| 29 মার্চ 2024
Categories
ধারাবাহিক প্রবন্ধ

বেদান্ত-বিরিয়ানির অভিনব ককটেল (পর্ব-২) । ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

সংসারে অভাব যে কি ভয়ানক হতে পারে তা স্বামীজির মুখেই শোনা যাক :

“প্রাতঃকালে উঠিয়া গোপন অনুসন্ধান করিয়া যেদিন বুঝিতাম, গৃহে সকলের পর্যাপ্ত আহার নাই, সেদিন মাতাকে আমার নিমন্ত্রণ আছে’ বলিয়া বাহির হইতাম এবং কোনদিন সামান্য কিছু খাইয়া, কোনদিন অনশনে কাটাইয়া দিতাম। অভিমানে ঘরে বাহিরে কাহারও নিকট ঐকথা প্রকাশ করিতেও পারিতাম না।”

এই বরানগর মঠেই একদিন হীরানন্দ নামক ভক্ত এসে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনাদের চলে কী করে?”

নরেন বলেছিলেন “সকলেই মুষ্ঠিভিক্ষা করে নিয়ে আসে, তাতেই একরকম চলে যায়।”

হীরানন্দর কাছে ছয় আনা পয়সা ছিল। তিনি তা দিয়ে বললেন, “এই পয়সায় এ বেলা চলুক।”

নরেন উত্তর দিলেন, “পয়সার আবশ্যক হবে না, এবেলার মতন চাল আছে।”

এক এক দিন বরানগরে চারজন গুরুভাই ভিক্ষে করতে বেরিয়ে রিক্ত হাতে ফিরে আসতেন। গান করে ভুলে থাকতেন খিদে। অনাহার বা অর্ধাহারটাই ছিল বরানগরের রেওয়াজ। স্বামী প্রেমানন্দের কথায় : “একবেলা ভাত কোনদিন জুটতো, কোনদিন জুটতো না। থালাবাসন তো কিছুই নেই। বাড়ির সংলগ্ন বাগানে লাউগাছ, কলাগাছ ঢের ছিল। দুটো লাউপাতা, কি একখানা কলাপাতা আনতে গেলে মালী যা তা বলে গালি দিত। শেষে মানকচুর পাতায় ভাত ঢেলে তাই খেতে হতো। তেলাকুচো পাতা সিদ্ধ আর ভাত–তা আবার মানপাতায় ঢালা। খেলেই গলা কুটকুট করতো।”

কচুপাতা এড়ানোর উপায় ? ভিক্ষার চাল সিদ্ধ করে তা একটা কাপড়ের ওপরে ঢেলে সকলে মিলে খেতে বসতেন এবং লবণ ও লঙ্কার ঝোল করে সকলেই একগ্রাস করে ভাত মুখে নিতেন এবং বাটিতে রাখা নুন লঙ্কার ঝোলে হাত দিয়ে তা মুখে দিতেন।

ভারত-পরিক্রমায় বেরিয়ে পরিব্রাজক বিবেকানন্দ এক গুরুভাইকে লিখলেন

 “আমি নির্লজ্জভাবে ঘুরে ঘুরে অপরের বাড়িতে আহার করছি, আর এতে বিবেকের দংশনও হচ্ছে না–ঠিক যেন একটি কাক…আর ভিক্ষে করবো না। আমাকে খাইয়ে গরীবের লাভ কী? তারা একমুঠো চাল পেলে বরং নিজের ছেলেমেয়েদের খাওয়াতে পারে।”

স্বামীজি স্থির করেছিলেন খাদ্যভিক্ষা করবেন না। ফলে মাঝে মাঝে উপবাসে কাটাতে হতো। একবার দুদিন অনাহারে আছেন, এমন সময় এক বড়লোকের ঘোড়ার সহিস তাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলো, “সাধুবাবা, কিছু ভোজন হয়েছে?” এরপর দয়াপরবশ হয়ে সহিস কয়েকটা রুটি ও ঝালচাটনি খেতে দিলেন। এই চাটনিতে এত ঝাল যে দু’দিন উপবাসের পর ওটা খেয়ে তিনি পেটের যন্ত্রণায় ছটফট করতে লাগলেন। সহিসও খুব বিপদে পড়ে গিয়েছে। এমন সময় একটা লোক মাথায় ঝুড়ি নিয়ে যাচ্ছিল। স্বামীজি তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ঝুড়িতে কি আছে? লোকটি বললো, তেঁতুল। “এই তো চাই!” ঐ তেঁতুল খেয়ে স্বামীজির পেটের যন্ত্রণার নিবৃত্তি হলো।

আলমোড়ার উপকণ্ঠে এক গোরস্থান। এক ফকিরের দয়ায় সেবার স্বামীজি বেঁচে গেলেন। ফকিরটির দেওয়া একফালি শশা খেয়ে তৃপ্ত হয়েছিলেন সেবার।

একবার উত্তরভারতে স্বামীজি একা একা ঘুরে বেড়াচ্ছেন। একজন অসৎ থানাদার তার পিছনে লাগলো, কয়েদে পূরবে জানালো।বিষণ্ণ কিন্তু ভয়শূন্য মনে বললেন, “চলুন না। এরূপ অনিশ্চিত অনাহারে থাকার চেয়ে তবুও থানায় দু’বার খেতে পাওয়া যাবে, সেতো ভাল কথা।”

ঈশ্বরের দয়ায় কখনও তিনদিনের বেশি উপবাস করতে হয়নি।

তুমুল ভোজনরসিক তিনি। কিন্তু অনাহারের আশঙ্কা বিবেকানন্দকে কখনও দমিয়ে রাখতে পারেনি। ১৮৯০ সালে ডিসেম্বরের এক সন্ধ্যায় মীরাট শহরের ২৫৯ নম্বর রামবাগে লালা নন্দরাম গুপ্তর বাগানবাড়িতে ক’দিন ছিলেন। আফগানিস্থানের আমীর আব্দার রহমানের জনৈক আত্মীয় সেবার সাধুদের পোলাও খাওয়ানোর জন্য কিছু টাকা দেন! স্বামীজি উৎসাহভরে পোলাও রান্নার দায়িত্ব নেন। নিজে বাজার থেকে মাংস, ডিম কিনে এনে উপাদেয় সব পদ প্রস্তুত করেন।

মীরাটে থাকাকালীন স্বামীজি গুরুভাইদের পোলাও কালিয়া রান্না শেখাতেন। একদিন পোলাও আর মাংসের কিমা দিয়ে কিছু শিক্ কাবাব করবার ইচ্ছা। কিন্তু শিক পাওয়া গেল না। তখন মাথা ঘামিয়ে স্বামীজি সামনের পিচগাছ থেকে গোটাকয়েক ছোট ডাল ছিঁড়ে নিয়ে তাতেই কিমা জড়িয়ে দিয়ে কাবাব করলেন। সবাইকে খাওয়ালেন, নিজে কিন্তু খেলেন না। বললেন, “তোমাদের খাইয়ে আমার বড় সুখ হচ্ছে।”

এই স্বামীজিই আবার একটা নয়, দুটো ডিমের পোচই পছন্দ করতেন খুব।

শিকাগো বক্তৃতায় স্বামীজি বিশ্বে খ্যাতি, সম্মান ও শ্রদ্ধার মুকুট পরেছেন। কিন্তু প্রবাসে অর্থসমস্যার সমাধান সব সময় হয়নি।

অনাহার কাকে বলে তা জানতেন বলেই পৃথিবীর অনাহারী অর্ধ-আহারী মানুষের দুঃখের কথা অনুভব করতে সক্ষম হয়েছেন।

দু’ মুঠো অন্ন সবার মুখে তুলে দেবার জন্য সর্বত্যাগী সন্ন্যাসীর আকুলতা শেষদিন অবধি তাড়িয়ে নিয়ে চলেছিল।

“শেষজীবনে শত শারীরিক যন্ত্রণা সত্ত্বেও সন্ন্যাসী বিবেকানন্দ তাঁর প্রিয় শিষ্য শরচ্চন্দ্রকে অন্নসত্র খোলার কথা বলেছেন। “যখন টাকা আসবে তখন একটা মস্ত কিচেন করতে হবে। অন্নসত্রে কেবল ‘দীয়তাং নীয়তাং ভুজ্যতাম’ এই রব উঠবে, ভাতের ফেন গঙ্গায় গড়িয়ে পড়ে গঙ্গার জল সাদা হয়ে যাবে। এই রকম অন্নসত্র হয়েছে দেখব তবে আমার প্রাণটা ঠাণ্ডা হবে।”

প্রবাসেও একসময় অর্থাভাবে কখনও স্রেফ পাঁউরুটিই ভরসা,আবার কখনও ব্যাংকোয়েটে ভুরিভোজন।

Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,book add


আরো পড়ুন: বেদান্ত-বিরিয়ানির অভিনব ককটেল (পর্ব-১)


মার্কিন মুলুকে তিনি চকোলেট আইসক্রিমের প্রবল ভক্ত হয়ে উঠে আইসক্রিমকে কুলপি বলতে শুরু করেছিলেন। এর কারণও ছিল। কলকাতায় যখন প্রথম বরফ এলো তখন ওই দুর্লভ বস্তুটি অতি অল্প সময়ের মধ্যে সিমলের দত্তবাড়িতে হাজির হলেও তখন রেফ্রিজারেটর ছিলনা ঘরে ঘরে। বরফের বাক্সে খাবার, ফল, দুধ রাখার চল। নেয়াপাতি ডাবের ভিতর চিনি দিয়ে সেই ডাবের খোলে বরফ দিয়ে খাওয়া ছিল স্বামীজির খুব পছন্দের। 

একদিন মার্কিনদেশে তাঁর সঙ্গিনীরা স্ট্রবেরি খাচ্ছিলেন, তাঁরা জিজ্ঞেস করলেন, “স্বামীজি আপনি কি স্ট্রবেরি পছন্দ করেন?”

স্বামীজি সঙ্গে সঙ্গে অভিযোগ করলেন, “কখনও তো চেখে দেখিনি!”

“কখনও খাননি! সে কি? রোজই তো খাচ্ছেন!”

এবার স্বামীজির জোরালো উত্তর : “তোমরা তো সেগুলো ক্রিম দিয়ে ঢেকে দাও, ক্রিম মাখানো পাথরের নুড়িও ভাল লাগতে বাধ্য!”

লেগেট পরিবারে থাকার সময় ধূমপানের লোভে স্বামীজি সান্ধ্য-আহারের পর ঝটপট ডিনার টেবিল ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতেন। ডিনার টেবিলে স্বামীজিকে আটকে রাখার সহজতম উপায়টি স্নেহময়ী মিসেস লেগেট আবিষ্কার করেছিলেন। টেবিল ছেড়ে স্বামীজির উঠে যাবার একটু আগেই তিনি ঘোষণা করতেন, “আইসক্রিম আছে।” অমনি ছোটছেলের মতন স্বামীজি নিজের জায়গায় বসে তৃপ্তি সহকারে আইসক্রিম খেতেন।

একদিন ক্যালিফোর্নিয়ায় তাঁর সান্ধ্য বক্তৃতার শেষে সবাই মিলে রেস্তোরাঁয় খেতে বেরোলেন।

রেস্তোরাঁয় ঢুকে পড়ে ঐ হাড়কাঁপানো ঠাণ্ডাতেও স্বামীজির প্রবল ইচ্ছে আইসক্রিম খাওয়ার। দোকানের মালিক একটু দেরি করতে পারেন তা আশঙ্কা করে স্বামীজি বললেন, “দয়া করে দেরি করবেন না, তাহলে ফিরে এসে এখানেই দেখবেন একতাল চকোলেট আইসক্রিম।” অর্থাৎ বাইরে থেকে আসা অতিথিরাই ঠাণ্ডায় জমে আইসক্রিম হয়ে গিয়েছেন।

আইসক্রিম নিয়ে ভ্রান্তিবিলাসও হয়েছে! একবার লেকচারের শেষে আটজনকে স্বামীজি আইসক্রিম খেতে নেমন্তন্ন করলেন।

আইসক্রিমের প্রতি এই অস্বাভাবিক টান দেশে ফিরে এসেও অব্যাহত ছিল। এক আধবার নিবেদিতার কাছে আইসক্রিম খাওয়ার আব্দার করেছেন স্বামীজি। বেশ চিন্তায় পড়ে গিয়েছেন নিবেদিতা, কারণ স্বামীজি তখন মধুমেহ রোগী।

অঢেল ঠাণ্ডা খাবার সম্বন্ধে স্বামীজি স্বদেশে রিপোর্টও পাঠিয়েছেন গুরু ভাই স্বামী রামকৃষ্ণানন্দকে। “দুধ আছে, দই কদাচ, ঘোল অপর্যাপ্ত।”

ক্রিমের চমৎকার বাংলা করেছেন স্বামীজি–মাঠা, “মাঠা সর্বদাই ব্যবহার চায়ে, কফিতে, সকল তাতেই মাঠা ব্যবহার–সর না, দুধের মাঠা। মাখন তো আছেন–আর বরফ জল–এন্তের বরফ জল…আর কুলফি এন্তের নানা আকারের।”

স্বদেশ ফিরেও বিবেকানন্দর আইসক্রিমের প্রতি আকর্ষণ কমছে না। সেবার মায়াবতীতে প্রচণ্ড শীত–স্বামী বিরজানন্দকে স্বামীজি বললেন, “জীবনের শেষভাগে সব কাজ ছেড়ে এখানে আসা, বই লিখব আর গান করব।” ইতিমধ্যে হ্রদে বরফ জমেছে। সেই বরফ সংগ্রহ করে প্রকাণ্ড একতাল আইসক্রিম তৈরি করে ফেললেন স্বামী বিরজানন্দ। স্বামীজিকে সন্তুষ্ট করার সহজতর উপায় সেই মুহূর্তে।

বিদেশে এলাহি ডিনার কীরকম হয় তার বর্ণনা স্বামীজির লেখাতেই রয়েছে

 “ডিনারটাই প্রধান খাদ্যধনী হলে তার ফরাসি রাঁধুনি এবং ফরাসি চাল। প্রথমে একটু আধটু নোনা মাছ বা মাছের ডিম, বা কোন চাটনি বা সবজি। এটা হচ্ছে ক্ষুধাবৃদ্ধি, তারপর স্যুপ, তারপর আজকাল ফ্যাশন–একটা ফল, তারপর মাছ, তারপর মাংসের একটা তরকারি, তারপর থান-মাংস শূল্য, সঙ্গে কাঁচা সবজি, তারপর আরণ্য মাংস মৃগপক্ষাদি, তারপর মিষ্টান্ন, শেষ কুলপি–মধুরেণ সমাপয়েৎ…থাল বদলাবার সঙ্গে সঙ্গে কাঁটা-চামচ সব বদলাচ্ছে; আহারান্তে কফি বিনা-দুগ্ধ।”

সেই ভোজসভায় যাঁরা মদ্যপান করেন তাদের জন্য খাদ্যের তালে তালে পানীয়–থাল বদলাবার সঙ্গে সঙ্গে মদ বদলাচ্ছে–শেরি, ক্ল্যারেট, শ্যামপা ইত্যাদি এবং মধ্যে মধ্যে মদের কুলপি একটু আধটু।

 

 

 

 

 

One thought on “বেদান্ত-বিরিয়ানির অভিনব ককটেল (পর্ব-২) । ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত