| 23 এপ্রিল 2024
Categories
গীতরঙ্গ

গীতরঙ্গ: কী মিষ্টি, দেখ মিষ্টি । সংগ্রামী লাহিড়ী

আনুমানিক পঠনকাল: 3 মিনিট

ভবানীপুরের প্রাচীন ও ঐতিহ্যশালী মল্লিকবাড়ির দুর্গাপুজো বিখ্যাত। চিত্রতারকা রণজিৎ মল্লিকের বাবা উপেন্দ্রচন্দ্র মল্লিক ছিলেন মজলিশী মানুষ। বন্ধু বান্ধবদের নিয়ে প্রায়ই আড্ডা বসাতেন। বহু গুণী মানুষ আসতেন সে আড্ডায়। একবার কথা উঠল ছোটদের নিয়ে। বাবা-মা আজকাল পড়া পড়া করে বড্ড জ্বালাতন করছে। সারাদিন ঠাসা রুটিন, বইয়ের ভারে পিঠ বেঁকে যায়, কারোর সঙ্গে কথা বলারও সময় নেই, খেলাধুলো দূরে থাক।প্রবীণ, বয়স্ক ব্যক্তিরা অশনি সংকেত দেখছেন। ছোটরা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে তাদের বৃহত্তর পরিবার থেকে।

এক মজলিশে এটা নিয়ে আলোচনা হল। কেউ স্যাটায়ার, কেউ গল্প বা কবিতার মাধ্যমে ছোটদের করুণ অবস্থাটা তুলে ধরলেন। তারপর এল রামকুমার চট্টোপাধ্যায়ের পালা। পুরাতনী গানে তাঁর তখন খুব নাম।নিজের তৈরী করা একটি মজার গান শোনালেন, তাতে কতরকম সুখাদ্যের কথা যে আছে! গান শুনেই জিভে জল।

সেই দিন নাই আর নাইও

কেউ এসে বলবে না আমাদের বাড়ি তুমি যাইও

ঘরে পাতা দই দিয়াভাজা মুড়ি খৈ মেখে

পেট পুরে যত খুশি খাইও।

সেই দিন কি গেল কইও

কেউ কেউ বলবেন তুমি তো ঘরের লোক হইও

আমাদের বাড়ি গিয়া আমে জামে দুধে ভাতে

যতদিন তত খুশি খাইও।”

মজার গান হলেও কোথায় যেন একটু বিধুর সুর বাজে। আপন করে নেওয়ার মানুষগুলো কোথায় হারিয়ে যাচ্ছে!সেইসঙ্গে ঘরে-তৈরী মিষ্টি খাবার, যার আস্বাদের তুলনা নেই, গানটিকে অন্য মাত্রায় নিয়ে গেল গানে খাবারের উল্লেখ অবশ্য এই প্রথম নয়, রামকুমার চট্টোপাধ্যায় নিজেই অনেক গান গেয়েছেন যাতে রসনাতৃপ্তির অঢেল আয়োজন।

আসলে পুরাতনী বা বৈঠকি গানের জলসায় আমোদপ্রমোদের বিরাট আয়োজন থাকত। পেটপুজো তার অন্যতম অঙ্গ। সুখাদ্যে ও পানীয়ে আপ্যায়িত হতেন আমন্ত্রিত ব্যক্তিরা। সেই খাওয়াদাওয়ার বর্ণনা গানের কথায় তো উঁকিঝুঁকি মারবেই!
 
সময়ের সঙ্গে দুশো বছর পিছিয়ে যাওয়া যাক। রসরাজ অমৃতলাল বসু সে আমলের বাংলা রঙ্গমঞ্চের সুখ্যাত নট ও নাট্যকার।গিরিশ ঘোষের অভিন্নহৃদয় সহচর। হাসির গান বাঁধতে তাঁর জুড়ি ছিল না। গানগুলি সেসময় মঞ্চে ব্যবহার হত।এমনই একটি গানে আমরা শুনি এক রাজ্যের কথা, সে রাজ্যের মানুষের নিত্যকারের খাবারের বিবরণ।মজার ব্যাপার এই যে, যার যেমন সামাজিক অবস্থান, সেই অনুসারে তার রোজের খাবার। শ্রেষ্ঠ ভাগ রাজামশাইয়ের।নিরামিষাশী মন্ত্রীমশাইয়ের খাদ্যতালিকায় শুধুই নানারকমের মিষ্টান্ন।তারপর রানি, সান্ত্রী, সেপাই ইত্যাদি হয়ে আমজনতা প্রজার ভাগে আর কিছু জোটে না। ভৈরবী রাগে হালকা চালে বাঁধা গান, কিন্তু বড় গভীর কথা বলে। শ্রদ্ধেয় রামকুমার চট্টোপাধ্যায়ের গলায় আছে গানটি।

রাজা খান দাদখানিভেটকি মাছের আধখানি

ন্যাজাখান খাবেন রানিগুঁড়োগাঁড়া রাজছানা।

মন্ত্রী সব নিরামিষভোজীপ্যাঁজ রসুনে তাই অরুচি

তাদের ভোগে লাগে রোজইদইসন্দেশ মিহিদানা।

শান্তি রাখেন নগর কোটালতিনি আবার মস্ত দাঁতাল

খান তাই সকাল বিকালকচি পাঁঠার ডালনা।

যত সব সান্ত্রীসিপাই কাজের বেলা কেহ তো নাই

তাদের জোটে কপালে তাই সুসিদ্ধ ডগকাখানা

প্রজারা মায়ের ছেলেবিরাজে মাটির কোলে

দেশ রবে না তারা খেলেতাদেরই খাওয়া মানা।“

বৈঠকি এই হাসির গানটির প্রথমাংশ গেয়ে শোনালাম।

রবীন্দ্রনাথের সমসাময়িক ‘কান্তকবি’ রজনীকান্ত সেন ছিলেন মিষ্টান্নে মোহিত। প্রায় তিনশোটি গান লিখেছেনপ্রাঞ্জলতাই গানগুলির শ্রেষ্ঠ আকর্ষণ। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের সঙ্গে দেখা হবার পর রজনীকান্ত উৎসাহিত হয়ে রম্যগীতি রচনায় হাত দেন। বেশ কয়েকটি হাসির গানের মধ্যে মিষ্টি নিয়ে গানটি অভিনব। কুমড়োর মত যদি ছাতে পান্তুয়া ফলতকিংবা সর্ষের ক্ষেতে মিহিদানামিষ্টিদাঁতের (Sweet tooth) পেটুক বাঙালির আর কী চাইবার আছেমনোহরসাই কীর্তন রীতিতে গাওয়া হয় গানটি।

যদি কুমড়োর মতচালে ধরে রত,

পানতোয়া শত শত;

আরসরষের মতহত মিহিদানা

বুঁদিয়া বুটের মত!…

যদি তালের মতন হত ছানাবড়া,

ধানের মত চসি:

আর তরমুজ যদিরসগোল্লা হ

দেখে প্রাণ হত খুশি !…

যেমন সরোবর মাঝেকমলের বনে,

কত শত পদ্মপাতা,

তেমনি ক্ষীরসরোবরেকত শত শত লুচি,

যদি রেখে দিত ধাতা!

যদি বিলিতি কুমড়োত লেডিকিনি,

পটোলের মত পুলি;

আর পায়েসের গঙ্গাবয়ে যেত পান,

করতাম দুহাতে তুলি।…”

কল্যাণী” কাব্যগ্রন্থের এই গান কান্তকবির মিষ্টিপ্রীতির সাক্ষী। বিংশ শতকের প্রথমদিকে শরৎচন্দ্র পন্ডিত ছিলেন হাস্যরসের খনি। দাদাঠাকুর নামে আমজনতা চিনত। গান লিখে গেছেন অনেকমূলত হাসির গান। তেমনই একটি গানে প্রেমিকপ্রেমিকার মানঅভিমানের কাহিনি বলা আছে। মানিনী প্রেমিকারাধার মতই অভিমানিনী। প্রেমিক সে অভিমান ভাঙতে কত চেষ্টাই না করছে। সেই মানভঞ্জন নিয়ে দাদাঠাকুর গান বাঁধলেন। খেতে কে না ভালোবাসেবাগদা চিংড়িজিভে গজারসগোল্লা তো জিভে জল আনবেই। তাই প্রেমিক তার প্রেমিকাকে তুলনা করল ভালো ভালো খাবারের সঙ্গে। অভিনব আইডিয়াসুখাদ্যের মেলা বসেছে তাঁর লেখা এই মজার গানে। সবই প্রেমিকার জন্যেযাতে মানিনীর অভিমান ভাঙে!

সুন্দরী কার কথায় করেছো এতো মন ভারী

আমি যেখানে সেখানে থাকি অনুগত তোমারি।

প্রিয়ে তুমি বালাম চালতুমি অড়হর ডাল

তুমি আমার মাছের অম্বল জানি চিরকাল,

তুমি আমার বাগদা চিংড়িউচ্ছে পটল চচ্চড়ি।

কার কথায় করেছো এতো মন ভারী।

প্রিয়ে তুমি পাঁউরুটি যেন জিভে গজাটি

রসগোল্লা রসে ভরা মোহনভোগ রুটি

তুমি আমার কাঁচাগোল্লা তুমি আমার কচুরি।

কার কথায় করেছো এতো মন ভারী।

তুমি পিপাসার বারি যেন জল দেবার ঝারি

রোদের ছাতা শীতের কাঁথা মশার মশারি

তুমি আমার মাথার মণি আয় তোরে মাথায় ধরি।

কার কথায় করেছো এতো মন ভারী।“

গানখানি যেন রসগোল্লার রসে ভরাগেয়ে শোনাচ্ছি একটু।

গান ছেড়ে এবার গাইয়েদের দিকে একটু চোখ ফেরানো যাক।

বিহারের গয়ায় খ্যাতিমান ধনী গোবিন্দলালের বাড়িতে গানের মজলিস।মৌজুদ্দিন গাইবেন। অভ্যর্থনা হচ্ছে আতর-এলাইচ, গোলাপজলের ছড়া আর সোনা-রূপার তবকে মোড়া পান দিয়ে। বাদাম-পেস্তা দেওয়া সিদ্ধির পানীয় হাতে হাতে ঘুরছে। মৌজুদ্দিনের তখন রীতিমত নাম-ডাক, তাঁর মিষ্টি, সুরেলা গলার অবিশ্বাস্য কারুকাজ শ্রোতাদের আচ্ছন্ন করে রাখে। আসরে উপস্থিত সবার সঙ্গে অল্পস্বল্প আলাপ করে মৌজুদ্দিন আসরের জন্যে ‘তৈরি হতে’ গেলেন। তৈরি হওয়ার অর্থ মিঠাই সেবন। পুরী-হালুয়া-রাবড়ি ইত্যাদি সহযোগে কন্ঠশুদ্ধি হল। এবার মৌজুদ্দিন পুরোপুরি তৈয়ার। সুরের জাদুতে আচ্ছন্ন করলেন শ্রোতাদের।

পাতিয়ালা ঘরানার ওস্তাদরা গানে বসার আগে পেটভরে খেয়ে নিতেন। হালুয়া-রাবড়ি-মিঠাইয়ের গুণেই বোধহয় গান হত মিষ্টি, সুরেলা। পাতিয়ালা ঘরানার অগ্রজ কালে খাঁ, তাঁর ভাইপো ও শিষ্য বড়ে গোলাম আলি খাঁ, সবাই ছিলেন মিঠাই-ভক্ত। সেরা ঘি দিয়ে তৈরী সেরা হালুয়াটি না পেলে তাঁদের মেজাজ আসত না, গলা খুলত না।

বড়ে গোলাম আলি খাঁ ঘি নিয়ে খুব খুঁতখুঁতে ছিলেন। আসলি লুধিয়ানার ঘি তাঁর চাইই চাই। পঞ্চাশের দশকে একবার কলকাতায় থাকার সময় তাঁর ঘি ফুরিয়ে গেল। ঘিয়ের অভাবে খাঁ সাহেব বাক্স-প্যাঁটরা গোছাবার হুকুম দিলেন। তখন কলকাতায় তাঁর পর পর আসর, কনফারেন্স। তিনি কলকাতা ছেড়ে গেলে সর্বনাশ হবে! কর্তারা ছুটে এলেন। যে বাড়িতে ছিলেন, সেটি কলকাতার বিখ্যাত ধনী ও স্টিভেডর সন্তোষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ি। বাড়ির কর্তাও ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। বাজার থেকে টিন টিন নামীদামী ঘি আনা হল। কোনোটাই পছন্দ নয়। চেহারা দেখেই বাতিল করে দিলেন। কর্তাব্যক্তিদের শত উপরোধেও খাঁ সাহেব অনড়, পরের দিনই ফিরে যাচ্ছেন। লুধিয়ানার ঘিয়ের মিঠাই-বিরিয়ানি ছাড়া গান হয় না।

সেবার অনেক কষ্টে দুদিন সময় চেয়ে নিয়ে লুধিয়ানা থেকে ঘি আনানো হল। খাঁ সাহেব থেকে গেলেন। সবাই হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। কলকাতা বড়ে গোলাম আলির গান শুনতে পেল।

আমার গুরু বিষ্ণুপুর ঘরানার প্রতিনিধি সঙ্গীতাচার্য অমিয়রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় অসামান্য সংযমী ও মিতাহারী। মিষ্টি ভালোবাসেন। পরিমাণে অল্প খানকিন্তু গুণমানে সেরা হওয়া চাই। কোয়ান্টিটি নয়কোয়ালিটিতে বিশ্বাসী। উত্তর কলকাতায় রামদুলাল সরকার স্ট্রিটের একটি একটি বিশেষ দোকানের সন্দেশ তিনি পছন্দ করেন। গিরিশ চন্দ্র দে ও নকুড় চন্দ্র নন্দীর মিষ্টির দোকানটির বয়স হল একশো পঁচাত্তরেরও বেশি। কলকাতার প্রাচীনতম মিষ্টির দোকানঐতিহ্যে ভরপুর। তাঁদের তৈরি করা তালশাঁস সন্দেশ সঙ্গীতাচার্যের বিশেষ প্রিয়। যেখানে থাকেন সে অঞ্চলে কাছাকাছির মধ্যে রয়েছে সেন মহাশয়। অভাবে তাকে দিয়েও চালিয়ে নেন। এ দু’টির বাইরে আর কোনো দোকানের মিষ্টি নৈব নৈব চ।

গিরিশ-নকুড়ের সন্দেশের গুণে পঁচানব্বইয়ের তরুণ সঙ্গীতাচার্যের গলা আজও তুলতুলে ছানার মতোই মোলায়েম, আসরে শ্রোতারা মন্ত্রমুগ্ধের মত শোনেন তাঁর ঠাসবুনোট তান, তানের মধ্যে কৌশলে ভরে দেওয়া ছোট ছোট মুড়কি, অলংকার। ঠিক যেন একটি নলেন গুড়-ভরা কড়াপাকের সন্দেশ!

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত