ঈশ্বরসন্ধান, বেদ-উপনিষদের বাণীপ্রচার, মানবজীবনের গভীরতম অনুভূতি ও প্রশ্নগুলির অসামান্য বিশ্লেষণ এবং একই সঙ্গে বিভিন্ন রান্নার রেসিপি সম্বন্ধে সিরিয়াস চিন্তা বিশ্বসংসারে স্বামী বিবেকানন্দ ছাড়া কে করতে পেরেছেন?
লস অ্যাঞ্জেলিসে এক ঐতিহাসিক বক্তৃতা দিয়ে মিস জোসেফিন ম্যাকলাউডের সঙ্গে বাড়ি ফিরছেন বিবেকানন্দ। গভীর চিন্তায় ডুবে রয়েছেন বিবেকানন্দ, মিস ম্যাকলাউড ভাবলেন নিশ্চয় কোনো জটিল দার্শনিক চিন্তা? এখন কথা বলাটা ঠিক হবে না। এমন সময় বিবেকানন্দ সরব হলেন। মনে হলো, অবশেষে জটিল কোনো রহস্যের সমাধানে সমর্থ হয়েছেন তিনি। বিবেকানন্দ: “এবার বুঝেছি, ওটা কীভাবে হয়।” ম্যাকলাউড অতি সন্তর্পণে জিজ্ঞেস করলেন, “কীসের কথা বলছেন?” এবার সত্যিই অবাক হবার পালা। বিবেকানন্দ উত্তর দিলেন, “মুলিগাটানি স্যুপটা কীভাবে রান্না করা উচিত! আমি বুঝেছি, পাতাগুলো আগে দিতে নেই, ওগুলো পরে দিতে হয়, তবে অমন সুগন্ধ হয়।”
দক্ষিণী রান্না সম্পর্কে এবং একই সঙ্গে দক্ষিণীসভ্যতা সম্পর্কে স্বামীজির দীর্ঘদিনের দুর্বলতা! রামানুজী তিলক-পরিব্যাপ্ত ললাটমণ্ডল সম্পর্কে তাঁর বিরামহীন রসিকতা, সেই সঙ্গে বোষ্টমদের নিয়ে নানারকম মজা।সর্বাঙ্গে ছাপ দেওয়া এক গোঁসাই দেখে এক মাতাল তাকে চিতাবাঘ ঠাওরেছিল। স্বামীজি লিখছেন, “এ মাদ্রাজী তিলক দেখে চিতে বাঘ গাছে চড়ে! আর সে তামিল তেলুগু মালয়ালম্ বুলি–যা ছয় বৎসর শুনেও এক বর্ণ বোঝবার জো নেই, যাতে দুনিয়ার রকমারি লকার ও ডকারের কারখানা; আর সেই মুড়তন্নির রসম’ সহিত ভাত সাপড়ানো–যার এক গরাসে বুক ধড়ফড় করে ওঠে (এমনি ঝাল আর তেঁতুল!); সে মিঠে নিমের পাতা, ছোলার ডাল, মুগের ডাল, ফোড়ন, দুধ্যম্ল ইত্যাদি ভোজন; আর সে রেড়ির তেল মেখে স্নান, রেড়ির তেলে মাছ ভাজা,–এ না হলে কি আর দক্ষিণমুলুক হয়?”
কথাটা তাহলে মুলগাথানি নয়! মুড়গ্তন্নি!
এবিষয়ে ভুল হবার কোনও চান্স নেই। স্বয়ং স্বামীজি তাঁর লেখায় ফুটনোট জুগিয়েছেন “অতিরিক্ত ঝাল-তেঁতুল-সংযুক্ত অড়হর ডালের ঝোল বিশেষ। মুড়গ’ অর্থে কালো মরিচ ও তন্নি’ অর্থে দাল।”
প্রবাসে শুধু ঝাল কারি এবং বিলিতি চপ কাটলেট নয়, আরও কয়েকটি খানার ব্যাপারে গবেষকদের সংগ্রহে প্রচুর তথ্য রয়েছে। স্বামীজির কাছে ফলের ব্যাপারটাও যে মজার তা বারবার দেখা যাচ্ছে।
আরো পড়ুন: বেদান্ত-বিরিয়ানির অভিনব ককটেল (পর্ব-৯ ) । ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়
আমেরিকায় আসবার আগেই পরিব্রাজককালে এক যাদুকরের সঙ্গে স্বামীজির সাক্ষাৎ হয়েছিল। হাতদুটো কম্বলের মধ্যে রেখে তাঁবুতে বসা জাদুকর জানালেন, তুমি যা খাবার চাইবে তা দিয়ে দেব। স্বামীজিও ছাড়বার পাত্র নন, জাদুকরকে ফাঁপরে ফেলবার জন্য এতো জিনিস থাকতে খেতে চাইলেন, ক্যালিফোর্নিয়ার আঙুর। বোঝা যাচ্ছে, ক্যালিফোর্নিয়া আঙুরের প্রবল ভক্ত ছিলেন তিনি। কিন্তু যা আশ্চর্য, যাদুকর সত্যিই কম্বল থেকে হাত বার করে ক্যালিফোর্নিয়ার আঙুর তাঁকে উপহার দিয়েছিলেন এবং বিস্মিত স্বামীজি সেই গল্প মার্কিন দেশের অনুরাগিণীদের কাছে নিজেই করেছিলেন।
আঙুরের প্রবল প্রশস্তি স্বামীজি ইংলন্ডে বসেও করেছেন। ১৮৯৬ সালে লন্ডনে তখন গ্রীষ্মকাল। ভাই মহেন্দ্র দেখা করতে এসেছেন। স্বামীজি বললেন, “কাঁচের পাত্রে কালো আঙুর রয়েছে, এটা নতুন উঠেছে, খা, খুব গোটাকতক খা। আঙুর খেলে গায়ের রক্ত পরিষ্কার হয়।”
লন্ডনে থাকাকালীন মিস হেনরিয়েটা মুলারের কাছে কয়েকটি আম এল, ভারতবর্ষ থেকে কেউ উপহার পাঠিয়েছে। জাহাজে আসতে মাসাবধি লেগেছে। স্বামীজি একজন বিশেষজ্ঞের মতন আমের পুনরুজ্জীবনের ব্যবস্থায় নেমে পড়লেন।
স্বামীজির নিজের জীবনেও কি আমের গল্প শেষ আছে?
“বেশ কয়েক জায়গায় আমকে তিনি ‘আঁব’ বলেছে। ভেবেছিলাম কলকেত্তিয়া উচ্চারণ, কিন্তু পরে ভাষাতত্ত্ববিদদের কাছে জেনেছি, আঁবটাই সঠিক উচ্চারণ।”
“স্বামীজির রান্নায় সবসময় এতো ঝাল কেন?” এই প্রশ্ন থেকেই যায়। লঙ্কা দেখলেই স্বামীজি পাগল হতেন! পরিব্রাজক জীবনে তিনি তো একবার লঙ্কাভক্ষণ প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েছিলেন। খেতে বসেছেন গোবিন্দ বসুর বাড়িতে, আর একজন অতিথি (সাধু অমূল্য) স্বামীজিকে দেখিয়ে মনের আনন্দে একটা শুকনো লঙ্কা খেলেন। চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে স্বামীজি সঙ্গে সঙ্গে দুটি লঙ্কা খেলেন, অমূল্য তিনটি খেলেন, স্বামীজি চারটে খেলেন, এইভাবে প্রতিযোগিতা বেড়েই চললো, শেষ পর্যন্ত সাধু অমূল্যকে পরাজয় মানতে হলো।
আর একবার আলোয়ারে বৈষ্ণব সাধু রামসানাইয়ার সঙ্গে স্বামীজির অন্তরঙ্গ পরিচয় হয়েছিল। এই সাধুও ঝাল ভালবাসতেন। মাধুকরী করে আটা এনে তাতে নুন ও লঙ্কা মেখে ধুনি জ্বালিয়ে টিক্কর বানাতেন। স্বামীজিও স্রেফ এই ঝাল টিক্কর ও জল খেয়ে দিন কাটাতেন,দু’জনে প্রায়ই মনের আনন্দে ঘটি বাজিয়ে ভজন গাইতেন।
রন্ধন পারিপাট্যের বিষয়ে গুরুভাইরাও দ্বিমত হতেন না। নিজেদের মধ্যে বলাবলি করতেন।
“দেখ নরেনের সব কাজ কি চটপট, পাগড়ী বাঁধবে তাও কি চটপট করে…অন্য লোক এক ঘণ্টায় যে কাজ করছে নরেন দুই মিনিটে সে কাজ করে ফেলে এবং এক সঙ্গে পাঁচছয়টা কাজ করে যায়।…এমন লোক জগতে খুব কম আছে। আলুর খোসা ছাড়ানো দেখ, কুটনো কোটা দেখ, পাঁচ মিনিটে সব কুটনো কুটে ফেললে। আলুর খোসা ছাড়ানো দেখ, আলুকে আঙুল দিয়ে ধরলে বঁটির গায়ে ছুঁয়াতে লাগল আর ঠিক খোসাটি উঠে গেল। আলুটা কোন জায়গায় বেধে গেল না বা চোকলা উঠে গেল না। কি আশ্চর্য তার কাজকর্ম! সব বিষয় যেন চনমন করছে, এই কুটনো কুটছে, এই হাসি তামাসা করছে, এই দর্শনের কথা বলছে, কোনটাই যেন তার পক্ষে কিছুই নয়।”
ডাল সম্বন্ধে তার যথেষ্ট দুর্বলতা ছিল, বিশেষ করে কলায়ের ডাল হলে তো কথাই নেই। বহুবার প্রিয়জনদের কাছে তিনি আব্দার করেছেন, কলায়ের দাল কর। তবে বলে রাখা ভাল, তার গুরুভাই অভেদানন্দ আবার কলায়ের ডাল একেবারেই সহ্য করতে পারতেন না। বোধ হয় এলার্জি ছিল, ওই ডাল দেখলেই কালী বেদান্তীর সর্দি হতো, হাঁচতে শুরু করতেন।
ডাল ভালবাসলেও পরামর্শ দিয়েছিলেন এরূপ:
খুব সাবধানে “ডাল দক্ষিণীদের মতন খাওয়া উচিত, অর্থাৎ ডালের ঝোলমাত্র, বাকিটা গরুকে দিও…ডাল অতি পুষ্টিকর খাদ্য, তবে বড়ই দুষ্পচ্য। কচি কলাইশুটির ডাল অতি সুপাচ্য এবং সুস্বাদু।… কচি কলাইশুটি খুব সিদ্ধ করে, তাকে পিষে জলের সঙ্গে মিশিয়ে ফেল। তারপর একটা দুধ ছাঁকনির মতো তারের ছাকনিতে ছাঁকলেই খেলাগুলো বেরিয়ে আসবে। তখন হলুদ, ধনে, জিরে, মরিচ, লঙ্কা, যা দেবার দিয়ে সাঁতলে নাও। উত্তম সুস্বাদু সুপাচ্য ডাল হল।” এই হচ্ছে শখের শেফ স্বামীজির স্পেশাল রেসিপি।
বোঝা যাচ্ছে, রান্না শেখাতে এবং উদ্ভাবন করতে স্বামীজি ছিলেন অতুলনীয়।
রান্নায় ক্রিয়েটিভিটি আর ইম্প্রোভাইজেশন যে মূল কথা,সেটাই বোঝা যায় বারেবারে।
একবার তিনি বোধগয়ায় রয়েছেন, জনৈক বাঙালি ভক্ত প্রতিদিন সকালে এক কলসি তালের রস এবং এক কলসি খেজুর রস স্বামীজি অ্যান্ড পার্টিকে পাঠিয়ে দিতেন। খেজুর রস নষ্ট করতে প্রাণ চায় না। অনেক ভেবেচিন্তে স্বামীজি ভাতের হাঁড়িতে জলের বদলে রস দিয়ে তাতে চাল ফেলে দিয়ে ভাত রাঁধতে বললেন! বোধহয় ওয়ার্লডের প্রথমও শেষ খেজুরেভাত!অনুসন্ধিৎসুরা শীতকালে স্বামীজি উদ্ভাবিত খেজুর রসের এই পদটি আর একবার বেঁধে দেখতে পারেন।
বিদ্রোহী বিবেকানন্দকে আমরা তার খাদ্যাভ্যাসের মধ্যেও খুঁজে পাই। শাস্ত্রে বলে দুধ ও মাংস একসঙ্গে খাওয়া উচিত নয়, কিন্তু স্বামীজি বেপরোয়া, তাই দুধ-মাংসের বিপরীত আহারে তিনি বেশ অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলেন।
ঠেসে ভাত খাওয়ার প্রচণ্ড বিরোধী ছিলেন আমাদের বিবেকানন্দ। একবার বেলুড়ে আহার করতে করতে বন্ধু প্রিয়নাথ সিংহকে বললেন, “দেখ সিঙ্গি, কনসেনট্রেটেড়’ ফুড খাওয়া চাই। কতকগুলো ভাত ঠেসে খাওয়া কেবল কুঁড়েমির গোড়া।…আমাদের যে দু’বার আহার কুঁচকিকণ্ঠা ঠেসে। একগাদা ভাত হজম করতে সব এনার্জি চলে যায়।”

উত্তর কলকাতায় জন্ম। রসায়নে মাস্টার্স রাজাবাজার সায়েন্স কলেজ থেকে। বিবাহ সূত্রে বর্তমানে দক্ষিণ কলকাতার বাসিন্দা। আদ্যোপান্ত হোমমেকার। এক দশকের বেশী তাঁর লেখক জীবন। বিজ্ঞানের ছাত্রী হয়েও সাহিত্য চর্চায় নিমগ্ন। প্রথম গল্প দেশ পত্রিকায়। প্রথম উপন্যাস সানন্দা পুজোসংখ্যায়। এছাড়াও সব নামীদামী বাণিজ্যিক পত্রিকায় লিখে চলেছেন ভ্রমণকাহিনী, রম্যরচনা, ছোটোগল্প, প্রবন্ধ এবং ফিচার। প্রিন্ট এবং ডিজিটাল উভয়েই লেখেন। এ যাবত প্রকাশিত উপন্যাস ৫ টি। প্রকাশিত গদ্যের বই ৭ টি। উল্লেখযোগ্য হল উপন্যাস কলাবতী কথা ( আনন্দ পাবলিশার্স) উপন্যাস ত্রিধারা ( ধানসিড়ি) কিশোর গল্প সংকলন চিন্তামণির থটশপ ( ধানসিড়ি) রম্যরচনা – স্বর্গীয় রমণীয় ( একুশ শতক) ভ্রমণকাহিনী – চরৈবেতি ( সৃষ্টিসুখ) ২০২০ তে প্রকাশিত দুটি নভেলা- কসমিক পুরাণ – (রবিপ্রকাশ) এবং কিংবদন্তীর হেঁশেল- (ধানসিড়ি)।অবসর যাপনের আরও একটি ঠেক হল গান এবং রান্নাবাটি ।