সুদীপ্ত মাজির কবিতাগুচ্ছ
আজ ২৭ নভেম্বর কবি, অধ্যাপক সুদীপ্ত মাজি’র শুভ জন্মতিথি। ইরাবতী পরিবার তাঁকে জানায় শুভেচ্ছা ও নিরন্তর শুভকামনা।

অন্তরিনপর্ব
ঘুম ভেঙে জেগে ওঠে বিষাদের ঘটনাতন্ময়…
জেগে ওঠে বন্ধ হয়ে পড়ে থাকা বালিঘড়ি, সন্ধ্যার বিষুব
আহ্নিকগতির মাঝে ঘুরে ঘুরে ফিরে আসা তারা
কিন্তু কারো মুখে কোনো রব নেই, সুর নেই, কানে নেই শ্রুতি…
নিজেরই ভেতরে ঘুরে সব পাখি একা, দিশাহারা…
সকলই ঘুমায় আর ঘুম থেকে জেগে উঠে
আধো ঘুমে-জাগরণে দেখে :
জনহীন হয়ে পড়া বান্ধবসমাজে
একা একলা লুব্ধকের নির্বিকল্প সমাজ-পাহারা!

অসমাপ্ত গানের খাতা : ২৮
তোমার সুরশ্রী থেকে জেগে ওঠা আলো
মেঘের আহ্লাদ থেকে ঝরে পড়া সজলের
পাশে জেগে থাকে !
#
— এই দৃশ্য আজীবন প্রতিটি গোধূলিবেলা
মনের মহলে লিখে যায়…
#
আমি সেই আলোটুকু কৃতাঞ্জলিপুটে নিয়ে
একা বসে থাকি…
#
আর কোনও গল্প নেই, গান নেই
প্রবাহিত আয়ুষ্কাল ঘিরে —
#
দৃশ্যটির কিছু দূরে, গুলঞ্চের ঝোপেঝাড়ে
জেগে ওঠে সন্ধের জোনাকি !

আষাঢ়
বহুদিন পরে কিছু অসবর্ণ মেঘ জমে আসক্তিরেখায়
খুব ঝুঁকে, ঘন হয়ে, অসমাপ্ত পড়ে থাকা গানের
পাতায়
ঝোড়ো বাতাসের এক অগ্নিবর্ণ স্বর শোনা যায় —
বৃষ্টির কিছুটা আগে যেমন গুমোট, যেমন
হাওয়ার তোড়ে পাতাপতনের ফলে গাছগুলি
সাময়িক ক্লান্ত, দিশেহারা
সেভাবে দাঁড়াই, মূঢ়, একা একা, নিজেরই
আড়ালে…
চাঁদ ঢেকে যাওয়া মেঘ অতর্কিতে গ্রাস করে শরীরের
শুকনো বালুকণা
বর্ষণের তুমুল এক অতিপ্লাবী ছদ্মবেশ ধরে…
দ্বিরাগমনের রাত্রি পার হয়ে বহুদিন পর
মল্লার বেজেছে উঠে অনিশ্চিত , ভুলে যাওয়া
অন্দরমহলে…
মেঘ নয়, গলা মোম, কেঁপে উঠছে সন্ধ্যার সময়
পরিপার্শ্বে, গানে গানে, সমস্ত শরীর জুড়ে অতর্কিতে
বজ্রপাত হয়!

শাপলা পর্ব -৬
১. চিত্রকল্প
হাওয়া তাকে স্পর্শ করে, কখনও ঝাপট
রৌদ্র দেয় শীতে তাপ, কখনও দহন
জল তাকে আর্দ্র করে, কখনও সলিল-
সমাধির মোক্ষে টানে
কখনও বিবর
কেবল দেখায় তাকে শূন্যপট…
নৌকো-নেই-নদী
ফুটো জাল কাঁধে একা চলেছে ধীবর!
২. চৌর্যবৃত্তি
তোমার দেরাজ থেকে
সাদা পৃষ্ঠা চুরি করে আনি।
অজস্র বকুলফুল ঝরেছিল, পূর্বজন্মে
তুমি, মৃত্তিকার প্রসাধনে নিজেকে সাজিয়েছিলে
আজ মনে পড়ে।
এনামেল করা নখ,তীক্ষ্ণ নখের স্পর্শ, শিহরণ
ভুলে আজ ভাবতে থাকি, ভালবাসা খুব হলে
সেপ্টিকের সম্ভাবনা বেশি।
ভাবতে থাকি রক্ষিতের ভ্যারাইটিজ স্টোরে পাব
বোরোলীন,সুরভিত ক্যালেণ্ডুলা ক্রিম?
পলিত কেশের পাশে,তরুণেরা ইহপৃথিবীতে
নিজ বুকে এপিটাফ লেখে,
শরীরে গজিয়ে ওঠে ঘাস ।
যাত্রাপথে পড়ে এই বধির বিষণ্ণ ভাঙা
প্রভাত-প্রদোষ।
তবু মেঘ, অন্ধকার, কলঙ্কের কালো ভেঙে,
দু’হাতে সরিয়ে
এই চৌর্যমনোবৃত্তি বেঁচে আছে বলে
পতঙ্গের মরণোন্মুখতা নিয়ে পৃথিবীতে
এত গবেষণা!
এই চৌর্যমনোবৃত্তি বেঁচে আছে বলে
আমাদের জলযান আজও এত অলৌকিক
বলে মনে হয়।
৩. সারাংশ
পাঁচটা-দশটা ফুটো পয়সার ঝনঝন আর
অ্যাসপিরিনের রুপো রাঙতায়
ভরে যাওয়া লাল পলাশের দিন
টিউশানি ড্রপ! উদাস-পাগল
পাখি উড়ে গেছে, শূন্য খাঁচাটি
কাঠবেকারের হাল সঙ্গিন
চপ্পলে আঁটা সেফটিপিন আর
কামানো হয়নি দাড়ি -গোঁফ তার
চায়ের দোকানে বেড়ে গেছে ঋণ
‘প্রেম’ বিষয়ক গবেষণা এই
সারসংক্ষেপে, হৃদজীবীগণ
ছায়ায় দাঁড়িয়ে নোট করে নিন!
৪. অপরাহ্ন
শিশুতোষ সচিত্র বইয়ের মতন দিন। আর
রঙে রঙে রাঙানো উষ্ণীষ
আর কত ইচ্ছেপূরণের স্বপ্ন — নন্দনকানন থেকে
নামা ইলশেগুড়ি
আর কত বালুচরি মুগা ও রেশমকাজে
ভরে থাকে স্মৃতি, তন্তুবায়
নির্জন মাকুর দিকে হাত বাড়ায় —- আর
স্থবির রঘুডাকাত
সাহসী ঝোপের মধ্যে ফেলে রাখা রণপা খুঁজে যায়…
৫. সান্তালাবাড়ি
জারুলের কাছে, অমলতাসের কাছে
যেতে গিয়ে চেপে ধরছে ভয়
কেঁপে উঠছে চপ্পল
ভয়ের ওপারে শিস্ দিচ্ছে দেখার রোমাঞ্চ
তোমার মুখ থমকে যাওয়া নদীখাতের মতো…

অসমাপ্ত গানের খাতা : ৪২
গান নয়, পাহাড়ি অর্কিড ।
ঝুঁকে আছে হৃদয়ের নির্জন টিলায়…
মেঘ-কুয়াশার দেশে রহস্য সচরাচর
অফুরান হয়ে থাকে বলে
পাকদণ্ডী বেয়ে বেয়ে উঠে আসা পথিকের
নির্জন ঝোলায়
রক্তকরবীর মতো মাঝেমধ্যে উদ্ভাসিত হয় !
ইচ্ছুক শ্রোতার কানে সেই মূর্চ্ছনার শব্দ
সহজে পৌঁছোয়…
জলতরঙ্গের মধ্যে জেগে ওঠা ভোরবেলা হয়ে
মাথা তোলে রঙিন অর্কিড ।
রঙেরও যে সুর আছে , ঈড়া-পিঙ্গলার মধ্যে
জেগে ওঠা ধ্বনির ভুবনে
সেই সত্য জাগরিত হয়…
অর্কিডের আলো থেকে মাথা তোলে
অজ্ঞাত, অপরিমেয়
গানমাখা নতুন উদ্ভিদ !

অসমাপ্ত গানের খাতা :৪৩
অগমলোকের রাস্তা পিচ নয়, কুয়াশায় ঢাকা…
বার্চ, স্প্রুস, দেবদারু, ফার
অজানা গুল্মের কত বিচিত্র পাতাবাহার —
ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে দেখেছি !
এই রহস্যের রাস্তা পূর্ণিমারাতের
কণিকা বন্দ্যোর মতো, কিন্নরী দাঁড়িয়ে থাকা
রহস্যরোমাঞ্চে ভরা কুহকে জড়ানো
অবিরাম কাছে ডাকে, কাছে টেনে নেয়…
তারপর
সুরের সমগ্র দিয়ে সম্পূর্ণ আত্মসাৎ করে !
সুরে খেয়ে নেওয়া দেহ আজীবন
সমুদ্রের নানা তীরে
ভবা পাগলা হয়ে ঘুরে মরে !

অসমাপ্ত গানের খাতা : ৪৪
গানের তুফান থেমে গেলে
শামিয়ানা জুড়ে সারারাত
অসংখ্য শবদেহ ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকে !
যতক্ষণ না পরবর্তী পূর্ণিমা এসে
নর্তকীর মতো ফের
সুরাপাত্র ভরে ভরে দেয়…
অজ্ঞাত গায়িকা এসে আগামী ভোরের সুর
কানে ঢেলে যায়…
বিষ থেকে বিশল্যকরণী — নির্ধারিত এই রুটে
যতক্ষণ না গন্ধমাদনের দিকে
যাত্রা শুরু করে সেই বাস —
মৃতদেহ আগলে থাকে ঊর্বশীর দল !

