ডোরবেল
প্রচুর বৃষ্টিতে সারা রাস্তা সয়লাব। তবু গাড়ি চলছে শৃংখলার আলো মেপে মেপে। ড্রাইভ করতে করতে ভাল দেখা যাচ্ছে না। খুব সাবধানে ড্রাইভ করছে ঋতা। কদিন আগেই বড় বড় শিল পড়ে গাড়ির সামনের কাচ ভেঙ্গে গুঁড়ো হয়ে গেছিলো। আজ ভয়ই লাগছে বৃষ্টি, বিদ্যুৎতে। গত দুইদিন জিম এ যাওয়া হয়নি। আজ সময় নিয়ে ‘মাইন্ড প্লাস বডি” জিম সেন্টারের ভেতরে গাড়ি নিয়ে পার্ক করল। এবং গাড়ীর লক করে জিমের ব্যাগ নিয়ে দৌড়। নির্দিষ্ট কাউন্টারে গিয়ে পরনের ড্রেস চেঞ্জ করে ঝুলিয়ে রেখে টি শার্ট টাইটস পরে নিলো। এরপর শুরু হলো ইয়োগা, সাইকেলিং, এয়ারোবিক্স, সুইমিং সব মিলিয়ে ঝাড়া দুইঘন্টা।
যদিও অফিস করে জিম করলে ক্লান্তি লাগে, তবু জিম না করলে খারাপ লাগে ঋতার। এবার বৃষ্টি কিছুটা ধরেছে। রাস্তায় গাড়ি রেখে এক দৌড়ে ফুড ম্যানারে ঢুকে মাশরুম, এগ, পনির, চেরি টমেটো, এভোকাডো, এবং রেডি ডিল্যাক্স স্যান্ডুইচ নিয়ে নিলো ডিনারের জন্য। আগামীকাল জব নেই, কাল রান্না করবে। আজ আর শরীর কুলাচ্ছে না।
বাসায় ফিরেই শাওয়ার নিয়ে মাথা মুছতে মুছতে লিভিং রুমে টিভি অন করে ইনডোর প্লান্টগুলোকে আগে নাস্তাপানি খেতে দিলো। তারপর ভেজা চুলের ব্যবস্থা করতে ডায়ার নিয়ে বসলো। ঋতা ফিরেছে কি না কনফার্ম হতে উঁকি মেরে দেখতে এলো সুতপা। ভারতের মেয়ে। তারা এক এপার্টমেন্টে থাকে। কাল সুতপার এক্সাম তাই বেশী কথা না বলে ঋতার স্যান্ডুইচ থেকে এক কামড় দিয়ে নিয়ে চলে গেল।
ঋতা নেট ফ্লিক্স দেখতে দেখতে চুল শুকাতে লাগলো। নিচ থেকে থেকে ধীর ধীরে ওয়াকিং স্টিকের সাহায্যে হেঁটে হেঁটে এলেন মিসেস স্মিথ। উনি ল্যান্ডলর্ড। একাই থাকেন। স্বামী মারা গেছেন। ছেলেরা দূরে যার যার সংসারে। মিসেস স্মিথ এই দুই মেয়েকে দোতলা ভাড়া দিয়ে নিচে থাকেন। আজ ঋতার আসতে দেরী হওয়াতে খোঁজ নিতে উপরে চলে এসেছেন। ঋতা উঠে গিয়ে স্মিথ কে বসালো। ”When did you come back? I was getting worried since you were out so late.”
“Sorry aunty i had a really hectic day. I will remember to call next time if i am late.”
পরের দিন ছুটির দিন। বেলা করে ঘুম থেকে উঠলো ঋতা। রাইস কুকারে বসালো সবজি খিচুড়ি, চটপট নাস্তা। ব্যাক ইয়ার্ডে গিয়ে দেখে অনেক সবজি তুলতে হবে। কতগুলো পেকে হলুদ হয়ে গেছে, সেগুলোর বিচি রাখতে হবে। বেচারা সময় পায় না। ঝুড়ি ভরে বেগুন, ঢেঁড়শ, মিষ্টি কুমড়া ফুল, জুকিনি এসব নিয়ে এলো। আজকের দুপুরের লাঞ্চে বেশী করে রান্না করে রাখবে।
বাসায় ঢোকার আগে মিস স্মিথকে দেখে এলো। বলে এলো দুপুরে যেন একসাথে খেতে উপরে আসে। নইলে তারা দুইজন খাবার নিয়ে নিচে আসবে। ঋতা স্পাইস কম দেয় ওদের জন্য।
ঋতা রান্না এঞ্জয় করে, তাই মাঝে মাঝে খাওয়াতে ভালোবাসে। আজ চিকেন দই, মশলা মাখিয়ে রেখেছিলো। সেটা বসিয়ে দিলো। কিছু স্যামন বসালো বেক করতে। সাথে ম্যাসড পটেটো, চেরি টমেটো। প্লেইন পরোটা কিম্বা ব্রেড যে যা নেয়। আর সময় মতো এসে যাবে কেক।
দুপুরে খুব হৈ চৈ করে খাওয়া হলো। মিসেস স্মিথ বার বার মাই ডার্লিং, মাই চাইন্ড বলে জড়িয়ে ধরছিলেন। সুতপা পেট ভরে খেয়ে আর নড়তে পারছে না।, “Is there anything else left to eat? I don’t thing I can eat any more.”। আবার হাসাহাসি শুরু হল। খোলা গলায় চলছে গান সুতপা আর ঋতা, আন্তাক্ষরি খেলে খেলে তারা টায়ার্ড।
কিছুক্ষন পর ডোর বেইল। টুং টাং। পার্সেল রিসিভ করলো ঋতা। দুই পাউন্ডের মেল্টেড চকলেট কেক। কেক দেখে সবাই অবাক। আজ কার জন্মদিন? মিসেস স্মিথের তো নয়। সুতপার নয়। তবে কার জন্মদিনের কেক এসেছে ঋতার নামে!
ঋতা চুপচাপ ছোট ছোট মোমবাতি লাগাচ্ছে। সূর্য আলোর সিদ্ধান্ত থেকে ডোবার এই মুহূর্তটা চারিদিকের মিঠে করে মিহি হয়ে আছে। পাখিরা অল্প আলোয় দ্রুত বাসাবাড়িতে ফিরছে। মোম ছড়াচ্ছে মমতার মায়া মায়া কথা। চোখের তারা ঝিক মিক করছে। এবং চোখের জলগুলো টপ টপ করে পড়ে আলোকে বাড়িয়ে দিচ্ছে নিভতে নিভতে।
সবাই মিলে কেক কাটার ছুরি ধরলো। ঋতা একাই গাইলো হ্যাপি বার্থডে টু ইউ হ্যাপি বার্থ ডে টু ইউ , হ্যাপি বার্থ ডে ডিয়ার মাম্মি…।
আর গাইতে পারে না। চুপ থাকে প্রবল শব্দহীনতায়। তার দু‘পাশে একজন তরুনী এবং একজন বৃদ্ধা ঋতাকে জড়িয়ে ধরে থাকে। আজ ৫০টা মোমবাতি এবং পঞ্চাশটা লিলি আনিয়ে ছিলো ঋতা মায়ের জন্য। দু‘বছর হলো তিনি চলে গেছেন। প্রবাসে মায়ের চলে যাওয়া মুখ সে দেখতে পারেনি। ভিডিওতে দেখতে চায়নি। কোভিডের কারণে দেশে ফিরতে পারেনি। শুধু নিয়ম করে রোজ মায়ের সাথে কিছু গল্প করে, লাইভে। রান্না করতে করতে নানান মজার কথা নিয়ে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে ঋতা। ঐ প্রান্তে কেউ থাকে না, নেই। সে নিয়ম করে মায়ের জন্য মভ/ন্যুডকালারের, ন্যাচারাল কালারের লিকুইড ম্যাট লিপস্টিক কেনে। প্রতি বছর এই দিন আসে যায়। ঋতার বয়স বাড়ে। কিন্তু মায়ের থেমে গেছে পঞ্চাশেই। পঞ্চাশের বেশী মোম মায়ের জন্য আর লাগবে না ঋতার।
আজ আরেকটু বেশী সময় ধরে ঘুমালে মা ঠিকই মেল্টেড চকলেট কেকটা কাটতে চলে আসতেন। ডোরবেলের শব্দে ঋতার ঘুম ভেঙ্গে গেছে। লেফটওভার খাবার, কেক সব ফ্রিজে তুলে রেখে পড়তে চলে গেছে সুতপা। আশেপাশের বাচ্চারা কেউ বেল বাজিয়ে হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে, মায়ের মতোই।

কবি, গল্পকার