Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,Swami Vivekananda Indian monk part 5

বেদান্ত-বিরিয়ানির অভিনব ককটেল (পর্ব- ৬) । ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়

Reading Time: 3 minutes

বিবেকানন্দই একমাত্র ভারতীয় সন্ন্যাসী যিনি বেদান্ত ও বিরিয়ানিকে একই সঙ্গে পাশ্চাত্য দেশে প্রচারের দূরদর্শিতা অথবা দুঃসাহস দেখিয়েছিলেন। খোদ ইংল্যান্ডে ইন্ডিয়ান চিকেনকারি কে শ্বেতাঙ্গদের জাতীয় খাদ্যের স্বীকৃতি লাভই হোক কিম্বা ভারতীয় ডাল অথবা ভুনি খিচুড়িই হোক। 

ঠাকুরের দেহাবসানের পর দক্ষিণেশ্বরে তাঁর জন্মোৎসবে যে রান্নার মেনু নরেন্দ্রনাথ নির্ধারণ করেছিলেন, সেখানেও ব্যবস্থা হয়েছিল মুগের ডালের ভুনি খিচুড়ির সঙ্গে আলুকপির দম, দই, বোঁদে ইত্যাদি!

তিনিই সাম্প্রতিক কালে জোরের সঙ্গে প্রমাণ করলেন পোলাওটা খাঁটি ভারতীয়, বাইরে থেকে আমদানি করা মোগলাই খানা নয়। বোধ হয় এই প্রাচীন ভারতীয়ত্বের ওপর জোর দেওয়ার জন্যেই স্বামীজি মাঝে মাঝে পোলাও রাঁধবার জন্যে প্রবল উৎসাহী হয়ে উঠতেন।

রাজস্থানের খাওয়াদাওয়া প্রসঙ্গে একবার মহিষাদলের রাজার ম্যানেজার ভক্ত শচীন বসু মন্তব্য করলেন,”মহারাজ, ওরা কি খেতে জানে? সব তরকারিতে টক দেয়।”

স্বামীজি: ”তুমি বালকের মতো কথা কইছো যে!… সিভিলাইজেশন তো ওদের দেশেই ছিল–বেঙ্গলে কোন কালে ছিল? ওদের দেশে বড় লোকের বাড়ি যাও, তোমার ভ্রম ঘুচে যাবে।…আর তোমার পোলাওটা কি? লং বিফোর ‘পাক রাজ্যেশ্বর’ গ্রন্থ, পলান্নের উল্লেখ আছে; মুসলমানরা আমাদের নকল করেছে। আকবরের আইনি-আকবরীতে কি করে হিন্দুর পলান্ন প্রভৃতি রাঁধতে হয় তার রীতিমত বর্ণনা আছে।”

এর আগে লন্ডনেও স্বামীজি পোলাও প্রসঙ্গ নিয়ে নিজের মতামত জানিয়েছিলেন। ”পেঁয়াজকে পলাণ্ডু বলে–পল মানে মাংস। পেঁয়াজ ভেজে খেলে দুষ্পাচ্য, পেটের ব্যামো হয়, সিদ্ধ করে খেলে উপকার করে এবং মাংসের যে কস্টিভনেস’ থাকে সেটা নাশ করে।”

পোলাও পর্বের যেন শেষ নেই। প্রথমবার আমেরিকা যাবার আগে স্বামীজি বোম্বাইতে রয়েছেন, হঠাৎ ইচ্ছে হলো স্বহস্তে সকলকে পোলাও রেঁধে খাওয়াবেন। মাংস, চাল, খোয়া-ক্ষীর ইত্যাদি সকল প্রকার উপকরণ জোগাড় হল। এদিকে আখনির জল তৈরি হতে লাগল, স্বামীজি আখনির জল থেকে সামান্য কিছু মাংস তুলে খেলেন। পোলাও তৈরি হলো। স্বামীজি ইতিমধ্যে অন্য একটি ঘরে গিয়ে ধ্যান করতে লাগলেন। আহারের সময় সকলে বারবার তাকে খেতে অনুরোধ করলেন। কিন্তু তিনি বললেন, আমার খেতে কোনো ইচ্ছে নেই, তোমাদের একটা রেঁধে খাওয়ানো উদ্দেশ্য ছিল, সেজন্য ১৪ টাকা খরচ করে এক হাঁড়ি পোলাও রেঁধেছি-খাওগে যাও।” স্বামীজি আবার ধ্যানে বসলেন।

প্রবাসে কোথায় কোথায় কতবার তিনি পোলাও/খিচুড়ি রেঁধেছেন তার ইয়ত্ত্বা নেই।

 


আরো পড়ুন: বেদান্ত-বিরিয়ানির অভিনব ককটেল (পর্ব-৫)


আমেরিকার মাটিতে বসে হামানদিস্তা দিয়ে স্বামীজি মশলা গুঁড়ো করলেন। তিনি রান্নায় ঝাল বেশি তত দিতেনই, তার সঙ্গে লাল লঙ্কা চিবিয়ে খেতেন। ভক্তিমতী আইডা অ্যানসেলকে বললেন, “খেয়ে দেখো, এতে তোমার ভাল হবে।” আইডা পরে বলেছিলেন, “স্বামীজি বিষ দিলেও খেতাম। তাই খেলাম, কিন্তু ফল হলো অতীব যন্ত্রণাদায়ক।” মেমসায়েবদের কি অতো লঙ্কা সহ্য হয়! যদিও লঙ্কাটা এসেছে বলিভিয়া থেকে।

তাঁর রান্না খিচুড়ি অথবা পোলাওতে ঝাল কম হবার জো ছিলনা। হৃষিকেশে সেবার স্বামীজির কঠিন অসুখ হয়েছিল। একটু সুস্থ হয়ে খেতে চাইলেন। নিবিড় জঙ্গলে চাল-ডাল জোগাড় করে খিচুড়ি হবে। প্রিয় গুরুভাই রাখাল এক ডেলা মিছরি খিচুড়িতে দিলেন। ঝালখোর স্বামীজির খিচুড়ির আস্বাদ মোটেই ভাল লাগছে না। এমন সময় খিচুড়ির মধ্যে একটা লম্বা সুতো বেরুলো। অভিজ্ঞরা জানেন, তখনকার দিনে মিছরির মধ্যে এক আধটা সুতো থাকতো।সদ্য রোগ থেকে ওঠা স্বামীজির তীক্ষ্ণ প্রশ্ন, খিচুড়িতে সুতো কেন? সকলে বললো, এক ডেলা মিছরি ফেলেছে রাখাল। মহাবিরক্ত স্বামীজি সঙ্গে সঙ্গে পাকড়াও করলেন গুরুভাইকে। “শালা রাখাল, এ তোর কাজ, তুই খিচুড়িতে মিষ্টি দিয়েছিস।দুঃ শালা। খিচুড়িতে কখনও মিষ্টি দেয় রে? তোর একটা আক্কেল নেই!”

ইলিশ আর কই মাছ তাঁর প্রিয় খাবারগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল। মৃত্যুর দিনেও স্বামী বিবেকানন্দ দুপুরে ভাত আর ইলিশ মাছের ঝোল খেয়েছিলেন বলে জানা যায়। আম, আপেল, লিচু ও পেয়ারা ছাড়াও জল খাবারের পর কমলালেবু, আঙুর। সন্ধে ৬.৩০ টার মধ্যেই তাঁকে নৈশভোজ দেওয়া হত। অবসরে রান্নাবান্নায় সাহায্য করতেন তিনি, সবজি ও রুটি করতে ভালোবাসতেন বলে জানা যায়।

১৮৯৬ সালে লন্ডনে স্বামীজির ফল নিয়ে এক রহস্যময় ব্যাপার ঘটেছিল।তখন ওখানকার বিখ্যাত ফলের দোকানের নাম উইলিয়ম হোয়াইটলি। কোনো এক ভক্ত রহস্যজনকভাবে এই দোকানে নিজের পরিচয় গোপন করে বেশ কিছু টাকা জমা রেখে গিয়েছিলেন, প্রত্যেকদিন স্বামীজির বাড়িতে সেরা ফল হোম ডেলিভারির জন্য।

রোজ বেলা এগারোটার সময় হোয়াইটলির দোকান থেকে একজন কর্মচারি এসে কাগজে মোড়া বেশ কিছু ফল স্বামীজির বাসস্থানে দিয়ে যেতো।

কার আদেশে এই ফল আসতো সে রহস্য আজও পরিষ্কার হয়নি, তবে সন্দেহের তীর রয়েছে মিস জোসেফিন ম্যাকলাউডের দিকে। কারণ তিনি লন্ডনে আসার পর থেকেই অঘটন ঘটতে আরম্ভ করে।

সেবার লন্ডনে হঠাৎ কাঁচা লঙ্কা খাবার সাধ হলো স্বামীজির। খুঁজতে খুঁজতে অনেক সন্ধানের পর কৃষ্ণ মেনন মহার্ঘ্য তিনটি কাঁচালঙ্কা হোয়াইটলি থেকে সংগ্রহ করলেন।ঝাল নেই, তবে গন্ধ আছে। ব্রেকফাস্টে বসে লঙ্কাপ্রেমী স্বামীজি একের পর এক লঙ্কাগুলো খেয়ে নিলেন।

কলেজ স্ট্রিট পাড়ায় কথামৃতকার মাস্টারমশায়ের কাছে গিয়ে স্বামীজি তরমুজ খাবার ইচ্ছা প্রকাশ করছেন। আমরা দেখেছি, তিনি একাধিক ভক্তকে দীক্ষান্তে গুরুকে লিচুর গুরুদক্ষিণা দেবার পরামর্শ দিচ্ছেন। আবার বেলুড় মঠে যে বিশাল সাইজের কাঁঠাল ফলেছে তার প্রশস্তি গেয়ে সে সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে বিদেশিনী শিষ্যা ক্রিস্টিন কে চিঠিও লিকেছিলেন তিনি ।

শেষপর্বে আমরা দেখছি, ডায়াবিটিসে কাতর স্বামীজি বড় জাগুলিয়ায় তার বোনের বাড়ি থেকে সেরা জাম নিয়ে বেলুড় মঠে ফিরে কালোজামের রসকে বোতলবন্দি করে ছিপি এঁটে প্রসেসড করতে কারণ মধুমেহর অব্যর্থ ওষুধ হল এই জাম।

 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>