একজন অসাধারণ শিক্ষকের ছাত্র হওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। কিন্তু আমি নিজে অত্যন্ত সাধারণ বলেই সেই শিক্ষকের অসাধারণত্বের স্বরূপ নির্ণয় বা বিশ্লেষণ আমার সাধ্যাতীত। সেই অসাধ্য সাধনের দুর্বিনীত ইচ্ছাও আমার নেই। আমি শুধু সেই বিস্মৃত মানুষটির প্রতি স্মরণের নৈর্বেদ্য নিবেদন করতে চাই।
সেই উনিশ শো আটচল্লিশ সালে যখন আমার বয়স মাত্র বারো এবং আমি ক্লাস সিক্সের ছাত্র, তখন তার কাছে আমি পাঠ গ্রহণ করেছি। তিনি ছিলেন আমাদের ইস্কুলের নেত্রকোনার চন্দ্রনাথ হাইস্কুলের রেক্টর। রেক্টর কথাটার সঙ্গে এখনকার কোনো ইস্কুলের ছাত্র নিশ্চয়ই পরিচয় নেই। অথচ সে সময় নেত্রকোনা এলাকায় প্রায় সব ইস্কুলেই একজন করে রেক্টর থাকতেন, এখানকার সব ছাত্রই রেক্টর কাকে বলে জানত। রেক্টর শব্দটি দিয়ে প্রথমে খ্রিস্টীয় যাজক বিশেষকে বোঝালেও পরে বিশেষ বিশেষ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধানের জন্যও কোথাও কোথাও রেক্টর পদবিটি ব্যবহার করা হতে থাকে। নেত্রকোনার ইস্কুলগুলোতে হেডমাস্টারকে রেক্টর বলার মধ্যে বোধ হয় বিদ্যালয়প্রধানের পদটিকে বিশেষ মর্যাদায় ভূষিত করারই প্রয়াস ছিল। কিন্তু আমি যে রেক্টরের কথা বলছি, সেই সুখরঞ্জন রায়ের জন্য এ পদবিটি কোনো বাড়তি মর্যাদার দ্যোতক হয়ে দেখা দেয়নি, অনেক উচু মর্যাদার আসন ছেড়ে দিয়েই বোধ হয় তিনি এখানে নেমে এসেছিলেন। যিনি উনিশ শো এগারো সালের পর থেকে কুড়ি বছরেরও বেশি সময় জগন্নাথ কলেজে ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক ছিলেন, তিনিই নেত্রকোনার মতো পাড়াগেঁয়ে শহরের একটি ইস্কুলে মাস্টারি করতে গেলেন। এমন ঘটনা তো অবিশ্বাস্য। অথচ, বিশ শতকের তিরিশের দশকে এমন একটি অবিশ্বাস্য ঘটনাই ঘটালেন সুখরঞ্জন রায়, যিনি জন্মেছিলেন আঠারো শো ঊননব্বই সালে (বারো শো ছিয়ানব্বই বঙ্গাব্দের পনেরোই বৈশাখ) কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রামের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে, উনিশ শো এগারো সালে যিনি কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে ইংরেজিতে এমএ পাস করেছিলেন, ছাত্রজীবন থেকেই যার সাহিত্যকর্মের সূচনা হয় এবং যৌবনেই যিনি বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় গল্প প্রবন্ধ কবিতা লিখে সাহিত্যিক হিসেবে যথেষ্ট খ্যাতি অর্জন করেন এবং যিনি ছিলেন ‘রবীন্দ্রনাথের ও বাংলা ছোটগল্পের আদি সমালোচক’।
সেকালের (অর্থাৎ বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে) নানা সাহিত্যপত্রে তরুণ সুখরঞ্জন রায়ের লেখা পড়ে রবীন্দ্রনাথ অত্যন্ত প্রীত হন, এবং সুখরঞ্জনকে ‘প্রবাসী’ পত্রিকার লেখক তালিকার অন্তর্ভুক্ত করার জন্য সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়কে উপদেশ দেন। প্রবাসী-সম্পাদকের আমন্ত্রণেই সুখরঞ্জন সে পত্রিকায় ‘জ্যোতি : পিপাসু’ ছদ্ম নামে পুস্তক সমালোচনা লিখতে শুরু করেন। স্বনামে ও ছদ্ম নামে লেখা তার বিভিন্ন প্রবন্ধ সে সময়কার সাহিত্যিক মহলে রীতিমতো আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল।
সুখরঞ্জন রায় সম্পর্কে এসব কথা আমি শুনেছি ও জেনেছি অনেক পরে, পরিণত বয়সে। কৈশোরে আমি তাকে পেয়েছি কেবল একজন শিক্ষক রূপেই। এখনকার ইস্কুলের হেডমাস্টার বা কলেজের প্রিন্সিপালরা শিক্ষক নন, তারা প্রশাসক মাত্র। কিন্তু আগে এমন ছিল না। শিক্ষকের পরিচয়ই হতো হেডমাস্টার বা প্রিন্সিপালের মুখ্য পরিচয়, প্রতিষ্ঠানের সবচেয়ে কৃতী শিক্ষক বলেই তো তিনি তার হেডমাস্টার বা প্রিন্সিপাল। চন্দ্রনাথ হাইস্কুলের রেক্টর সুখরঞ্জন রায় ক্লাস ফাইভ থেকে টেন পর্যন্ত সব ক্লাসেই পড়াতেন। আমাদের ক্লাস সিক্সে তিনি আসতেন সপ্তাহে এক দিন, পড়াতেন ইংরেজি গল্প স্টোরিজ ফ্রম ইস্ট অ্যান্ড ওয়েস্ট। এমন মজা করে তিনি পড়াতেন যে সারা সপ্তাহে আমরা তার ক্লাসটির জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকতাম। সরস্বতী পূজাকে উপলক্ষ করে ইস্কুলে প্রতিবছর অনুষ্ঠিত হতো শিক্ষা সপ্তাহ। সপ্তাহজুড়ে চলত খেলাধুলা, কবিতা-আবৃত্তি, গল্পবলা, বিতর্ক, উপস্থিত বক্তৃতা, প্রবন্ধ রচনা ও গানের প্রতিযোগিতা। সপ্তাহের শেষদিনে পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে প্রতিবছরই দেশের প্রখ্যাত লেখক বা শিক্ষাবিদদের কেউ না কেউ পৌরোহিত্য করতে আসতেন। সেদিনই সুখরঞ্জন রায়-লিখিত ও পরিচালিত নাটক অভিনয় করত ইস্কুলের ছাত্ররা। সে নাটকগুলো অবশ্য ছাপার হরফে কোনোদিন প্রকাশিত হয়নি।
সুখরঞ্জন রায়ের কোনো বিস্তৃত জীবনকথা পাওয়া যায়নি। তেরো শো সত্তর সালের তেইশে চৈত্র (অর্থাৎ উনিশ শো চৌষট্টির এপ্রিলে) তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুর তেরো বছর পর, তেরো শো তিরাশি সালের ফাল্গুনে, তার পুত্র মিহির রঞ্জন রায় ‘রবীন্দ্র কথা কাব্যের শিল্প সূত্র’ নাম দিয়ে পিতার লিখিত কতকগুলো প্রবন্ধের যে সংকলন কলকাতা থেকে প্রকাশ করেন তাতে তিনি মাত্র পঁচিশটি ছত্রে ‘সুখরঞ্জন রায়ের সংক্ষিপ্ত জীবনী’ সংযোজন করে দেন। এই অতি সংক্ষিপ্ত বিবরণীর বাইরে আর কোথাও সুখরঞ্জনের ব্যক্তিজীবন সম্পর্কে তেমন কোনো লিখিত তথ্য পাওয়া যায়নি। কিন্তু, কী আশ্চর্য, এখানেও তার প্রায় বিশ বছরের নেত্রকোনা বাস সম্পর্কে কিছুই বলা হয়নি। পিতার জীবনের একটি বড় অধ্যায়ের কথা তার পুত্র চেপে গেলেন কেন বোঝা গেল না।
কেন যে তিনি প্রায় কুড়ি বছর (উনিশ শো পঁয়ত্রিশ সাল থেকে পঞ্চাশের দশকের সূচনা পর্যন্ত) ‘পাণ্ডব বর্জিত’ নেত্রকোনায় অজ্ঞাত বাস করলেন, সে সম্পর্কে নিশ্চিত করে কেউ কিছু বলতে পারে না। তার এককালের স্নেহভাজন ছাত্র প্রয়াত দুর্গেশ চন্দ্র পত্রনবিস একদিন আলাপ প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘স্যারকে জিজ্ঞেস করেও নেত্রকোনায় তার স্বেচ্ছানির্বাসন বা অজ্ঞাতবাসের কারণ জানা যায়নি। সম্ভবত তার কোনো একটি কবিতার বইয়ে নৈতিকতাহীনতার প্রকাশ ঘটেছে— এমন একটি অভিযোগ আনা হয়েছিল। এই অভিযোগেই তার জগন্নাথ কলেজের অধ্যাপনার চাকরি চলে যায়। এরপর কিছুদিন তিনি বলধার জমিদার বাড়িতে থেকে নাটক লিখতেন ও পরিচালনা করতেন। এরও পর এলেন নেত্রকোনায়। চন্দ্রনাথ হাইস্কুলের রেক্টর হয়ে তিনি ইস্কুলের কাজকর্ম নিয়েই থাকতেন। বাইরে কারও সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তোলেননি, কোনো অনুষ্ঠানে বা সুধী সমাবেশেও যেতেন না, তবে দুএকবার রবীন্দ্রজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন।… মোটকথা, তার অজ্ঞাতবাস ও অন্তর্বৃত জীবনযাপনের কারণ অজ্ঞাতই থেকে গেছে।’
মিহির রঞ্জন তার পিতা সম্পর্কে জানিয়েছেন যে, ‘ঢাকা জগন্নাথ কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপনার কাজে দীর্ঘদিন তিনি ব্রতী ছিলেন।’ কত দিন জগন্নাথ কলেজে ও কতদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি অধ্যাপনা করেছেন, মিহির রঞ্জন তা স্পষ্ট করে লিখেননি। এমনও হতে পারে যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি খণ্ডকালীন অধ্যাপক ছিলেন। যাই হোক, উনিশ শো তেইশ সালেই তিনি ‘শান্তি নিকেতনে কবিগুরুর সহকর্মী রূপে কাজ করার অভিপ্রায় জানিয়ে’ রবীন্দ্রনাথের কাছে পত্র লিখেছিলেন। কিন্তু তার সেই অভিপ্রায় বাস্তবায়িত হতে পারেনি। কবিগুরু তার পত্রের উত্তরে লিখেছিলেন—
ওঁ
শান্তি নিকেতন
কল্যাণীয়েষু,
তোমাকে আমি দেখেছি কিনা মনে নেই কিন্তু তোমার পরিচয় আমি জানি। সুতরাং এও আমার জানা আছে যে, এখানকার কাজে তোমার মত লোকেরই প্রয়োজন। ভাবপ্রকাশ করবার স্বাভাবিক ক্ষমতা যাঁদের আছে তারাই শিক্ষা দিতে পারেন। আমাদের দেশের অধিকাংশ শিক্ষক তেল সংগ্রহ করেছেন মাত্র কিন্তু আলো জ্বালেননি, তারা শিক্ষার আয়োজনকে বড় করেন কিন্তু শিক্ষা দিতে পারেন না। তাই তোমার মত মানুষকে আমরা চাই। কিন্তু আমার বিদ্যালয় এখন ব্যয়ভারগ্রস্ত, তার আয়ের পথ সংকীর্ণ। অর্থসংগ্রহের চেষ্টায় ঘুরে বেড়াচ্ছি— অনুরূপ ফল পাচ্ছি যে তা বলতে পারিনে। বোধ করি বিশ্বভারতীর সংকল্পটি দেশের লোকের কাছে মনোহর ঠেকছে না। অতএব ধৈর্য্য ধরে সুসময়ের প্রতীক্ষা করতে হবে, এইটুকু বলতে পারি আমার জীবিতকালের মধ্যে যদি সেই সুসময় আসে তবে আমার সহায়রূপে তোমাদের পাবার চেষ্টা করব। ইতি ৫ই ফালগুন ১৩২৯
শ্রীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
রবীন্দ্রনাথ-কাঙ্ক্ষিত সেই সুসময় কখনো আসেনি, সুখরঞ্জনেরও বিশ্বভারতীতে শিক্ষকরূপে যোগ দেওয়ার সৌভাগ্য হয়নি। তবে ভাগ্যলক্ষ্মী নিশ্চয়ই নেত্রকোনার ছেলেদের প্রতি প্রসন্ন হয়েছিলেন! তাই কবিগুরুর এই চিঠি পাওয়ার বারো বছর পরে সুখরঞ্জন রায় যোগ দিলেন নেত্রকোনার চন্দ্রনাথ হাইস্কুলে। দুর্গেশ পত্রনবিসের মুখেই শুনেছি : এককালের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের জাঁদরেল অধ্যাপক সুখরঞ্জন রায়কেও মফস্বল শহরের এই ইস্কুলটিতে চাকরি পাওয়ার জন্য রীতিমতো ইন্টারভিউ দিতে হয়েছিল। চন্দ্রনাথ হাইস্কুলটি যার পিতার নামে প্রতিষ্ঠিত সেই নলিনী রঞ্জন সরকার (পরে যিনি পশ্চিমবঙ্গের অর্থমন্ত্রী হয়েছিলেন) ইন্টারভিউ নিয়েছিলেন।
চন্দ্রনাথ হাইস্কুলের বাৎসরিক পুরস্কার বিতরণী সভায় প্রতিবছর রেক্টরের প্রতিবেদন পাঠ করা হতো। রেক্টর সুখরঞ্জন রায় বাংলায় প্রতিবেদন লিখলে ইস্কুল কমিটির সদস্যরা ঘোর আপত্তি উত্থাপন করলেন। এরকম একটি নামকরা ইস্কুলের বার্ষিক প্রতিবেদন বাংলায় লিখলে তার মান থাকে কী করে!
আসলে নবনিযুক্ত রেক্টরকে বাংলায় প্রতিবেদন লিখে আনতে দেখে ইস্কুল কমিটির সদস্যরা তার ইংরেজি জ্ঞান সম্পর্কেই সন্দেহ করে বসেছিলেন। এটি বুঝতে পেরেই সুখরঞ্জন নতুন করে ইংরেজিতে প্রতিবেদন লিখে আনলেন, সদস্যদের কাছে তার ইংরেজিতে পাণ্ডিত্য ‘সুপ্রমাণিত’ হলো। এরপর আর কোনোদিনই তিনি ইংরেজিতে প্রতিবেদন লিখেননি, প্রতিবছরই তিনি বাংলায় ইস্কুলের বার্ষিক প্রতিবেদন পাঠ করতেন। এ রকম দুই বছরের দুটো মুদ্রিত প্রতিবেদন একসময় আমার হাতে পড়েছিল। দুটোরই দীর্ঘ ভূমিকায় শিক্ষা বিষয়ে যেসব চিন্তা-উদ্দীপক বক্তব্য দেখতে পেয়েছিলাম তাতে আমার মনে হয়েছিল যে, সুখরঞ্জন রায়-লিখিত সবগুলো বার্ষিক প্রতিবেদন সংগ্রহ করে যদি একটি সংকলন করা যেত তবে সেটি হতো শিক্ষা সম্পর্কে একটি মৌলিক গ্রন্থ।
তার অনেক লেখাই গ্রন্থাকারে অপ্রকাশিত রয়ে গেছে। তার জীবতকালে তিনি মাত্র তিনটি কবিতার বই— ‘শুক্লা’ (১৩১৭); ‘মায়াচিত্র’ (১৩১৮), ‘আকাশ প্রদীপ’ (১৩২১)— আর একটি ছোট গল্প সংকলন ‘হিমানীর বর’ (১৩৩৩) প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু যে ক্ষেত্রে তার কৃতিত্ব সবচেয়ে উজ্জ্বল, সেই সাহিত্য সমালোচনার কোনো বই তিনি প্রকাশ করে যাননি। পুত্র মিহির রঞ্জন পিতার স্মৃতিচারণ করে লিখেছেন,—
‘স্বভাবজ আত্মস্থ ব্যক্তিত্ব ও আত্মপ্রচার বিমুখতার জন্য এবং বিশেষত কোন গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না বলে পিতৃদেব আজ বাংলা সাহিত্যে অর্ধবিস্মৃত। বাংলা সাহিত্যে তার মৌলিক অমূল্য অবদান সত্ত্বেও জীবিতকালে তিনি ছিলেন মূলত উপেক্ষিত। তাই জীবনের শেষ ২০/২৫ বছর যখন তার সুপরিণত জ্ঞান ও সৃষ্টি প্রতিভার সার্থক অবদানে বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন বিভাগ দিকে দিকে সমৃদ্ধ হয়ে উঠতে পারত তখন তিনি অভিমানবশে সাহিত্যকর্ম থেকে স্বেচ্ছা-নির্বাসনের আশ্রয় নিয়েছিলেন এবং এক সময় যা লিখেছিলেন তাও প্রকাশে ছিলেন সম্পূর্ণ নিরাসক্ত। তার এই ঔদাসীন্যের জন্য তার জীবিতকালে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত রচনাদিরও নির্দিষ্ট কোনো তালিকা তিনি রেখে যাননি।’
তবু অনেক পত্রপত্রিকা ঘেঁটে মিহির রঞ্জন যখন তার পিতা সুখরঞ্জন লিখিত সাহিত্য সমালোচনামূলক প্রবন্ধগুলোর একটি সংকলন প্রকাশ করলেন, তখনই বাংলার সারস্বত সমাজ এই অসাধারণ লেখকের মননশীলতার পরিচয় নতুন করে পেয়ে বিস্মিত হয়ে গেলেন। আর আমরা যারা তার ছাত্র ছিলাম তারা শুধু বিস্মিতই নই, নতুন করে গর্বিতও হলাম।
১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ আগস্ট (বাংলা ১৩৪৩ সনের ২ ভাদ্র) তারিখে যতীন সরকারের জন্ম হয় নেত্রকোণা জেলার কেন্দুয়া উপজেলার চন্দপাড়া গ্রামে।
শিক্ষকতা করতে করতেই তিনি আজ ‘গণশিক্ষক’। ১৯৫৯ সালে ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজের বিএ পরীক্ষা দেয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের লেখাপড়ার খরচ জোগাতে তিনি দু’মাস কেন্দুয়ার আশুজিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে এবং পরবর্তী দু’বছর (১৯৫৯-১৯৬১) বারহাট্টা উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। এরপর ১৯৬৩ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে এমএ পরীক্ষা দেয়ার পর দশমাস গৌরীপুর হাইস্কুলে শিক্ষকতা শেষে ১৯৬৪ সালে যোগ দেন ময়মনসিংহের নাসিরাবাদ কলেজে বাংলা বিভাগের শিক্ষক হিসাবে।
চার দশক একাগ্রচিত্তে শিক্ষকতার পর অবসর নেন তিনি।
কলেজ জীবনে লেখালেখির সূচনা হলেও যতীন সরকারের লেখা প্রথম বই প্রকাশিত হয় ১৯৮৫ সালে, পঞ্চাশ বছর বয়সে। প্রথম বইয়ের নাম ‘সাহিত্যের কাছে প্রত্যশা’। এরপর একে একে প্রকাশিত হয় ‘বাংলাদেশের কবিগান’, ‘বাঙালির সমাজতান্ত্রিক ঐতিহ্য’, ‘সংস্কৃতির সংগ্রাম’, মানবমন, মানবধর্ম ও সমাজবিপ্লব’, ‘গল্পে গল্পে ব্যাকরণ’, ‘পাকিস্তানের জন্ম-মৃত্যু দর্শন’, ‘পাকিস্তানের ভূত দর্শন’, ‘দ্বিজাতিতত্ত্ব, নিয়তিবাদ ও সমাজ চেতনা’, ‘সংস্কৃতি ও বুদ্ধিজীবী সমাচার’, ‘রাজনীতি ও দুর্নীতি বিষয়ক কথাবার্তা’, ‘আমদের চিন্তার চর্চার দিক্ দিগন্ত, ‘নির্বাচিত প্রবন্ধ’, ‘ধর্মতন্ত্রী মৌলবাদের ভুত ভবিষ্যত’, ভাষা সংস্কৃতি উৎসব নিয়ে ভাবনা চিন্তা’, ‘প্রাকৃতজনের জীবনদর্শন’, ‘আমার রবীন্দ্র অবলোকন’, ‘সত্য যে কঠিন’, ‘বিনষ্ট রাজনীতি ও সংস্কৃতি’, ‘বাংলা কবিতার মূলধারা এবং নজরুল’, ‘ভাবনার মুক্ত বাতায়ন’, রচনা সমগ্র(১ম ও ২য় খ-)সহ আরও বেশকিছু জীবনীগ্রন্থ ও সম্পাদিত বই। ‘সমাজ, অর্থনীতি ও রাষ্ট্র’ নামে একটি তাত্ত্বিক ত্রৈমাসিক সম্পাদনা করতেন তিনি।
রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি, সংস্কৃতি ও লোকসাহিত্য সবক্ষেত্রেই তিনি এক ক্ষুরধার লেখক। অসামান্য প্রতিভার কারণেই মফস্বলের নিভৃতে পড়ে থাকা সত্ত্বেও সচেতন লোকচক্ষু তাকে এড়িয়ে যায়নি কখনও।
স্বাধীনতা পদক(২০১০), বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরস্কার(২০০৭), বাংলা একাডেমী প্রদত্ত ড. এনামুল হক স্বর্ণপদক(১৯৬৭), খালেকদাদ চৌধুরী সাহিত্য পরস্কার(১৯৯৭), প্রথম আলোর বর্ষসেরা বই পুরস্কার(২০০৫), মনিরউদ্দিন ইউসুফ স্মৃতি পদক(১৯৯৭), ময়মনসিংহ প্রেসক্লাব সাহিত্য পদক(২০০১), আলতাব আলী হাসু পুরস্কার(২০০৯) সহ অসংখ্য পুরষ্কার-খ্যাতি পেয়েছেন।