| 20 এপ্রিল 2024
Categories
সময়ের ডায়েরি

রক্তের ভিতর এক বিপন্ন বিস্ময় খেলা করে । সুকন্যা দত্ত

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট
ভিনসেন্ট ভ্যানগগের রঙ তুলির যুগলবন্দী ক্যানভ্যাসে কত গল্পের জন্ম দিয়েছে। রঙ নিয়ে খেলা করতে করতে ও হৃদয়ের বর্ণহীন বিষন্নতায় আত্মহত্যার আগে তিনি লিখে গিয়েছিলেন,
” দুঃখ সব সময়ই টিকে থাকবে”।
আসলে ভিনসেন্ট ভ্যানগগ হোক কিংবা পৃথিবীর নানান বিখ্যাত মানুষ, জীবনের পথ চলতে  চলতে হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে যান ।আলোর পিছনের  গাঢ় ছায়ায় মিশে যান। পৃথিবীতে রয়ে যায় তাদের আলোকোজ্জ্বল সৃষ্টি,  তারা চলে যান তাদের ব্যথা ও বিষন্নতাকে সঙ্গী করে। অ্যাডলফ হিটলারের মতো দাপুটে দেশনেতা ও শত্রুর কাছে আত্মসমর্পনের আগে স্ত্রী ইভাকে নিয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। সাদা কাগজে রেখে যান হৃদয়ের বিষন্নতার ধারাপাত,
” আমি নিজে এবং আমার স্ত্রী পদচ্যুতি ও আত্মসমর্পনের  হীনতা থেকে মুক্তি পেতে মৃত্যুকে বাছাই করলাম”।
মনে পড়ে জীবনানন্দ দাশের সেই কথাগুলো?
“বধূ শুয়েছিলো পাশে-শিশুটি ও ছিলো;
প্রেম ছিলো, আশা ছিলো,জ্যোৎস্নায়,-তবু সে দেখিলো
কোন ভূত? ঘুম কেন ভেঙে গেলো তার?
অথবা হয়নি ঘুম বহুকাল লাশকাটা ঘরে শুয়ে ঘুমায় এবার।”
অথবা,……
“জানি -তবু জানি
নারীর হৃদয় -প্রেম-শিশু-গৃহ-নয় সবখানি;
অর্থ নয়, কীর্তি নয়,স্বচ্ছ্বলতা নয়-
আরো এক বিপন্ন বিস্ময় 
আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতর 
খেলা করে;
আমাদের ক্লান্ত করে
ক্লান্ত – ক্লান্ত করে;
লাশ কাটা ঘরে 
সেই ক্লান্তি নাই;”.
“আট বছর আগের একদিন” কবিতায়  কবি  হয়তো বোঝাতে চেয়েছিলেন ,মানুষের আত্মহত্যার  কারণ বা ইচ্ছা  সে নিজে ও হয়তো  জানে না। তবু ও আজীবন কিছু বিষাদময় অভিজ্ঞতা হয়তো সেই ভূমি কিছুটা রচনা করে। সাধারণ মানুষ ভাবেন, হয়তো অর্থ বা খ্যাতিলাভের তীব্র আকাঙ্খায় মানুষ এই পথ বেছে নয়।  বিষয়টা এতো সহজ নয়। একজন মানুষের পরিচয় শুধুই কি বাহ্যিক?  চিন্তা চেতনা, উপলব্ধির  জন্য কোনো পরিচয়পত্র তৈরি হয় না। শরীর ও আত্মার মধ্যের দূরত্ব মানুষ কে আত্মহননের পথে ঠেলে দেয়। পৃথিবীর  বিখ্যাত কিংবা সাধারণ মানুষের আত্মহত্যা আমাদের মন নাড়িয়ে দেয়। 
 ১৯৬১ সালের ২ রা জুলাই। ইদাহোর সটুথ পাহাড়ের কোলে রোদ ঝলমলে সেই দিনে সকাল  সাতটায় এক ব্যক্তি ঘুম থেকে উঠে  তার নিজের বাড়ীর বিছানা ছেড়ে সোজা চলে গেলেন স্টোর রুমে। সেখানে রাখা ছিলো তার দু নল যুক্ত আগ্নেয়াস্ত্র  যেটা দিয়ে তিনি পায়রা শিকার করতেন। বন্দুক নিয়ে চলে এলেন বাড়ীর সামনের হলঘরে। কপালের মাঝামাঝি নলদুটো তাক করে ট্রিগারে একটা চাপ দিলেন। নিমেষে  গুলি ভেদ করলো তার মস্তিস্ক কে। মৃত্যু হলো তার।
তিনি আর কেউ নন, স্বয়ং আমেরিকার বিখ্যাত লেখক আরনেষ্ট হেমিংওয়ে।
মৃত্যুর আগে  আলমারী থেকে  বের করেন  ওনার  অতি প্রিয় পোশাক এবং যত্নে সেটি  পরিধান করেন।   তার শেষ চিঠিতে তিনি  লিখেছিলেন, পোশাকটি তার “emperor’s robe”.এটি মনে করায় শেক্সপীয়রের ক্লিওপেট্রার মৃত্যু পূর্ববর্তী ঘটনার কথা।
নিজের শরীরে সর্প দংশনের আগে ক্লিওপেট্রার উক্তি ছিলো 
” Give me my robe.Put on my crown ; I have immortal longings in me.”
হেমিংওয়ের এই আত্মহত্যার ঘটনা কে যদি ও তার স্ত্রী মেরী  প্রথমে আকস্মিক দূর্ঘটনা বলে প্রমাণ করতে  চান, পরে অবশ্য তিনি এটিকে আত্মহত্যা বলেই  স্বীকার করেন।এই ঘটনাটি আমেরিকার সমস্ত সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়। পরবর্তীতে  হেমিংওয়ের আত্মহত্যার কারণ অনুসন্ধানে কিছু কিছু দিক অনুমান করা হয়।
১.হয়তো শৈশব থেকেই তিনি হতাশাগ্রস্ত ছিলেন। তার মা  গ্রেসের একটি অভ্যাস ছিলো, তিনি তার ছেলেকে সাদা ফ্রক পড়িয়ে রাখতেন। নানান কায়দায় চুল কাটাতেন মেয়েদের মতো। তাই হেমিংওয়ে কে তার মা “Dutch Dolly ” বলে ডাকতেন কিন্তু লেখক তার তীব্র প্রতিবাদ করতেন।এ কারণে তিনি তার মায়ের প্রতি ছোটো থেকেই বীতশ্রদ্ধ ছিলেন।
২.ব্যক্তিগত জীবনে তার স্ত্রী র অ্যাক্টোপিয়া গর্ভাবস্থার কারণে  হেমিংওয়ে হতাশ হয়ে থাকতেন।
৩.তার বহু সাহিত্যিক বন্ধুর মৃত্যু ও তাকে মানসিকভাবে দূর্বল করে তুলেছিলো ।১৯৩৯ এ ইয়েটস, ফোর্ড ম্যাডক্স ফোর্ড,১৯৪০ এ স্কট ফিৎসগেরাল্ড, ১৯৪১ এ শেরউড অ্যান্ডারসন, জেমস্ জয়েস, ১৯৪৬ এ গারট্রুড স্টেইন ও ম্যাক্স পারকিনস্, ১৯৪৭ এ এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু,  একে একে সকলের  মৃত্যু মিছিল মানসিকভাবে তাকে অবসন্ন করে তুলেছিলো।
৪.হেমিংওয়ের অতিরিক্ত মদ্যপান শারীরিকভাবে তাকে দূর্বল করে তুলেছিলো। হতাশা ও মদ্যপানের ফলে মাথা যন্ত্রনা, ওজনের অতিরিক্ততা ও ডায়েবিটিস ভিতর থেকে ক্ষয় করছিলো।
৫.বংশগত রোগ হেমোক্রোমাটোসিস অর্থাৎ শরীরে আয়রন বিপাকের অভাব জনিত এই রোগ তাকে ভিতর থেকে ধ্বংস করে দিয়েছিলো।
৬. গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, হেমিংওয়ের  পিতা ও আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। তার পরিবারে ওনার বাবা, বোন আরসুলা, ভাই লেইসেসটর সকলে আত্মহত্যা করেছিলেন।
এই সকল কিছুর অবসাদ থেকে তিনি হয়তো এই পথ বেছে নিয়েছিলেন।
২৮ শে মার্চ, ১৯৪১। ইংল্যান্ডের  ৫৯ বছর বয়সী লেখিকা ভার্জিনিয়া উলফ তার শরীরে কোট চাপালেন, পায়ে পড়লেন ওয়েলিংটন বুট এবং অসম্ভব চঞ্চল অবস্থায় তার সাসেক্স এর বাড়ীর দরজা খুলে গৃহ সংলগ্ন নদীর দিকে রওনা দিলেন।তারপর আর তাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। তিন সপ্তাহ পর তার দেহ পাওয়া যায় ইংল্যান্ডের একটি স্থান থেকে।
ভার্জিনিয়া উলফ্ এর স্বামী লিওনার্ড  তাদের বাড়ী থেকে দুটো চিঠি পান, তার মধ্যে একটি ছিলো তার নিজের জন্য।
সেখানে লেখা ছিলো-
” Dearest , I feel certain that i am going mad again.I feel we cannot go through another of those terrible  times.And I shan’t recover this time.I begin to hear voices,and i can’t Concentrate. So i am doing what seems the best thing to do.”
পূর্বে ও তিনি বহুবার আত্মহত্যা করতে চেষ্টা করেছিলেন।দুঃস্বপ্ন দেখতে দেখতে মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। তার বিবাহিত জীবন  সুখের হওয়া সত্ত্বে ও অতীত এর কালো অভিজ্ঞতায় হতাশাগ্রস্ত  হয়ে পড়ছিলেন। ছয় বছর বয়সে তিনি তার নিজের দাদা জর্জ ও জেরাল্ড ডাকওয়ার্থ এর  দ্বারা যৌন নিগৃহীত হন।এ অত্যাচার চলতে থাকে তার ২৩ বছর বয়স পর্যন্ত। সারাজীবন তিনি এই অত্যাচার ভুলতে পারেননি।
১৩ বছর বয়সে প্রথম তার মস্তিস্কে সমস্যা র সূত্রপাত লক্ষ্য করা যায় । এরপর ১৮৯৫ তে মায়ের মৃত্যু, কয়েক বছর পর বোন স্টেলার মৃত্যু ও ১৯০৪ এ পাকস্থলীর ক্যান্সারে পিতার মৃত্যু তাকে তিলে তিলে শেষ করে দেয়।
অবশেষে তিনি বেছে নেন আত্মহত্যার পথ।
চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্যের অধিকারিণী বিখ্যাত হলিউড তারকা মেরিলিন মনরোর শৈশব কেটেছিলো অনাথ আশ্রমে। সেই অনাথ আশ্রমে  আশ্রয়ের বিনিময়ে তার কপালে জুটেছিলো যৌন নিপীড়ন।  বাল্যকালের এই কঠোর অভিজ্ঞতা   আজীবন তিনি ভুলতে পারেননি। রূপোলী পর্দার ঔজ্জ্বল্যের অন্তরালে বিষন্নতা, হতাশা থেকে তিনি কখনই বেরোতে পারেননি। নিজের  বাবাকে  একবার দেখার আকুলতা ও তাকে কুড়ে কুড়ে খেতো। মেরিলিন মনরোর একটি বিখ্যাত উক্তি হলো,
” I Don’t stop when I’m tired.I only stop when I’ m done.”.
অসম্ভব প্রতিভাময়ী অভিনেত্রী, যিনি নিজের যোগ্যতায় হলিউডের জগতে স্থায়ী আসন করেছিলেন,  ৪ ই আগস্ট, ১৯৬২ সালে তার শোবার ঘর থেকে  জ্ঞান শূন্যহীন নিথর পাওয়া যায়। তার বাড়ীর গৃহকর্মী অনেক ডাকাডাকির পর ও সাড়া না পেয়ে ওনার মানসিক চিকিৎসককে খবর দেয়।  চিকিৎসক শোবার ঘরের দরজা ভেঙে দেখেন, বিছানায় মেরিলিন মনরোর দেহটি পড়ে আছে। সে সময় তার এক হাতে ছিলো টেলিফোন অন্য হাতে হতাশা দূর করার জন্য দেওয়া ঘুমের ওষুধ। পুলিশি তদন্তে,  মাত্রাতিরিক্ত ড্রাগ গ্রহণকে মৃত্যুর  কারণ বলা হয়। কার ও মতে এটি দূর্ঘটনা হলে ও অনেকেই এই মৃত্যুকে আত্মহত্যা বলেছেন।
” ইতিহাসের সুন্দরতম আত্মহত্যা” র সাথে জড়িয়ে আছে এভিলিন ম্যাকহেলের নাম। নিউইয়র্কের একটি বইয়ের দোকানে তিনি কাজ করতেন।  ব্যারি রোডসের সাথে বিয়ের একমাস আগেই আকস্মিকভাবে  তিনি আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। ১৯৪৭ সালের ১ লা মে, ভারতবর্ষ যখন স্বাধীনতার প্রায় দোরগোড়ায়, সেদিন এভিলিন নিউইয়র্কের এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং এর ৮৬ তলায় যান। প্রথমে তার পরিধেয় কোট খুলে রেলিঙে ঝুলিয়ে দেন তারপর একটি চিঠি লিখে ৮৬ তলা থেকে ঝাঁপ দেন। তার মৃত্যুর চার মিনিট পর তার নিথর দেহের ছবিটি তোলেন ফটোগ্রাফির এক ছাত্র রবার্ট উইলস। দেহটি পড়েছিলো ৮৬ তলার নীচের জাতিসংঘের একটি লিমুজিনের উপর। ছবিটি টাইম ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হলে  ও তার মৃত্যু যেন অদেখা থাকে তাই ছিলো এভিলিনের শেষ ইচ্ছা। 
পৃথিবীর “গভীরতর অসুখ” এ অকালে পরলোকে চলে গেছেন। কখন ও হান্টার এস. থম্পসন কখন ও রোহিত ভেমুলা। ২০১৯ সালের ভারতের পরিসংখ্যান বলছে, প্রতিদিন গড়ে ৩৮১ জন আত্মহত্যা করে।  এ অসুখ বিলীন করতে  হাতের উপর হাত রাখা দরকার। কবীর সুমনের সেই গানটা মনে আছে তো?
” পাশেই কারোর একখানা হাত ধরো,
কাছেই কাউকে তোমার বন্ধু করো
দূরেও রয়েছে বন্ধু মিষ্টি হেসে,
হয়তো কোথা ও হয়তো অন্য দেশে।।”

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত