| 24 এপ্রিল 2024
Categories
গদ্য নারী সাহিত্য

বিস্মৃতির অতলে সুখলতা রাও

আনুমানিক পঠনকাল: 3 মিনিট

জয়িতা বাগচি

উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, তাঁর কিংবদন্তি পুত্র সুকুমার এবং সুকুমারের সন্তান স্বনামধন্য সত্যজিৎ রায়— এই ত্রিমূর্তিকেই সাধারণ ভাবে বিখ্যাত রায় পরিবারের প্রতিনিধি হিসাবে গণ্য করা হয়। সেটা অসঙ্গত নয় ঠিকই, তবে এঁদের ছায়ায় যে আরও কিছু ঊজ্জ্বল নাম চাপা পড়ে যায় প্রায়শই, সে কথাটাও ভুল নয় বিশেষ। তেমনই একটি নাম সুখলতা রাও। কেন, সে কথা জানতে গেলে একটু পুরনো কথা পাড়তে হবে।

বিংশ শতাব্দীর গোড়ার কথা। ঔপনিবেশিক ভারতে শিল্প এক নতুন মাত্রা ধারণ করে। শিল্পের যে নান্দনিক মূল্য ছাড়াও কোনও বার্তাবহক পরিচয় আছে সেটা উপনিবেশের মনিব ও বান্দা সকলের কাছেই খুব স্পষ্ট হয়ে ধরা দিল। শিল্প হয়ে উঠল রাজনৈতিক মতাদর্শ ব্যক্ত করার মাধ্যম। ১৯০৫-এর বঙ্গভঙ্গ-স্বদেশী আন্দোলনের সময় থেকে বিশেষ করে শিল্প হয়ে উঠল লড়াইয়ের বড় হাতিয়ার।

এর ঠিক আগেই রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় ১৯০১ থেকে চালু হয়েছে ‘প্রবাসী’ ও ১৯০৭-এ ‘Modern Review’ পত্রিকাগুলি। কিছু দিন পরে চালু হল ‘রূপম’। এছাড়া ‘প্রদীপ’, ‘ভারতী’, ‘সাধনা’, শিল্প ও সাহিত্য’ ইত্যাদি সব পত্রিকা জুড়ে শুরু হল ভারতীয় শিল্প কাকে বলে তার বিস্তারিত বাগ-বিতণ্ডা।

তুমুল প্রকাশ্য তর্কে আসলে নামলেন কলকাতার অবিস্তৃত বিদ্বৎসমাজ। বিপুল তর্ক হল একদিকে বেঙ্গল স্কুল অন্যদিকে পশ্চিমী চিন্তার সমর্থক ধ্বজাধারীদের মধ্যে।

একদিকে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ওসি গাঙ্গুলি অন্যদিকে উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী ও পরিবার। ভারতীয় আদর্শ শিল্প ভারত থেকেই তৈরি হয় ও হবে ছিল এক পক্ষের রায়। আর পক্ষের বক্তব্য ছিল ঔপনিবেশিক মনিবদের শৈলী প্রশংসার দাবি রাখে তাই সে শিক্ষা তাদের কাছ থেকে নেওয়াই উচিত।

তবে এঁরা এক সঙ্গে কাজ করতে পিছপা হতেন না মোটেও। একই পত্রিকা বিরোধী স্বরও ছাপত। মুদ্রাকর হিসেবে উপেন্দ্রকিশোর বিরোধী পক্ষের ছবি ছাপতেন। যদিও মহিলারা এই তর্কে অংশ নেননি সরাসরি তবে ক্ষীণ স্বর ও বক্তব্য তাঁদেরও ছিল।

সুখলতা রাও এই তর্কে এসেছিলেন তাঁর পিতা উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর পদাঙ্ক অনুসরণ করেই। ছোট ভাই সুকুমার রায়কে সমর্থন করা ছিল তাঁর উদ্দেশ্য। সদ্য আবিষ্কৃত অজন্তার গুহাচিত্র এই সময় তুমুল আলোড়ন ফেলেছিল নানা দেশে। ভারতীয় শিল্পের এই আদর্শ নিয়ে খুশি হননি সুখলতা কারণ নগ্নপ্রায় অজন্তার নারীচিত্র ঠিক সর্বসমক্ষে দেখা বা দেখাবার নয় মনে হয়েছিল তাঁর। শিশুদের দেখাবার তো প্রশ্নই ওঠে না।

এর চেয়ে মার্জিত রুচিশীল পশ্চিমী দৃশ্যচিত্র এবং pre-Raphaelite-দের চিত্রশিল্প তাঁকে টানত অনেক বেশি। এখানে হয়তো এ-ও ভুললে চলবে না যে সুখলতার প্রজন্মই বাংলাদেশে প্রথম আধুনিক নিয়মে শাড়ি ব্লাউজ সেমিজ পরতে শিখেছিলেন। সে সাজের অবমাননা মেনে নেওয়া মোটেই সহজ নয়। উনি নিজে অবশ্য বলেছেন ঘাগরা চোলি ভারতীয় আদর্শ পোশাক হিসেবে অতি শিষ্ট। নিশ্চয় মনের ভিতরে রাজস্থানী চিত্রের কথা ভেবেছিলেন সে সময়!

তৈলচিত্রে মানুষের প্রতিকৃতি আঁকার শখ তাঁর পূরণ হয়নি কারণ মহিলা হিসেবে কারও কাছে কারিগরি ওই প্রয়োগকৌশল শেখার সৌভাগ্য সেই সময় ছিল না। পাশের ঘরেই তরুণ ইতালি ফেরৎ তৈলচিত্র শিল্পী শশিকুমার হেশ থাকলেও সে বিদ্যা আয়ত্ত করার অধিকার হয়নি তাঁর।

প্রথাগত শিল্পশিক্ষার উপায় ছিল না। ভাগ্য ভালো ছিল তাই জন্মেছিলেন উপেন্দ্রকিশোরের ঘরে। বাবার কাছে অন্তত হয়েছিল পারিবারিক হাতেখড়ি। খুব কম পরিবারেই সে সময় মহিলাদের এমত শিক্ষা পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল।

২৬ অক্টোবর ১৮৮৬-তে জন্মেছিলেন উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী ও বিধুমুখীর প্রথম সন্তান সুখলতা ওরফে হাসি। শিশুসাহিত্যিক হিসেবে আজও বাঙালিরা সুখলতাকে মনে রাখে ঠিকই কিন্তু সাহিত্য জগতে পদার্পণ করার আগে থেকেই তিনি হাতে নিয়েছিলেন তুলি। ১৯০৬-৭-এ পান ভারতীয় কারিগরি ও কৃষি প্রদর্শনীতে মহিলা বিভাগে পদক, ১৯১০-এ জলরঙের জন্য সংযুক্ত প্রদেশসমূহের প্রদর্শনীতে প্রথম পুরস্কার।

এছাড়াও আরও অনেক পুরস্কার পেয়েছিলেন কিন্তু ছবি আঁকার জগৎ থেকে তিনি বিদায় নেন অল্পবয়সেই। বেঁচে ছিলেন সুদীর্ঘ তিরাশি বছর— ৯ জুলাই ১৯৬৯-তে উনি মারা যান। প্রবাসী পত্রিকাতে হয়তো তিনিই প্রথম মহিলা যাঁর আঁকা ছবি ছাপা হয়। বাংলায় প্রথম শিল্পী এবং একই সঙ্গে লেখিকা হওয়ার কৃতিত্ব তাঁরই প্রাপ্য— অর্থাৎ সচিত্র গল্প লিখে ওঁর আগে কেউ ছাপাননি।

১৯১২-তে যখন ওঁর প্রথম বই বেরোয় হাতে ছিল নিজের হাতে আঁকা বাচ্চাদের জন্য সব সাদা-কালো ছবি। ১৯২০ অবধি নিজেই আঁকতেন বইয়ের ছবি। ক্রমশ তা হারিয়ে যায় হয়তো পেশাগত শিল্পীদের চাপে। শেষ ছবি আঁকেন বাচ্চাদের জন্য লেখা ইংরেজি বই বেহুলা-র জন্য ১৯৩০ এর পর। সে বইখানা নানা কারণে খুব ব্যতিক্রমী। এটি একমাত্র বই যাতে ওঁর আঁকা রঙিন ছবি দেখা যায়।

সুখলতার ছবিতে যে বিদেশি ছবির প্রভাব চোখে পড়ে সে কৌশল তিনি উপেন্দ্রকিশোরের কাছ থেকেই শিখেছিলেন। কাজের ধরণ খেয়াল করলেই সাদৃশ্য বোঝা যায়— বিষয় ও আঙ্গিক দু’দিক থেকেই।

এর পর তাঁর দীর্ঘ জীবনে শুধু নিকট আত্মীয়স্বজন ছাড়া কারও জন্য এঁকেছিলেন বলে জানা যায় না। নিজের জগতে নানা কাজে নিজেকে জড়িয়ে রেখেছিলেন যেগুলো নিঃসন্দেহে খুব মূল্যবান কিন্তু প্রকাশ্য জগতে চিত্রশিল্পী কেন রইলেন না এ এক আশ্চর্য রহস্য। পরবর্তী জীবনে সমাজ সেবায় মন দিয়ে ১৯৪৪-এ কাইজার-ই-হিন্দ্ পদক পান। এবং আমৃত্যু শিশুদের জন্য লিখে গেছেন, অনুবাদ করেছেন গল্প কবিতা নাটক।

শেষ যে সাক্ষাৎকার পাওয়া যায় তাতেও মনের মতো ছবি আঁকতে না শিখতে পারার দুঃখের কথা বলেন অথচ ওঁর ছবি হারিয়ে গেছে লেখক সুখলতা রাও বেঁচে থাকতে থাকতেই। আজও ভারতীয় যাদুঘরে সবার অলক্ষ্যেই হয়তো ঝোলে ওঁর একটা ছবি। ওঁর লেখা বইয়ের পাতায় ছবি আঁকেন অন্য শিল্পীরা। এই পরিণতি সুখলতার প্রাপ্য ছিল? মহিলা বলেই কি শুধু?

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

কৃতজ্ঞতা: এইসময়

 

 

 

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত