বেদান্ত-বিরিয়ানির অভিনব ককটেল (পর্ব- ৪) । ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়
সময়কালঃ মার্চ ১৮৯৯, স্থানঃ বেলুড় মঠ।
মানসকন্যা নিবেদিতা এবং রবীন্দ্রনাথের ভাগ্নী সরলা ঘোষালকে এক রবিবারে তিনি যে লাঞ্চ খাইয়েছিলেন তার মধ্যে দিয়ে সারাবিশ্বের ছায়া নামিয়ে এনেছিলেন বিশ্বপথিক বিবেকানন্দ।
এই লাঞ্চের মাত্র কয়েকদিন আগে বিনা নোটিসে সিস্টার নিবেদিতাকে তিনি সাপার খাইয়েছিলেন বেলুড়ে। তার মেনু : কফি, কোল্ড মাটন, ব্রেড অ্যান্ড বাটার। স্বয়ং স্বামীজি পরম স্নেহে পাশে বসে খাইয়ে নিবেদিতাকে বোটে করে কলকাতায় ফেরত পাঠিয়েছিলেন। আর রবিবারের সেই অবিস্মরণীয় লাঞ্চের ধারাবিবরণী নিবেদিতা রেখে গিয়েছেন মিস ম্যাকলাউডকে লেখা এক চিঠিতে।
“সে। এক অসাধারণ সাফল্য! তুমি যদি সেখানে থাকতে!” স্বয়ং স্বামীজি রান্না করেছেন, পরিবেশনও তিনি নিজে করলেন। “আমরা দোতলায় একটা টেবিলে বসেছি। সরলা পুবমুখো হয়ে বসেছিল যাতে গঙ্গা দেখতে পায়।”
এই ভোজনের নাম নিবেদিতা দিয়েছিলেন ‘ভৌগোলিক’ লাঞ্চ, কারণ সারা বিশ্বের রান্না একটি টেবিলে জমায়েত হতে শুরু করেছে। সব বেঁধেছেন স্বামীজি। রাঁধতে রাঁধতে তিনি একবার নিবেদিতাকে তামাক সাজতে নির্দেশ দিয়েছেন। সেই অবিস্মরণীয় মেনুর কথা।
১। আমেরিকান অথবা ইয়াঙ্কি–ফিস্ চাউডার।
২। নরওয়েজিয়ান ফিস বল বা মাছের বড়া–”এটি আমাকে শিখিয়েছেন ম্যাডাম অগনেশন”–স্বামীজির রসিকতা।
৩। ইংলিশ না ইয়াঙ্কি? –ববার্ডিং হাউস হ্যাঁশ। স্বামীজি আশ্বাস দিলেন ঠিকমতন রান্না করা হয়েছে এবং পেরেক মেশানো হয়েছে। “কিন্তু পেরেক? তার বদলে আমরা পেলাম লবঙ্গ!–আহা পেরেক না থাকায় আমাদের খুব দুঃখ হতে লাগলো।”
৪। কাশ্মিরী মিন্সড পাই (আ লা কাশ্মির) অর্থাৎ বাদাম ও কিসমিস সহ মাংসের কিমা!
৫। বেঙ্গলি রসগোল্লা ও ফল।
এক মেন্যুর মধ্যে দিয়ে বিশ্বায়নের ভাবনা সে যুগে! ভাবা যায়?
আরেকটি খোদ ১৮৯৬ সালের রিপোর্ট! ভেজিটারিয়ান মিস হেনরিয়েটা মুলারের বাড়িতে সান্ধ্য আহার–দুধ দিয়ে মোটা ম্যাকারনি স্যুপ। তাতে নুন দেওয়া ছিল–অদ্ভুত এই ইংরেজ জাত, দুধে নুন মেশাতে ভয় করে না। বিবেকানন্দ তাঁর গুরুভাই নবাগত স্বামী সারদানন্দকে শেখালেন, কেমন করে চামচ ধরতে হয় এবং কীভাবে স্যুপ খেতে হয়। একবার টেবিলের তলায় সারদানন্দের পা চেপে ধরে ইঙ্গিত দিলেন নাইফ সবসময় ডান হাতে ধরতে হয়, কখনই বাঁ হাতে নয়।
আরো পড়ুন: বেদান্ত-বিরিয়ানির অভিনব ককটেল (পর্ব-৩)
সারদানন্দকে স্বামীজি বললেন, “বাঁ হাতে কাটা দিয়ে মুখে তুলতে হয় অত বড় বড় গরস করে না, ছোট ছোট গরস করবি। খাবার সময় দাঁত জিভ বার করতে নেই, কখনও কাশবি না, ধীরে ধীরে চিবুবি। খাবার সময় বিষম খাওয়া বড় দূষণীয়; আর নাক ফোঁস ফোঁস কখনও করবি না।” এর থেকে বোঝা যায় তাঁর কাছে খাওয়াটা শুধুই খাওয়া নয়। একটা শিল্পও বটে।
আর একদিন স্বামীজির নিরামিষ লাঞ্চের মেনু, ভাত ও ওলন্দা কড়ায়ের মটর ডাল। ডালেতে একটু কারি পাউডার ও নুন দিয়ে সেদ্ধ করে খানিকটা মাখন দেওয়া ছিল। খেতে বসে স্বামী সারদানন্দের দুঃখ, “হায় কপাল! এখানেও মটর ডাল সিদ্ধ।” মাংস। ইংরেজরা তিনবার সকালে অল্প, কিন্তু মধ্যে মধ্যে কফি-যোগ, চা-যোগ আছে। আমেরিকানদের তিনবার–উত্তম ভোজন, মাংস প্রচুর।”
বিবেকানন্দ তুলনামূলকভাবে লক্ষ্য করেছেন, গরিব অবস্থায় সকল দেশের খাওয়াই ধান্যবিশেষ। বাংলায় তার সঙ্গে ডাল তরকারি, কখনো সঙ্গে মাছমাংস, চাটনি।
“ইউরোপের অবস্থাপন্ন লোকের এবং আমেরিকার আবালবৃদ্ধবনিতার। খাওয়া আর এক রকম–অর্থাৎ রুটি ভাত প্রভৃতি, চাটনি এবং মাছ-মাংসই হচ্ছে খাওয়া। আমেরিকায় রুটি খাওয়া নাই বললেই হয়। মাছ মাছই এল, মাংস মাংসই এল, তাকে এমনি খেতে হবে, ভাত-রুটির সংযোগ নয়।”
স্বামী বিবেকানন্দ বাংলাদেশের ঝোলের ভীষণ ভক্ত ছিলেন। ঝোল সম্পর্কে সৈয়দ মুজতবা আলীর কথাগুলি? পূর্ববাংলার গোয়ালন্দ, নারায়ণগঞ্জ, চাঁদপুরে জাহাজের খলাসীরা যে মুরগির ঝোল রান্না করে সে রকম ঝোল ভূভারতে আর কেউ রাঁধতে পারে না। সত্যিই তাই। যেমন তেমন করে মুরগীর সাদামাটা ঝোল মায়েরা বসিয়ে দিলেও আমাদেরও চেটেপুটে খেয়ে সেটাই মনে হত।
কোনো এক সূর্যগ্রহণের দিনে স্বামীজি তাঁর এক শিষ্য বলরাম বসুর বাড়িতে শিষ্যের হাতে সেবা গ্রহণে উৎসাহী হয়েছেন। স্বামীজি পূর্ববঙ্গজ শিষ্যের হাতে পূর্ববঙ্গীয় রীতিতে রান্না খেতে চাইলেন। যোগীন মা রান্নার কাজে সাহায্য করছিলেন। স্বামীজি মাঝে মাঝে রান্নাঘরে এসে রান্নার বিষয়ে খোঁজ নিচ্ছিলেন। কখনো বলছিলেন, “দেখিস মাছের ‘জুল’ যেন ঠিক বাংলাদেশি ধরনের হয়”। ভাত, মুগ ডাল, কই মাছের ঝোল, মাছের টক ও মাছের সুক্তুনি রান্না হতে না হতেই স্বামীজি খেতে বসে গেলেন। তিনি মাছের সুক্তুনি খেয়ে খুশি হলেন, মাছের “জুল”-কে ঝাল বললেন। মাছের টক খেয়ে বলেন, “এটা ঠিক বর্দ্ধমানী ধরনের হয়েছে”। দই, সন্দেশ দিয়ে তিনি আহার শেষ করলেন। আহার শেষে তামাক টানতে টানতে বললেন, “যে ভালো রাঁধতে পারে না, সে ভালো সাধু হতে পারে না- মন শুদ্ধ না হলে ভালো সুস্বাদু রান্না হয় না”।’
আর পাঁচজন বাঙালির মতো খাদ্য-রসিক স্বামীজির রান্না ছিল পছন্দের আর তাই নিজের কথাতেই তিনি সত্যনিষ্ঠ সাধু হয়ে উঠেছিলেন । ভোজনপ্রিয় স্বামী বিবেকানন্দের কথা সর্বজনবিদিত না হলেও তার পরিবার, শিষ্য ও ঘনিষ্ঠ মহলে একথা জানতেন অনেকেই। খাবার পাশাপাশি রান্না করতেও বেশ ভালোবাসতেন ।
ভোজনরসিক বাঙালির তালিকায় রয়েছেন বহু মনীষী যাদের মধ্যে সর্বাগ্রে মনে পড়ে তাঁর কথা। স্বামীজি সব ধরনের মিষ্টি খাবার দাবারই ভালোবাসতেন বিশেষ করে আইসক্রিম। ১৮৯৩ সাল আমেরিকা সফরে তাঁর আইসক্রিম প্রীতির কথা জানা যায়৷ ভাত, ডাল, মাছ, সবজি, দুধ, মুড়ি, আলুভাজা তাঁর পরবর্তী সময়ে প্রিয় ছিল৷ এছাড়াও মা ভুবনেশ্বরীদেবীর হাতের যে কোনও রান্নাবান্না অত্যন্ত পছন্দ করতেন স্বামীজি।

উত্তর কলকাতায় জন্ম। রসায়নে মাস্টার্স রাজাবাজার সায়েন্স কলেজ থেকে। বিবাহ সূত্রে বর্তমানে দক্ষিণ কলকাতার বাসিন্দা। আদ্যোপান্ত হোমমেকার। এক দশকের বেশী তাঁর লেখক জীবন। বিজ্ঞানের ছাত্রী হয়েও সাহিত্য চর্চায় নিমগ্ন। প্রথম গল্প দেশ পত্রিকায়। প্রথম উপন্যাস সানন্দা পুজোসংখ্যায়। এছাড়াও সব নামীদামী বাণিজ্যিক পত্রিকায় লিখে চলেছেন ভ্রমণকাহিনী, রম্যরচনা, ছোটোগল্প, প্রবন্ধ এবং ফিচার। প্রিন্ট এবং ডিজিটাল উভয়েই লেখেন। এ যাবত প্রকাশিত উপন্যাস ৫ টি। প্রকাশিত গদ্যের বই ৭ টি। উল্লেখযোগ্য হল উপন্যাস কলাবতী কথা ( আনন্দ পাবলিশার্স) উপন্যাস ত্রিধারা ( ধানসিড়ি) কিশোর গল্প সংকলন চিন্তামণির থটশপ ( ধানসিড়ি) রম্যরচনা – স্বর্গীয় রমণীয় ( একুশ শতক) ভ্রমণকাহিনী – চরৈবেতি ( সৃষ্টিসুখ) ২০২০ তে প্রকাশিত দুটি নভেলা- কসমিক পুরাণ – (রবিপ্রকাশ) এবং কিংবদন্তীর হেঁশেল- (ধানসিড়ি)।অবসর যাপনের আরও একটি ঠেক হল গান এবং রান্নাবাটি ।