| 28 মার্চ 2024
Categories
নারী প্রবন্ধ সাহিত্য

তসলিমা নাসরিনের ডায়েরি

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

আজ ২৪ বছর আমি নির্বাসিত। দেশে আমাকে প্রবেশ করতে দেয় না দেশের কোনও সরকারই। আমি অবৈধভাবে দেশে প্রবেশ করতে চাই না।  আমাদের নির্লজ্জ সরকারেরা কিন্তু অবৈধভাবে আমাকে দেশে প্রবেশে বাধা দিচ্ছে।

২৪ বছর আগে খালেদা জিয়ার সরকার আমাকে দেশের বাইরে বের করে দিয়েছিল কারণ মৌলবাদিরা দেশ জুড়ে তাণ্ডব করছিল।  দেশের অবস্থা শান্ত হলে এক দু’মাস পর দেশে ফিরতে পারবো, এরকমই বলা হয়েছিল। ২৪ বছর শেষ হয়েছে, অপেক্ষার সেই এক দু’মাস এখনও শেষ হয়নি, আজও আমাকে আমার নিজের দেশে ফিরতে দেওয়া হয় না। ইতিহাস বলে, পৃথিবীর অনেক  প্রতিবাদী লেখক শিল্পীকেই নির্বাসন দিয়েছে বিভিন্ন দেশের সরকার, কিন্তু সরকার বদল হলে সেই লেখক শিল্পীরা ফিরতে পেরেছেন নিজ বাসভূমে। কিন্তু আমার বেলায় সেটিও হয় না। সরকার বদল হয়, আমার ভাগ্য বদল হয় না। আসলে কোনও সরকারই লেখকের  বাক স্বাধীনতায় বা মত প্রকাশের অধিকারে বিশ্বাস করে না, সে কারণেই সমস্যা।

পশ্চিমবঙ্গও বাংলাদেশের পদাংক অনুসরণ করে চলেছে। এক সরকার আমাকে রাজ্য থেকে তাড়িয়েছে, নতুন সরকার এসে আগের সরকারের কিছু না মানলেও আমার নির্বাসনদণ্ড দেওয়াকে   মেনে নিয়েছে। আমার বেলায় নিষেধাজ্ঞাগুলো অদ্ভুতভাবে সংক্রামক। এক সরকার নিষেধাজ্ঞা জারি করলে দেখে দেখে আরেক সরকারও নিষেধাজ্ঞা জারি করে। এক প্রকাশক বই প্রকাশ বন্ধ করলে দেখে দেখে আরেক প্রকাশকও বই প্রকাশ বন্ধ করে। মানুষ ভয়কে জয় করেনি, ভয় মানুষকে জয় করেছে।

দেশে যখন আমাকে  ফিরতে দেওয়া হয় না, ইউরোপ থেকে তল্পি তল্পা গুটিয়ে  পাড়ি দিয়েছিলাম পশ্চিমবঙ্গে। আমি ইউরোপের নাগরিক, এত দেশ থাকতে পশ্চিমবঙ্গে কেন? এর উত্তরটি সোজা, ভাষাটির জন্য ,  বাংলা নামের ভাষাটির জন্য– যে ভাষায় আমি গদ্য পদ্য লিখি, সেই ভাষাটি দিনভর শুনবো বলে, সেই ভাষাটি দিনভর বলবো বলে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গও একই আচরণ করলো আমার সঙ্গে। কিছু একটার ছুতো দেখিয়ে আমাকে নির্বাসন দিল। বাংলার  পূব আর পশ্চিমকে লোকে আলাদা ভাবে, আমি কিন্তু এর স্বভাব চরিত্র হুবুহু একই দেখি।

দুই বাংলা থেকে নির্বাসিত হয়েও আমি ইউরোপে ফিরি না, আমেরিকায় বাস করি না। বাংলার কাছাকাছি কোথাও পড়ে থাকি। অনেকটা বাড়ির উঠোনে পড়ে থাকার মতো। কেন বাংলার প্রতি আমার এত আকর্ষণ? বাংলার   মাটি,হাওয়া, গাছপালা নদীনালা বাড়িঘরের জন্যই কি এমন উতলা আমি? এসব তো অনেক দেশেই আছে—তারপরও কেন কোথাও আমার মন ভরে না! এ নিয়ে আমি প্রচুর ভেবেছি। উত্তর খুঁজেছি বছরের পর বছর। লক্ষ করেছি, বিদেশ বিভুঁইয়ে এই ভাষাটি কোথাও শুনলে আমি থমকে দাঁড়িয়ে ভাষাটি শুনি, এই ভাষাটি কোথাও   লেখা আছে দেখলে পড়ে দেখি, এমনকী ছুঁয়েও দেখি। ভাষাটির কাছ থেকে দূরে সরতে আমার মোটেও ইচ্ছে করে না। আমি অনুভব করি আমার মা আমাকে মুখে তুলে খাওয়াচ্ছে, আমার বাবা আমাকে দুহাতে বুকের কাছে টেনে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে, অনুভব করি ভাই বোনের সঙ্গে মাঠ জুড়ে হৈ চৈ করে গোল্লাছুট খেলছি। এই অনুভাবটি   আমাকে সুখ দেয়, অদ্ভুত এক নিরাপত্তা দেয়। এভাবেই ধীরে ধীরে আমি বুঝেছি, আসলে ভৌগলিক কোনও অঞ্চল আমার দেশ নয়, আমার দেশের নাম বাংলাদেশ নয়, আমার দেশের নাম বাংলা ভাষা। ভাষাটিই আমার দেশ। এই ভাষাটি যদি বাংলাদেশে কেউ না বলে, তাহলে ওদেশে ফিরলেও আমার মনে হবে না ও দেশ আমার দেশ।

এই ভাষাটিকে ভালবাসি বলে    ভিন্ন ভাষাভাষির অনেক দেশে বাস করেও কোনও দেশের কোনও ভাষাই   আমি শিখিনি। এই বাংলার মধ্যেই আমি আমার দেশ, আমার আনন্দ, আমার সর্ব সুখ খুঁজে পাই। মানুষ প্রাচুর্যের জন্য নিজের দেশ ত্যাগ করে উন্নত দেশে পাড়ি দেয়। আর আমি প্রাচুর্যের দেশ ছেড়ে অনুন্নত দেশে পাড়ি দিয়েছি ভাষাটির জন্য। এই ভাষাকে আমি প্রাণের ভেতরে রাখি। আমার আজ মা নেই, বাবা নেই, ভাইয়েরা নেই, প্রিয় অনেক মানুষই আর নেই। এই ভাষাটি আমি যখন উচ্চারণ করি, আমি উচ্চারণ করি আমার মা বাবাকে, আমার ভাইদের, আমার প্রিয় প্রিয় মানুষদের।

যে দেশ তার প্রতিটি মানুষকে অন্ন বস্ত্র বাসস্থান আর  শিক্ষা স্বাস্থ্য নিরাপত্তা দিতে পারে না, সেই দেশকে দেশ বলার কোনও অর্থ হয় না। বাংলাদেশটির ভেতর সত্যিই কি কারও নিরাপত্তা আছে, যে কেউ যে কোনও সময় খুন হয়ে যেতে পারে,যে কেউ যে কোনও সময় ধর্ষণের শিকার হতে পারে, কারও হাতে দূর্নীতির অঢেল টাকা, কারও হাত ফাঁকা। একটা ভয়ঙ্কর বৈষম্যের সমাজ! বাঁচতে হলে ক্ষমতাশীলদের চাটুকার হতে হয়।   সততা,সহযোগিতা, সমমর্মিতা, সাহসিকতা, সব নির্বাসিত। আমি তাই বাংলাদেশকে আর দেশ বলি না, বাংলা ভাষাটিকে বলি। এই ভাষাটিই আমাকে দেখে দেখে রাখে, ভয়ংকর দুঃসময়ে, ভূতুড়ে অন্ধকারে, আমার হাহাকারের দিনে আমাকে নিরাপত্তা দেয়।

এই ভাষাটি কতদিন পৃথিবীতে টিকে থাকবে আমি সঠিক জানি না। তবে অনুমান করি খুব বেশি শতাব্দি  নয়। বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গই বাংলা ভাষার দুটো মূল ভূমি। এই মূল ভূমির পড়ালেখা জানা আধুনিক মানুষই ভাষাটি বলতে আগ্রহী নয়, ভাষাটি নিয়ে তাদের কোনও অহংকার নেই। ভাষাকে না ভালোবাসলে ভাষা টিকে থাকে না। ভাষাকে না ভালোবাসলে ভাষা বলার লোক ক্রমশ কমে যেতে থাকে।  যে ভাষায় কথা বলার মানুষ খুব কম, সেই ভাষাগুলো মরে যায়। পৃথিবীতে মোট ৭০৯৯ টি মুখের ভাষা আছে। প্রতি ২ সপ্তাহে ১টি করে ভাষা মরে যাচ্ছে। আমি বুঝি, ইংরেজিতে কথা বললে যদি মনে করা হয় মানুষটি শিক্ষিত, জ্ঞানী, তাহলে লোকে নিজের আঞ্চলিক ভাষায় কথা না বলে ইংরেজিতেই কথা বলার চেষ্টা করবে।  তাই বলছে। এই সমস্যা গোটা ভারতীয় উপমহাদেশে। বাংলায়, মারাঠিতে, মালায়ালামে, অসমীয়ায়, উড়িয়ায়, তেলুগুতে, কন্নরে,পাঞ্জাবিতে, রাজস্থানীতে, তামিলে, এমনকী হিন্দিতে কথা বললেও তুমি একটু গেঁয়ো, একটু পিছিয়ে- থাকা, একটু অনাধুনিক, আর ইংরেজিতে কথা বললেই তুমি শিক্ষিত, তুমি জ্ঞানী। এরকম যখন অধিকাংশ মানুষের মানসিকতা, তখন এই মানসিকতা যে সহজে বদল হওয়ার নয়, তা অধিকাংশ মানুষই জানে। জানে বলেই চারদিকে  ইংরেজি শেখার হিড়িক পড়েছে। দরিদ্ররা তাদের ছেলেমেয়েদের বাংলা মিডিয়ামের সরকারি স্কুলে পাঠাতো, আর বড়লোকেরা ইংরেজি মিডিয়ামের প্রাইভেট স্কুলে। এই নিয়মটিও উঠে গেছে। এখন দরিদ্ররাও গর্ব করে বলে, ‘ছেলেকে ইংলিশ মিডিয়ামে দিয়েছি’। ইংলিশ মিডিয়ামে ধার কর্জ করে হলেও পড়াচ্ছে, কারণ তাদের ধারণা বাংলা মিডিয়ামে পড়লে কোনও লাভ নেই, কোথাও চাকরি পাবে না। হতদরিদ্র পথের ভিখিরি ছাড়া বাংলা মিডিয়াম অগত্যা কারও জন্য নয়। এই ভাষা মরবে না তো কী করবে?

আমাকে ভারতের জাতীয় টিভিতে সাক্ষাতকার দেবার জন্য খুব ডাকা হয়, আমি না বলে দিই। বলে দিই, আমি ইংরেজি ভালো জানি না। আমাকে যারা ‘ইন্টারন্যাশনাল সেলিব্রিটি’ ভাবে, তারা আকাশ থেকে পড়ে। সেলিব্রিটি হয়েও, ভি আই পি হয়েও, ইন্টেলেকচুয়াল হয়েও  ইংরেজি ভালো জানি না, এ তারা বিশ্বাস করতে পারে না। তারা মনে করে বড় হতে গেলে, বুদ্ধিমান হতে গেলে, বিখ্যাত হতে গেলে ইংরেজি জানতেই হয়। আমি তা মনে করি না। কেউ শুধু নিজের ভাষা জেনেই জ্ঞানী, গুণী, বিদ্বান, বুদ্ধিমতি, বিখ্যাত হতে পারে। পৃথিবীর হাজারো কবি লেখক শিল্পী বিজ্ঞানী গবেষক  নিজের ভাষা ছাড়া অন্য ভাষা জানতেন না, কিন্তু তাঁরা পৃথিবী-বিখ্যাত। মানুষ তাঁদের লেখা অনুবাদ করে পড়ে।

আমাদের জগত বৈষম্যে ভরা। যে দেশের টাকা বেশি, সে দেশকে বলি  উন্নত দেশ। সে দেশের ভাষা শেখার জন্য মানুষের আগ্রহ প্রচন্ড। আমাদের গরিব দেশ,  আমাদের দেশের ভাষাও তাই গরিব। গরিব ভাষা শিখতে বা বলতে লিখতে গরিবদেরই আগ্রহ নেই। এই যে বাংলায় বই লিখছি,   বহু শতাব্দি পর, ইতিহাসের কবর খুঁড়ে কোনও গবেষক হয়তো আবিষ্কার করবেন বিলুপ্ত ভাষার বই। বাংলার ভবিষ্যতের কথা ভাবলে আমি ওইরকম একটি বেদনাময় চিত্রই দেখি।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত