| 19 এপ্রিল 2024
Categories
চলচ্চিত্র বিনোদন সিনেমা

কাগজের ফুল আর কখনও সত্যিকারের ফুল হয়ে ফুটবে না

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

মুহাম্মদ সাইদুজ্জামান আহাদ 

ফ্রান্সে বসেছে বিশ্বের সবচেয়ে সম্মানিত ফিল্ম ফেস্টিভ্যালগুলোর একটি, কান চলচ্চিত্র উৎসব। সেখানে দেখানো হচ্ছে একটা বাংলাদেশী সিনেমাও। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে খানিকটা ভিন্ন আঙ্গিকে উপস্থাপন করা হয়েছে সেখানে। সমালোচকেরা প্রশংসায় ভাসালেন তৃতীয় বিশ্বের অখ্যাত এক দেশ থেকে আসা সেই চলচ্চিত্রকে, একটি দেশের গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের সংগ্রামের হৃদয়স্পর্শী ও স্বচ্ছ উপস্থাপনা”র জন্য ‘The Clay bird’ শিরোনামের সেই পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের পরিচালককে ভূষিত করা হলো ডিরেক্টর্স ফোর্টনাইট সম্মানে, সিনেমাটা পেল ফিপরেস্কি ইন্টারন্যাশনাল ক্রিটিকস্ অ্যাওয়ার্ড। পুরস্কার নিতে স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে মঞ্চে উঠলেন দীর্ঘদেহী একজন মানুষ, তাঁর নাম তারেক মাসুদ।

যে সিনেমাটা নিয়ে তিনি ফ্রান্সে এসেছেন, জয় করেছেন সবার হৃদয়, সেই ‘মাটির ময়না’কে প্রথমে সেন্সরবোর্ড ছাড়পত্রই দিতে চায়নি স্পর্শকাতর আখ্যা দিয়ে! মাটির ময়নাকে আলোর মুখ দেখানোর জন্যে তারেক মাসুদকে আদালতের বারান্দায় পা রাখতে হয়েছে, লড়তে হয়েছে সিস্টেমের বিরুদ্ধে। তারেক মাসুদের মনে পড়ে যায় সেইসব ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ দিনের কথা, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে সিনেমা বানালে যখন সেটাকে দর্শকের কাছে পৌঁছে দেয়াটা ছিল পুলসিরাত পার করার মতো ঘটনা। একটা দেশের জন্ম হয়েছে রক্তক্ষয়ী একটা স্বাধীনতা যুদ্ধের মাধ্যমে, ত্রিশ লক্ষ প্রাণ আর দুই লক্ষ নারীর সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত সেই ভূমিতে মুক্তিযুদ্ধ ব্যপারটা তখন ‘স্পর্শকাতর’ একটা ইস্যু!

সেই অসহিষ্ণু সময়ে মুক্তির গান গেয়েছেন তারেক মাসুদ, নিজের মতো করে বলেছেন যুদ্ধের কথা, অন্য একটা আঙ্গিকে দেখিয়েছেন বাংলাদেশের মানুষের সবচেয়ে বড় গৌরব আর ত্যাগের এই অর্জনকে। নিজের মতো করে গল্প বলেছেন, তুলে এনেছেন মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সমাজের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সম্পৃক্ততাকে। তারেক মাসুদ যেভাবে মুক্তিযুদ্ধকে দেখিয়েছেন, সেভাবে অন্য কেউ বাংলা চলচ্চিত্রে স্বাধীনতার এই সংগ্রামকে ফুটিয়ে তোলার কথা ভাবেননি কখনও। তাঁর গল্পে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাস্প ছিল, ছিল কুসংস্কার আর ধর্মীয় গোঁড়ামির পাশাপাশি সহাবস্থান। আর সেইসব ট্যাব্যুকে নিজের হাতে ভেঙেই তিনি গেয়েছেন অসাম্প্রদায়িকতার জয়গান।

অথচ সিনেমায় তাঁর আসার কথা ছিল না। শুরুটা যেভাবে হয়েছিল, তারেক মাসুদ নামের মানুষটা হয়তো কোন মাদ্রাসার শিক্ষক বা মসজিদের ইমাম-মুয়াজ্জিন হয়ে জীবন কাটিয়ে দিতে পারতেন। ধর্মভীরু এক পরিবারে জন্ম তাঁর, শিক্ষার হাতেখড়ি হয়েছিল মাদ্রাসায়। ফরিদপুরের ভাঙা তাঁর জন্মস্থান, সেখানেই ঈদগা মাদ্রাসায় শিক্ষাজীবনের শুরু। ঢাকার লালবাগ মাদ্রাসা থেকে মৌলানা পাশও করেছিলেন। এরই মধ্যে শুরু হলো মুক্তিযুদ্ধ, যুদ্ধের পরই মাদ্রাসা ছেড়ে দিলেন, চলে এলেন সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থায়। ঢাকার নটরডেম কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করার পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে ভর্তি হলেন, তখন থেকেই সংস্কৃতি বা শিল্পের সঙ্গে বসবাসের শুরু।

বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকে লেখক শিবির বা বাম আন্দোলন কিংবা বাংলাদেশ চলচ্চিত্র আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ততা ছিল তাঁর। তবে নিজে পরিচালক হয়ে যাবেন, সেটা ভাবেননি তখনও। আড্ডায় তানভীর মোকাম্মেল বা মোরশেদুল ইসলামের মতো গুণী পরিচালকদের সঙ্গে দেখা হতো, মুগ্ধ হয়ে শুনতেন ওদের ছবির গল্প। মাথায় ফিল্মের পোকা ঢুকলো, শুরু করলেন এখানে সেখানে ফিল্মের কোর্সে অংশ নেয়া। পরিবার থেকে তীব্র বাধার সম্মুখীন হয়েছেন, মওলানার ছেলে মাদ্রাসায় পড়ে এখন সিনেমা বানাবে- এটা বাবা মেনে নিতে পারেননি। কিন্ত নিজের সঙ্গে আপোষ করেননি তারেক মাসুদ, ভালোবাসার জায়গাটাকে আপন করে নিয়েছেন নিঃসঙ্কোচে, নির্ভীক চিত্তে।

১৯৮২ সালে হাত দিলেন স্বল্পদৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্র নির্মাণে। একটা শর্টফিল্ম বানাতেই লেগে গেল সাত বছর! ‘আদম সুরত’ শিরোনামের সেই প্রামাণ্যচিত্রটি মুক্তি পায় ১৯৮৯ সালে, প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী এস এম সুলতানের জীবনের ওপর নির্মিত হয়েছিল সেটি। ‘আদম সুরত’ বেশ প্রশংসা কুড়ালো সবার মাঝে। এরপর বেশকিছু শর্টফিল্ম আর ডকুমেন্টরী বানিয়েছেন তিনি, ১৯৯৬ সালে এলো ‘মুক্তির গান’। মার্কিন নাগরিক লেয়ার লেভিনের ক্যামেরায় ধারণ করা হয়েছিল রক্তাক্ত একাত্তরের কিছু প্রামাণ্যচিত্র, ভিডিওতে সেসব ধারণ করেছিলেন লেভিন। সেগুলো ব্যবহার করলেন মাসুদ, এরসঙ্গে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংরক্ষণাগার থেকে মুক্তিযুদ্ধের ফুটেজ সংগ্রহ করে মুক্তির গান বানিয়ে ফেললেন তারেক মাসুদ। ১৯তম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে শ্রেষ্ঠ প্রামাণ্যচিত্রের পুরস্কার ঘরে তোলে মুক্তির গান।

স্বল্পদৈর্ঘ্যের কাজ তো অনেক হলো। এরপর তারেক মাসুদ হাত দিয়েচিলেন পূর্ণদৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্র নির্মাণে। নিজের জীবন সংগ্রামকে মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে মিশিয়ে একদম ভিন্নরকম একটা পটভূমি তৈরী করেছিলেন তিনি, ষাটের দশকের শেষপ্রান্তের সেই উত্তাল সময়ের ঢেউ কিভাবে শহরের সীমানা ছাড়িয়ে গণ্ডগ্রামে গিয়ে আঘাত হানে, সেটাই ‘মাটির ময়না’র মাধ্যমে একজন মাদ্রাসাছাত্রের চোখে দেখিয়েছেন তারেক মাসুদ। কিশোর আনুর ভেতরে কোথাও তারেক মাসুদ নিজের শৈশবের ছায়াটা দেখাতে চেয়েছেন সবাইকে, সেটা তিনি সফলভাবেই পেরেছিলেন। অথচ এই সিনেমাটাই অনেকদিন নিষিদ্ধ ছিল বাংলাদেশে, কোন সিনেমা হলে মুক্তি পায়নি মাটির ময়না, ২০০৫ সালে ডিভিডিতে রিলিজ হয় এটি!

মাটির ময়না থেকে অন্তর্যাত্রা বা রানওয়ে- তিনটে গল্প সম্পূর্ণ আলাদা এঁকে অন্যের চেয়ে। তারেক মাসুদ কখনও সিনেমা বানানোর সময় নিজের সেফ জোন সৃষ্টি করেননি, তিনি মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে সিনেমা বানিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতি পেয়েছেন, সেটাকেই অবলম্বন বানিয়ে ফেলেননি, পরের সিনেমাতেই একশো আশি ডিগ্রীতে ইউটার্ণ করে বদলে ফেলেছেন বিষয়বস্তু। রানয়েতে দেখিয়েছেন ইসলামী শিক্ষার আড়ালে লুকিয়ে থাকা জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ করার গল্প, যে জিনিসগুলো ২০১০ সালেই সিনেমায় তুলে এনেছেন তারেক মাসুদ, সেই ব্যপারগুলোই এদেশে ঘটেছে কয়েক বছর বাদে। সিনেমা যদি সমাজের আয়না হয়, তারেক মাসুদের রানওয়ে ছিল ভবিষ্যতের আয়নার মতো। সেই আয়নাটা পড়ার চেষ্টা তখন কেউ করেনি। এই মানুষটাই আবার ‘নরসুন্দর’ নামের স্বল্পদৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্র বানিয়েছেন, যেখানে পাকিস্তানী মিলিটারীর জিজ্ঞাসাবাদের মুখে নিজেকে বিহারী পরিচয় দেয়া একজন নাপিত প্রাণ রক্ষা করছেন এক স্বাধীনতাকামীর। অস্থির সময়ের গল্প বলতে গিয়ে অসাম্প্রদায়িকতার বার্তাটাও সবাইকে জানিয়ে দিয়েছেন তারেক মাসুদ, অনেকটা অগোচরেই।

তারেক মাসুদ তাঁর চলচ্চিত্রে বরাবরই সমাজের দুর্লভ শ্রেণীর কিছু গল্প তুলে এনেছেন। এই গল্পগুলো হয়তো সবার জীবনে একইভাবে ঘটে না, এইসব পরিস্থিতির শিকার হয়তো সিংহভাগ মানুষই হয় না। মাটির ময়না বলি, অন্তর্যাত্রা কিংবা তাঁর জীবনের শেষ চলচ্চিত্র রানওয়ের কথাই ধরি, এগুলো সর্বসাধারণের ঘটনা নয়। কিন্ত চমৎকার নির্মাণ আর ভিন্ন আঙ্গিকে গল্পের বর্ণনা করার ধরণটাই বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে তারেক মাসুদকে অনন্য করে রেখেছে। তিনি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি পেয়েছেন কিংবা কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে পুরস্কৃত হয়েছেন- সেটা বড় ব্যপার নয়, সেগুলো ছিল তাঁর কাজের স্বীকৃতি। কিন্ত সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় এটাই যে, তিনি একটা নির্দিষ্ট শ্রেণির দর্শকের মনে ছাপ ফেলে গেছেন। অশ্লীলতার বিষবাস্পে ঢাকা যে সময়টায় তিনি সিনেমা নির্মাণ শুরু করেছিলেন, তখন যুদ্ধাপরাধী শক্তি ক্ষমতায়, মুক্তিযুদ্ধ, পাকিস্তানী হানাদারদের অত্যাচার কিংবা তাদের এদেশীয় দোসরদের অত্যাচারের ঘটনাগুলো বর্ণনার ওপরে তখন অলিখিত একটা নিষেধাজ্ঞা ছিল। সেই নিষেধাজ্ঞাকে পাশ কাটিয়ে বুকভর্তি সাহসের স্ফুলিঙ্গ নিয়ে তারেক মাসুদ মুক্তিযুদ্ধ নিয়েই সিনেমা বানিয়েছেন।

পরের সিনেমার নামও ঠিক হয়ে গিয়েছিল, ‘কাগজের ফুল’। ১৯৪৭ এর দেশভাগের গল্প নিয়ে সিনেমা বানাবেন, সেটার লোকেশন দেখতেই টিম নিয়ে গিয়েছিলেন পাবনার ইছামতীর তীরে। কাজ শেষ করে দুপুরে ফিরছিলেন ঢাকার দিকে। সঙ্গে ছিলেন স্ত্রী ক্যাথেরিন মাসুদ, বন্ধু মিশুক মুনীর(প্রয়াত নাট্যকার শহীদ মুনীর চৌধুরীর ছেলে এবং এটিএন নিউজের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা) সহ আরও বেশ ক’জন। মানিকগঞ্জের ঘিওরে যখন তাদের গাড়িটি পৌঁছায়, তখন সময় সাড়ে বারোটার আশেপাশে। বিপরীত দিক থেকে আসা একটা বাসের সঙ্গে সংঘর্ষে চুরমার হয়ে যায় তাদেরকে বহনকারী মাইক্রোবাসটি। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীর সহ আরও তিনজনের। ক্যাথেরিন মাসুদ গুরুতর আহত হন।

বাংলাদেশের চলচ্চিত্রজগতে তারেক মাসুদের পথচলাটা খুব দীর্ঘ নয়। অথচ মাত্র তিনটে পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের নির্মাতা এই মানুষটা নিজের কাজ দিয়েই আমাদের চলচ্চিত্রের ছোট্ট ইতিহাসে নিজের বিশাল একটা অধ্যায় তৈরী করেছিলেন তিনি। জহির রায়হান আর আলমগীর কবিরের পর যে মানুষটাকে ভাবা হচ্ছিল আলোর দিশারী হিসেবে, সেই তারেক মাসুদ না ফেরার দেশে চলে গেলেন মাত্র চুয়ান্ন বছর বয়সে। কাকতালীয় ব্যাপার, যে দুজনের সঙ্গে তাঁর তুলনা করা হয়, সেই জহির রায়হান আর আলমগীর কবীরের মতো তারেক মাসুদের মৃত্যুও একদমই অপ্রত্যাশিত, একেবারেই সময়ে নিভে গিয়েছিল তাঁর জীবন প্রদীপ।

কাগজের ফুল আর কখনও সত্যিকারের ফুল হয়ে ফুটবে না, সুবাস ছড়াবে না কোনদিন। আরেকটা মাটির ময়না কেউ নির্মাণের সাহস দেখাতে পারবে না, ভ্রান্ত সমাজ কিংবা ভ্রষ্ট নিয়মের বেড়াজাল ভেঙে কেউ গাইবে না মুক্তির গান। সেই সামর্থ্য আর সাহসটুকু শুধু তারেক মাসুদের ছিল, স্রষ্টা সেই মেধা তারেক মাসুদকেই দিয়েছিলেন। তারেক মাসুদ তাই গৌরব আর আক্ষেপের অপূর্ব এক সংমিশ্রণ হয়েই বেঁচে আছেন আমাদের মনে!

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত