| 28 মার্চ 2024
Categories
ধারাবাহিক প্রবন্ধ

বেদান্ত-বিরিয়ানির অভিনব ককটেল (পর্ব- ৫) । ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়

আনুমানিক পঠনকাল: 3 মিনিট

অনেকের মুখেই শোনা যায় স্বামীজির কচুরিপ্রেমের হাবুডুবু খাওয়ার গল্প। কলকাতার অলিগলিতে সেযুগেও ছিল থরে থরে কচুরির দোকান। তিনি কচুরি আনিয়ে খেতেন বলেও জানা যায়। ১৮৯৬ সালে লন্ডনে থাকাকালীন কচুরি বিহনে বৃথা কষ্ট না পেয়ে বাড়ির বেসমেন্টে বসেই  বিশ্ববিজয়ী স্বামীজি বাড়ির বেসমেন্টে গিয়ে নিজেই মাখন গলিয়ে ঘি করে আলুর পুর দেওয়া কচুরি ও বেশ ঝাল ঝাল চচ্চড়ি করে ওপরকার ডাইনিং রুমে ফিরে এসেছিলেন।

এই বিবেকানন্দ কিন্তু জগৎ চষে বেড়িয়ে, প্রাণ ভরে ফাগুর দোকানের কচুরি খাওয়ার পর বাঙালি ময়রার দোকান সম্বন্ধে মত একেবারেই পাল্টে ফেলেছিলেন। তাঁর বক্তৃতায়, লেখায় বারেবারে উঠে এসেছে সেসব কথা।

“এই যে ঘরে ঘরে অজীর্ণ, ও ঐ ময়রার দোকানে বাজারে খাওয়ার ফল। ঐ যে পাড়াগেঁয়ে লোকের তত অজীর্ণদোষ…হয় না, তার প্রধান কারণ হচ্ছে লুচি-কচুরি প্রভৃতি ‘বিষলড়ুকের’ অভাব।” এইখানেই ইতি টানা যুক্তিযুক্ত মনে না করে বিরক্ত বিবেকানন্দ নিজের হাতে লিখে চলেছেন, “ভাজা জিনিসগুলো আসল বিষ।ময়রার দোকান যমের বাড়ি। ঘি-তেল গরমদেশে যত অল্প খাওয়া যায়, ততই কল্যাণ। ঘিয়ের চেয়ে মাখন শীঘ্র হজম হয়। ময়দায় কিছুই নাই, দেখতেই সাদা।গমের সমস্ত ভাগ যাতে আছে, এমন আটাই সুখাদ্য।ময়রার দোকানের খাবারের খাদ্যদ্রব্যে কিছুই নেই, একদম উল্টো আছেন বিষ-বিষ-বিষ। পূর্বে লোকে কালেভদ্রে ঐ পাপগুলো খেতো; এখন শহরের লোক, বিশেষ করে বিদেশী যারা শহরে বাস করে, তাদের নিত্যভোজন হচ্ছে ঐ।…খিদে পেলেও কচুরি জিলিপি খানায় ফেলে দিয়ে এক পয়সার মুড়ি কিনে খাও, সস্তাও হবে, কিছু খাওয়াও হবে।”

 খাদ্যরসিক স্বামীজি বেঁচে থাকলে যে কতবড় মাপের পুষ্টিবিদ হতে পারতেন তা বলার অপেক্ষা রাখেনা।

আবার আরেক জায়গায় তাঁর এই প্রিয় কচুরি নিয়েই বিস্ফোরক উক্তি।

“ধনী হওয়া, আর কুঁড়ের বাদশা হওয়া–দেশে এককথা হয়ে দাঁড়িয়েছে।…যেটা লুচির ফুলকো ছিঁড়ে যাচ্ছে, সেটা তো মরে আছে।…যার দু’পয়সা আছে আমাদের দেশে, সে ছেলেপিলেগুলোকে নিত্য কচুরি মণ্ডামেঠাই খাওয়াচ্ছেন!! ভাত-রুটি খাওয়া অপমান!! এতে ছেলেপিলেগুলো নড়ে-ভোলা পেটামোটা আসল জানোয়ার হবে না তো কি? এত বড় ষণ্ডা জাত ইংরেজ, এরা ভাজাভুজি মেঠাইমণ্ডার নামে ভয় খায়..আর আমাদের…আব্দার লুচি কচুরি মেঠাই ঘিয়ে ভাজা, তেলেভাজা। সেকেলে পাড়াগেঁয়ে জমিদার এককথায় দশ ক্রোশ হেঁটে দিত,…তাদের ছেলেপিলেগুলো কলকেতায় আসে, চশমা চোখে দেয়, লুচি কচুরি খায়, দিনরাত গাড়ি চড়ে, আর প্রস্রাবের ব্যামো হয়ে মরে; ‘কলকেত্তা’ই হওয়ার এই ফল!!”

কচুরি, সিঙাড়া, খিচুড়ি, পলোয়ার পরে এবার আসি জিবেগজায়। কম বয়সে  বিলে জেলা জজ নরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যাযয়ের  বাড়িতে নিয়মিত যেতেন। উত্তরকলকাতার অন্যতম ট্র্যাডিশন ছিল দোরে দোরে মিষ্টি হেঁকে বিক্রি করা। কৈলাস ওয়ালা নানা রকমারি খাবার ঝুড়ি ভরে রোজ বাড়িতে দিত। সব ছেলেরা মিলে পরমানন্দে জলপান করত। কারুর দু’পয়সা বরাদ্দ, কারুর চারপয়সা, কারুর দু’আনা।…স্বামীজির জিবে গজা বড়ই প্রিয়, একদিন ওঁর বখরায় যা পেলেন, তাতে সন্তুষ্ট নন। একখানা গজা হঠাৎ তুলে নিয়ে সব্বাইয়ের সামনে নিজের জিবে ঠেকালেন এবং অম্লান বদনে হাঁড়ির মধ্যে টপ করে ফেলে হো হো করে হেসে বললেন, ওরে তোরা কেউ গজা খাসনি–এই য্যা–সব এঁটো হয়ে গেল। হাঁড়িসুদ্ধ একাই মেরে দিলেন। কী আমোদই না করতেন সেই ছোটো বয়স থেকেই!


আরো পড়ুন: বেদান্ত-বিরিয়ানির অভিনব ককটেল (পর্ব- ৪)


কাশীপুর উদ্যানবাটী পর্বে দেখতে পাচ্ছি মেজভাই মহিমকে কাশীপুরে আসতে দেখে বরানগরের বিখ্যাত ফাগুর দোকান থেকে গরম লুচি, গুটকে কচুরি ও কিছু মিষ্টি এনে খাওয়াতে।

আরেকদিনের কথা। নরেন একদিন গায়ক পুলিন মিত্রর মেস বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছেন। কচুরি ভেজে দেওয়া হয়েছে, খাচ্ছেন, খুব ভাল লেগেছে। একটু খেয়ে পুলিনকে দিলেন। পুলিন খাচ্ছেন। তখন নরেন আবার বলছেন–”এটা থেকেই একটু দেনা! বেশ চমৎকার, কি বলিস?”

এই বিবেকানন্দ মহাপ্রয়াণের কিছু আগে পাঁউরুটি নিয়েও প্রচণ্ড গবেষণা শুরু করেন তার প্রমাণ নীচে দিলাম। 

“একসময় তিনি লুচি কচুরির সঙ্গে পাঁউরুটিকেও প্রবল সন্দেহের চোখে দেখতেন। তিনি নিজের হাতে লিখেছেন : “ঐ যে পাঁউরুটি উনিও বিষ, ওঁকে ছুঁয়ো না একদম। খাম্বীর (ইস্ট) মেশালেই ময়দা এক থেকে আর হয়ে দাঁড়ান। …যদি একান্ত পাঁউরুটি খেতে হয় তো তাকে পুনর্বার খুব আগুনে সেঁকে খেও।”

আসলে নিজের এই কচুরি বা ময়দা প্রীতিই বুঝি নিঃশব্দ ঘাতকের মত শেষ করে দিয়েছিল তাঁর শরীর। ফল পেয়েছিলেন হাতেনাতে। মারণ মধুমেহর কবলে পড়ে।

স্বামীজির ভোজনবিলাস আর রন্ধন পারিপাট্য নিয়ে আমাদের জানার কোনও শেষ নেই।

 

Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,book add

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত