| 23 এপ্রিল 2024
Categories
গদ্য সাহিত্য

বিন্দুর মধ্যে ব্যাপ্তিদানই সার্থক অণুগল্প । তৈমুর খান

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

গল্পের সঙ্গে ‘অণু’ কথাটি যুক্ত করে আমরা নাম দিয়েছি অণুগল্প।’ণ’ এর বদলে ‘ন’ লিখলে যে ‘অনু’ পাওয়া যায় তা হল সংস্কৃত উপসর্গ। এর অর্থ পশ্চাৎ বা অনুসরণ বা অনুরূপ। কিন্তু ‘অণু’ লিখলে মৌলিক কণাকেই বোঝায়। সুতরাং অণুগল্প লিখতে বসে কখনোই ‘অণু’ শব্দটিতে যেন ‘ন’ না হয় সেদিকেই আমাদের সদা সতর্ক দৃষ্টি রাখা কর্তব্য।

মানুষের জীবনটাই গল্পের ভিত্তি। যতগুলি ধর্মীয় শাস্ত্র পৃথিবীতে রচিত হয়েছে, যতগুলি ইতিহাস, লোকাচার ও সংস্কৃতি প্রচলিত রয়েছে সবগুলির মধ্যেই আছে এক একটি  আখ্যানের ব্যঞ্জনা।  আখ্যা বা কাহিনি না থাকলে কোনো ধর্মই ধর্মীয় চেতনায় দীক্ষা দিতে পারত না। সভ্যতাচারী মানবজীবনের প্রতিটি উত্থান, প্রতিটি পদক্ষেপ এই কাহিনিকে কেন্দ্র করেই। ছোটবেলায় বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয় কিংবা বিষ্ণু শর্মার পঞ্চতন্ত্র কিংবা মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার এর হিতোপদেশ পড়ে বড় হয়ে রবীন্দ্রনাথ ও বনফুলে আমরা মজে গেছি। তারপর আরেকটু অগ্রসর হলে পেয়েছি কাফকা, হেমিংওয়ে, আর্থার সি ক্লার্ক, রে ব্রাডবুরি, ডোলান্ড বার্থলেম, আমব্রুস বিয়ার্স, বোর্হেস প্রমুখের মতো অণুগল্পকারদের। বর্তমানে এই সংখ্যাটা বহুগুণ বেড়ে গেছে। বাংলাদেশ-ভারত মিলে অসংখ্য অণুগল্প লেখক এগিয়ে চলেছেন। এঁদের মধ্যে কয়েকজন হলেন: শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, হাসান আজিজুল হক, অমর মিত্র, স্বপ্নময় চক্রবর্তী, স্মরণজিৎ চক্রবর্তী, তমাল বন্দ্যোপাধ্যায়, উল্লাস মল্লিক, সুকুমার রুজ, তৃষ্ণা বসাক, সায়ন্তনী ভট্টাচার্য,তৃপ্তি সান্ত্রা, সুজয় চক্রবর্তী, ইলিয়াস বাবর, যুগান্তর মিত্র, আনোয়ার কামাল, চন্দন আনোয়ার, রহমান হেনরী, মোজাফফর হোসেন, একলব্য ঠাকুর, মাহমুদ কামাল, হাসান আল আব্দুল্লাহ, রনি অধিকারী প্রমুখ। কবিতা এবং অণুগল্প খুব কাছাকাছি একটি বিষয়, কিন্তু অণুগল্প কখনোই ছোটগল্পের নতুন সংস্করণ নয়।

শিল্পের প্রতিটি স্তরেই কাহিনির বীজ আছে, এই বীজের অঙ্কুরোদগমও হতে পারে, আবার বিস্তারও ঘটে বিশাল ব্যাপ্তি নিয়ে। বিভিন্ন পর্যায়ে এর বিভিন্ন নাম হয়। যেভাবে কাহিনিটি সেখানে পল্লবিত হয়েছে সেভাবেই তাকে বিচার করা হয়। শুধুমাত্র অণুগল্পের ক্ষেত্রে দেখতে পাই একটা চুম্বকীয় মুহূর্ত যা কয়েকটি শব্দে বা একটি বাক্যেও তার তরঙ্গ তুলতে সক্ষম। অতি সংক্ষেপণে তাই তার পরিসর রচিত হলেও ব্যাপ্তিতে মহাজীবনের কোনো নিগূঢ় সত্যে বোধকে উদ্দীপ্ত করতে পারে। যা বাস্তবতা, দার্শনিকতা, চিরন্তনতায় অনপনেয় হয়ে ওঠে। লেখকের একান্ত অনুভূতি অন্তর্লোকে উঁকি দিয়ে তুলে আনে শুক্তো থেকে মুক্তো। সমুদ্রের কথা লিখতে গিয়ে মাত্র এক ফোঁটা সমুদ্রের জলই প্রয়োজন হয়। ছোটগল্পে গল্পের মুহূর্ত তৈরি করার অনেক জায়গা থাকে, কিন্তু অণুগল্পে প্রতিটি শব্দকেই প্রখর ও সচেতন থাকতে হয় গল্পের মুহূর্ত তৈরি করার জন্য। সুতরাং অণুগল্প একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ শিল্পরূপ, এক ধরনের কবিতা কর্ম, যার পরিমিতিবোধের সঙ্গে অভিব্যক্তির গভীর সম্পর্ক রয়েছে। ছোটগল্পের আবেদন সমগ্র কাহিনিটিতে বা কোনো ঘটনার মধ্যে নিহিত থাকে, কিন্তু অণুগল্পে শব্দের আবেদন তার অর্থের ব্যঞ্জনায় স্পন্দিত করে তোলে। যে কাজ কবিতা করতে পারে সেকাজ একটি সার্থক অণুগল্পও করতে পারে। অণুগল্পের রূপকাশ্রয়, সাংকেতিকতা, কুহেলিকা সৃষ্টি পাঠককে কিছুক্ষণের জন্য আশ্চর্য করে দেয়, অথচ নিখুঁত অন্বেষণে জীবনের গভীরেই তার শেকড় খুঁজে পাওয়া যায়। কয়েকটি অণুগল্পের উদাহারণ নিলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে। স্বপ্নময় চক্রবর্তী বহু অণুগল্পের রচয়িতা। তাঁর ‘অণুগল্প সংগ্রহ'(২০১৪) ইতিমধ্যে সাড়াও ফেলেছে। ‘প্রেম’ নামের একটি ছোট্ট অণুগল্প এখানে উদ্ধৃত করা যায়।

                         প্রেম

 ও আমাকে অনেকবার বলেছিল এভাবে দুপুরবেলায় চোরের মতো এসো না।

 তবু যাই।

 আজ গেলাম।

 বলল কেন এলে?

 বললাম তেষ্টা পেয়েছে। একটু জল খেয়েই চলে যাব।

 ও বলল খেয়েছ দুপুরে?

 বললাম না। খাওয়া হয়নি।

 ও বলল ভাত নেই। শশা আছে আর পেয়ারা আছে। তাড়াতাড়ি খেয়ে বিদেয় হও।

 ও আমাকে কাটা ফল দিয়েছিল। তাতে রক্ত লেগে ছিল।

পিপাসার জন্য জল খেতে আসা শুধু বাইরের একটা অজুহাত মাত্র, পিপাসা তো হৃদয়ের। প্রেমিকার দেওয়া ভাতের বদলে ‘ফল’ যে ফল কাটা এবং তাতে রক্ত লেগে যাওয়া মারাত্মক ইঙ্গিত। হৃদয় ফালা ফালা, রক্তক্ষরণে তার প্রমাণ। ‘ফল’ প্রেমেরই পরিণতি। রক্তাক্ত হৃদয়ের পরশ মাখা। খুব বেশি কথা না বলেও লেখক পাঠকের তথা ভাবুকের হৃদয়ের কাছে সেই অনুভূতির সংবাদটি পৌঁছে দিতে পেরেছেন। প্রেমের প্রকৃত তাৎপর্যটি স্বয়ংক্রিয়তায় চিরন্তন হয়ে উঠেছে।

আর একটি গল্পে এযুগের লেখক প্রশান্ত মৃধা প্রেমের এক ভিন্ন তাৎপর্য দান করেছেন। গল্পটি এরূপ।

                                চুম্বনের স্বাদ

ছেলেটি মেয়েটিকে বলল, ‘এখন তোমাকে একটা চুমু খেতে ইচ্ছে করছে।’মেয়েটি ঘরের ঝুল ঝাড়ছিল। মুখে ঘাম, পরিশ্রমে চুল আলুথালু, একটু ক্লান্তও। শুনে অভিমানের সঙ্গে রাগসহ কটমট করে ছেলেটির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমার হাতে ধুলো।’

ছেলেটি ভড়কে গেল। একটু ভয়ও পেল যেন। খানিক বিব্রতও। ভাবল, মেয়েটির হাতে ধুলো না থাকলে হয়তো চড়টড় খেত। সে মেয়েটির কাছাকাছি যেখানে দাঁড়িয়ে বলেছিল কথাটা, সেখান থেকে সরে এল।

তখনই ছেলেটিকে সম্পূর্ণ অবাক করে দিয়ে মেয়েটি বলল, ‘কী, সরে গেলে কেন? সত্যিই তো দেখছো না, আমার হাতে ধুলো। এখন তোমার মুখের দু-পাশে কোনোভাবে হাত দিতে পারতাম না!’

সঙ্গে সঙ্গে চুমু না খেয়েও ছেলেটি পেল একটি চুম্বনের স্বাদ।


আরো পড়ুন: শামীম রেজা বদলে দেয়ার যাদুকথা শোনানোই যার কাজ

চুমু খাওয়া হয়নি, কিন্তু চুমু দেওয়ার ইচ্ছাটিই পরোক্ষে প্রকাশ করে মেয়েটি ছেলেটির সাধ পূরণ করেছে। ধুলো লাগা হাত মুখের দুই পাশে দিয়ে চুমু দেওয়ায় যে মুখটিকে ধুলামলিন করা তা বুঝিয়ে দিয়েছে। এখানেই গল্পটির মহিমা।

ইঙ্গিতময়তা থেকে উপলব্ধির বিস্তৃত ক্ষেত্রে মানবীয় চিরন্তন আবেদনে গল্পগুলির কাব্যিক ব্যঞ্জনা একটা আলাদা শৈল্পিক মর্যাদা দান করেছে। অল্প কথায় অসাধারণ প্রকাশ, গল্প না থাকলেও একটা চমক পাঠককে আকৃষ্ট করে। শুরু ও শেষের আকস্মিকতা যা বর্ণনার বর্ণচ্ছটায় বাহুল্য হয়ে ওঠে না। অনেক না বলা কথার মধ্যেও পাঠকের বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না গল্পকারের মূল উদ্দেশ্য। প্রচণ্ড সংযম, শব্দের পরিমিত ব্যবহার, প্রাকৃত বা অপ্রাকৃত দৃশ্যকে সুষম বিন্যাস দান এবং সর্বজনীন করে তোলার মধ্য দিয়েই গল্পটি লক্ষ্যে পৌঁছবে। ভিড়ের হইহুল্লার মধ্যেও লেখক কারও নীরব চিৎকার, নিরশ্রু বেদনাময় আভাস ঠিক তুলে আনবেন। একটি কবিতা যদি এভাবে লেখা যায়:

                          সন্তান

 হাসপাতালের সামনে বসে আছি।

 আমার দুঃখী বউ আনন্দের জন্ম দিলে

 বাড়ি ফিরে যাব।

তখন এটাকে অণুগল্পও বলা চলে। হাসপাতাল তো এই জগৎ-সংসার। টি এস এলিয়ট বলেছিলেন: All World is Hospital. আমরা প্রতিমুহূর্তে আমাদের ভাবকে সেখানে প্রসব করাতে চাই। আমাদের প্রতিটি ভাবই আনন্দের। পরোক্ষে সন্তানও আনন্দ। দুঃখী বউ আমাদের বেঁচে থাকার মুহূর্ত। কত অল্প কথায় এই গল্পের সন্নিধান অথচ সার্বিক ও বহুস্বরের সন্নিবেশ। একটি তরঙ্গের কম্পন যেন সমুদ্রের তলদেশ থেকে উঠে আসছে। আয়োজন সামান্য হলেও আবেদন বৃহৎ।

বাংলা সাহিত্যের প্রাণকণায় অণুগল্পের ঔজ্জ্বল্য দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। কবিতার সঙ্গে অণুগল্পের সামঞ্জস্য বিধানই এর কারণ। একজন কবি সার্থক অণুগল্পকার হতে পারেন। আর একজন অনুগল্পকারও সার্থক কবি হতে পারেন। আসলে শব্দবোধ জীবনবোধ অভিজ্ঞতা মাল্টি মিডিয়ার যুগে অণুগল্পের প্রতিই সকলের ঝোঁক দেখা দিচ্ছে। এটা বড় আশাব্যঞ্জক কথা এবং প্রবণতাও।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত