Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,Swami Vivekananda Indian monk part 5

বেদান্ত-বিরিয়ানির অভিনব ককটেল (পর্ব- ৭) । ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়

Reading Time: 3 minutes

এবার দেখি শ্রীসারদা মায়ের মুখে তাঁর সন্তানসম নরেনের রান্নার কথা।

ঠাকুরের জন্য রান্নার কথায়া মা বলছেন, “আমি যখন ঠাকুরের জন্য রাঁধতুম কাশীপুরে, কাঁচা জলে মাংস দিতাম। কখানা তেজপাতা ও অল্প মশলা দিতুম, তুলোর মতো সিদ্ধ হলে নামিয়ে নিতুম।…নরেন আমার নানারকমে মাংস রাঁধতে পারত। চিরে চিরে ভাজত, আলুচটকে কিসব রাঁধত, তাকে কি বলে?” বোধ হয় চপ-কাটলেট হবে।

এই মা কে পরের দিকে দেখেছি নরেনের জন্য মোটা মোটা আটার রুটি আর ছোলার ডাল বানাতে।

ভগিনী নিবেদিতাকে মহাপ্রস্থানের ঠিক আগে নেমন্তন্ন করে বিবেকানন্দ অনেককিছুর সঙ্গে  খাইয়েছিলেন বাংলার কাঁঠালবিচি সেদ্ধ।

তখন স্বামীজির কবিরাজি চিকিৎসা চলছে। জলখাওয়া বন্ধ, শুধু দুধ পান করে পাঁচসাতদিন চলছে।

মঠে এক শিষ্য একটি রুইমাছ ঠাকুরের ভোগের জন্য এনেছে।

“মাছ কাটা হলে ঠাকুরের ভোগের জন্য অগ্রভাগ রাখিয়া দিয়া স্বামীজি ইংরেজি ধরনে রাঁধিবেন বলিয়া কতকটা মাছ নিজে চাহিয়া লইলেন। আগুনের তাতে পিপাসার বৃদ্ধি হইবে বলিয়া মঠের সকলে তাহাকে রাঁধিবার সঙ্কল্প ত্যাগ করিতে অনুরোধ করিলেও কোন কথা না শুনিয়া দুধ, ভারমিসেলি, দধি প্রভৃতি দিয়া চার-পাঁচ প্রকারে ওই মাছ রাঁধিয়া ফেলিলেন। …কিছুক্ষণ পরে স্বামীজি জিজ্ঞেস করিলেন, “কেমন হয়েছে? শিষ্য বলিল, এমন কখনও খাই নাই।…ভারমিসেলি শিষ্য ইহজন্মে খায় নাই। ইহা কি পদার্থ জানিবার জন্য জিজ্ঞাসা করায় স্বামীজি রসিকতা করিলেন, “ওগুলি বিলিতি কেঁচো। আমি লন্ডন থেকে শুকিয়ে এনেছি।”

এই শিষ্যই আরও পরে স্বামীজির মহাসমাধির অতি সামান্য আগে আহিরিটোলার ঘাটে গঙ্গাতীরে গুরুকে আবার দেখেছিল। স্বামীজির বাঁ হাতে শালপাতার ঠোঙায় চানাচুর ভাজা, বালকের মতো খেতে খেতে আনন্দে পথ ধরে এগোচ্ছেন।

স্বামীজি বললেন, “চারটি চানাচুর ভাজা খা না? বেশ নুন-ঝাল আছে।” শিষ্য হাসতে হাসতে প্রসাদ গ্রহণ করলেন।

ছোটবেলার স্মৃতিতে উদ্বেলিত হয়ে স্বামীজি একদিন বেলুড় মঠে বসে প্রকাশ্যে পাড়ার ফুলুরিওয়ালা হতে চাইলেন। উনুন জ্বললো, কড়া বসলো, তেল ঢালা হলো। ফাটানো বেসন গরম তেলে ছেড়ে, পিঁড়িতে বসে বিশ্ববিজয়ী বিবেকানন্দ হয়ে উঠলেন ফুলুরিওয়ালা নরেন। ছোটবেলায় সিমলা পাড়ায় যেমন দেখেছেন ফুলুরিওয়ালাকে। বেলুড়ের মাঠে হাঁক ছেড়ে খদ্দের ডেকে স্বামীজি মহানন্দ পেতে লাগলেন।রান্না ছিল তাঁর জীবনের অন্যতম প্যাশন।

এসব দৃশ্য কিন্তু স্বদেশ কিংবা কলকাতায় সীমাবদ্ধ নয়। সেবার ট্রেনে যেতে যেতে একজন মুসলমান ফেরিওয়ালাকে ফার্স্ট ক্লাসের সামনে ছোলা সেদ্ধ হাঁকতে দেখে সেবককে স্বামীজি বললেন, “ছোলা সেদ্ধ খেলে বেশ হয়, বেশ স্বাস্থ্যকর জিনিস”.. ছোলাওয়ালাকে একটা সিকি দেওয়ায় স্বামীজি তার সেবককে বললেন, “ওরে ওতে ওর কি হবে? দে একটা টাকা দে।” স্বামীজি ছোলা কিনলেন, কিন্তু খেলেন না। মনে হয় ফেরিওয়ালাটিকে কিছু দেবার জন্যেই এই ছোলা কিনেছিলেন সেদিন।

কিন্তু লস এঞ্জেলেসে একের পর এক জগৎ-কাঁপানো বক্তৃতা করে সাড়া ফেলছেন তিনি। আয়োজকদের একজন কিছু আলোচনার জন্য স্বামীজির সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এসে দেখলেন, তিনি আপনমনে চিনেবাদাম ভাজা চিবোচ্ছেন। মানুষটির সরলতা দেখে সায়েবটি মুগ্ধ।

স্বামী বিরজানন্দসহ দলবল নিয়ে মায়াবতী থেকে বেরিয়ে পড়েছেন স্বামীজি। প্রথমে চম্পাবত, সেখান থেকে ডিউরির ডাক বাংলো।

রান্নার দায়িত্বে রয়েছেন স্বামী বিরজানন্দ। হাঁড়ির আকারের তুলনায় চাল বেশি হওয়ায়, ভাত আধসিদ্ধ হয়ে উথলে পড়ছে, আর ক্ষিদে পাওয়ায় স্বামীজি লোক পাঠিয়ে খবর নিচ্ছেন, রান্নার কত দেরি।

বিরজানন্দ ভাবছেন, খানিকটা ভাত নামিয়ে নিয়ে বাকি ভাত আরও জল দিয়ে ফুটোবেন। এমন সময় স্বামীজি রান্নার জায়গায় ঢুকে অবস্থা পর্যালোচনা করে প্রিয় শিষ্য বিরজানন্দকে বললেন, “ওরে ওসব কিছু করতে হবে না। আমার কথা শোন–ভাতে খানিকটা ঘি ঢেলে দে, আর হাঁড়ির মুখের সরাখানা উলটে দে, এখনই সব ঠিক হয়ে যাবে, আর খেতেও খুব ভাল হবে।”

রন্ধনবিদ গুরুর ম্যাজিকে সেদিনকার সেই ঘি ভাত সবার উপাদেয় লেগেছিল।

অনেকের সবিনয় অনুসন্ধান, “খাওয়ার জন্যে অযথা দীর্ঘসময় অপেক্ষা করতে হলে স্বামী বিবেকানন্দ কি একটু অধৈর্য হয়ে উঠতেন?”

সময়ানুবর্তিতার প্রতি স্বামীজির প্রবল আকর্ষণ–শুধু নিজের জন্য নয়, সকলের জন্য।

সুদূর আমেরিকা থেকে স্বামী রামকৃষ্ণানন্দকে (১৮৯৫) স্বামীজি নির্দেশ দিচ্ছেন : “ভোগের নামে সকলকে পিত্তি পড়িয়ে বাসি কড়কড়ে ভাত খাওয়াবে না।”

সময় মার্চ ১৮৯৯, স্থান বেলুড় মঠ।

মানসকন্যা নিবেদিতা এবং রবীন্দ্রনাথের ভাগ্নী সরলা ঘোষালকে এক রবিবারে তিনি যে লাঞ্চ খাইয়েছিলেন তার মধ্যে দিয়ে সারাবিশ্বের ছায়া নামিয়ে এনেছিলেন বিশ্বপথিক বিবেকানন্দ।


আরো পড়ুন: বেদান্ত-বিরিয়ানির অভিনব ককটেল (পর্ব- ৬) । ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়


এই লাঞ্চের মাত্র কয়েকদিন আগে বিনা নোটিসে সিস্টার নিবেদিতাকে তিনি সাপার খাইয়েছিলেন বেলুড়ে। তার মেনু :

কফি, কোল্ড মাটন, ব্রেড অ্যান্ড বাটার।

স্বয়ং স্বামীজি পরম স্নেহে পাশে বসে খাইয়ে নিবেদিতাকে বোটে করে কলকাতায় ফেরত পাঠিয়েছিলেন। আর রবিবারের সেই অবিস্মরণীয় লাঞ্চের ধারাবিবরণী নিবেদিতা রেখে গিয়েছেন মিস ম্যাকলাউডকে লেখা এক চিঠিতে।

“সে। এক অসাধারণ সাফল্য! তুমি যদি সেখানে থাকতে!” স্বয়ং স্বামীজি রান্না করেছেন, পরিবেশনও তিনি নিজে করলেন। “আমরা দোতলায় একটা টেবিলে বসেছি। সরলা পুবমুখো হয়ে বসেছিল যাতে গঙ্গা দেখতে পায়।”

এই ভোজনের নাম নিবেদিতা দিয়েছিলেন ‘ভৌগোলিক’ লাঞ্চ, কারণ সারা বিশ্বের রান্না একটি টেবিলে জমায়েত হতে শুরু করেছে। সব বেঁধেছেন স্বামীজি। রাঁধতে রাঁধতে তিনি একবার নিবেদিতাকে তামাক সাজতে নির্দেশ দিয়েছেন। সেই অবিস্মরণীয় মেনুর কথা।

১। আমেরিকান অথবা ইয়াঙ্কি–ফিস্ চাউডার।

২। নরওয়েজিয়ান ফিস বল বা মাছের বড়া–”এটি আমাকে শিখিয়েছেন ম্যাডাম অগনেশন”–স্বামীজির রসিকতা।

৩। ইংলিশ না ইয়াঙ্কি? –ববার্ডিং হাউস হ্যাঁশ। স্বামীজি আশ্বাস দিলেন ঠিকমতন রান্না করা হয়েছে এবং পেরেক মেশানো হয়েছে। “কিন্তু পেরেক? তার বদলে আমরা পেলাম লবঙ্গ!–আহা পেরেক না থাকায় আমাদের খুব দুঃখ হতে লাগলো।”

৪। কাশ্মিরী মিন্সড পাই (আ লা কাশ্মির) অর্থাৎ বাদাম ও কিসমিস সহ মাংসের কিমা!

৫। বেঙ্গলি রসগোল্লা ও ফল।

এক মেন্যুর মধ্যে দিয়ে বিশ্বায়নের ভাবনা সে যুগে! ভাবা যায়?

আরেকটি খোদ ১৮৯৬ সালের রিপোর্ট! ভেজিটারিয়ান মিস হেনরিয়েটা মুলারের বাড়িতে সান্ধ্য আহার–দুধ দিয়ে মোটা ম্যাকারনি স্যুপ। তাতে নুন দেওয়া ছিল–অদ্ভুত এই ইংরেজ জাত, দুধে নুন মেশাতে ভয় করে না। বিবেকানন্দ তাঁর গুরুভাই নবাগত স্বামী সারদানন্দকে শেখালেন, কেমন করে চামচ ধরতে হয় এবং কীভাবে স্যুপ খেতে হয়। একবার টেবিলের তলায় সারদানন্দের পা চেপে ধরে ইঙ্গিত দিলেন নাইফ সবসময় ডান হাতে ধরতে হয়, কখনই বাঁ হাতে নয়।

সারদানন্দকে স্বামীজি বললেন, “বাঁ হাতে কাটা দিয়ে মুখে তুলতে হয় অত বড় বড় গরস করে না, ছোট ছোট গরস করবি। খাবার সময় দাঁত জিভ বার করতে নেই, কখনও কাশবি না, ধীরে ধীরে চিবুবি। খাবার সময় বিষম খাওয়া বড় দূষণীয়; আর নাক ফোঁস ফোঁস কখনও করবি না।” এর থেকে বোঝা যায় খাওয়াটা শুধুই খাওয়া নয়। একটা শিল্পও বটে।

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>