থাক। গান বা সুরের কোনো স্থায়ী সংস্কার কি থাকতে পারে আধুনিক মানসতায়? কে বলল মল্লারেই শুধু বাঁধতে হবে বর্ষার গান? মনে নবীন মেঘের সুর লাগলে বর্ষার গানও দ্যুতিময় হয়ে ওঠে রবীন্দ্রনির্মাণে ‘বাহার’-এ, আর বসন্ত যে শুধুই ফোটা ফুলের মেলা নয়, তা যে ঝরাফুলেরও খেলা সেই অন্তর্গূঢ় অভিনব গানের অনুভব রবীন্দ্রনাথকে জানাতে হয় লোকায়ত সুরে।

দ্বিজেন্দ্রলালের ‘ঐ মহাসিন্ধুর ওপার হতে কী সংগীত ভেসে আসে’ শুনে একজন শ্রোতা নাকি দ্বিজেন্দ্রলালকে জিজ্ঞাসা করেছিলেনঃ ‘এটা কোন রাগিণীতে বাঁধা?’ কম্পোজার বলেছিলেন, ‘মহাসিন্ধুর ওপারের রাগিণী’। গানের আধুনিকতা তাই শুধু কথার বিস্ময়কর বিন্যাস বা কবিতার ধর্মকে গানে সংলগ্ন করা নয় বরং তাকে এক সামুহিক কম্পোজিশনে সমঞ্জস করা। সেটা কারা পারেন? যারা একই সঙ্গে গীতিকার-সুরকয়ার-গায়ক। রবীন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রলাল থেকে নজরুল ইসলাম পর্যন্ত সকলেই কম্পোজার। গান তাঁদের সব অর্থে স্বায়ত্ত। গানের বাণী, সুর ও গায়ক তাঁদেরই নিজস্ব উদ্ভাবন। কোনো ভাবেই কোনো পরমুখাপেক্ষিতাই নেই। বড় জোর থাকতে পারে নিজের গানকে প্রাসারণের অভিলাষ, প্রচারের ব্যাপকতায় বহুকন্ঠলগ্ন করার আকাঙ্খা। আরেকটা কথা মনে আসবে। এঁরা কেউ জীবিকা বা উপার্জনের জন্য গান তৈরি করেননি। গান ছিল তাঁদের আত্মআস্বাদন বা আত্মপ্রকাশের একটা সূচিমুখ কিংবা আত্ম-আবরণ ছিন্ন করে বেরিয়ে আসার একটা ভাবময় প্রক্রিয়া। এ ভাবেই চলছিল বাংলা গান। সম্বৃত রুচিমান একদল শ্রোতার পরিপোষণ ও সমাদরে। অন্তরে ঘটছিল লাবণ্যময় মাধুরীক্ষরণ। পটভূমি হঠাৎ পালটে দিল দেশের প্রযুক্তিগত উন্নতি, যন্ত্রায়ন। ১৯৭০ থেকে ১৯৩০ সালের মধ্যে পর পর গ্রামোফোন ডিস্কের প্রবর্তন, বেতার সম্প্রচার ব্যবস্থার সুচনা ও সবাক চলচ্চিত্রের আবির্ভাব একযোগে দাবি করল নতুন নতুন গান, অনেক গান, বিচিত্রস্বভাবী গান। গান হল নন্দনের সঙ্গে বিনোদনেরও সামগ্রী। শ্রোতার চাহিদা বা ভোক্তার রুচি হয়ে উঠল নতুন গানের নিয়ামক শক্তি। গানেরও নির্ধারণ হল পণ্যমূল্য, বিনিময় যোগ্যতা। আত্ম আস্বাদনের জায়গায় আত্ম বিক্রয়ের ও আপোষের একটা ভবিষ্যৎ আশংকা সেদিন থেকে বাংলা গানের অপনয়নের চিহ্ন এঁকে দিল।

এতদিন গান ছিল মানুষের যাপনাগত দৈনন্দিনের সঙ্গী, তার ব্যবহারিক মুল্য ছিল প্রধান। রেকর্ড-রেডিও-সিনেমার প্রয়োজনে সৃষ্ট গান ব্যবহারিক মুল্যের চেয়ে বিনিময় মুল্যে স্বতন্ত্র হয়ে উঠল। লোকে বুঝল এটা একতা নতুন সামগ্রী। এ গানের গীতিকার একজন, সুরকার আরেকজন এবং শিল্পী সম্পূর্ণ অন্য আরেকজন। অর্থনীতি শাস্ত্রে একেই বলে ‘ডিভিশন অফ লেবর’ বা শ্রমবিভাগ। তাতে কাজের ও উৎপাদনের সংখ্যা বাড়ে, ঝকঝকে কৃৎকৌশলের চমক আসে, কিন্তু গানে সেই শ্রমবিভাগ দক্ষতার চিহ্ন রাখলেও গুণগত উৎকর্ষ বোধহয় বাড়ায় না। অজয় ভট্টাচার্যের কথায় কমল দাশগুপ্তের সুর এবং তাতে কানন দেবীর কন্ঠ এই ত্র্যহস্পর্শে গানটা বেশ জমতে পারে, না-ও পারে। না পারলে তাতে কারুর আলাদা দায় নেই। পারলে নতুন কনজ্যুমারদের কাছে গানটা লেগে গেল, প্রচার ও বিপণন বেড়ে গেল, কিন্তু তাতে বাংলা গানের ধারাবাহিকতার কী লাভ হল? এ সব গানে চিরায়ত উপাদান তো তেমন থাকতে পারে না। শ্রোতা বদলায়, রুচির উন্নয়ন-অবনয়ন ঘটে, চাহিদার ধরন পাল্টে যায়, তাই আজকের জনাদরের গান কাল হয়ে যায় লুপ্তপ্রচল। নতুন নতুন শ্রোতার রুচির টানে গানের চেহারা চরিত্র কেবইলই টাল খায়। এটাকেই বলে আধুনিক গান- অন্তত আমাদের দেশে। তাতে গানের আধুনিকতা অনেকটাই নেই, একেবারেই হয়ত ঐতিহ্যছুট কিন্তু আধুনিক মানুষের চাহিদার ওপর ভর করে তার সংখ্যাবৃদ্ধি। এমত চাহিদা থেকে গত এক দশক গীতিকার-সুরকার-শিল্পীর পাশে এসেছেন ‘অ্যারেঞ্জার’ ফলে বাংলা গানে প্রতীচীর পপ গানের শিশুতোষ অনুকরণে এসে গেছে, কবি অমিয় চক্রবর্তী যেমন বলেছেন, ‘চীৎকৃতসংগীতহীনতা’। এক কালের নামী ও গুণী ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য বলেছেন, ‘আগে ছিল গানবাজনা, এখন হয়েছে বাজনাগান’। শুধু বাজনার তান্ডব কেন, গানের কথায় যে অশালীন ইঙ্গিত এবং শব্দচয়নের ন্যাকামি তাও কি প্রশংসনীয়? কিংবা গানের বিষয়? রবীন্দ্রনাথের গানের আধুনিকতা শিরোধার্য না করে বাঙালি গীতিকার কেন যে চাঁদ-ফুল-প্রিয়া-মিলনবাসর ও প্রেমের সমাধির কল্পনায় মশগুল হলেন? সুন্দর প্রার্থিব দ্বন্দ্ব-ছন্দের উত্তাল জীবনস্বপ্ন ছেড়ে কেন যে ‘যদি ডাকো ওপার হতে’ এমন আর্তি জাগে আধুনিক গানে। আমাদের স্পষ্ট প্রত্যক্ষ শ্রমকিণাঙ্ক স্বেদজ জীবনকে কেন যে হাতছানি দিল বকুল বিছানো পথের ছায়াছন্ন রোমান্টিকতা তা নিরূপণ করা কঠিন। এর ফলে ক্রমশ খুব ধীরে ধীরে নিশ্চিত অন্তর্ঘাতে বাঙালির চর্চিত সবরকম কলাবিদ্যার মধ্যে গান হয়ে পড়েছে সবচেয়ে অনাধুনিকতা। বাংলা চলচ্চিত্র পোছেছে আন্তর্জাতিক মানে। বাঙালির ভাস্কর্য, চিত্রকলা, কবিতা, ছোটগল্প, উপন্যাস সবই সময়কে ধারণ করে সমুন্নত। বাংলা নাটক নিত্য নিরীক্ষায় উদ্বেল। লোকায়ত জীবন ও নিম্নবর্গকেও আমরা বুঝতে চাইছি সব স্তরে। কিন্তু বাংলা গানকে নিয়ে আমাদের কোনো প্রত্যাশা বা আবেগ গড়ে ওঠেনি। তার আধুনিকতা আমাদের কাম্য নয়।

বাংলা গানের এত সমৃদ্ধ ঐতিহ্য রয়েছে যে তার প্রতি এই তাচ্ছিল্য ও প্রত্যাশাহীন অনজ্ঞা জাগিয়ে তোলে অভিমান। মননশীল ও সৃজনশীল বাঙালির কাছে এটা কি কম দুঃখের যে, তার গাইবার মতো গান নেই, যাতে ধরা আছে আধুনিক মানসের আনন্দ-বেদনা, প্রত্যাশা-স্বপ্ন, জীবন-জীবিকা। রাবীন্দ্রিক বলয় ভেদ করে আমাদের গল্প কবিতা নাটক চিত্রকলা সবই তো সাবালক হল কিন্তু গানের সাবালকত্ব কই? এখনও তো সভাসমিতি-সমাবর্তন-উদ্বোধন-বনমহোৎসব-জন্মদিন-বিদায় সংবর্ধনায় সেই একমেব রবীন্দ্রগীতির সম্বল। বড়জোর তিন দশক আগেকার গনসংগীতে স্বাদ বদল। আমাদের গান কই, যা আমাদের জীবনযাপনের গায়ে গায়ে লাগে? এই খিন্ন বেদনা, শূণ্যতা ও নির্বোধ পরিব্যপ্তির মধ্যে হঠাৎ শোনা গেল সুমন চট্টোপাধ্যায়ের গান। এক স্পষ্ট ও সংবেদী মেধা যেন ঝলসে উঠল বাংলা গানের অপ্রত্যাশিত প্রান্তরে। তাঁর গাওয়া ‘তোমাকে চাই’ এবং ‘হাল ছেড়ো না বন্ধু’ সত্যিই বড় দ্যোতক দুটি শন্দবন্ধ। ১৯৯২ সালের এপ্রিলে বেরোয় সুমনের প্রথম ক্যাসেট এবং ৯৩-এ তৃতীয়। এত স্বল্প সময়ে বাংলা গানের শ্রোতাদের কাছে, বিশেষত ছাত্র-যুবা-তরুণ-তরুণী ও শিক্ষিত মহলে এতখানি দোলা জাগানো একটা নতুন রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা। হুজুগ ও জনাদরের আবেগে মত্ততা সত্ত্বেও তাঁর গানের এক ধরনের শিল্পগত বিচার ও নিরীক্ষা শুরু হয়েছে সেটা সুলক্ষণ।

তিনখানা ক্যাসেট এবং বাংলার নানা মঞ্চে সুমনের গান গাওয়ার ঘটনা এখন প্রসিদ্ধির পর্যায়ে চলে গেছে। তাঁর গানের সামর্থ্য, কন্ঠসম্পদ ও গায়নের রীতি চমকপ্রদ। ‘সুমনের গান’ এখন একটা বহুলপ্রিয় বাংলা গানের ধরন, যা আমাদের অভিজ্ঞতায় আনকোরা নতুন। তাঁর কথার অন্তর্দীপ্তি, বিষয়ের অভিনবত্ব এবং সুর বিন্যাসের কুশলী দক্ষতা অনেক নৈরাশ্যবাদীকেও ভাবিয়ে তুলেছে। প্রথম ক্যাসেট শুনে অনেকে বুঝি ভেবেছিলেন এ-গান লোকে নেবে তো? সেটা সম্পর্কে সুনিশ্চিত হবার পর আজ নতুন সংশয় জেগেছে এ গান টিকবে কি?

শ্রোতাদের দিক থেকে এই যে দোলাচাল আর আশংকা, তাঁর কারন, সুমনের গান মানুষের মনে লেগেছে। বহুদিন পর যেন একটা আঁকড়ে ধরার জিনিস। সুমনের কনসার্টে অত্যুৎসাহী শ্রোতারা ‘তোমাকে চাই তোমাকে চাই’ সমস্বরে আওয়াজ তোলেন। সত্যিই এই হৃতসর্বস্ব অনিকেত দেশে কতদিন গানের শুশ্রূষা পাইনি আমরা। সুমন ‘হাল ছেড়ো না বন্ধু’ বলে তীব্র আহ্বানে যে শ্রান্ত দিশাহীন যৌবনশক্তিকে জাগাতে চান তাঁরা তাঁকে ভালোবাসে। ‘সুমনদা’ বলে ডাকে। সুমনের কাছে তাঁদের দাবির শেষ নেই। পিচ্ছিল ক্ষণবাদী এই উঞ্ছজীবী সমাজে কিছুই আর তলাচ্ছে না। প্রতারক সঞ্চয় প্রতিষ্ঠানের মতো ‘কনজ্যুমারিজম’ চেহারা বদলায় দ্রুত। সুমনের শ্রোতারা তাই আন্তরিকভাবে চায় বাংলা গানের এই নবধারা যেন টিকে যায়। সুমন যেন আরও গায়। গেয়েই যায়।

ভরসা এই যে, সুমন জেনে শুনে বুঝে আটঘাট বেঁধে বাংলা গানের জগতে নেমেছেন। গান তো তাঁর নতুন কোনো অর্জন নয়। সেই কবে ষোল বছর বয়সেই তিনি গেয়েছিলেন বেতারে। বাইশ-তেইশ বয়সে বেরিয়েছে তাঁর রবীন্দ্রসংগীতের দুটো রেকর্ড। রাগসংগীতে পাকা তালিম ছিল। তবু ইংরাজী সাহিত্যের এই মরমী ছাত্র যাদবপুরের স্নাতক হয়েই গান বাজনার সংস্রব ছেড়ে একেবারে বিদেশে পাড়ি দেন। ১৯৭৫ থেকে ১৯৮৯, চোদ্দ বছর ধরে পশ্চিম জার্মানী, মার্কিনদেশ আবার পশ্চিম জার্মানীতে বেতার সাংবাদিকের জীবিকার নিত্যবৃত্তে সুমন সজাগ রেখেছিলেন চোখ কান মন। ১৯৮৫ সালে গিয়েছিলেন নিকারাগুয়া। সেখানকার বিপ্লব বিষয়ে সুমন বই লেখেন ‘মানব মিত্র’ ছদ্মনামে। মানব মিত্র যেন সুমনের জীবনগত অঙ্গীকার ও অবস্থানের নামান্তর। তাঁর গানে সব রকম মানবতার স্বপক্ষে মিত্রতার স্বপ্ন। রুক্ষ উদাসীন নগর জীবনের মধ্যে বসে-থাকা পাগল, জ্যামজটের মাঝখানে ফুটপাতের একলা কিশোরীর ‘ট-টা’ তাঁর গানে এসে যায়। শহরতলীর একটেরে গাছের তলায় যাযাবর সংসার-পাতা দলিত মানুষের আনন্দ-বেদনা কে জানতো বাংলা গানের বিষয়ীভূত হবে? শিক্ষার নামে তোতাকাহিনী আমরা পরেছি কিন্তু শৈশব-কৈশোরের আলো-ম্লান করে-দেওয়া সবজান্তা সন্তান গড়ে তোলার হালফিল অভিভাবকত্বের মূঢ়তা সুমনের গানে বেদনার মতো রিনরিন করে।

এই সবই সুমনের অর্জন। প্রতীচ্য তাঁর বাঙালিয়ানাকে গ্রাস করেনি। আশিরনখ বাঙালি সুমন দূর বিদেশে বুকে পুষে রেখেছিলেন বাংলা গানের জন্য দারুণ অভিমান। বিদেশি গানের আধুনিকতা তিনি অন্তর দিয়ে বুঝে নিতে পেরেছেন, শুনেছেন প্রতীচ্যের নানাতর কন্ঠসংগীতের ব্যক্তিত্বকে। আয়ত্ত করেছেন বিদেশী যন্ত্রের বাদনরীতি এবং স্বরক্ষেপের কৌশল। শিখেছেন গানকে অর্কেস্ট্রেট করার করণকলা। এর সব কিছুই কিন্তু বাংলা গানের পালাবদলের দুরূহ কর্মের আকর্ষণ ও জেদে।

শেষমেশ বিদেশের পালা চুকিয়ে ১৯৮৯ সালে কলকাতায় সুমনের অনিশ্চিত গানের ভেলা ভাসানো। প্রত্যয় ছিল, সংশয়ও ছিল, কিন্তু প্রয়াসের আন্তরিকতা এবং গানের আধুনিকতা সৃষ্টির একাগ্র আকুতি ছিল। রবীন্দ্রব্যবসার জন্মগত উত্তরাধিকার ভেঙে না খেয়ে সুমন বাংলা গানকে ধরতে চাইলেন বিস্তারে ও সাম্প্রতিকতায়। অলক্ষ্য প্রিয়াকে নিয়ে রোমান্টিক গান বানানোর দেশে তিনি গান লিখলেন স্বস্তি ছায়ার বনস্পতি হয়ে যাওয়া বাবাকে নিয়ে। দশ ফুট বাই দশ ফুট ঘরের বিকল্পহীন যাপনে আবদ্ধ অসহায় মানুষের ত্রস্ত দিনরাত তাঁর গানে গুমরে উঠল। ঘুড়ি ওড়াবার স্বাভাবিক আনন্দ থেকে বঞ্চিত কিশোর-রিক্সাচালকদের দৈনন্দিন শ্রমের নৈমিত্তিক তাঁর গান চুইয়ে আমাদের সভ্য বিবেকে ঘা দেয়। শ্যাম-সামসুল যাতে সাম্প্রদায়িক বিভাজন ভুলে দাঁড়াতে পারে একই মিলন স্বপ্নে তাঁর জন্য অশ্রান্ত সুমন জাগর রাতটহলিয়ার মতো বলেন রাই জাগো রাই জাগো।

কিন্তু শুধু মিথটিক নয়, সুমনের গান বহুদিন পর বাংলা গানে গীতিকার-সুরকার-শিল্পীর অবিভাজিত সত্তার সম্পুর্ণ আত্মপ্রকাশ। নিপুণ তাঁর সুরপ্রয়োগ, অনবদ্য কর্তৃত্বে গিটার-সিনথেসাইজারে তাঁর বলিষ্ঠ সুরেলা গমগমে গলার বিক্ষেপ। গত তিন দশকের নির্বোধ বাংলা গানের স্বরস্বভাবের সৃজনহীন ঊষরতায় সুমন বুদ্ধিদীপ্ত ও প্রাসঙ্গিক মনস্কতায় আভাসিত হয়েছেন। সুমনের গান যে একটা নতুন সামগ্রী, তাঁর গায়ক ও গানের বিষয় যে জনপ্রিয় তার একটা বড় প্রমাণ তাঁর আবিষ্কৃত এই জীবনধর্মী গানের সরণি তরুণতর পদাতিকের পদক্ষেপে ধ্বনিত। গান যারা ভালবাসেন, বাংলা গানের সাম্প্রতিক অবনয়ন যাঁদের উৎকণ্ঠা জাগায়, সুমনের গানকে তাঁরা স্বাগত জানাবেন দ্বিধাহীনভাবে।

বাংলা গানের বহুদিনের একজন রসবেত্তা হিসাবে আমি সুমন চট্টোপাধ্যায়কে অভ্যর্থনা জানাই। বাংলা গানকে তিনি প্রত্যাশার বৃত্তে আনতে পেরেছেন। শ্রোতাদের সঙ্গে গড়ে তুলেছেন সখ্য ও বিতর্কের দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক। সেটা সাস্থ্যকর।

 

 

~ সুধীর চক্রবর্তী (অধ্যাপক, লেখক, গবেষক)

 

 

কৃতজ্ঞতাঃ লাল জীপের ডায়েরী

 

 

 

 

 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>