| 18 এপ্রিল 2024
Categories
গল্প সাহিত্য

কিছু কথা ছিলো বাকি

আনুমানিক পঠনকাল: 7 মিনিট

কলেজে ঢুকে ডিপার্টমেন্টের সামনে এগোতেই একটা জটলা দেখতে পেলো সৌমিত্র। তৎসঙ্গে বেশকিছু ছেলেমেয়ের গলার আওয়াজ। যদিও সেটাকে আওয়াজ না বলে চিৎকার বলাই বাঞ্চনীয়। তবে তারমাঝে যে মেয়েলি কন্ঠস্বর ওর কানে তীব্র ফলার মতো ঢুকছে, মুখ না দেখেও বুঝতে বাকি রইল না তিনি কে। মুহুর্তেই মনটা বিষিয়ে উঠলো ওর। এই মেয়েটি কি কলেজে শুধু ঝগড়া আর টাকার গরিমাই দেখাতে আসে ! অবশ্য করবে নাইবা কেন! বাপের অঢেল সম্পত্তির একমাত্র উত্তরাধিকারী তো তিনিই। আর সেটা সবাইকে না বোঝাতে পারলে তো চরম লজ্জাজনক ব‍্যাপার। তবে এক্ষেত্রে শুধুমাত্র  অর্থপ্রাচুর্যকে দায়ী করা যায় না, ভগবানও কিছুটা হলে তার অংশীদার। তিনি যেনো নিজের অবসর সময়ে নিখুঁত ছাঁচে ঢেলে গড়েছেন এই রক্তমাংসের প্রতিমাকে। রূপের ছটাতেই তো আসমুদ্রহিমাচল কাঁপিয়ে চলেছেন তিনি। কলেজের ছেলেগুলো তো এমনভাবে তাকিয়ে থাকে, যেনো জন্মের অভুক্ত এক একটা শেয়াল। আর মেয়েগুলো হিংসের জ্বালায় সামনে কিছু বলার সাহস না পেয়ে পেছনে বাক্যগ্রেনেড ছোঁড়ে। যদিও তাতে ওনার খুব একটা ফারাক পড়ে বলে মনে হয়না সৌমিত্রর। উপরন্তু মেয়েটা যেনো এইসব তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করে। একটুসময় চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে অন‍্যবারের মতো এবারও আর পাঁচজন উৎসাহী জনতার ভিড়ে নাক না গলিয়ে পাশ কাটিয়ে নিজের ক্লাসে ঢুকে পড়ল সৌমিত্র। আজকাল কলেজে পড়াশোনা কম, নাটক বেশি হয়।সৌমিত্রর তো কখনো কখনো মনে হয়, মোটা টাকা ডোনেশন পেলে একটা গাধাকেও ওরা অবলীলায় এডমিশন দিয়ে দেবে।
-কিরে, তুই এখানে চুপচাপ বসে আছিস যে?
এইসব ভাবনার ভিড়ে হঠাৎ একটা গলার আওয়াজে মাথা তুলে দেখল নিলয় ক্লাসে ঢুকে অবাক চোখে ওরদিকে তাকিয়ে আছে।
-মাথাটা এখনো এতোটাও খারাপ হয়নি যে ফাঁকা ক্লাসে একা একা চেঁচাবো।
-নাহ্ মানে বাইরে তো সাইক্লোন চলছে, আর তুই এখানে, তাই জিজ্ঞেস করলাম আরকি। থতমত খেয়ে বলল নিলয়।
-সেতো বিগত তিনবছর ধরেই চলছে। ক্ষয়ক্ষতি বেশি হলে বলিস, তখন নাহয় অন‍্যত্র শেল্টার খুঁজব। বইয়ের পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে নির্বিকারস্বরে বলল সৌমিত্র।

-আরে ল‍্যাবে এক্সিডেন্টালি আঙুলে একটু কেমিক‍্যাল পড়েছে হয়তো, তাতেই এমন সিন ক্রিয়েট করেছে যেনো হাতটাই পুড়ে গেছে। সত‍্যি মেয়েটা এতো এট‍্যানশন সিকার যে কখনো কখনো খুব বিরক্তি লাগে। 
-তাই বুঝি? আপনাকে দেখে তো তেমনটা মনে হয়না। মুখটা ভেংচে বলল সৌমিত্র।
-দেখ, আমার তো আর তোর মতো পাষাণহৃদয় নয় যে সবসময় চোখের সামনে ঊর্বশী, মেনকাদের দেখেও বুকে কাঁপুনি ধরবে না। নিলয়ও পাল্টা খোঁচা মেরে বলল।
-তোদের মতো বাপের টাকায় বিলাসিতা করার ক্ষমতা নেই বলেই হয়তো বুকে কাঁপুনি ধরে না।
কথাটা মনে মনে বললেও চোখের সামনে বাবার মুখটা ভেসে উঠলো সৌমিত্রর। সরকারি পোস্টঅফিসে একটা কেরানির চাকরি করে কতই বা মাইনে পেতেন সুবিমলবাবু। তবু দুই ছেলেমেয়ের পড়াশোনার খরচায় কখনো কার্পণ্য করেননি। প্রয়োজনে পরিশ্রমের মাত্রা বাড়িয়েও দুটো টাকা বেশি রোজগার করেছেন, যাতে সন্তানদের উপর অভাব অনটনের ছায়া না পড়ে। কিন্তু সবকিছুর শেষে তিনিও তো রক্তমাংসের মানুষ, যন্ত্র নয়। তাই মুখে না বললেও ইদানিং যে সুবিমলবাবুর শরীর ওনার অদম্য মনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সমান পরিশ্রম করতে পারছে না, তা খুব স্পষ্ট সৌমিত্রর কাছে।বর্তমানে ওর একটাই লক্ষ্য, কলেজ শেষ করে যেভাবেই হোক, ওকে একটা চাকরি পেতে হবে।তাতে বাবার কাঁধের বোঝা সম্পূর্ণ না হলেও কিছুটা তো লাঘব হবে।
এই জল আছে তোর কাছে ?
হঠাৎ পাশের জায়গায় সজোরে একটা ঝাঁকুনিতে চিন্তার জাল কেটে বর্তমানে ফিরে এলো সৌমিত্র। না তাকিয়েই বিরক্তস্বরে সংক্ষিপ্ত উত্তর দিলো,
-না।
-ইসস! রোজ তো গাদা গাদা বই নিয়ে আসিস। আর জল আনার বেলায় এতো কিপ্টেমি কেনো তোর? চিল্ ড‍্যুড, শুধু জলই চাইছি, অন‍্যকিছু তো নয়। অবশ্য চাইলেও তুই দিবি কিনা সন্দেহ আছে।
কিছু মনে করিস না বিদিতা, তোর এসব জঘন্য ইয়ার্কিতে অন‍্যসবাই ইমপ্রেস্ড হয়ে তোর পিছনে আরো বেশি ছোঁকছোঁক করলেও আমার কিন্তু একফোঁটাও ভালো লাগে না। বেকার নিজের সময় আর এনার্জি নষ্ট করিস। তাই যেখানে তোর এসব নাটুকেপনার কদর আছে, সেখানেই করগে প্লিজ।” এবার আর থাকতে না পেরে বেশ রূক্ষ্মস্বরেই কথাগুলো বলে উঠল সৌমিত্র।
-যাহহ্ বাওয়া! হঠাৎ এতো খচে গেলি কেন? মানছি মেয়েদের প্রতি তোর একটা বিশেষ এলার্জি আছে, তাবলে ফ্রেন্ডলি কথাবার্তাতেও কি আজকাল তোর প্রবলেম হচ্ছে? অবাক হওয়ার ভান করে জিজ্ঞেস করল বিদিতা।
-উই আর নট ফ্রেন্ডস। গম্ভীরস্বরে বলল সৌমিত্র।
-সেটা তোর মনে হয়। আমার কাছে তো তুই আমার প্রাণাধিক প্রিয় বন্ধু। তাইতো দেখ্, ভগবানও আমাদের একসঙ্গে মিলিয়ে সিটিং অ্যারেঞ্জমেন্ট করে ‍দিয়েছেন। দেখিস, এবার ফাইনাল ইয়ারটা কমপ্লিট হতে হতে আমাদের মধ্যে প্রেমটাও বেশ জমে উঠবে। অনেক কষ্টে হাসি চেপে কনুইয়ের একটা খোঁচা মেরে বলল বিদিতা। কেন জানেনা, সৌমিত্রকে ক্ষেপাতে যেনো ও একটা অদ্ভুত আনন্দ পায়। সেটার একটা কারণ হতে পারে, যেখানে কলেজের অন‍্যসব ছেলেরা বলতে গেলে ওকে চোখে হারায়, সেখানে এই নিতান্ত ছাপোষা মধ‍্যবিত্ত ঘরের ছেলেটা ওরদিকে একবার ফিরেও তাকায় না।
প্রেম আর তোর সঙ্গে? লাগামছাড়া ইয়ার্কিরও তো একটা সীমা থাকেরে বিদিতা। তুই তো দেখছি সবকিছু ছাপিয়ে গেছিস। তাচ্ছিল্যের একটা হাসি হেসে বলল সৌমিত্র।
কেন, আমি কি দেখতে এতোটাই খারাপ যে তোর এটা ডে-ড্রিম মনে হচ্ছে? কঠোরস্বরে প্রশ্ন করল বিদিতা।

বিদিতার মুখের এক্সপ্রেশনই হোক কিংবা গলার স্বর, কিছুসময়ের জন্য কেমন যেনো থমকে গেলো সৌমিত্র। একদৃষ্টিতে কিছুসময় বিদিতার দিকে তাকিয়ে শান্তস্বরে বলল,
রূপ আর বাবার অঢেল সম্পত্তি ছাড়া আর কি আছে তোর? যে দুটো জিনিস নিয়ে আজ তুই অহংকারে ডুবে আছিস, এগুলো কিন্তু খুব ক্ষণস্থায়ী রে। সারাজীবন যে এর উপর নির্ভর করে কাটিয়ে দিবি, তার কি কোনো গ‍্যারেন্টি আছে? এই যে কিছুক্ষণ আগে ক্লাসের বাইরে দাঁড়িয়ে চিৎকার, চ‍্যাঁচামেচি করলি, অথবা পোশাক পাল্টানোর মতো ঘন ঘন বয়ফ্রেন্ড পাল্টাচ্ছিস, তাতে হয়তো সাময়িকভাবে সবার আলোচনার বিষয়বস্তু তুই থাকিস, কিন্তু তারপর? কলেজের যে ছেলেগুলো আজকে তোকে মাথায় নিয়ে নাচছে,কলেজ পাশ করার পরও কি ওরা এমনটা করবে? উত্তরটা আশা করি তোরও জানা আছে। একটানা কথাগুলো বলে একটু দম নিলো সৌমিত্র। তারপর আবার বলতে শুরু করল,
-জানি তোর পড়াশোনা করতে খুব একটা ভালো লাগেনা, কিন্তু নাচ তো ভালোবাসিস। কলেজ ফেস্টে দেখেছিলাম কত সুন্দর ক্লাসিক্যাল ডান্স করিস তুই, অথচ কোনোদিন তোকে এই বিষয়ে সিরিয়াসলি ভাবতে দেখিনি। সাময়িক আনন্দের নেশায় কেনো নিজের ট‍্যালেন্টকে এভাবে নষ্ট করছিস? ভগবান তোকে রূপ, গুণ দুটোই দিয়েছেন বিদিতা।এখনো সময় আছে, পারলে এই দুটোর সদ্ব্যবহার করিস।

চারপাশে করতালির শব্দে ফ্ল‍্যাশব‍্যাক থেকে বর্তমানে ফিরে এলো সৌমিত্র। স্মিতমুখে একবার স্টেজের দিকে তাকিয়ে চুপচাপ বেরিয়ে এলো অডিটোরিয়াম থেকে। শীত যদিও এখনো পড়েনি, তবু মাঝেমধ্যে রাতের দিকে হাল্কা হিমেল বাতাস যেনো তারই আগমন বার্তা জানান দিয়ে যাচ্ছে। গাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে তাই উপভোগ করছিলো সৌমিত্র। হঠাৎ দূর থেকে একজোড়া ত্রস্তপায়ের শব্দ শুনে পিছনে তাকিয়েই বলে উঠল,
-আস্তে আয়, পড়ে যাবিতো।
-উহু, আর জ্ঞান দিতে এসোনা বাপু, আমার অভ‍্যাস আছে। গাড়িতে বসতে বসতে বলল বিদিতা।
-কিসে? শাড়িতে পা আটকে আছাড় খাওয়ার? মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করল সৌমিত্র।
-বাব্বা এই চারবছরে তো দেখছি ছেলে বেশ কথা শিখেছে। কলেজ লাইফে তো সাত চড়েও রা কাড়তেন না বাবু। এখন বেশি পাঁয়তারা না করে তাড়াতাড়ি চল্, ক্ষিদেয় আমার পেট চোঁ চোঁ করছে।সিটে মাথা রেখে বলল বিদিতা।
-তাহলে ডিনারটা বাইরেই করি। আমার ফ্ল‍্যাটে গিয়ে রান্না করে খেতে খেতে অনেক দেরি হয়ে যাবে।
লাস্ট দেড়মাস ধরে অনুষ্ঠানের কল‍্যাণে নানা জায়গার হোটেল আর রেস্টুরেন্টের খাওয়া খেয়ে আমার মুখে জং ধরে গেছে। ভাবলাম আজকে তোর বাড়িতে গিয়ে একটু ঘরোয়া খাওয়াদাওয়া করবো। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, তোর খুব একটা ইচ্ছে নেই আমাকে নিয়ে যাওয়ার। মুখটা কালো করে বলল বিদিতা।
-থাক্ হয়েছে, আর নাটক করতে হবেনা। হাসি চেপে গম্ভীর গলায় বলল সৌমিত্র।
-তুই কতদিন ধরে ব‍্যাঙ্গালোরে আছিস? ডিনার শেষ করে সোফায় বসতে বসতে জিজ্ঞেস করল বিদিতা।
-লাস্ট দু’বছর।
-হঠাৎ এখানে কেনো শিফ্ট করলি? কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞেস করল বিদিতা। 
-কোম্পানির একটা প্রজেক্টের কাজে তিনবছরের কন্ট্রাক্টে এসেছি। কাজ মিটে গেলেই আবার সস্থানে ফিরে যাবো।
-হুম। বাই দ‍্য ওয়ে, তুই কিভাবে জানতে পারলি আমি ব‍্যাঙ্গালোরে আছি?
-বিখ্যাত ক্লাসিক্যাল ডান্সার বিদিতা মল্লিকের খোঁজ পাওয়া কি খুব দুঃসাধ্য ব‍্যাপার? অল্পহেসে পাল্টা প্রশ্ন করল সৌমিত্র।
-তুই আমার খোঁজ রাখতিস? নিজের অজান্তেই বিদিতার মুখ দিয়ে অস্ফুটে কথাটা বেরিয়ে এলো।
উত্তর না দিয়ে চুপচাপ বিদিতার দিকে তাকালো সৌমিত্র। বরাবরই এই উশৃঙ্খল, বেপরোয়া মেয়েটাকে এড়িয়ে চলতো সে। ঘৃণা না করলেও পছন্দের পাত্রী সে কোনোদিনই ছিলোনা সৌমিত্রের কাছে। কিন্তু সেদিন কলেজে ওর বলা কথাগুলো শোনার পর মেয়েটার অভিব‍্যক্তিতে কিছু একটা দেখতে পেয়েছিলো সে, যার কোনো যথাযথ নামকরণ দিতে পারেনি। হয়তো সেই কারণেই তারপর থেকে আরও বেশি করে এড়িয়ে চলতে শুরু করেছিলো মেয়েটাকে। আশ্চর্যের বিষয় সেদিনের পর থেকে বিদিতাও আর অহেতুক উত্ত‍্যক্ত করেনি সৌমিত্রকে। কলেজ শেষ করার প্রায় চারবছর পর আজ ওদের দেখা হয়েছে। মাঝে আর কোনো যোগাযোগই ছিলনা। অবশ্য ছিলনা বলাটা ভুল। আজকাল ভার্চুয়াল জগতে ইচ্ছে করলেই একে অপরের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করা যায়। অনেকবার করবো করবো বলেও কোনো এক অজানা কারণে দুজনেই সেই অদৃশ্য সেতুটা তৈরি করতে পারেনি। কিন্তু গতকাল রাতে ফেসবুকে বিদিতার ব‍্যাঙ্গালোরের অনুষ্ঠানের খবর জেনে আর নিজেকে আটকে রাখতে পারেনি সৌমিত্র। কোনো এক অজানা মন্ত্রবলে ম‍্যাসেঞ্জারে একটা ম‍্যাসেজ পাঠিয়ে দিয়েছিলো। আজ অফিস শেষে সোজা সেখানেই চলে গেছিলো। সুরের তালে তালে বিদিতার পায়ের ছন্দগুলো যখন স্টেজ কাঁপাচ্ছিলো, সৌমিত্রের মনটাও যেনো আরো একবার অজ্ঞাত কারণে বিচলিত হয়ে পড়েছিলো। ঠিক যেমনটা বিগত চারবছর ধরে মাঝেমাঝেই হয়। যে কারণে আজপর্যন্ত আড়ালে, আবডালে সৌমিত্র বিদিতার খোঁজ রাখে। তবে কি সেই বাহ‍্যিক অপছন্দের আড়ালে কোথাও প্রচ্ছন্ন ভালোলাগা লুকিয়েছিল ! সেজন‍্যই কি কলেজলাইফে বিদিতার ঘন ঘন বয়ফ্রেন্ড পাল্টানো অথবা অন‍্য ছেলেদের সঙ্গে ফ্লার্ট করতে দেখলে প্রয়োজনাতিরিক্ত বিরক্ত হতো সৌমিত্র! সেজন্যই কি বিদিতাকে হাজারের ভিড়ে না হারিয়ে নিজস্ব প্রতিভায় প্রতিষ্ঠিত দেখতে চাইতো সে! সেজন্যই কি সেদিনের ঘটনার পর বিদিতার হঠাৎ পরিবর্তন অল্প হলেও ওকে ব‍্যাকুল করে তুলেছিলো! সেজন্যই কি আজ সকালে যখন বিদিতা ফোনে বলেছিলো ওর ফ্ল্যাটে এসে নিজে রান্না করবে, অদ্ভুত এক ভালোলাগায় মনটা ভরে উঠেছিলো! কে জানে! এই প্রশ্নগুলোর উত্তর যে আজও অজানা সৌমিত্রর।
-বিয়ে করিসনি কেনো এখনো? এতো ভালো জব করছিস, অফিসে নিশ্চয় অনেক মেয়েরা লাইন দিয়ে বসে আছে।
গাড়ি চালাতে চালাতে হঠাৎ বিদিতার প্রশ্নে সম্বিৎ ফিরে পেয়ে তাকালো সৌমিত্র। বাইরের আলো কাঁচের জানালা ভেদ করে গাড়িতে এক মায়াবী আলোছায়ার সৃষ্টি করেছে।সেই আলোতে যেনো আরো অপরূপা লাগছে বিদিতাকে। নাহ্, এই রূপে আজ থেকে চারবছর আগের উগ্র মাদকতার গন্ধ নেই বরং অদ্ভুত এক স্নিগ্ধতা ছড়িয়ে আছে। এই সৌন্দর্যে কামুকতার পরিবর্তে কমনীয়তা ভেসে উঠছে। একটুসময় অপলকে সেদিকে তাকিয়ে মুখটা আবার সামনের দিকে ঘুরিয়ে অল্প হেসে উত্তর দিলো সৌমিত্র,
-ভালো জব করলে কি হবে, মেয়ে পটাতে ট‍্যালেন্ট লাগে বস্। আর সেদিক থেকে দেখতে গেলে, আই এম এ বিগ জিরো। মুখে বললেও কথাটা যে কতটা মিথ্যে, তা শুধু সৌমিত্র জানে। যখনই কোনো মেয়ের সান্নিধ্যে যাওয়ার চেষ্টা করেছে, অদৃশ্য একটা মুখ যেনো মাঝখানে বাধা হয়ে দাঁড়াতো বারবার।
-আমার কথা ছাড়, তুই কেনো এখনো বিয়ে করিসনি বল্। এখন তো তোর অসংখ্য এডমায়ার আছে। তাদের মধ্যে কাউকে ভালো লাগেনি? জোর করে মুখে হাসি এনে কথাটা বলতে বলতে হোটেলের সামনে এসে গাড়ি দাঁড় করলো সৌমিত্র। উত্তরে অদ্ভুত এক স্নিগ্ধ হাসি হেসে আলগোছে বলল বিদিতা,
-ভালো থাকিস সৌমিত্র।
চলে যাচ্ছে বিদিতা। ওর প্রত‍্যেকটা পদক্ষেপে যেনো সৌমিত্রর মনে ভাঙনের শব্দ তুলছে। আস্তে আস্তে ফিকে হয়ে আসছে ওর অবয়ব সৌমিত্রের চোখে। আর একটা বাঁক নিলেই অদৃশ্য হয়ে যাবে।  ডাকবে কি একবার ওকে সৌমিত্র! কিন্তু সব শোনার পর বিদিতা যদি ওকে স্বার্থপর ভাবে! যদি ভাবে আজকে সে প্রতিষ্ঠিত বলেই হয়তো সৌমিত্র ওকে পেতে চাইছে! কি উত্তর দেবে সে! তবু কেনো জানি আজকে সৌমিত্রের বারবার মনে হচ্ছে এবার বিদিতা চলে গেলে শুধু চোখের আড়ালে না, মনের আড়ালেও চলে যাবে চিরতরে। হঠাৎ স্থান, কাল ভুলে ডাক দিলো সৌমিত্র,
-বিদিতা…
বলছিলাম যে আজকের মতো কি আগামীতে আমরা একসঙ্গে রান্না করতে পারিনা? অল্প ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করল সৌমিত্র।
-একটা শর্তে। গম্ভীরস্বরে বলল বিদিতা।
-কি?
-আমার রান্না নিয়ে খোঁটা দিতে পারবি না।
হেসে ফেললো দুজনেই। হাসতে হাসতে  লক্ষ্য করলো দুজনেরই চোখের কোণে জল চিকচিক করছে। একটুসময় সেদিকে তাকিয়ে বিদিতার হাত ধরে বলল সৌমিত্র।
-সেদিন তোকে এতো রূঢ়ভাবে কথাগুলো বলতে চাইনি রে। কিন্তু কেনো জানিনা, নিজের অজান্তেই মুখ থেকে বেরিয়ে গেছিলো। আই এম রিয়ালি স‍্যরি ফর দ‍্যাট।
-ভাগ‍্যিস বলেছিলি। তাইতো নিজেকে নতুনভাবে খুঁজে পেলাম। নাহলে হয়তো আজীবন পরগাছা হয়ে বেঁচে থাকতাম। কৃতজ্ঞস্বরে বলল বিদিতা।
-তোকে খ‍্যাতির শীর্ষে দেখে সত্যি খুব গর্ববোধ হয়। হাতের আঙুল দিয়ে বিদিতার কপালের চুলগুলো আলগোছে সরাতে সরাতে বলল সৌমিত্র।
-জানি। একটু আগে জিজ্ঞেস করেছিলি না, এতো এডমায়ারদের ভিড়ে কাউকে ভালো লেগেছে কিনা। মিথ্যে বলবোনা, ভালো হয়তো লেগেছে, কিন্তু ভালবাসা হয়নি। ওই যে তুই বলেছিলি না, সাময়িক আনন্দ, কিছুটা সেরকমই।
-তা এবার সাময়িক ছেড়ে স্থায়ীর প্ল‍্যান শুরু করুন ম‍্যাডাম।
-করতে পারি, তবে আগে কথা দে, যদি কোনোদিন আবার ভুলপথে হাঁটতে শুরু করি, এভাবেই আমার হাত ধরে সঠিক পথে নিয়ে আসবি। প্রত‍্যুত্তরে বিদিতার কপালে আলতো একটা ভালোবাসার চুম্বন এঁকে দিলো সৌমিত্র।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত