| 29 মার্চ 2024
Categories
দুই বাংলার গল্প সংখ্যা

একটা ভিউ মাস্টার, কয়েকটা মার্বেল

আনুমানিক পঠনকাল: 9 মিনিট

Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.comআমার ধারে পাঁচটা মার্বেল আছে! নয়া। এক্কেরে চকচকা।

কথাটা বলার সময় চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছিলো সোহেলের। তার ডান হাতটা মুঠো বন্ধ করা, বেনুর দিকে বাড়ানো, আর আরেকটা হাতশরিরের পেছনে। বেনু মুখ ভেংচি দিয়ে বললো-তোমার ওই হাতোত কি?

-করমচা। খাবি? এবার অন্য হাতটাও উদার প্রশ্রয়ের সাথে বাড়িয়ে ধরলো সোহেল।

-করমচা দিবা, আবার মার্বেলও? বেনুর চোখে অবিশ্বাস। 

-হুম।

-ক্যান?

সোহেল এবার আসল কথা পাড়ে-তোর ওই ক্যামেরার লাহান খেলনাটা আমারে দেখতে দিবি?

বেনু পুরনো ভাঙা পাচিলেঁর ওপর উঠে বসে দুই হাতের বালু ঝাড়লো। এবার সোহেলের দেয়া করমচা একটা মুখে পুরে এর টক স্বাদে চোখ মুখ কুঁচকালো। তারপর দুই পা দোলাতে থাকলো মনের আনন্দে। সোহেলের ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে যাবার উপক্রম। সে জ্বলজ্বলে চোখে চেয়ে রইলো বেনুর দিকে, উত্তরের আশায়।

ভাঙা পাঁচিলটা তাদের পুরান বাড়ির, যে বাড়িতে এক সময় তাদের পূর্বপুরুষদের বাস ছিলো। তাদের দাদারা ছিলো দুই ভাই। দুই দাদা যুবক বয়সেই আলাদা হয়ে এই পুরান বাড়ি ছেড়ে দুদিকে চলে গিয়েছিলো তাদের জন্মেরও আগে, তাদের ক্রমবর্ধমান ও বিস্তৃত বংশ পরম্পরা নিয়ে। ক্রমে উত্তরসূরীদের জায়গা জমি বেড়েছে চতুর্দিকে, বেড়েছে তাদের নিজেদের বাড়ির সীমানাও, কিন্তু পুরান বাড়ির জমিটা নিয়ে মামলা মোকদ্দমা এখনও শেষ হয় নি। এই জায়গাটা তাই এখনো পতিত। আশি বছরের পুরনো মাটির বাড়িটা ভেঙে গেছে কবেই। এখানে ওখানে পড়ে আছে মাটির চাঙর, পাথরের টুকরো, ঘাস গজানো কাঠ, বড় বড় কচু গাছের নিচে আশ্রয় নেয়া ব্যাঙ, পিঁপড়েদের উঁচু ঢিবি। দিন দুপুরেও শেয়াল ডাকে এই জায়গায়, বেজী আর সাপেরা ছোটাছুটি করে পরস্পরের পেছনে। সীমানার ঠিক বাইরে বিরাট প্রাচীন মাদার গাছটা পাঁচিলের ধার ঘেঁষে ঝুকেঁ পড়েছে ভেতর দিকে, যার ভারে  শ্যাওলা ধরা সবুজ পাঁচিলটা একটু হেলে পড়েছে ভেতর দিকে। কবে যে হুড়মুড় করে ভেঙে পড়বে কে জানে। গ্রামের মুয়াজ্জিন সাহেব কবে নাকি রাতের বেলা এই মাদার গাছের নিচে একজন লম্বা সাদা দাড়িওলা বুজুর্গকে দাঁড়িয়ে অবিরত তসবী টিপতে দেখেছেন, তাঁর তসবীর গোটাগুলো থেকে ঠিকরে বেরোচ্ছিলো সাদা আলো, তার পর থেকে কেউ সন্ধ্যার পর এ তল্লাটে আসে না। তাদের দুই বংশের ভিটা পুরান বাড়ির দুই দিকে ভিটেবাড়ি, উঠান আর পুকুর সমেত গ্রামের মধ্যে অনেক দূর পর্যন্ত বিস্তৃত এখন। দুই ভিটের মাঝখানের সংযোগ বিন্দুটাতে পড়েছে এই জঙ্গল যা এখনও দুই বাড়ির ছেলেমেয়েদের খেলার প্রিয় জায়গা। এখানেই বংশানুক্রমে তারা বড় হয়ে উঠেছে পরস্পরের সাথে খেলতে খেলতে আর ফল পাকুড় পেড়ে খেতে খেতে। এটাই তাদের সব রহস্যের আধার ঘেরা স্বপ্নপুরী। কোন দাড়িওলা বুজুর্গকে তারা ভয় পায় না।

একটা একটা করে ছয়টা টক তিতকুটে স্বাদের রক্তজবা রঙের করমচা খেয়ে বেনু পাঁচিল থেকে লাফ দিয়ে নামলো। তার ফ্রকে মাকড়সার ঝুল লেগে গেছে, স্যান্ডেল দুটো ধুলায় ধুসরিত। বেনুর মা সব সময় মেয়েকে ফিটফাট করে সাজিয়ে রাখতে পছন্দ করেন। শহরের দরজিবাড়ি থেকে সেলাই করিয়ে আনান কুঁচি দেয়া ফুলেল প্রিন্টের ফ্রকগুলো, আজকাল যেসব ফ্রকের বুকের কাছে কুঁচিগুলো একটু বেশি দেয়া হয় যাতে সদ্য ফুটতে থাকা সুপুরির মতো স্তন দুটো ঢাকা থাকে ভদ্রস্থভাবে। বেনুর বাপ শুকুর আলিসৌদি আরব থেকে নিয়মিত যেসব বিদেশি শ্যাম্পু আর সাবান পাঠান তার উড়ন্ত খুচরো চুলে  সেগুলোর মিষ্টি সুবাস লেগে থাকে। ছোট ছোট উলের পুতুল কি প্রজাপতি লাগানো লাল গোলাপি চুলের ব্যান্ড দিয়ে মেয়ের সেই শ্যাম্পু করা মসৃণ চুলগুলো রোজ সুন্দর করে বেঁধে দেন তার মা। কিন্তু বেনু ভারি অসতর্ক, প্রায়ই খেলতে গিয়ে সেই দামি ব্যান্ডগুলো হারিয়ে ফেলে। পুরান বাড়ির জঙ্গলে এখানে ওখানে পড়ে থাকে তার চুলের ব্যান্ড, গলার লকেট কি হাতের ব্রেসলেট-সেগুলো সে লক্ষ্যই করে না। তার সুন্দর ফ্রকগুলোও ধুলা আর ঝুল লেগে নোংরা হয়ে থাকে প্রায়ই। নিজের ব্যাপারে বেনু একটু উদাসীনই বটে। সোহেলেরও এসব দিকে কোন নজর নাই। বরং তার নজর এবার শুকুর চাচার আনা ভিউ মাস্টার নামের আজব ক্যামেরার মতো খেলনাটার দিকে। ছোট ছোট ছবির নেগেটিভ দেয়া একটা গোল চাকতি ওই ক্যামেরার মতো জিনিসটার সামনের ফোকড়ে ঢুকিয়ে দুই চোখ এপাশে লাগালেই দেখা যায় আশ্চর্য সব রঙিন ছবি। প্রথম দিনই শুকুর চাচার স্যুটকেস খোলার সময় জিনিসটা নজর কেড়েছিলো তার। শুকুর চাচা একটা চাকতি ঢুকিয়ে তাদের সবাইকে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলেন ছবিগুলোর সাথে-ওই যে তিনকোণা উচা জিনিস দেখতাছোস ওইটার নাম পিরামিড। মিশরের পিরামিডের কতা পড়ছোস না ইশকুলে? এইবার সুইচে টিপ দিয়া ঘুরান দে, হ এর পরের ছবিডা অইলো তুর্কির একটা মসজিদ। মাইনসে কয় নীল মসজিদ। আরেকবার টিপ। হ, ক্কাবা শরীফ দেখতাছোস? ক আলহামদুলিল্লাহ। ক্কাবা দেখলে মনে মনে আল্লার কাছে চাইতে অয় যেন আল্লায় ক্বাবা দেখার নসিব কইরা দেয়।

তো ভিড় ভাট্টার মধ্যে সেদিন একবারই কয়েক মুহুর্তের জন্য ওটা হাতে পাবার সৌভাগ্য হয়েছিলো সোহেলের। কেবল ক্কাবা নয়, দেশ বিদেশে ঘুরে এই সব আশ্চর্য জিনিস দেখার নসীব যাতে হয় সেজন্যই মনে মনে প্রার্থনা করেছিলো সোহেল। শুকুর চাচা বেশ কয়েকটা চাকতিসহ ভিউ মাস্টারটা একটা প্লাস্টিকের ব্যাগে ঢুকিয়ে তুলে দিয়েছিলেন বেনুর হাতে-ধর, সাবধানে রাখবি। নষ্ট করিস না। তোর লাইগ্যা এইটা আনছি।

সেই থেকে সোহেল বেনুর পিছে পিছে ঘুরছে। ইস আরও না জানি কত কিছু দেখার আছে ওই জিনিসটার মধ্যে। কত দূর দূর দেশের আজব সব দৃশ্য। কত রহস্য, কত বিস্ময় লুকিয়ে আছে ওই নেগেটিভগুলোতে।  বেনুই এই মহার্ঘ জিনিসটার মালিক এখন। আজকে তাই সে ঘুষ হিসাবে নিয়ে এনেছে পাঁচটা চকচকে মার্বেল, যেগুলো তার খুবই প্রিয়।সময় পেলেই মার্বেলগুলো গড়িয়ে দিয়ে সেগুলোর গতিপথের দিকে চেয়ে থাকা তার অভ্যেস। মার্বেল মাটিতে ছেড়ে দিলে কে যে কোনপথে কতদূর গিয়ে ঠেকবে তা আগে থেকে কিছুই বলা যায় না। এও এক আজব ব্যাপার। কিন্তু বেনু যা মুড দেখাচ্ছে!

বেনু, বেনু উ উ উ-মার চিৎকার শোনা গেলো এ সময়। ‌ আবার হাইনজা বেলা পুরান বাড়িত গেছোস? কইছি না আছরের আজান দিলে লগে লগে বাড়িত আয়া পড়বি।

বেনু ফ্রকের ঝুলগুলো পরিস্কার করতে করতে বললো-মায় তো আলমারিত উঠায়া রাখছে ওইটা। কইছে খেলার সুম বাইর কইরা দিবো। তোমারে ডাকুম নে তহন। লিমাবুরেও আইতে কইও। জাহাঙ্গীররেও লয়া আসুম। সবতে মিলা দেখুম নে। তুমি চিনায়া দিও কোনটা কি।

-কাইল বিকালে? ভাত খাইয়া আইয়া পড়িস? –সোহেলের তর সয় না।

বেনু একটু চিন্তা করলো-না কাইল না। পরশু। কাইল আব্বায় কোর্টত যাইবো। মায় ছাড়বো না আমারে। পরশু আসুম নে। অহন মার্বেল দেও।

বেনুর বাড়িয়ে দেয়া হাতের দিকে মলিন দৃষ্টিতে তাকালো সোহেল। কথা যখন দিয়েই দিয়েছে, মার্বেলগুলো তো দিতেই হবে। কী আর করা! বিষন্ন মনে পাঁচ পাঁচটা চকচকে মার্বেল সে তুলে দিলো বেনুর হাতে। তার প্রিয় মার্বেল। কত কষ্টে একে একে জমিয়েছে। বেনু মার্বেলগুলো হাতে পেয়েই এক ছুটে চলে গেলো বাড়ির দিকে। আর সোহেল বাড়ি ফিরে দেখলো পরদিনের শুনানি নিয়ে বেশ উত্তেজনা চলছে।

এই মামলার পেছনে প্রজন্মের পর প্রজন্ম টাকা ঢেলে যাচ্ছে দুই পরিবার, কিন্তু মামলাটা যেন দ্রৌপদীর শাড়ির মত অন্তহীন, কিছুতেই তার সুতো শেষ হয় না। তবে এবার বেশ বড় সড় উকিল ধরেছে সোহেলের বাপ মজিদ আলি। এসি ল্যান্ড অফিসে গিয়ে সব ম্যানেজ করে এসেছে সেই উকিল। কেবল পুরান বাড়ির ন্যায্য অংশই নয়, চাচাতো ভাই শুকুর আলি যে তাদের উত্তর পাড়ার কিছু জমিও ভোগদখল করে রেখেছিলো তাও এবার উদ্ধার হবে আশা করা যায়। সবচেয়ে বড় কথা শুকুর আলির এবার সৌদি আরব যাওয়া ভেস্তে দেবে মজিদ আলি। নতুন উকিলের পরামর্শ মতো শুকুর আলির নামে অবৈধ জমি দখল আর তিন মাস আগে গরু চুরির একটা মামলা ঠুকে দিলেই হবে। গরু দুটো অবশ্য চুরি হয় নি, বোশেখ মাসে তারা নিজেরাই বেচে দিয়েছিলো। কিন্তু কে জানে সেই খবর? একবার মামলা হলেই হলো। পুলিশের খাতায় নাম উঠলে শুকুর আলি দেশ ছেড়ে আর বের হতে পারবে না, বিমানবন্দরেই দেবে আটকে। বেশ শিক্ষা হবে তখন হারামজাদার। নিত্য ওবাড়িতে সৌদি থেকে সোনার গয়না, ক্যাসেট রেকর্ডার, মোলায়েম কম্বল আনার দৃশ্য কাঁহাতক আর সহ্য হয়? বড্ড বেশি বাড় বেড়েছে ওবাড়ির লোকেদের। টাকার গরম! গত রমজানে গাঁয়ের মসজিদে মজিদ আলি ঘোষণা দিয়ে এসেছে যে পুরান বাড়ির দখল পেলে তাদের পরিবার ওখানে একটা নতুন পাকা মসজিদ করবে। সেই মসজিদে কারেন্টের লাইন থাকবে, থাকবে মাথার ওপর ফ্যান, মেঝেতে রঙিন টাইলস, পানির ট্যাপ বেয়ে ঝরঝর করে পানি আসবে অজুর। “আল্লায় দিলে আমগো তো জাগা জমির অভাব নাই বুঝছেন নি? দাদার বাপের জাগাখান জঙ্গল হইয়া পইরা রইছে হুদাই, ওই শুক্কুর মিয়াগো ষড়যন্ত্রে, জাগাখান যদি পাই তো সেইডা আল্লার নামেই হাওলা কইরা দিমু। মসজিদের লগে থাকবো আমগো পারিবারিক গোরস্তান। সামনের রমজানে আপনেরা পাক্কা মসজিদে ফ্যানের নিচত তারাবির নামাজ পরবেন ইনশাল্লা।

কাজেই গ্রামবাসীও তাদের পক্ষেই আছে বলে আশা করা যায়। বাড়ি ফিরে  উত্তেজিত বাপ চাচাদের পাশ কাটিয়ে ঘরে ঢুকে সোহেলতার টিনের কৌটা বের করে অবশিষ্ট মার্বেলগুলো গোণে। এক দুই তিন, বাকি রইলো আর মোটে চারটা। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো সে। প্রিয় জিনিসগুলো এভাবেই তার হাত গলে বেরিয়ে যায়। এর আগে তিনটে মার্বেল খেলার সময় হারিয়ে গেছিলো পুরান বাড়ির জঙ্গলে। লিমাবুকে নিয়ে বড় বড় কচুগাছের জঞ্জালের নিচে মার্বেল খুঁজতে গিয়ে সেবার একটা ঢোড়া সাপ দেখে পালিয়ে এসেছিলো সোহেল। তার পরে আর মার্বেল খুঁজতে যাওয়া হয় নি। তবে পরশুদিন বেনুর ভিউ মাস্টার নামের সেই আজব ক্যামেরা হাতে পেলে সব দুঃখ ভুলে যাবে সে। এই দুনিয়াতে যে কত রহস্যময় সব দেশ আছে, সেসব দেশে কত কিসিমের লোকজন, আর কত আজব আজব দালান কোঠা, ইমারত, কত বড় বড় রঙিন রাস্তা ঘাট, এই গায়েঁর চৌহদ্দি পেরোলেই যে কত বিস্ময় অপেক্ষা করে আছে বড় হয়ে একদিন সে এসব দেখতে বেরিয়ে পড়বে নিশ্চয়। তার এই বাসনার কথা শুনে একদিন শুকুর চাচা হেসে বলেছিলো-আর তো কয়টা দিন, মেট্টিকটা পাশ কর, হের পর সাজাহানের লাহান তোরেও বিদেশ নিবার ব্যবস্থা করমু নে। আমার লাইন ঘাট জানা আছে। আমগো বেনুর লিগাও বিদেশ থাহে এমুন পোলা দেখুম। তাইলে বেনুও নানান দেশ দেখতে পারবো।

শুনে বেনুর মা গোলাপি চাচী, গায়ের রং বিলিতিদের মতো ফরসা আর গালগুলো গোলাপি বলে তাদের এই চাচীকে সবাই গোলাপি চাচী বলে ডাকে, বেনুকে কাছে টেনে নিয়ে বলেছিলেন, বেনুরে বিয়া দিমু লন্ডনি কি আম্রিকান পাত্রর লগে। হেরা বুঝবারই পারবো না বেনু কুন দেশ থন আইছে!

বেনুও তার মায়ের গায়ের রং পেয়েছে। টকটকে ফরসা মুখ আর কানের পাশটা, গালের উঁচু জায়গাটাতে গোলাপি আভা। চুলগুলোও হালকা খয়েরি। এই গ্রামে সে একেবারেই বেমানান। এই জন্যই গোলাপি চাচী বেনুকে সারাক্ষণ সাজিয়ে গুছিয়ে রাখতে পছন্দ করেন। চুল বেঁধে দেন বিদেশি ব্যান্ড দিয়ে, সুন্দর সুন্দর জামা বানিয়ে দেন শহর থেকে এনে। বেনু সব সময় পায়ে স্যান্ডেল পরে। গোলাপি চাচী গ্রামের ধুলিমাখা, কালো, ময়লা বালিকাদের থেকে বেনুকে সব সময় একটু আলাদা দেখাতে চান।

সেদিনের পর থেকে সোহেল আর বেনু প্রায়ই দেশ বিদেশের গল্প করে। সোহেল বিভিন্ন দেশের ভিউ কার্ড জমায় যত্ন করে। মালয়েশিয়ার টুইন টাওয়ার, দুবাই এর আকাশচুম্বী হোটেল, লন্ডনের ঘড়ির ছবি আছে তার কাছে। বেনুর ভিউ মাস্টারের গোল চাকতিগুলোতে যেসব ছবি আছে সেই জায়গাগুলোরও নাম লিখে রাখতে হবে খাতায়। সে যখন যাবে ওসব জায়গায়, বেনুকেও খবর দেবে, যাতে বেনু তার স্বামীকে নিয়ে চলে আসতে পারে। আরও ভালো হয় যদি সোহেল নিজেই বেনুকে বিয়ে করে ফেলতে পারে। দুজনে মিলে অনেক দেশ ঘুরবে তখন। সোহেল কোনমতে লন্ডন আম্রিকা যেতে পারলে গোলাপি চাচী তাতে আপত্তি করবেন বলে মনে হয় না। দুই বাড়ি মিলে সোহেলই যা একটু গোলাপি চাচীর ভক্ত, নয়তো চাচীর রূপ আর শুকুর চাচার সৌদি রিয়েল এ বাড়ির সকলের চক্ষুশুল। চাচীকে কেউ দেখতে পারে না এ তল্লাটে। 

কিন্তু পরদিন বেনুদের বাড়িতে বিরাট হই চই শুরু হয়ে গেলো। মামলায় শুকুর আলি চাচা শুধু হেরে যায়নি, তাকে বিরাট অংকের ক্ষতিপূরণও দিতে বলা হয়েছে, অনাদায়ে কারাদন্ড। আবার মজিদ আলি হুমকি দিয়ে রেখেছে যে তার নামে গরু চুরির মামলা করা হবে। এর ফলে শুকুর মিয়ার আর সৌদি ফেরত যাওয়া লাগবে না, এখন দেশে বসে জেলের ঘানি টানতে হবে তাকে ইত্যাদি ইত্যাদি। আদালতে সবার সামনেই লেগে গিয়েছিলো হাতাহাতি, লোকজন মিলে টেনে দুই ভাইকে থামিয়েছে সেখানে। সন্ধ্যাবেলা সোহেলের বাপ মজিদ আলি যখন বাড়ি ফিরলো মিষ্টি আর জিলাপির প্যাকেটহাতে হাসিমুখে, তখন বেনুর বাবা শুকুর আলি ফিরলো রাগে অপমানে ফুঁসতে ফুঁসতে। বেনুর মা সব শুনেরান্নাঘরে ঢুকে মরাকান্না কাঁদতে বসলো। দাদা শ্বশুড়ের জমির প্রতি কোন আগ্রহ তার নাই, কিন্তু বেনুর বাপ যদি সৌদি আরব ফেরত যেতে না পারে তবে এ বাড়িতে তার ঠাঁটবাট সবই যে যাবে। মাস শেষে কাঁচা টাকা আসবে না হুন্ডি হয়ে, অব্যাহত থাকবে না বছরে দুবার বিদেশি সেন্ট, জর্জেট শাড়ি, দামি মোবাইল ফোন কি মখমলের মতো নরম কম্বল আসা। বাপের বাড়ি গাদা গাদা উপহার নিয়ে বছরে একবার বেড়াতে যাওয়া হবে না। আর বেনুকে অনেক যৌতুকের বিনিময়ে বিদেশি পাত্রের সাথেও বিয়ে দেয়া সম্ভব হবে না সেক্ষেত্রে।

“আপনে এই সব দিগদারির মইদ্যে আর থাইকেন না। পুরান বাড়ির যা খুশি হউক। আপনে সৌদি যান গা। বাড়িত তো আরও ময় মুরুব্বি আছে, হেরা যা করার করবো।‍“ কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলো বেনুর মা। কিন্তু শুকুর আলির তখন রাগে দুঃখে শরির জ্বলছে। অপমানে চোখ দিয়ে যেন আগুনের হলকা বের হচ্ছে তার। দুই পয়সার মজিদ আলির এত সাহস! সবার সামনে তার শার্টের কলার ধরে হুমকি দিলো। তাকে জেলের ভাত খাওয়াবে বলে শাসালো! আদালতে এমন ভাবটা দেখালো যেন শুকুর আলি একটা ছিঁচকে চোর। গরু চুরির অপবাদ! ছিঃ। শুকুর আলির উঠানে স্বপক্ষের আত্নীয় স্বজনরাও উত্তেজিত। এই অপমানের শোধ নিতেই হবে। এভাবে ছেড়ে দেয়া যায় না।

শুকুর মিয়া তুমি পাল্টা মামলা করো।

হেরেও ফাসাও। জেলের ভাত খাওয়াও।

হে নিজেরে কি মনে করছে?

আমরা তুমার লগে আছি শুকুর মিয়া। ডরাইও না।

মজিদরে ছাড়ন যইবো না। হেরে নির্ব্বংশ করতে অইবো।

উঠানে উত্তেজনা ক্রমবর্ধমান। এই সব হই চই ঝুট ঝামেলার মধ্যে মাকে আলমারি থেকে ভিউ মাস্টার বের করে দেবার কথা কি করে বলে বেনু? সে মন খারাপ করে বিছানায় বসে সোহেল ভাইয়ের দেয়া মার্বেলগুলো বের করে। সোহেল ভাইজান নানা রঙের মার্বেল জমায়। আরও জমায় ভিনদেশি ভিউকার্ড। বিদেশি ডাকটিকিট। পত্রিকায় ছাপানো সব ভ্রমণ কাহিনী পেপার কাটিং করে নিয়ে আসে বেনুর জন্য। একটা বড় টালি খাতায় আঠা দিয়ে সেগুলো লাগিয়ে রাখে আর মাঝে মাঝে খুলে পড়ে। বিদেশ ঘোরার খুব শখ সোহেল ভাইজানের। সোহেল ভাইজান আর কয়েক মাস পরে মেট্টিক পাশ করলেই বিদেশ চলে যাবে। বেনুর আব্বার আর বড় ভাই সাজাহানের মতো। বছরে হয়তো একবার কি দুইবার আসবে। অনেক জিনিসপত্র আর উপহার নিয়ে আসবে সবার জন্য। চকলেট, কসমেটিকস আর চুলের ব্যান্ড। এই রকম খেলনা তখন সোহেল ভাইজান নিজেই কত কিনতে পারবে অনায়াসে। নাহ, কাল এই মার্বেলগুলো ফেরত দিয়ে দেবে বেনু। এই সব ভাবতে ভাবতে বেনু বারঘরে মেহমানদের থাকার ঘরের বিছানায়ই শুয়ে পড়লো। মা তখনও রান্নাঘরে। রাতের খাওয়া হয় নি, উঠানে বাবার সাথে মিটিং এ বসা লোকজনকে কাপের পর কাপ চা পাঠাতে হচ্ছে। বাইরে সকলের উত্তেজিত কন্ঠস্বর। চেঁচামেচি। শুকুর আলি কাঠের চেয়ারে বসে ফুঁসছে কেবল। বেনু ঘুমের মধ্যে বিলিতি আকাশের স্বপ্ন দেখতে শুরু করলো।

পুরান বাড়ির বড় মাদার গাছটা যে সবুজ শ্যাওলা ধরা নোনা জীর্ণ পাঁচিলটার  গায়ের ওপর উঠে আসছিলো গত রাতের ঝড়ে সেই দেয়াল হুড়মুড় করে সত্যি ভেঙে পড়েছে। ভেতরের বড় বড় কচু গাছের ওপর পাৃচিলের ইট চাপা পড়ায় ব্যাঙগুলো সব পালিয়ে গেছে নিরাপদ আশ্রয় ছেড়ে। বৃষ্টির পানি জমে আছে জঙ্গলের ভেতর, এখানে ওখানে, রোদ পড়ে ঝকমক করছে কোথাও। সেই অগোছালো জঙ্গল আর ঝোপ ঝাড়ের প্যাক কাদার মধ্যেই পড়ে ছিলো বেনুর ছোট্ট শরিরটা। তার পরনে লাল বুটিদার ফ্রক, ফ্রকের কাঁধ আর বুকের কাছে কুচি দেয়া, খয়েরি চুলগুলো এলোমেলো মুখের ওপর এসে পড়েছে। তার ফরসা পা দুটো দেবে আছে কাদা আর আগাছার মধ্যে। বেনুর বাঁ হাতের মুঠোয় ধরা মার্বেলগুলোর তিনটি গড়িয়ে পড়েছে নোংরা কাদার মধ্যে, দুটো তখনও আঙুলের ফাঁক গলে বেরোতে পারে নি, আটকে আছে ফরসা হাতের তেলোয়। আর তার খোলা স্থির চোখ দুটোতে তীব্র অবিশ্বাস আর বিস্ময়; এই আশ্চর্য, রহস্যময় জগতের না জানি কত কিছু সে দেখে ফেলেছে এ বয়সেই, অবাক হবার যেন আর কিছু বাকি নেই তার এ ছোট্ট জীবনে। বিশাল মাদার গাছটার নিচে গ্রামবাসীদের গিজগিজে ভিড়। মুয়াজ্জিন সাহেব জোরে জোরে দোয়া কুনুত পড়ছিলেন। কেউ কেউ গাছের ওপর চড়ে বসেছে দৃশ্যটা আরেকটু ভালো করে দেখার আশায়। মহিলারাও মাথায় ঘোমটা টেনে মুখে আঁচল চাপা দিয়ে ঘটনা দেখতে এসেছে।ছভিউ মাস্টার দর্শনের আশায় পূর্ব পরিকল্পনা মতো এখানে এসে প্রথম সোহেলই দেখতে পেয়েছিলো বেনুকে। তার চিৎকার শুনে লোক জমায়েত হয়েছিলো একে একে। বেনুদের বাড়ি থেকে উথাল পাতাল করে ছুটে এসেছিলো গোলাপি চাচী। এসে মাদার গাছের নিচে স্থানুর মতো দাঁড়িয়েছিলো সেই কখন থেকে। তারও কয়েক ঘন্টা পর এসেছিলো পুলিশ। বেনুর ছোট্ট শরিরটা কাপড়ে মুড়ে জিপগাড়িতে উঠিয়ে নেবার পর তারা সোহেল আর তার বাপ মজিদ আলিকেও কোমরে দড়ি বেঁধে গাড়িতে উঠিয়ে নিয়েছিলো এক সাথে। গাড়িতে বসেই সোহেল দেখতে পেয়েছিলো গোলাপি চাচী সাদা পোশাক পরা বুজুর্গের মতো মাদার গাছটার তলায় দাড়িয়েঁ আছে তখনও। শুকুর চাচা স্ত্রীর হাত ধরে তাকে ঘরে নিয়ে যেতে চাইলে জ্বলন্ত চোখে তার দিকে ফিরে একবার চেয়েছিলো শুধু গোলাপি চাচী। সোহেল তখন অবাক হয়ে দেখছিলো বেনুর কাপড়ে মোড়া হাত থেকে দুইটা চকচকে মার্বেল কখন যে গড়িয়ে জিপের মধ্যে তার পায়ের কাছে এসে গড়িয়ে যাচ্ছে সিটের নিচে। মার্বেল জিনিসটা আমাদের জীবনের মতোই রহস্যময়, কখন যে কোথায় গিয়ে ঠেকবে কেউ বলতে পারে না।

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত