| 28 মার্চ 2024
Categories
ইরাবতী তৃতীয় বর্ষপূর্তি সংখ্যা

বাংলাদেশের বিকল্প ধারার চলচ্চিত্র: কিছু অভিজ্ঞতা ও উপলদ্ধি

আনুমানিক পঠনকাল: 12 মিনিট

বিকল্প চলচ্চিত্র, সমান্তরাল চলচ্চিত্র অথবা দ্বিতীয় চলচ্চিত্র যে নামেই অভিহিত করা হোক না কেন, বিভিন্ন দেশে তা, বিভিন্নভাবেই যাত্রা শুরু করেছে। এই বিভিন্নতার পেছনে রয়েছে সরকারি ও বেসরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সমর্থন, দর্শকদের রুচিবোধ, সমাজের গণতন্ত্রায়ণের অবস্থা, কারিগরী উপরিকাঠামো, সেন্সরশিপের ধরণ ও আরও কিছু দেশীয় কারণ। বাংলাদেশে বিকল্পধারার চলচ্চিত্রের বিকাশে এই সব প্রয়োজনীয় পূর্বশর্তের কিছুই তেমন উপস্থিত নেই। ষাটের দশকের দিকে বাস্তববাদী কাহিনীচিত্র নির্মাণের কিছু আন্তরিক প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা গেলেও প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের বিকল্পধারার চলচ্চিত্রের সূচনা ঘটে ১৯৭১ সালে যখন জহির রায়হান- আলমগীর কবীর জুটি “স্টপ জোনোসাইড” ও “লিবারেশন ফাইটার্স” ছবি দুটি তৈরি করেন। এটা বিশেষ উল্লেখযোগ্য যে, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সেই দুর্যোগঘন পরিস্থিতিতে, সম্পদের অপ্রতুলতা সত্তে¡ও, মুজিবনগরে এই ধরণের মননশীল ছবি নির্মিত হয়েছিল এবং দুঃখজনক যে, স্বাধীনতাপরবর্তী সরকারগুলির আমলে বাংলাদেশ আরও অনেক বেশি সম্পদের অধিকারী হলেও এই ধারাটি পরিত্যক্ত হয়।

দুঃখবোধ আরও গভীর হয় এ কারণে যে, ব্যাপক নিরক্ষরতার দরুণ (আমাদের জনসংখ্যার মাত্র চল্লিশ ভাগ সাক্ষর) বাংলাদেশে মুদ্রিত শিল্পের ক্ষমতা সীমিত হতে বাধ্য। পক্ষান্তরে চলচ্চিত্র, টেলিভিশন, ভিডিও তথা দৃশ্যরূপের যে কোনও ধরণের প্রকাশেরই রয়েছে অসীম সম্ভাবনা।

আগেই বলা হয়েছে চলচ্চিত্রে ষাটের দশকের সামাজিক বাস্তবতা এখন আর নেই, যেমনটি “তিতাস একটি নদীর নাম” (১৯৭৩) বা “পালঙ্ক” (১৯৭৭) ছবিতেও আমরা পেয়েছি। “সূর্য দীঘল বাড়ী” (১৯৭৯) সম্ভবত ছিল এই ধারার ছবির শেষ উজ্জ্বল উদাহরণ। আমাদের মত তৃতীয় বিশ্বের একটি গরীব দেশে সরকার হচ্ছে সবচেয়ে ক্ষমতাধর সামাজিক সংস্থা। তাই এই ব্যর্থতার দায়ভার সবচেয়ে বেশি বর্তায় সরকারেরই ওপর।

সত্যিকার অর্থে সরকার নিজেই একাট সমস্যা। বিগত কয়েকটি সরকারের আমলে সরকারী কর্তাব্যক্তিদের অদূরদর্শী ও অসংবেদনশীল সিদ্ধান্তহীনতার কারণে অবহেলিত চলচ্চিত্র মাধ্যমটি পেন্ডুলামের মতো কেবল দুলে বেড়িয়েছে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় ও তথ্য মন্ত্রাণলয়ের মধ্যে!

এটা দুঃখজনক যে, স্বাধীনতার প্রায় দু’দশক পরে গণতান্ত্রিকভাবে নিবার্চিত সরকারগুলি ভাল ছবির পৃষ্ঠপোষকতার ব্যাপারে তেমন কোনো সুনির্দিষ্ট নীতিমালা গ্রহণ করতে পারেনি। মন্ত্রীরা আসে যায়! সেমিনার-সমাবেশে তাঁরা চলচ্চিত্রের উন্নতির বিধানে অনেক ভাল ভাল কিছু কথা বলেন। কিন্তু হায়! বাস্তবে ঘটে না কিছুই। দূরদর্শী সাংস্কৃতিক নীতির অনুপস্থিতি এবং উচ্চাসনে অর্ধশিক্ষিত আমলাতন্ত্রের অবস্থানের কারণে, মন্ত্রণালয়ের অবস্থানও বলা চলে, কাফকা বর্ণিত জগতটির মতোই বন্ধা।

দূরদৃষ্টির অভাব, শিথিল গা-ভাসানো মনোভাব, দূর্নীতি এবং আর দশটা সরকারি সংস্থার মতো নিজস্ব উদ্যোগের ঘাটতির কারণে এফডিসিও (ফিল্ম ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন) হয়ে উঠেছে নিছক এক লুম্পেন স্বপ্নব্যবসায়ী এবং উদ্গীরণ করে চলছে বস্তাপচা সব বাণিজ্যিক ছবি। বাংলাদেশের বাস্তবতার সঙ্গে সম্পর্কবিহীন, স্থূল ও হিংসাত্মক এই সব ছবি, যাদের চিহ্নিত করা হয় অ্যাকশান (!) সামাজিক অ্যাকশান (!!) ও সুপার অ্যাকশান (!!!) ছবি হিসাবে, সেসবই এখানে নিয়মিত নির্মিত হয়ে চলেছে।

সাম্প্রতিককালে টিনএজারদের প্রেম চলচ্চিত্রে খুবই লাভজনক বিষয়বস্তু হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রত্যেক দশকে কিশোর-কিশোরী বা টিনএজারদের নতুন এক প্রজন্ম তৈরি হয় এবং তাদের দিকে লক্ষ্য রেখেই নির্মিত টিনএজ প্রেমকাহিনীর ছায়াছবি এক মুনাফাদায়ক পণ্য হয়ে ওঠে।

প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের কাহিনীচিত্র তৈরীর মূলধারার ব্যবসাটি দীর্ঘদিন ধরেই শুধুই এক কালো টাকা সাদা করার নোংরা ব্যবসায়ে পরিণত হয়ে গেছে। সুতরাং এটা বিস্ময়কর নয় যে, বাংলাদেশের মতো একটি হতদরিদ্র দেশে বছরে সত্তরআশিটি পূর্ণদৈর্ঘ্য ছবি নির্মিত হলেও এর একটিও পাতে দেবার মতো নয়। এই ছবিগুলো হচ্ছে লুম্পেনদের জন্যে, লুম্পেনদের নিয়ে, লুম্পেনদের দ্বারা নির্মিত সব ছবি। এইসব ছবির স্থূলতা এবং সিনেমা হলগুলোর অস্বস্তিকর পরিবেশের কারণে সংবেদনশীল মানুষদের সঙ্গে দেশীয় চলচ্চিত্র শিল্পের সৃষ্টি হয়েছে এক চরম বিচ্ছিন্নতা। চিত্তাকর্ষক দুই বিকল্প চ্যানেল টিভি এবং ভিডিওর আগমনের ফলে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক ছায়াছবির ভবিষ্যৎ অস্তিত্ব নিয়েই আজ মনে প্রশ্ন জাগছে।

তবে আমার ধারণা আমাদের চলচ্চিত্রভক্ত দর্শকবৃন্দ এবং সামাজিকভাবে অনুমোদিত বিকল্প বিনোদন ব্যবস্থার অনুপস্থিতি সিনেমার আয়ুকে এদেশে আরও দীর্ঘকালই টিঁকিয়ে রাখবে। এ কারণে এই বাস্তবতা কাউকে অবাক করে না যে, বিশ্বের অন্যান্য অংশে যখন সিনেমা হলগুলো ব্যবসা গুটিয়ে নিচ্ছে, তখন বাংলাদেশের শহর ও সেই সঙ্গে গ্রামাঞ্চলেও, নতুন নতুন সিনেমা হল গজিয়ে উঠছে।

প্রতিবন্ধকতা ও সরকার

ডকুমেন্টারি বা প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ আগামীর চলচ্চিত্র নির্মাতাদের জন্যে একটি ভাল লালনক্ষেত্র হয়ে উঠতে পারে। বাংলাদেশের প্রামাণ্যচিত্রের প্রেক্ষিতটা একটু দেখা যাক। প্রতি বছর সরকারের চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তর খুব স্থূল ধরণের কিছু প্রচারমূলক প্রামাণ্য ছবি তৈরি করে। এসব ছবিকে বড়জোর “ফুটেজ” (ভড়ড়ঃধমব) বলা যেতে পারে, ঠিক ফিল্ম নয়। এদেশের ডিএফপি প্রতিবেশী দেশ ভারতের চলচ্চিত্র অধিদপ্তর এনএফডিসির মতো নয়, যেখান থেকে সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক, মৃণাল সেন, আদুর গোপালকৃষ্ণান অথবা মনি কাউলের মতো নির্মাতাদের ছবি নির্মিত হয়েছে। এটা পশ্চিম বাংলার রাজ্য সরকারের চলচ্চিত্র নির্মাণের মতোও নয় যা তার সীমিত সম্পদ নিয়েও কিছু ভাল প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করেছে, যেমন, “টুমরো ইজ টু লেট”, “কবিতার অনন্ত যাত্রাপথে”, “মিটিং এ মাইলস্টোন”, “বীরভূমের পটচিত্র”ইত্যাদি।

একটি ভাল প্রামাণ্যচিত্র ছবি হতে পারে সাংবাদিকতাসুলভ কিম্বা উন্নত হতে পারে কাব্যিক এক স্তরে (“নাইটমেল” ছবিতে রেলের চাকার ঘূর্ণনের সঙ্গে অডেনের কবিতার অপূর্ব ছন্দময় সমন্বয় কে ভুলতে পারে?)। তবে আমার মনে হয় প্রামাণ্যচিত্রের সারকথা হচ্ছে সত্য, কেবলই সত্যকে তুলে ধরা। দুর্ভ্যাগবশত বাংলাদেশ সরকারের নির্মিত তথ্যচিত্রগুলো খুব কমই সত্য ও বিশ্বাসযোগ্য। চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে প্রতি বছর যে হাজার হাজার ফুট সরকারী ফুটেজ তোলা হয় তার বেশির ভাগই হচ্ছে সর্ব্বোচ পদে আসীন ব্যক্তিটির কৃত্রিম এক রূপকে তুলে ধরা। তিনি ফিতা কাটছেন বা ভাষণ দিচ্ছেন। কিন্তু ইতিহাস সর্ম্পকে আমাদের সরকারগুলির অদ্ভুত ধারণার কারণে পূর্ববর্তী সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ফুটেজগুলো পরবর্তী সরকারের আমলে পুরোপুরিই বাতিল হয়ে যায়। কেউই পতিত দেবতাদের ফুটেজগুলো সংরক্ষণের প্রয়াস নেয় না! মাঝে-মধ্যে অন্য ধরণের কিছু তথ্যচিত্র ডিএফপি তৈরি করে থাকে বটে তবে সেখানে ছবির নির্মাতার সঙ্গে ডিএফপি-র অসৎ কর্তাব্যক্তিদের এক ধরণের অশুভ আতাঁত পরিলক্ষিত হয়। ডিএফপি-র মানদন্ডে যোগ্য বিবেচিত ছবিনির্মাতা যে একজন দক্ষ পরিচালক হবেন এমন কোনো কথা নেই। সর্বক্ষমতাধর মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে তার যোগসূত্রটাই সেখানে মূল নিয়ামক হিসাবে কাজ করে। একটি প্রকল্পের কাজ সূচিত হওয়ার আগেই টেবিলের তলা দিয়ে বড় রকমের টাকার লেনদেন হয়ে যায়। ফলে ক্ষতি হয় চলচ্চিত্রটির এবং করদাতাদের টাকা মিলিয়ে যায় হাওয়ায়!

সরকারি অর্থে পরিচালিত অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মধ্যে শিশু একাডেমী মাঝে-মধ্যে কিছু ছবি নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। কিন্তু সেখান থেকেও উল্লেখযোগ্য কোনো কিছু এখনও নির্মিত হয়নি।

বাংলাদেশে ভাল ছবি নির্মাণের ক্ষেত্রে আরেকটি বাঁধা হচ্ছে, আমাদের মান্ধাতা আমলের সেন্সর বিধিমালা। বর্তমানে প্রচলিত সেন্সরশিপ নীতিমালার উৎস হচ্ছে বৃটিশ ভারতের “সিনেমাটোগ্রাফি অ্যাক্ট ১৯১৮।” বৃটিশরাজের শাসন যদিও আজ স্মৃতিপটে ফসিল হয়ে গেছে তথাপি “সেন্সরশিপ অ্যাক্টস রুল ১৯৭২’, ‘১৯৭৭ -য়ের চলচ্চিত্র আইন’ অথবা ১৯৮৫ সালের নতুন সেন্সর বিধিমালা, তথা বাংলাদেশে বিদ্যামান সকল সেন্সর বিধিই রয়ে গেছে বৃটিশ ঔপনিবেশিক যুগের মতোই গণতন্ত্রবিরোধী এবং নির্লজ্জভাবে প্রকাশ করছে ঔপনিবেশিক মানসিকতার প্রভাব। বিভিন্ন সৎ ছবির মুক্তিদান বাঁধাগ্রস্ত করে চলছে সেন্সর বোর্ড। আমার একটি ছবি “নদীর নাম মধুমতী” মুক্তি দানের জন্যে হইকোর্ট পর্যন্ত যেতে হয়েছিল। “স্মৃতি ’৭১” নামের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ইসলামী মৌলবাদীদের দ্বারা বুদ্ধিজীবী হত্যার উপর নির্মিত একটি প্রামাণ্যচিত্র তো আজও সেন্সরের নাগপাশ থেকে বের হতে পারেনি।

এই গণতন্ত্রবিরোধী সেন্সর নীতিমালা ও তার চর্চা এবং মন্ত্রণালয়ের উঁ”ু স্তরে অসংবেদনশীল আমলাতন্ত্রের কারণে শিল্পসম্মত চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে বড় ধরণের সাফল্য অর্জনের সম্ভাবনা বাংলাদেশে বেশ সুদূরপরাহতই।

নতুন ধারণা নতুন প্রত্যয়

১৯৮৪-৮৫ সালে “আগামী”, “হুলিয়া” পথ করে দেবার পর নির্মিত হো’ল কয়েক ডজন স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র। ফলে বাংলাদেশে বিকল্প চলচ্চিত্র জগতে এক নতুন ধারার সৃষ্টি হোল। যদিও এখনও এটি প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে, তা সত্তে¡ও এই তরুণ চলচ্চিত্রনির্মাতারা একটা নিজস্ব বিকল্প বিতরণ ব্যবস্থা চালু করতে সফল হয়েছে। চিত্রনাট্য লেখা থেকে শুরু করে নিজস্ব প্রদর্শন ব্যবস্থা, নির্মাতাদের ছবি করার প্রাথমিক চিন্তা থেকে শুরু করে শুটিং করা ও ১৬ মিঃ মিঃ প্রজেক্টরের মাধ্যমে সেসব ছবি যথাযথ প্রদর্শনের ব্যবস্থা পর্যন্ত, পুরো প্রক্রিয়াটাই বিকল্পধারার চলচ্চিত্রকারদের নিজেদেরকেই সম্পন্ন করতে হচ্ছে।

সাধারণত এই ছবিগুলো ১৬ মি. মি.য়ে শুট্ করা হয়। ৩৫ মি. মি.ও ১৬ মি. মি. ছবির মধ্যে বাছাই করার প্রশ্ন কেবল দু’টি ভিন্ন ফর্মাটের মধ্যে বাছাইয়ের বিষয় নয়, এটি হচ্ছে ছবি নির্মাণের দুই ধরণের দৃষ্টিভঙ্গি, দুই ধরণের আদর্শের মধ্যে বাছাই। একটি বাণিজ্যিক ধারা, আরেকটি গণমুখী ধারা।

সব ধরণের শিল্পের মধ্যে চলচ্চিত্রের শূন্যে তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে কম। কারণ চলচ্চিত্র হচ্ছে একটি নির্দিষ্ট আর্থসামাজিক বাস্তবতার ফসল যার নির্মাণের সঙ্গে জড়িত রয়েছে অর্থ ও শ্রম। তাই কোনো সমাজের বাস্তব বৈশিষ্ট্যের ছাপগুলি সে দেশের চলচ্চিত্রের অবয়বে ফুটে উঠবেই এবং আমাদের চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে স্বাভাবিকভাবে যে ছাপটা পড়ছে তা হোল সমসাময়িক বাংলাদেশের অমসৃণ বাস্তবতা।

তৃতীয় বিশ্বের কিছু কিছু দেশে পশ্চিমের চলচ্চিত্র উৎসবগুলির দিকে চোখ রেখে কারিগরীভাবে মসৃণ এক ধরণের “বিকল্প ধারা”র(!) ছবি নির্মাণ করা হয়। তবে বাংলাদেশে ঠিক চলচ্চিত্র উৎসবের কথা মনে রেখে “বিকল্প ধারা”র চলচ্চিত্র তেমন নির্মাণ করা হয় না (আমরা এই ধরণের উৎসবের নামও বিশেষ জানি না)। আমাদের ছবিগুলো কারিগরীভাবে দুর্বল। কিন্তু যেহেতু এসব ছবির লক্ষ্য হচ্ছে জনগণ, তাই এসব ছবিতে এদেশের মাটির গন্ধটা পাওয়া যায়। প্রকৃত পক্ষে কিছু কিছু স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবি নির্মিত হয়েছে যার লক্ষ্য দর্শকদের নান্দনিকভাবে আনন্দ দেয়া যতটা নয় তার চেয়ে বেশী বরং উদ্দীপ্ত করা। অনেকটা “এজিটপ্রপ” ধারায় নির্মিত ছবির মতো।

ষাটের দশকের শেষে এবং সত্তর দশকে কলকাতায় এক ধরণের বিকল্পধারার চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছিল মধ্যবিত্তের ক্ষয়িষ্ণু আর্দশের জগত নিয়ে, একজন রাগী যুবক ছিল যার কেন্দ্রবিন্দুতে, যেমন “পদাতিক”, “ইন্টারভিউ”,“ দূরত্ব”, “প্রতিদ্বন্দ্বি”, “দৌড়” প্রভৃতি। ঢাকার বিকল্পধারার ছবিতে এমনই এক প্রতীক হয়ে উঠেছে ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধের অবক্ষয়ের পটভূমিকায় প্রতিবাদী তরুণ সমাজ। এটি বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয় যে, বেশির ভাগ স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবিনির্মাতা তাদের কাজের হাতেখড়ি ঘটান ১৯৭১-য়ের উপর কোনো ছবি নির্মাণের মাধ্যমে। এর অন্যতম কারণ হয়তো এই তরুণ যুবকদের বেশীর ভাগই ১৯৭১-এর যুদ্ধের সময় ছিলেন বালক, কিশোর, তাদের মনোজগত গড়ে ওঠার যেটা ছিল সবচেয়ে সংবেদনশীল সময়। সেই কারণে হয়তো ১৯৭১-য়ের যুদ্ধের অভিঘাত তাদের ছবিতে বারবার দেখা দেয়।

আমাদের এই উপমহাদেশে মাঝ মাঝে দেখা যায় কোনো কোনো আভা গার্দ ছবি আর্থিক ঝুঁকি এড়াতে কিছু যৌনাত্মক দৃশ্যের আশ্রয় নেয় (যেমন গোবিন্দ নিহালনি’র “আক্রোশ”-য়ের শারীরীক প্রেমদৃশ্য কিংম্বা “চক্র” ছবিতে স্মিতা পাতিলের স্নান দৃশ্য)। কিন্তু বাংলাদেশে দেখা যায় রাজনৈতিক বাঁধা-নিষেধের আরোপিত দিকগুলোকে চ্যালেঞ্জ করার মাধ্যমেই ছবিগুরো জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। তবে এসব রাজনৈতিক প্রতীকগুলি বাংলাদেশের জন্যে এতই বিশিষ্ট ও সমকালীন যে বাইরের কেউ কারিগরীভাবে দুর্বল এই সব ছবিতে হয়তো আলাদা কিছু খুঁজে পাবেন না। কিন্তু বাংলাদেশের দর্শকেরা সেন্সরের দৃষ্টি এড়াতে পারা ও রাজনৈতিক স্পর্শকাতর উপাদানকে ছবিতে দেখাতে পারাকে এক আনন্দদায়ক অভিজ্ঞতায় রূপান্তর করতে ইতিমধ্যে দক্ষ হয়ে উঠেছেন। লক্ষ্য করার বিষয় যে, এই সমস্ত স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবি বেশি প্রদর্শিত হয় ডিসেম্বর-মার্চ মাসে, যে সময়কালটি মূলত: বাংলাদেশের ব্যাপক রাজনৈতিক কর্মকান্ডের সময়। এতে অবাক হবার কিছুই নেই। এটা বোধহয় আমাদের বিধিলিপি যে, আমরা রাজনৈতিক আন্দোলনের সাথে বেড়ে উঠেছি এবং বোধ হয় এর সঙ্গেই বিলুপ্ত হব। বস্তুত আমরা ভাল করেই জানি, “জাতীয়” কিংবা “জাতীয়তাবাদী” যারাই ক্ষমতায় থাকুক না কেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় চরিত্র একই রইবে— সা¤প্রদায়িক, আমলাতান্ত্রিক এবং শিল্পবোধহীন। সুতরাং আমাদের প্রত্যেককেই একজন চলচ্চিত্রকর্মী হওয়ার পাশাপাশি একজন প্রতিষ্ঠানবিরোধী রাজনৈতিক কর্মীও হয়ে পড়তে হচ্ছে।

একই সময়ে আমরা এস্টাব্লিশমেন্ট দ্বারা নিছক “স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রনির্মাতা” হিসেবে পিঠচাপড়ানি ও প্রান্তিকীকরণকে প্রত্যাখান করি। আমরা হচ্ছি স্বাধীন চলচ্চিত্রনির্মাতা, বাস্তববাদী চলচ্চিত্রনির্মাতা অর্থাৎ প্রকৃত চলচ্চিত্রনির্মাতা, বাদবাকিরা হচ্ছে— ব্যবসায়ী।

যদিও আমরা বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে ১৬ মি.মি.য়ে কাজ করি তবুও মাধ্যম হিসাবে আমরা ভিডিওÑর সম্ভাবনাকেও গুরুত্ব দিয়ে থাকি। আমি মনে করি, আমাদের সময়ের বিকল্পধারার ছবি নির্মাতাদের সকলকেই ভিডিও নিয়ে কাজ করতে শিখতে হবে। এই দুটি মাধ্যম একেবারে পৃথক কিছু নয়। কোনও চলচ্চিত্রনির্মাতা হয়তো ভিন্ন প্রেক্ষিত ও ভিন্ন বিষয়বস্তু অনুযায়ী এই দুই আলাদা ধরণের মাধ্যমেই কাজ করবেন। ডিজিটালের প্রভাবে ভিডিওর দৃশ্যমান উন্নয়নের ক্ষেত্রে পরিবর্তন ঘটেছে এবং ফিল্ম সংরক্ষণের জন্যে উচ্চ পেশাদারী মানসম্পন্ন টেপ তৈরির গবেষণা চলছে। এইসব নতুন কৌশলগত উন্নয়ন, এবং এক্ষেত্রে আগামীতে আরও অনেক নতুন নতুন উন্নয়নের ফলে ভিডিও, বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে ডকুমেন্টেশনের উন্নত মান সুনিশ্চিত করবে, এবং সম্ভব করে তুলবে, গ্রিয়ারসন যাকে বলেছেন; “বাস্তবতার সৃজনশীল রূপায়ন”। সাম্প্রতিককালের ভিডিও উত্থানকে অবহেলা করাটা তাই প্রবাদের সেই উট পাখির মতোই আচরণ হবে। আসুন সেলুলয়েড বনাম ভিডিও-র বিতর্কটি আমরা চিরতরে পরিহার করি এবং এ দু’য়ের সঙ্গেই একত্রে জীবনযাপনে অভ্যস্ত হই।

ইচ্ছায় কি অনিচ্ছায় ভিডিও একটা দ্রোহমূলক কাজ করছে। তা হচ্ছে তা সেন্সর ব্যবস্থাকে অর্থহীন করে তুলেছে। পাড়ার মোড়ের যে কোনো ভিডিও-র দোকানে যদি একবার ঘুরে আসা যায়, তাহলে আমি কি বলতে চাচ্ছি তা সহজেই বোঝা যাবে। একজন বিকল্পধারার চলচ্চিত্রনির্মাতাকে এই বিকল্প সম্ভাবনাকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করতে শিখতে হবে।

আমাদের আন্দোলনের সঙ্গে প্রায়ই গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলনের প্রতিতুলনা টানা হয়, যে গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলন বর্তমানে বয়োপ্রাপ্ত হয়েছে এবং দেশে-বিদেশে সম্মানের আসন অর্জন করেছে। কিন্তু আমি মনে করি এই দু’য়ের মধ্যে মৌলিক কিছু ভিন্নতা রয়েছে। থিয়েটারের চেয়ে চলচ্চিত্র অধিক ব্যয়বহুল এবং জটিল মাধ্যম। তাছাড়া চলচ্চিত্র হচ্ছে প্রযুক্তিগত মাধ্যম এবং বাংলাদেশে এই প্রযুক্তির একচ্ছত্র মালিকানা রয়েছে অসংস্কৃত এক সরকারি প্রতিষ্ঠানের। কিন্তু এ দু’য়ের মধ্যে সবচেয়ে বড় পার্থক্য হচ্ছে বাংলাদেশে কোনো প্রতিষ্ঠিত বাণিজ্যিক থিয়েটার নেই যার সঙ্গে গ্রুপ থিয়েটারকে প্রতিযোগিতা করতে হয়েছে বা হচ্ছে। কিন্তু বিকল্পধারার চলচ্চিত্র নির্মাতাদের প্রতি পদে শক্তিশালী ও প্রতিষ্ঠিত এক বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের বৈরিতার মোকাবেলা করে এগিয়ে যেতে হচ্ছে।

বহুমুখী সমস্যা

এই পটভূমিকায় বাংলাদেশে স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র তৈরি হচ্ছে। কিন্তু সমস্যা রয়েছে বিভিন্ন ধরণের। তহবিলের স্বল্পতা সবচেয়ে তীব্র সমস্যা। অর্থ ছাড়া কোনও কাজ হয় না, অন্তত চলচ্চিত্রে তো নয়ই। যদিও আমাদের চলচ্চিত্রের বাজেট একেরারেই বাহুল্যবর্জিত, তা সত্ত্বেও ওই পরিমাণ অর্থ যোগাড় করাও এক পর্বতপ্রমাণ সমস্যা। প্রতিবেশী দেশ ভারতের এনএফডিসি অথবা দূরদর্শনের মতো কোনও সংস্থার সমর্থন না থাকাতে বাংলাদেশে সৎ ও বাস্তববাদী ছবির জন্যে অর্থ সংগ্রহ করা এক কঠিন প্রক্রিয়া হয়ে রয়েছে। ভাল ছবির জন্যে সরকারি অনুদানও আমাদের কাছে এক মরীচিকা। খুব সামান্য দু’একজনই পান। সাম্প্রতিককালে একটা কৌতুক প্রচলিত হয়েছে, যদি কোনো করুণ চেহারার যুবককে ঘুরে বেড়াতে দেখেন যে সবার কাছে টাকা ধার চাইছে তবে নিশ্চিত হতে পারেন যে যুবকটি হচ্ছে একজন স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাতা!!

আর এত বাঁধা পেরিয়ে ছবি তৈরীর পর কেউ টাকার ব্যবস্থা করে উঠতে পারলেও দেশে যথাযথ ১৬ মিঃ মিঃ অবকাঠামোর অভাবে প্রযুক্তিগত বিঘ্নগুলো একজনকে বাঁধাগ্রস্ত করেই যেতেই থাকে। কাঁচামালের অভাব আরেকটি বাঁধা, নেগেটিভ ও পজেটিভ দুই ধরণের ফিল্মেরই অভাব রয়েছে। ম্যাগনেটিক টেপ, এমন কী একটা সামান্য স্পাইসার পাওয়াও এদেশে একটি জটিল সমস্যা। এফডিসি-র দীর্ঘদিনের প্রতিশ্রুতি ১৬ মি.মি.-য়ের একটা অবকাঠামো গঠনের কাজ শম্বুকগতিতে চলছে এবং ডিএফপি-র মান্ধাতা আমলের যন্ত্রপাতি দ্রুত অব্যবহারযোগ্য হয়ে পড়ছে। কলাকৌশলগতভাবে নিখুঁত ছবি আমাদের কাছে এখনও তাই স্বপ্ন। আমাদের চলচ্চিত্রের ছবি এবং শব্দের মানের দিক লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, প্রিন্টগুলো হিজিবিজি দাগ ও ফুটকিতে ভরা, ছবি ঘোলাটে এবং সাউন্ডট্রাক প্রায়শই শ্রুতিগোচর নয়। কারিগরী মানের ক্ষেত্রে আন্তরিকতাই যথেষ্ট নয় এবং এ ব্যাপারে আমরা চলচ্চিত্রনির্মাতারাও আমাদের দায়দায়িত্বের কথা অস্বীকার করতে পারি না। আমি মনে করি, শৌখিনতার দিন শেষ হয়ে গেছে এবং বিকল্পধারার চলচ্চিত্র নির্মাতাদেরকে তাঁদের কাজে পেশাদারিত্ব প্রমাণের সময় এসেছে।

প্রেক্ষাগৃহের বাইরে স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবি প্রদর্শনের জন্যে স্থানীয় প্রশাসনের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হয়। সে কারণে বিকল্পধারার চলচ্চিত্রনির্মাতাদের তাদের ছবি প্রদর্শনীর ক্ষেত্রেও প্রায়ই নানা রকম আমলাতান্ত্রিক জটিলতার সম্মুখীন হতে হয়। তাছাড়া বিভিন্ন সরকারী ও বেসরকারী মিলনায়তনগুলির ভাড়াও খুব বেশী।

আসলে বাংলাদেশে বিকল্পধারার চলচ্চিত্রের অনেক সমস্যাই প্রকৃতপক্ষে অনুন্নয়নের সমস্যা। এর অন্য দিকও আছে। অবিকশিত ধনতান্ত্রিক সর্ম্পকের কারণেই হয়তো আমরা এখনও আমাদের ছবির মালিকানা নিজেদের হাতে বজায় রাখতে পারছি। কিন্তু যখন এদেশে বাজার অর্থনীতি পুরোপুরি কার্যকর হবে তখন আমাদের স্বাধীন ইচ্ছায় ছবি নির্মাণ ও তার প্রদর্শন আমরা কতটা করতে পারব সে বিষয়ে আমার সন্দেহ রয়েছে।

সমস্যা স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র শিবিরেও রয়েছে। নির্ভেজাল বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে কতিপয় নীতিবর্জিত স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রনির্মাতা, যাদের ছবি কেবল দৈর্ঘ্যইে স্বল্প কিন্তু মূলধারার ছবির মতোই নানা রকম মুখরোচক উপাদানে ঠাসা, আমাদের ভেতরে ঢুকে পড়ছে। অতএব সাধু সাবধান !

সাম্প্রতিককালের কিছু ভাল স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রনির্মাতা এনজিও জগতের লোভনীয় ভিডিও জগতে ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে এবং তারা একেবারেই হরিয়ে যেতে পারে। যেমনটি ইতিমধ্যে আমরা বেশ কয়েকজন পুণে ফেরৎ স্নাতককে অর্থকরী বিজ্ঞাপনী ছবির লাভজনক জগতে হারিয়েছি।

প্রকৃতপক্ষে আমাদের যুদ্ধ বহুমুখী। চলচ্চিত্র হচ্ছে বিভিন্ন শিল্পধারার সমন্বয়ে এক শিল্প। সমাজে শিল্পের অন্যান্য শাখা বিকাশিত না হলে কেবল চলচ্চিত্রের কাছে খুব বেশী আশা করা সঙ্গত নয়। আমাদের সৎ সাহিত্যের কী অবস্থা ? কী অবস্থা ধ্রুপদী সংঙ্গীত, নৃত্যকলা, চিত্রকলা এবং অন্যান্য মাধ্যমের?

এটা সত্যি যে, কিছু ছবি তৈরি হয়েছে এবং এসব ছবির মাঝে কিছু ভাল দিক রয়েছে। তবে প্রত্যাশার তুলনায় তা তেমন কিছু নয়। তৈরী হওয়া কয়েক ডজন স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবির মধ্যে খুব কম সংখ্যক ছবিই হয়তো মানুষকে দেখানোর মতো।

তাছাড়া ৩৫ মি.মি.য়ের মূলধারার ছবির সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হলে ১৬ মি.মি.-য়ে পূর্ণদৈর্ঘ্য ছবি নির্মাণ করতে হবে। কেবল স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবি দিয়ে পূর্ণাঙ্গ বিকল্প সিনেমা এদেশে তৈরি করা যাবে না।

বিকল্পধারার বিতরণ অভিজ্ঞতা

চলচ্চিত্র যে একটি বিশেষ ধরণের শিল্প সে বিষয়ে সচেতনতাই যথেষ্ট নয়, এর জন্যে প্রয়োজন অর্থ, যন্ত্রপাতি, কাঁচামাল ও জনবল। একজন স্বাধীন চলচ্চিত্রনির্মাতা যেহেতু তাঁর নিজস্ব চলচ্চিত্রের প্রযোজক, ফলে তাঁকে হতে হয় একজন ভাল উদ্যোক্তাও। অন্তত উদ্যোক্তাসুলভ কিছু গুণাবলী তার মধ্যে থাকতেই হবে।

আশা করা যায়, একদিন এই অনভিজ্ঞ উঠতি চলচ্চিত্রকর্মীরা ধীরে ধীরে সামাজিক অন্তর্দৃষ্টি ও কারিগরী দক্ষতাসম্পন্ন পোক্ত একেকজন চলচ্চিত্রনির্মাতা হয়ে উঠবে। এফডিসি এবং এস্টাবিøশমেন্টের ভেতরে এবং বাইরে উভয় ক্ষেত্রেই আমাদেরকে শিখতে হবে সুকৌশলে কাজ করা। টিঁকে থাকা ও সামনে পথ চলার জন্যে বিকল্প একজন চলচ্চিত্রনির্মাতাকে যা আয়ত্ত করতে হবে তা এক জটিল ও বন্ধুর পথে চলার দক্ষতা ও মানসিক শক্তি। বস্তুত জহির রায়হান যে সমঝোতা করতে বাধ্য হয়েছিলেন এবং আলমগীর কবির যে কখনও কখনও দোদুল্যমান ছিলেন, সেই সচেতনতা আমাদেরকে শিখিয়েছে এস্টাবিøশমেন্টকে পুরোপুরিই পরিহার করতে অথবা অত্যন্ত সুকৌশলে ব্যবহার করতে।

স্বল্প বাজেট ও প্রর্দশনী সুবিধার কারণে আমাদের আন্দোলনের মূল মাধ্যমটি হচ্ছে ১৬ মি. মি.-য়ে ছবি তৈরী। বাস্তবিক পক্ষে ১৬ মি. মি.-য়ে স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবি নির্মাণের খোদ প্রক্রিয়াটিই চলচ্চিত্র নির্মাণ ও বিতরণ ব্যবস্থাটার গণতান্ত্রিকীকরণ করে ফেলেছে। চলচ্চিত্র নির্মাণ সর্ম্পকে ধারণার রহস্যময়তাও এতে দূর করা সম্ভব হয়েছে। ভিডিও প্রযুক্তির উদ্ভবের ফলে চলচ্চিত্র নির্মাণের গণতান্ত্রিকীকরণের এই প্রক্রিয়াটি আরও জোরদার হচ্ছে। এখন যে কেউ ছবি বানাতে পারেন, যদি তার যথেষ্ট নান্দনিক, আর্থিক ও সাংগঠনিক প্রস্তুতি থাকে।

আমাদের কিছু কিছু ছবি জনপ্রিয়, কেননা এইসব ছবিতে জনগণ কিছুটা হলেও তাদের জীবনের বাস্তব প্রতিচ্ছবি দেখতে পান যা বাণিজ্যিক ছবিতে তারা একেবারেই পান না। এমন কী আমাদের গোঁড়া সমালোচকেরাও স্বীকার করেন যে, বিকল্প ছবির নির্মাতারা আন্তরিকভাবে জনগণের দুঃখ-দুর্দশা ও আকাক্সক্ষাকে তুলে ধরার চেষ্টা করছেন।

আমাদের একটি সুবিধার দিক এই যে, আমাদের দেশটা নবীন। পৃথিবীর অনেক দেশে ফিল্ম সোসাইটি আন্দোলন দীর্ঘদিন ধরে ফসিল হয়ে গেছে, কিন্তু বাংলাদেশে এই আন্দোলন এখনও নতুন। এই ফিল্ম সোসাইটি আন্দোলনের তৎপরতা জন্ম দিয়ে চলেছে অনেক হবু চলচ্চিত্রনির্মাতাদের, বিকল্প পথে নামতে যাঁরা উৎসাহী ও উদগ্রীব।

এক দশক আগে আমরা যথার্থই অনুভব করেছিলাম যে আমাদের মধ্যেকার বন্ধুত্বের সম্পর্ককে প্রতিষ্ঠানিক রূপ দেয়া প্রয়োজন। তাই বর্তমানে আমরা “বাংলাদেশে শর্ট ফিল্ম ফোরাম” সংস্থায় সংগঠিত। যে সাফল্য নিয়ে সংগঠনটি গর্ব করতে পারে তা হো’ল আমাদের পরিকল্পিত বিকল্প বিতরণ নেটওয়ার্কটি চালু করতে পারা, যা এখনও বীজ আকারে হলেও চলছে। বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন, ছাত্র সংগঠন, যুব সংগঠন, ট্রেড ইউনিয়ন, জেলা এবং থানা পর্যায়ের বিভিন্ন গণসংগঠন আমাদের ছবিগুলি নিয়ে সিনেমা হলের বাইরে সমান্তরাল একটি প্রদর্শন নেটওয়ার্কও ধীরে ধীরে গড়ে তুলছেন।

যদিও বাংলাদেশে স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের মাধ্যমেই বিকল্পধারার চলচ্চিত্র বিকাশ লাভ করছে তা সত্তে¡ও সূচনাবিন্দুতে ফিরে যাওয়ার আর কোনো কারণ নেই। এখন দৃষ্টিভঙ্গি হতে হবে স্বল্পদৈর্ঘ্য থেকে শুরু করে ক্রমে অন্যান্য বড় আকারের ছবি। স্বল্পদৈর্ঘ্যরে চলচ্চিত্রই শেষ কথা নয়। বিকল্পধারার চলচ্চিত্র আন্দোলনকে পূর্ণ বিকশিত করতে হলে আমাদেরকে বিকল্পধারাতে পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রও অবশ্যই নির্মাণ করতে হবে।

স্বপ্ন ও দাবি

এই পটভূমিকে স্মরণে রেখে আমাদের কিছু দাবির কথা এখন তুলে ধরা যাক।

এটা কী কেবল স্বপ্নই হয়ে রইবে যে, কানাডার ন্যাশনাল ফিল্ম বোর্ড অথবা ভারতের এনএফডিসি-র মতো সদাশয় কোনো প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশেও একদিন গড়ে উঠবে না? বাংলাদেশ সরকার চলচ্চিত্র ব্যবসা থেকে বছরে অনেক কোটি টাকা রাজস্ব আদায় করে থাকে। আমাদের দাবি স্বল্পদৈর্ঘ্য ও প্রামাণ্যচিত্রের জন্যে সরকারী অনুদান ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজিয়ে বছরে পাঁচটি পূর্ণদৈর্ঘ্য ও দশটি স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবিকে অনুদান দেয়া হোক।

স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রকে অনুদান প্রদান বাবদ যে টাকাটা বেশি ব্যয় হবে তা সরকারের জন্যে খুবই অকিঞ্চিৎকর অর্থ। আমি মনে করি, ভাল ছবির প্রতি সমর্থন দানের যে ঘোষণা সরকার দিয়েছে তা সত্যি সত্যি প্রমাণ করবার সময় এসেছে।

১৯৭২ সালের “সিনেমাটোগ্রাফি অ্যাক্ট” অনুয়ায়ী প্রতিটি সিনেমা হলকে সরকারি সংবাদচিত্র দেখানোর জন্যে বিশ মিনিট বরাদ্দ রাখতে হয়। এই প্রদর্শনীর সময় কালটা বাড়িয়ে সরকারি স্থূল প্রচারণামূলক ছবি না দেখিয়ে এর পরিবর্তে ভাল একটি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র দেখানো যেতে পারে।

এটা আমাদের দীর্ঘ দিনের দাবি যে, বাংলাদেশে একটি জাতীয় চলচ্চিত্র কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হোক। প্রস্তাবিত কেন্দ্রটি হবে একটি ফিল্ম কমপ্লেক্স যেখানে থাকবে সব ধরণের ছবি প্রদর্শনের উপযোগী পনের’শ আসনের একটি মিলনায়তন, ভিডিও প্রদর্শনের সুবিধাসহ তিন’শ আসনের একাধিক ছোট মিলনায়তন এবং একটি সমৃদ্ধ গবেষণামূলক গ্রন্থাগার। আমরা কি চাই তার একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ হচ্ছে বৃটেনের ন্যাশনাল ফিল্ম সেন্টার অথবা পশ্চিম বাংলার “নন্দন”। একটি ন্যাশনাল ফিল্ম সেন্টার নির্মাণ দেশের চলচ্চিত্র বোদ্ধাদের বহু দিনের দাবি এবং সরকার যদি এই বিষয়ে ভ্রুক্ষেপ না করে থাকে তবে আমরা নিজেরাই একদিন এটা প্রতিষ্ঠা করব— ইনশাল্লাহ!

ফিল্ম সোসাইটি আন্দোলনের বিরোধী সব কালাকানুন বাতিলের দাবিও আমরা উত্থাপন করছি। চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনকে জোরদার করতে হবে যা হচ্ছে দেশের বিকল্প নির্মাতাদের জন্মক্ষেত্র এবং যা আমাদের আর্দশগত মিলনের ভিত্তি।

বিকল্পধারার চলচ্চিত্রনির্মাতাদের একটা সম্ভাবনাময় প্রদর্শন ক্ষেত্র হতে পরে বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি)। কিন্তু এটা খুবই উদ্বেগজনক যে, বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি) জনগণের করের অর্থ দ্বারা পরিচালিত একটা প্রতিষ্ঠান হলেও এটা কেবলই সরকারের একচেটিয়া একটা প্রচারমাধ্যমে পর্যবসিত হয়েছে। এরকম একটি গণমাধ্যমকে আমরা কিছু অদূরদর্শী টিভি আমলার খেয়ালখুশি এবং মেধাহীনতার ওপর ছেড়ে দিতে পারি না। আমরা ইলেকট্রনিক মাধ্যমের গণতন্ত্রায়ণ চাই। চলচ্চিত্র প্রদর্শন বিষয়ে বিটিভিতে কোনও সুসমন্বিত ও অনুসৃত রীতি আমরা দেখতে পাই না। এফডিসির বস্তাপচা বাণিজ্যিক ছবিগুলো দেখাতে তারা বিশেষ আগ্রহী মনে হয় অথচ ভাল স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবি খুব কমই দেখানো হয়ে থাকে। তাছাড়া ক্বচিৎ কখনও কিছু ডকুমেন্টারি বা প্রামাণ্যচিত্র দেখানো হলেও সেটা দুই অনুষ্ঠানের মাঝখানের সময় ক্ষেপনের উপায় হিসাবে দেখানো হয় মাত্র। কোনও প্রামাণ্য চলচ্চিত্র, আলোচনাসহ, উপস্থাপন করার বিশেষ অনুষ্ঠানের কথা কি বিটিভি ভাবতে পারে না?

স্যাটেলাইট ও ক্যাবল টিভির কারণে সেকেলে হয়ে ওঠা বিটিভি সমানে তৈরি করে চলেছে মধ্যবিত্তের জোলো সব সোপ অপেরা, যাকে তারা বলে থাকে টিভি সিরিয়াল। এটা দুঃখজনক যে, সরকারের অপর একটা চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট সংস্থা ডিএফপির মতো বিটিভি-কেও দেশের সচেতন মহল অশ্রদ্ধার সঙ্গে দেখা শুরু করেছেন এবং সেটা অকারণে নয়!

আমরা জানি আমাদের দাবীগুলি ন্যায়সঙ্গত কিন্তু অভিজ্ঞতায় দেখা যায় যখনই আমরা আমাদের এইসব যৌক্তিক দাবিগুলো উপস্থাপন করি তখনই আমরা এস্টাব্লিশমেন্টের কাছ থেকে মুখোমুখি হই স্ফিন্ক্সমূলক এক রহস্যময় নীরবতার।

কিন্তু আমরা এখনও আশা করছি সরকারের নীতি-নির্ধারকেরা আমাদের এমন কোনো চরম অবস্থার দিকে ঠেলে দেবেন না যেখানে আমাদেরকে আমাদের চলচ্চিত্রিক কর্মকান্ডগুলো পরিচালনা করতে হবে গোপনে। যে কোনও জনকল্যাণমূলক সরকারের বোঝা উচিৎ যে, একজন স্বাধীন চলচ্চিত্রনির্মাতার কন্ঠস্বর গণতন্ত্রেরই কন্ঠস্বর। আমরা আশা করি যে, রাজনৈতিক ও সিভিল সমাজের নেতৃবৃন্দ উভয়ই চলচ্চিত্র মাধ্যমের এই সম্ভাবনাটাকে অনুধাবন করবেন এবং আমাদের বিকাশমান গণতন্ত্রের অতন্দ্র প্রহরী হিসেবে বিকল্পধারার চলচ্চিত্রকে বিবেচনা করবেন। এই ভাবনা আরও অপরিহার্য হয়ে ওঠার কারণ হো’ল, ১৯৭১ সালের রক্তপিপাসু খুনিরা জাতীয় সংসদে আজ যেরকম ভাল মানুষ সেজে বক্তৃতা দিচ্ছে এবং মৌলবাদীরা যেভাবে তরবারী উঁচিয়ে পেশী প্রদর্শন করছে তাতে যৌক্তিকভাবেই কারও মনে এই অস্বস্তিকর অনুভব জাগতে পারে যে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের অবস্থান এখনও বিশেষ নাজুক !

স্বাধীনতার পর থেকে রাজনৈতিক এবং সামাজিক ক্ষেত্রে বহু পরিবর্তন ঘটেছে কিন্তু মূলধারার চলচ্চিত্রের রুচিহীন অবস্থার কোনোই পরিবর্তন ঘটেনি। সপ্তম শিল্প, অথবা বেলা বেলাজ যেমন বলে থাকেন “দশম দেবী”, সেই চলচ্চিত্রের অবস্থা বাংলাদেশে আজ খুবই করুণ। এদেশের অন্ধকারাচ্ছন্ন চলচ্চিত্র জগতে আশার একমাত্র আলোকরেখা হচ্ছে বিকল্পধারার চলচ্চিত্র নির্মাতাদের প্রচেষ্টা এবং বিকল্প পন্থায় তাঁদের ছবি বিতরণের প্রয়াস। চাকা এখনও ঘুরছে, চূড়ান্ত ভবিষ্যদ্বাণী করার জন্যে এটা খুবই প্রাথমিক অবস্থা, কিন্তু আমরা বিশ্বাস করি যে, এই পথেই বাংলাদেশে সামাজিক ও শৈল্পিকভাবে দায়বদ্ধ চলচ্চিত্রের অবির্ভাব ঘটবে। কিন্তু আমরা এটাও জানি যে, আমাদের জনগণের গণতান্ত্রিক এবং প্রগতিশীল আশা-আকাঙ্ক্ষার সঙ্গেই আমাদের বসবাস ও বিকাশ। এই বন্ধন থেকে আমাদের শিল্প যেন কখনও বিযুক্ত না হয়। না বিশুদ্ধ শিল্পের নামে, না পরিশীলিত হওয়ার চেষ্টায়, না অন্য কোনো উদ্দেশ্যে। এসবের ফলে হয় তো কোনো বিদেশী চলচ্চিত্র উৎসবে কিছু পুরস্কার আমাদের কপালে জুটে যেতে পারে, তবে আমাদের জনগণের সঙ্গে যে নাড়ির বন্ধনটি আমরা গড়ে তুলেছি সেটা যদি ছিন্ন হয় তবে সেদিন থেকেই বাংলাদেশের বিকল্প চলচ্চিত্র আন্দোলনের সমাপ্তির দিন ঘনিয়ে আসবে।

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত