| 29 মার্চ 2024
Categories
ধারাবাহিক সাহিত্য

ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহল (পর্ব-১১)

আনুমানিক পঠনকাল: 15 মিনিট

১১.

এবার রেণুকার কথায় আসা যাক। রবীন্দ্রনাথের মেয়েদের মধ্যে দীর্ঘ জীবনের অধিকারিণী শুধু মীরা বা অতসীলতা। মীরার আগে ছিলেন রেণুকা। কবির মেজো মেয়ে রাণী বা রেণুকার মৃত্যু হয়েছিল কৈশোরে, ফুল হয়ে ফুটে ওঠার আগেই। অত্যন্ত জেদী একরোখা ধরনের মেয়ে রেণুকার কথা সবচেয়ে বেশি জানা যায় মীরার স্মৃতিকথা থেকে। সব ব্যাপারেই তাঁর ছিল সুগভীর ঔদাসীন্য। সাজতে ভাল লাগত না, চুল বাঁধা তো বিরক্তিকর ব্যাপার। খানিকটা নিস্পৃহ অথচ খেয়ালী মেয়ে রেণুকার বিয়ে হয়েছিল মাত্র এগারো বছর বয়সে। বেলার বিয়ের একমাস পরেই। কবি এসে স্ত্রীকে বললেন, রাণীর বিয়ে ঠিক করে এলুম ছেলেটিকে আমার বড় ভাল লেগেছে ছোট বউ, যেমন সুন্দর দেখতে তেমনি মিষ্টি অমায়িক স্বভাব। রাণীটা যা জেদী মেয়ে, ওর বর একটু ভাল মানুষ গোছের না হলে চলবে কেন? তাই বিয়ে হয়ে গেল। রেণুকা কিন্তু এ বন্ধনটা খুব খুশি মনে মেনে নিতে পারলেন না, তার ভুরু একটু কুঁচকেই রইল। বিয়ের পরই বর বিদায় হবে শুনে একটু নিশ্চিন্ত হলেন। বিয়ের সব অনুষ্ঠানই লক্ষ্মী মেঘের মতো মেনে নিলেন। মায়ের মৃত্যু এবং স্বামী অকৃতকার্য হয়ে আমেরিকা থেকে ফিরে আসার রেণুকা খুব দুঃখিত হন। মনের। ব্যথা পরিণত হয় বুকের ব্যাধিতে। কবি তাঁকে শোনাতেন শিশুর কবিতা। মেয়ের শৈশবের কথা বলতে গিয়ে নিজের শৈশব উঁকি মেরে যেত বারবার। হাওয়া বদলের জন্যে নিয়ে গেছিলেন হিমালয়ে। কিন্তু কিছুতে কিছু যখন হল না তখন কবি কে প্রতিদিন উপনিষদের মন্ত্রের অর্থ বুঝিয়ে দিয়েছেন, যাতে ছেড়ে যেতে কষ্ট না হয়! তাই হয়ত যাবার সময় রেণুকা বাবার হাত চেপে ধরে বলেছিলেন, বাবা, ওঁ পিতা নোহসি বল। রেণুকার জীবনে তার বাবাই ছিলেন তার সব, তাই মৃত্যুর হাতে যখন আত্মসমর্পণ করতে হল তখন তিনি বাবার হাত ধরেই দরজাটুকু পার হতে চেয়েছিলেন।

নিজের দিদির কথা নিপুণভাবে বললেও মীর স্মৃতিকথায় ব্যক্তিগত ক্ষয়ক্ষতির। কোন আভাস দেননি। তাতে আছে শুধু নিজের ছেলেবেলার কথা। দুঃখের দারুণ আঘাত বারবার হানা দিয়েছিল মীরার জীবনে তবু সব শোকতাপ থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলেন তিনি। তা বলে যে অন্যের দুঃখের বেদনা বুঝতে পারতেন না তা নয়, তাই তো রেণুকার কথাটুকু বললুম, কিশোরী রেণুকার কথা এত ভাল করে আর কেউ লেখেননি। এখন রেণুকার কথা থাক। মীরার কথাই বলি।

রবীন্দ্রনাথের সবচেয়ে কাছে থাকা সবচেয়ে নির্বাক মেয়েটি। হায়! বেলার ভাগ্যে জুটেছিল কত আদর! আর মীরা শৈশবেই হারিয়েছে মাকে, ভাইকে, দিদিকে। পিতার সান্নিধ্যই বা তেমন পেয়েছেন কোথায়? মানুষ হয়েছেন জ্ঞানদানন্দিনীর কাছে। বিবাহিত জীবনেও মীর সুখী হননি। সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের নগেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়কে ভাবী জামাতা রূপে নির্বাচন করেই কবি চরম ভুল করেছিলেন। প্রিয়দর্শন তেজস্বী নগেন্দ্ৰ আদি সমাজের নিয়ম অনুযায়ী মীরাকে বিয়ে করতে রাজী হয়েছিলেন আমেরিকা যাবার শর্তে। বিয়ের সময়েই উপবীত নিয়ে বিরোধ বাধে। আদি ব্রাহ্মসমাজের মতে উপবীত ধারণ অবশ্যকর্তব্য। সাধারণ সমাজের নিয়মানুযায়ী নগেন্দ্র উপবীত ত্যাগ করেছিলেন। এরপর তার বিরোধ শুরু হয় শং-মাধুরীর সঙ্গে, কবি নীরব থেকে অবিচার করলেন শরতের ওপর। কিন্তু অদৃষ্ট! সুখ ছিল না মীরার জীবনে। নগেন্দ্র তাকে ত্যাগ করে খ্রীস্টান হয়ে চলে যান ভিন্ন পথে। মীরাও তাকে ফিরিয়ে আনার কথা ভাবেননি; শুধু ছোট ছোট ছেলে-মেয়ে দুটিকে নিয়ে থেকেছেন স্বতন্ত্রভাবে। স্বামীর সঙ্গে আর একবার দেখা হয়েছিল মীরার, একমাত্র ছেলে নীতীন্দ্রের মৃত্যুশয্যার পাশে জার্মানীতে। কবি ভেবেছিলেন বিরাট দুঃখ দুটি অভিমানী হৃদয়কে কাছে এনে দেবে। দেয়নি। এমনকি মীরার স্মৃতিকথাতে একবারও আসেননি নগেন্দ্র, মীরার জীবন থেকে তিনি একেবারেই মুছে গিয়েছিলেন।

আত্মপ্রকাশে বিমুখ মীরার দিন কাটত নির্জনে। নিজের হাতে গড়া। মালঞ্চে বসে। একমাত্র সান্ত্বনা ছিল দুটি সন্তান। তারাও চলে গেল। নীতীন্দ্র অত্যন্ত অকালে, সেই পুরনো কালব্যাধি যক্ষ্মায়। নন্দিতা অনেক পরে। কিন্তু কোন রকম দুঃখশোকের বহিঃপ্রকাশ দেখা যেত না। কবি বলতেন, সব লোকের সামনে নিজের গভীরতম দুঃখকে ক্ষুদ্র করতে লজ্জা করে। মীরাও লুকিয়ে রেখেছিলেন দুঃখের উপচে-ওঠা ডালি। একেবারে শেষ জীবনে স্মৃতিকথা না লিখলে তাকে নিয়ে স্বতন্ত্র করে লেখার কিছু থাকত না।

জীবনের শেষ দিকে নিজেকে ব্যক্ত করতেই বা বসলেন কেন তিনি। তার কি মনে হয়েছিল যা হারিয়ে যায় তা আগলে বসে রইব কত আর তাই কি লিখে রাখতে চেয়েছিলেন? কখনই না। যার নিজের জীবনেরই সব কিছু হারানোর তহবিলে চলে গেছে সে আর কি চাইবে? তিনি স্মৃতিকথা লিখেছেন। রোগশয্যার দীর্ঘ অবসর কাঁটাবার জন্যে। তাই এর মধ্যে নেই কোন ধারাবাহিকতা, নেই নিজের জীবনের কোন ছবি। যাদের সান্নিধ্য তার অন্ধকার-মনের বুক চিরে আলোর আভাস এনে দিয়েছিল শুধু তাদের কথাই আছে। যার মনের আয়নায় তারা ধরা পড়লেন তিনিই শুধু রইলেন অধরা।

তবু মানুষ কি একেবারে নিজের কথা লুকিয়ে রাখতে পারে? তাই স্মৃতিকথার পাতাও আপনি হয়ে উঠেছে ভারি। যখন তার মনের মতো বাগানে ফুল ফুটত তখন আর কোন দুঃখ থাকত না। মন আর স্থির হয়ে আসত। মীরার ভাষা বা লেখার ভঙ্গিটিও ভারি সরল। একটু দেখলে মন্দ হয় না :

গাছ ভরে বেল জুই ফুটতে লাগল, সকালে উঠে লাল রাস্তার উপর শিশির ভেজা শিউলি ফুল বিছিয়ে আছে দেখতে পেতুম, বাতাসে দূর থেকে চামেলির গন্ধ ভেসে আসত, তখন আর আমার কোন দুঃখ রইল না। মনে হত এরা। আমাকে যথেষ্ট প্রতিদান দিয়েছে। কেননা কোন কাজে যখন আমি মন বসাতে পারছিলুম না, তখন এই বাগানের নেশা আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছিল।

লেখার অনেক আগে মীরা রবীন্দ্র নির্দেশে কয়েকটি দেশী-বিদেশী। ইংরেজী প্রবন্ধের সর সংকলন করেন। আটটি ছাপা হয় প্রবাসীতে এবং তিনটি তত্ত্ববোধিনীতে। এছাড়া দীর্ঘ জীবনে মীর। শান্তিনিকেতনে বাস করলেও, বলতে গেলে কিছুই করেননি। মীরার সঙ্গে সঙ্গেই মহর্ষির নাতনীদের কথা বলার পালাও ফুল। এবার আসা যাক, এ বাড়ির নতুন-আসা বৌয়েদের কথায়। মেয়েরা যেমন ঠাকুরবাড়ির নিজস্ব সংস্কৃতিকে নিয়ে গিয়েছিলেন ভিন্ন পরিবারে তেমনি ভিন্ন পারিবারিক ঐশ্বর্যের গরিমা নিয়ে এসেছিলেন আরও কয়েকটি মেয়ে। তবে সকলে তো আর সমান প্রতিভার অধিকারী হতে পারেন

তাই যারা বিশেষ গুণ বতীরূপে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন তাদের কথাই বলব। এ সময়ে ঠাকুরবাড়িতে যারা বৌ ছয়ে এসেছিলেন এঁদের মধ্যে তিনজনের নাম সবচেয়ে বেশি শোনা যায়। এই তিনজন হচ্ছেন হেমলতা, প্রতিমা ও সংজ্ঞা।
হেমলতা দ্বিজেন্দ্রনাথের জ্যেষ্ঠ পুত্রবধূ। দ্বিপেন্দ্রনাথের দ্বিতীয় স্ত্রী। দ্বিপেন্দ্রর প্রথমা স্ত্রী সুশীলা তার জীবনের স্বল্প অবকাশে অন্দরমহলকে হাসিয়ে-কাঁদিয়ে চলে গেছেন। বাংলা দেশের এক গ্রাম থেকেই বোঁ হয়ে এসেছিলেন সুশীল ও তাঁর বোন চারুশীলা, দু বোনের কেউই বেশিদিন বাঁচেননি। সুশীলা ভাল গান ও অভিনয় করতে পারতেন। প্রফুল্ল মন্ত্রী তার স্মৃতিচারণের সময় জানিয়েছেন যে, যে কোন গানই তিনি এমন ভাব নিয়ে গাইতেন যে লোকে মুগ্ধ হত। সুশীলার ছেলে দিনেন্দ্রর গানেও এই বৈশিষ্ট ছিল। সুশীলা অভিনয় করেছেন ঠাকুরবাড়ির সেই সোনালি পর্বে। বিবাহ-উৎসব নাটিকায় তিনিই সাজতেন নায়ক। তার একটা গান ও কেন চুরি করে চায় তখন খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। অবশ্য এই জনপ্রিয়তা ঠাকুরবাড়ির বাইরে নয়। বাইরে সুশীলার গান অভিনয় কিছুই পোঁছয়নি। তার স্বভাবটি ছিল ভারি মিষ্টি। সবার সঙ্গে মিলে-মিশে হৈচৈ করতে ভালবাসতেন, তারই মধ্যে দেখা গেল মেমেরাইজ করার দুর্লভ ক্ষমতাও সুশীলায় যথেষ্ট রয়েছে। তিনি দীর্ঘজীবী হলে আর একটি প্রতিভাময়ী নারীকে আমরা দেখতে পেতুম।

সুশীলার মৃত্যুর পরে ঠাকুরবাড়ির বৌ হয়ে আসেন হেমলতা। রাজা রামযোহন রায়ের পুত্র রাধাপ্রসাদ রায়ের দৌহিত্র বংশে তার জন্ম। ইতিপূর্বে তার তিন দাদার সঙ্গে ঠাকুরবাড়ির তিনটি মেয়ের বিয়ে হয়েছে। এবার সে বাড়ির বৌ হয়ে এলেন হেমলতা, বিয়ের আগে থেকেই ঠাকুরবাড়ির অন্তঃপুরের সঙ্গে হেমলতার পরিচয় ছিল। ষোলো বছর বয়সে বৌ হয়ে এসেই দ্বিপেন্দ্রর দুটি ছেলেমেয়ের একেবারে আসল মা হয়ে উঠলেন। তারপর থেকে হেমলতার বড় মা হয়ে ওঠার কাহিনী এগিয়েছে মসৃণভাবে। তার নিজের সন্তান ছিল না, কিন্তু তিনি ছিলেন সবারই বড় মা। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত এই শ্রদ্ধা ও সম্মান পেয়েছেন তিনি। সেবা, শুশ্রুষা, আদর-যত্ন, দেখাশোনা, কর্তৃত্ব ক্ষমতার সঙ্গে সঙ্গে ছিল লেখবার দুর্লভ ক্ষমতা। আদি ব্রাহ্মসমাজে তিনি প্রথম আচার্য। পারিবারিক কাজ, সমাজ সেবা, ধর্মোপদেশ দানের ফাঁকে ফাঁকে চলত তার সাহিত্য-সাধনা।

ছোটবেলা থেকেই হেমলতা বিদ্যোৎসাহিনী। তাই তার বাবা লতিমোহন যত্ন করে মেয়েকে বাংলা, ইংরেজী ভাষার সঙ্গে শিখিয়েছিলেন জ্যোতিষশাস্ত্র। মেয়েদের জ্যোতিষ পাঠ নিষিদ্ধ। যাদের বাঁচা-মরা খাওয়া-পরা নির্ভর করে পরের হাতে সে নিজের ভাগ্য গণনা করে করবেই বা কি? তাই মেয়ের মা বিরোধিতা। করতেন। এখন দিন বদলেছে। তাই ললিতমোহন হেসে বলতেন, এই মেয়ে আমার ব্রাহ্মণ। ব্রাহ্মণের মতোই হেমলতার ধারণাশক্তি ছিল তাই জ্যোতিষচর্চা। করা মোটেই অসম্ভব নয়। হেমলতার জ্যোতিষচর্চা অবশ্য কতটা এগিয়েছিল জানা। যায়নি তবে কয়েকটা গল্পে তার ছাপ পড়েছে। এছাড়া দাদা মোহিনীমোহনের কাছে তিনি পড়েছিলেন কালীসিংহির মহাভারত। বিয়ের পরও তার আগ্রহ দেখে দ্বিপেন্দ্র মিস ম্যাকস্কলকে নিয়োগ করেন হেমলতাকে ইংরেজী পড়াবার। জন্যে। শান্তিনিকেতনে বাস করার সময় হেমলতাকে দুবছর নিয়মিতভাবে ইংরেজী পড়ান পিয়ার্সন সাহেব। এণ্ডজের কাছে হেমলতা পড়তেন ইংরেজী কবিতা। হেমলতা পড়তেন রবীন্দ্রনাথের কাছেও। কবি দেশবিদেশের ইংরেজী পত্রিকা থেকে ভাল ভাল প্রবন্ধ বেছে নিয়ে হেমলতাকে অনুবাদ করতে দিতেন। শুধু সাহিত্য বা ভাষা নয়, হেমলতার আগ্রহ ছিল ধর্ম ও আধ্যাত্মবাদের ওপর। তার বাবা ছিলেন তৈলঙ্গস্বামীর সাক্ষাৎ শিষ্য। দাদা মোহিনীমোহনও প্রথমে থিয়সফিস্ট আন্দোলনের এবং পরে শিবনারায়ণ স্বামীর সংস্পর্শে আসেন। হেমলতাও পরমহংস শিবনারায়ণ স্বামীকেই গুরু হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। সুতরাং বিভিন্ন আধ্যাত্মিক চিন্তা ও ধর্মসাধনার প্রতি তার আগ্রহ ছিল। রাজা রামমোহনের ঐতিহ্য তো ছিলই, বিয়ের পরে এর সঙ্গে যুক্ত হল মহর্ষির জীবনসাধনা। রবীন্দ্রনাথের কাছে তিনি কিছু সুফীবাদের বইও পড়েন। অনুবাদ করেন আফ্রিকায় ইসলাম প্রবন্ধটি। সেটি পড়ে একদিন কবি পড়াতে পড়াতে বলেন, তুমি মুসলমান হবে নাকি? তোমার মন যে রকম উজ্জ্বল হয়ে ওঠে দেখি, সুফীদের কথায়।

হেমলতা তখন নতুন বৌ নন। তাই বললেন, সুফীরা মহাতাপস, তবে কোন কিছু হাওয়াইওয়ি চবে না রাজা রামমোহনের যুগে। কোন একটা কোঠায় ঢোকা যায় কি করে?

কবি শুনে খুশি হয়েছিলেন, কথা ঠিক। তোমার ওপর রাজা রামমোহনের আশীর্বাদ আছে দেখছি।

মহর্ষির আশীর্বাদও পেয়েছিলেন হেমলতা। বলেরে মৃত্যুর পর পারিবারিক ধর্মালোচনার সময় তার আগ্রহ, উৎসাহ এবং পৃথক ধর্মসাধনার কথা মহর্ষি শুনতে পান ও হেমলতার সঙ্গে প্রতিদিন দুপুরে একঘণ্টা ধর্মালোচনা করতে আরম্ভ করেন। এভাবেই কাটে দীর্ঘ সাত বছর।

মৃত্যুর আগে নাতবৌয়ের ধর্মবিশ্বাস ও ভগবৎ ভক্তির প্রতি আস্থার নিদর্শন রূপে মহর্ষি তাকে দিয়ে যান নিজের দীক্ষার আংটিটি। হেমলতা একথা জানতেন না। মহর্ষির মৃত্যুর পরে তাঁর খাজাঞ্চী যদুনাথ চট্টোপাধ্যায় আংটিটি হেমলতাকে দিয়ে বলেন, কর্তামহাশয় ইহা আপনাকে দিবার জন্য আমাকে বলিয়া গিয়াছেন এবং বলিয়াছেন আপনিই ইহার প্রকৃত অধিকারী। হেমলতা অনেকদিন এই আংটি পরেছিলেন, পরে আংটিটি শান্তিনিকেতনের রবীন্দ্রভবনে রাখা হয়। এই ঘটনা থেকেই প্রমাণ পাওয়া যায় হেমলতা ছিলেন সবার থেকে স্বতন্ত্র এবং মহর্ষির জীবন-সাধনার যোগ্যতম উত্তরাধিকারিণী। এ সময় ঠাকুরবাড়ির মেয়েরা বিভিন্ন দিকে এঁকে দিচ্ছেন নিজেদের সাফল্যের পরিচয় আর হেমলতা নীরবে নিভৃতে দিচ্ছেন ধর্ম উপদেশ। এই উপদেশগুলি পুস্তিকার আকারে ছাপা হয়েছিল। পরমাত্মায় কি প্রয়োজন, সৃষ্টি ও স্রষ্টা কাহার নাম, চৈতন্যময় পূর্ণ ও সর্বশক্তিমান ঈশ্বর কাহার নাম, সত্য লাভের উপায় কি প্রভৃতি উপদেশে ব্রাহ্মধর্মের সারসত্য নিহিত আছে। ধর্ম সম্বন্ধে হেমলতার যেমন গোঁড়ামি ছিল না তেমনি সর্বধর্মের প্রতি ছিল তার আন্তরিক শ্রদ্ধা। রামকৃষ্ণ মিশনের সন্ন্যাসীরা হেমলতার বক্তৃতা শুনে আনন্দিত হতেন। শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের জন্মশতবর্ষপূর্তি উৎসবে যোগ দিয়ে তিনি ঠাকুরকে ব্যাখ্যা করেছিলেন, সহজ আনন্দের উৎস শিশু ভোলানাথ রূপে।

ধর্মচর্চার সঙ্গে সঙ্গে হেমলত করেছেন সাহিত্যচর্চা এবং সমাজসেবা। এ কাজেও তিনি কোন বাধা পাননি। মেয়েদের বাধা ক্রমশই অপসারিত হচ্ছিল। তার ওপরে তিনি ধর্মপ্রাণ, সুশিক্ষিত এবং ধনী-ঘরনী। সব কাজের মধ্যেও বাড়ির সবার জন্যে সর্বদা ব্যস্ত থাকত তার দুit সেবানিপুণ হাতের প্রাণঢালা শুশ্রুষা। কি করে যে এত কাজ তিনি করতেন কে জানে? গল্প-কবিতা-প্রবন্ধনাটিকা-শিশুপাঠ্য বই-স্মৃতিকথা-গান বলতে গেলে সবই লিখেছেন হেমলতা। এর ওপর ছিল বঙ্গ লক্ষ্মী পত্রিকা সম্পাদনা, সরোজনলিনী ও বসন্তকুমারী বিধবা আশ্রমের ভার। ছিল শান্তিনিকেতনের ছেলেদের দেখাশোনার ভার। প্রথমে তার সাহিত্যচর্চার কথাটাই সেরে নেওয়া যেতে পারে। ঠাকুরবাড়িতে এসে অনেকেই লেখিকা হয়েছেন কিন্তু হেমলতার সাহিত্যবোধ ছিল সহজাত। এ বাড়ির বৌ হয়েও তার নিজস্বতা তিনি হারাননি। তাই তাঁর গল্পে পাওয়া যাবে ভিন্ন সুরের সন্ধান, তবে প্রবন্ধ-স্মৃতিকথায় তিনি ঠাকুরবাড়ির বিশেষ ভঙ্গিটিকেই গ্রহণ করেছেন।

হেমলতার কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে মাত্র তিনটি—জ্যোতিঃ, অকল্পিতা ও আলোর পাখি। এছাড়াও অনেক কবিতা এখনও পত্র-পত্রিকায়। ছড়িয়ে আছে। রবীন্দ্রনাথ এবং জ্যোতিরিন্দ্রনাথ হেমলতার কয়েকটা কবিতায় সুর দিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের সুর দেওয়া গান হল ওহে সুনির্মল সুন্দর উজ্জ্বল শুভ্র আলোকে ও বালক প্রাণে আলোক জালি। জ্যোতিরিন্দ্র সুর দিয়েছিলেন। আমি আর কিছু না জানি কবিতায়। এঁরা ছাড়াও হেমলতার গানের সুর ও স্বরলিপি করেছেন ইনিরা, ও বিখ্যাত গায়ক সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়।

হেমলতার সব কবিতাই ভগবৎ-প্রেমে সিক্ত। ছোট ছোট কবিতায় গভীরতার ছাপ স্পষ্ট কিন্তু কোথাও দুর্বোধ্য বা জটিল নয়। কোথাও নেই রূপ ও রূপকের ঠোকাঠুকি, প্রতীক ও ইঙ্গিতের ব্যঞ্জনা কিংবা চিত্রকল্পের সুমিত আভাস। তবু কি যেন আছে। অন্তর ও বাইরের চেতনাকে তিনি এক করে দেখতে চেয়েছেন। এই দেখার মধ্যে আছে তার নিজস্ব অনুভব :

অন্তরে চেতনা অনুভবে
বাহিরে সে ধরে
নানামত রূপ,
অন্তরে বাহিরে নেহারে যে তারে
ঘুচে তার ভব–
বন্ধনের দুখ।

হেমলতার সব কবিতাই আজকের তুলনায় বড় বেশি সরলীকৃত তবে ১৯১০১২ সালে এ জাতীয় কবিতার আদর ছিল। রবীন্দ্রানুসারী কবিগোষ্ঠী ছাড়াও এরকম কবিতা লিখতেন প্রিয়ম্বদা দেবী, কামিনী রায়, অনুদাসুন্দরী দেবী, মানকুমারী বস্তু আরো অনেকে। আসলে পারিবারিক সুখদুঃখ, প্রকৃতি এবং ঈশ্বর এই ছিল মেয়েদের কবিতার জগৎ এবং ছিল অনেকদিন। তখনও গদ্য কবিতা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু হয়নি। ভাব এবং কাব্যভাষাতে রাবীন্দ্রিক ছাপই বেশি ছিল। কবি হেমলতার কবিতা পড়তে ভালবাসতেন। স্কুলপাঠ্য কাব্য পরিচয়ে তিনি হেমলতার একটা কবিতাও যোগ করেন।

দুনিয়ার দেনা আর দেহলি হেমলতার লেখা গল্পের বই। প্রথমটির গল্পগুলো অনেকটা লিপিকাধর্মী তবে দার্শনিক চিন্তায় ভরা। কামিনী রায় গল্প পড়ে অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। এবং সেই সঙ্গে অনুভব করেছিলেন হেমলতার সাহিত্য সাধনায় অনুমান আর কল্পনার চেয়ে জীবনের অভিজ্ঞতা অনেক বেশি কার্যকর হয়েছে। কথাটা সত্যি, মেয়েদের লেখায় অভিজ্ঞতার অভাব একটা মস্ত বড় জিনিষ। তাই অনেক জিনিষই সত্য হয়েও বাস্তব হয়ে ওঠে না। হেমলতার সেই অসুবিধে ছিল না। তিনি সমাজসেবার জন্যে বিভিন্ন মানুষকে দেখেছিলেন, পর্যবেক্ষণ করেছিলেন আপন অসামান্য অন্তদৃষ্টি দিয়ে, তাই মুগ্ধ করতে পেরেছিলেন কথাকোবিদ রবীন্দ্রনাথকে। যিনি মেয়েদের লেখা পছন্দ করতেন না। তিনিও দেহলি পড়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে লিখেছিলেন একখানি অনবদ্য চিঠি। লিখেছিলেন :

বাংলা দেশের ছোট বড় নানা গ্রামে পল্লীতে তুমি ভ্রমণ করেছ, সেই উপলক্ষ্যে তোমার দৃষ্টিশক্তি তোমার অভিজ্ঞতাকে বিচিত্র করে তুলেছে, তোমার গল্পগুলি সেই অভিজ্ঞতার চিত্র প্রদর্শনী।

ঠাকুরবাড়ির মেয়ে-বৌদের মধ্যে স্বর্ণকুমারীর পর মৌলিক গল্প লিখে এতখানি সম্মান বোধহয় হেমলতাই পেলেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ও তাকে সম্মান জানিয়েছিল সর্বপ্রথম লীলা পুরস্কার দিয়ে। হেমলতার গল্পের সঙ্গে স্বর্ণকুমারীর লেখার সাদৃশ্য নেই, বরং যোগ আছে লাহোরিনী শরৎকুমারীর গল্পের। দুজনেরি স্বচ্ছ সরস জীবনদৃষ্টি তাঁদের গল্পে উদ্ভাসিত। তবে হেমলতার কবিতার মতোই গল্পগুলোও জটিলতাবর্জিত। তার গল্পের চরিত্র, ঘটনা, সংলাপ সবই অতি সহজ, স্বাভাবিক, অনাড়ম্বর। অধিকাংশ গল্পেই আছে হেমলতার বাস্তব অভিজ্ঞতা। বিধবা আশ্রম দেখা শোনার সময় তিনি অনেকের সুখ-দুঃখের সঙ্গে পরিচিত হন।

হলে চন্দ্রমণি গল্পের নায়িকাকে আঁকতে পারতেন না। দারিদ্র্যের জ্বালা সহ্য করতে না পেরে কুমারী মেয়েকে বিধবা সাজিয়ে আশ্রমে পাঠানো তৎকালীন লেখিকাদের কলমে আঁকা সম্ভব ছিল না। অভিজ্ঞতাই তাকে বহু বিচিত্র পরিস্থিতির সামনে এনে দাঁড় করিয়েছে।

হেমলতাকে প্রকৃত সমাজ সেবিক। বললেই বোধহয় তার যথার্থ পরিচয় দেওয়া হয়। ঠাকুরবাড়ির অন্যান্য মেয়েরাও সাহিত্য, সঙ্গীত চর্চার সঙ্গে সঙ্গে সমাজসেবা করেছেন। কিন্তু হেমলতার প্রধান লক্ষ্য ছিল নারী কল্যাণ। সখিসমিতি, বিধবা শিল্পাম কিংবা ভারত স্ত্রীমহামণ্ডলের সঙ্গেই তার যোগ বেশি। তিনি নিয়েছিলেন সরোজনলিনী নারীমঙ্গলসমিতি ও পুরীর বসন্তকুমারী বিধবা-আশ্রমের ভার। আশ্রম পরিচালনার সময় হেমলতা যে সংগঠনী শক্তির পরিচয় দিয়েছিলেন তার তুলনা বোধহয় চলে শুধু ভারত স্ত্রীমহামণ্ডলের কৃষ্ণভামিনী দাসের সঙ্গে।

সরোজনলিনী আশ্রম প্রতিষ্ঠা হয় ১৯২৫ সালে। তার কিছুদিন পরে গুরুসদয় দত্তের অনুরোধে হেমলতা এর ভার নেন। পরে তিনি দেখলেন নারীশিক্ষাসমিতির জন্যে অবলা বসু, হিরন্ময়ী শিল্পাশ্রমের জন্যে স্বর্ণকুমারী ও ভারত স্ত্রীমহামণ্ডলের দেখাশোনার জন্যে সরলা আছেন কিন্তু সরোজনলিনীর জন্যে কেউ নেই। তাই সে ভার তাকেই নিতে হল। নারীশিক্ষা ও কল্যাণের আদর্শে নিজেকে একেবারে সঁপে দিয়ে তিনি খুঁজেছিলেন, মেয়েদের সত্যিকারের অধিকার কোথায় খর্ব হয়েছে। নিজে কঠোর বৈধব্য জীবন যাপন করলেও মেয়েদের মৌল সমস্যা অনুসন্ধানের সময় সংস্কারমুক্ত দৃষ্টিভঙ্গিরই পরিচয় দিয়েছেন। মেয়েদের স্বাধীনতা কি এবং কাকে বলে সেকথাও তিনি খুব সংক্ষেপে জানাতে পেরেছেন। পুরুষের সঙ্গে অবাধে মিলতে মিশতে পারাকেই তিনি স্ত্রী-স্বাধীনতা নাম দিতে নারাজ। পুরুষকে শুধু পুরুষ বলেই জেনে যে মেয়ে পুরুষের সঙ্গে মেলামেশার জন্যে লালায়িত, সে মেয়ে অশিক্ষিত। পুরুষকে যিনি পুরুষের অতিরিক্ত মানুষ বলে দেখতে ও চিনতে শিখেছেন তিনিই প্রকৃত শিক্ষিত। তবে বাঙালী মেয়েদের স্বাধীনতা স্পৃহাকে যারা বাঁকা চোখে দেখেছেন তাদের ভুলও ভেঙে দিতে চেয়েছেন হেমত। বাঙালী মেয়েরা পুরুষের সঙ্গে মেশবার লালসায় স্বাধীনতা চাননি। তাদের সত্যিকারের অধীনতা হচ্ছে দায়ভাগে অনধিকার।

য়ুরোপে নারীমুক্তি আন্দোলনের কথা শুনে উৎসাহিত হয়ে হেমলতা দেখতে গিয়েছিলেন সেখানে নারীমুক্তি আন্দোলন কি ভাবে সফল হয়েছে এবং স্বাধীনতার প্রকৃত স্বরূপ কি? অনেক দেশ ঘুরে তিনি যখন ভারতে ফিরে এলেন তখনও তার এ সম্বন্ধে কোনো ধারণার পরিবর্তন দেখা যায়নি। নারীর আদর্শ তার কাছে ত্যাগ-তিতিক্ষা-সংযম ও পরহিত। সেই আদর্শেই তিনি মেয়েদের অনুপ্রাণিত করেছেন। তার একাধিক প্রবন্ধে এই কথাই বলা হয়েছে। সমাজসেবিকা হিসেবে স্বর্ণকুমারী, হিরন্ময়ী, সরলা, কৃষ্ণভামিনী দাস, অবলা বসু, চারুশীলা দেবী, মোহিনী সেন ও আরো অনেকেই ছিলেন, এঁদের মধ্যে হেমলতা ছিলেন মধ্যমণি হয়ে। সব আশ্রমেই তার ডাক পড়ত। হাসি মুখে এগিয়ে যেতেন সবার কাছে। মিশে যেতেন সবার সঙ্গে। অন্তরের অভিজাত শুদ্ধতাবোধের সঙ্গে মিশত প্রাণের আবেগ।

এখনও যে মাঝে মাঝে আমরা হেমলতার কথা মনে করি তার কারণ কিন্তু সমাজসেবা নয়, তার লেখা স্মৃতিকথা। না, ঠাকুরবাড়ির ট্র্যাডিশন অনুযায়ী তিনি নিজের আত্মকাহিনী লেখেননি। কিন্তু ঘরোয়া আটপৌরে ভঙ্গিতে এমন কয়েকটা প্রবন্ধ লিখেছেন যার মধ্যে মিশে আছে রম্য ব্যক্তির স্বাদ। নিজের জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতার কথা লিখে রাখার ইচ্ছে তার ছিল না। কিন্তু যাদের সংস্পর্শে এসে তার জীবন ধন্য হয়ে উঠেছিল, সেই স্পর্শমণির মতো কয়েকজন ব্যক্তিকে প্রবন্ধের মধ্যে ধরে রেখেছেন হেমলতা। না রেখে পারেননি। স্মৃতিকথা, ছোঁয়া থাকলেও এই প্রবন্ধগুলো লেখবার সময় নিজেকে সম্পূর্ণ। অপরিচয়ের দূরত্বে সরিনে রাখার কৃতিত্ব অস্বীকার করা যায় না। রবীন্দ্রনাথের বিবাহবাসর, বৈশাখের রবীন্দ্রনাথ, সংসারী রবীন্দ্রনাথ, আশ্চর্য মানুষ রবীন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথের অন্তমুখীন সাধনার বারা—কবিকে বুঝতে খুব বেশি সাহায্য করে। কবি নিজেও স্বীকার করেছেন রচনাগুলি অতি সুপাঠ্য। রবীন্দ্রজীবনসন্ধানীর কাছে হেমলতার প্রবন্ধগুলি অমূল্য সম্পদ হয়ে আছে। দু একটা ছবি দেখা যাক। হেমলতা লিখেছেন :

কবিপত্নী একবার সাধ করে সোনার বোতাম গড়িয়েছিলেন কবির জন্মদিনে কবিকে পরাবেন বলে। কবি দেখে বললেন, ছি ছি ছি, পুরুষে কখনো সোনা পরে—লজ্জার কথা, তোমাদের চমৎকার রুচি। কবিপত্নী সে-বোতাম ভেঙে ওপাল-বসানে বোতাম গড়িয়ে দিলেন। দু-চার বার কবি সেটি ব্যবহার করেছিলেন যেন দায়ে পড়ে।

জ্ঞানবৃদ্ধ আপনভোলা চিরশিশু দ্বিজেন্দ্রনাথের কথাও কম নেই। দুবেলা তার খাবার সময়ে একটা না একটা গোলযোগ লেগেই থাকত। মোচার ঘন্টে গরম মশলার গন্ধ পেয়েই তিনি হুলস্থুল কাণ্ড বাঁধিয়ে দিতেন, কোথা থেকে কতকগুলো মাথাঘসা বেটে মোচার ঘন্টে ঢুকিয়েছ। কিছু জান না কি করে রাঁধতে হয়। কিংবা

বৈকালে গরম লুচি ভেজে সামনে এনে দিয়েছে। লুচিতে হাত ঠেকিয়েই বললেন, এ কি লুচি? ঘি চপচপ করছে লুচির সারা গায়ে, আমার হাতশুদ্ধ নষ্ট হল ঘি লেগে। লুচির প্লেট আমার হাতে তুলে দিয়ে বললেন, যাও, জল দিয়ে লুচি ভেজে আন। ঘি দিয়ে বুঝি লুচি ভাজে?

হেমলতা একটু পরে ঘিয়ের বদলে শুকনো ময়দা দিয়ে বেলে লুচি ভেজে আনলেন। এবার ঠিক হয়েছে দেখা গেল। লুচির গায়ে ঘি লেগে নেই একটুও। খুশি হয়ে দ্বিজেন্দ্র বললেন, এই তো ঠিক হয়েছে, দেখলে জল দিয়ে ভেজে কেমন হল। খাওয়ার পরে হেমলতা গল্পচ্ছলে শোনালেন লুচি ভাজার ইতিহাস। তখন সে কি হাসি, তাই তো, গরমজলে ময়দা দিলে গুলে কাই হয়ে যাবে তো বটেই। আচ্ছা কাণ্ড আমার, কি বলতে কি বলি, তোমাদের জ্বালিয়ে মারি। তোমরা যা ভাল বোঝ তাই কর–

হেমলতা না থাকলে এ রকম অনেক ছবিই হারিয়ে যেত। হয়ত খুব বড় গোছের ক্ষতি হত না কিন্তু সেই বিশাল মহাপ্রাণ ব্যক্তিদের অনেকখানি ব্যক্তিত্ব রইত ঢাকা। কোন পুরুষ কি আমাদের কাছে পৌঁছে দিতে পারতেন ঠাকুরবাড়ির এই আটপৌরে অনাবৃত রূপ?

দ্বিজেন্দ্ৰপরিবারে সুশীলা, হেমলতা ছাড়াও বধূরূপে এসেছিলেন অরুণেরে দুই স্ত্রী চারুশীল ও সুশোভিনী, নীতীন্দ্রনাথের স্ত্রী সুহাসিনী, সুধীন্দ্রনাথের স্ত্রী চারুবালা এবং কৃতীন্দ্রনাথের দুই স্ত্রী সুকেশী ও সবিতা। সুশীলার মতো চারুশীলা ও সুকেশীর অকালমৃত্যু হয়। চারুশীলা ছিলেন সুশীলারই বোন। অন্যান্যরাও তাদের পারিবারিক গণ্ডির সীমা ছাড়িয়ে এমন কিছুই করেননি যে স্বতন্ত্রভাবে উল্লেখ করা চলে। বরং সুধীন্দ্রের স্ত্রী চারুবালা ওই পারিবারিক পরিবেশেই ছেলেমেয়েদের মনে স্বাদেশিকতা সঞ্চারের চেষ্টা করেন। তখন বাংলাদেশের আকাশে বাতাসে দেশপ্রেমের সুর ভেসে বেড়াচ্ছে। চারুবালা প্রত্যক্ষভাবে কোন আন্দোলনে জড়িয়ে না পড়ে ছেলেমেয়েদের স্বদেশী জিনিষ ব্যবহার, দেশপ্রেমের গান শেখাতেন। তাঁর শিক্ষা যে ব্যর্থ হয়নি তার পুত্র সৌম্যেন্দ্রনাথের বিদ্রোহী মনোভাবই তার প্রমাণ। তবে একটা কথা বলা ভাল। এ সময় ঠাকুরবাড়ির মেয়েরা আর বাংলায় নারী সমাজের নেত্রী হয়ে নেই। কয়েকজন প্রতিভাময়ী নিশ্চয় আছেন কিন্তু তাদের পরিধিও সংকীর্ণ। ঠাকুরবাড়ির সম্বন্ধে এমন একটা ধারা বা ধারণা গড়ে উঠেছে লোকের মনে। সে ধারণা শ্রদ্ধা ও বিস্ময় মেশা। কিন্তু এখন আর বাংলায় গুণবতী মেয়ের সংখ্যা কম নয়। শিক্ষা, শিল্প, বিজ্ঞান সব দিকেই তাদের ভূমিকা স্পষ্ট। বরং ঠাকুরবাড়ির মেয়েরা সে পথ থেকে কিছুটা দূরে সরে এসে নিরালায় শিল্পসাধনা নিয়ে মেতে উঠেছেন, কারণ বাংলার শিল্পজগৎ তখন সম্পূর্ণভাবে সমৃদ্ধ হয়নি।

সুকেশী থাকতেন শান্তিনিকেতনেএই হাসিখুশি মিশুকে বৌটি তার মধুর ব্যবহার দিয়ে সকলকে আপন করে নিয়েছিলেন। এ সময় রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতন—বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠা করায় ঠাকুরবাড়ির অনেকেই চলে এলেন শান্তিনিকেতনে। জোড়াসাঁকোর বাড়ি ক্রমশই যেন তার মহিমা হারাচ্ছিল। সেটাই স্বাভাবিক। কারণ, উনিশ শতকে প্রাধান্য বিস্তার করেছিল এই বিশাল বাড়িটি, বিশ শতকে বিশ্ববিখ্যাত হয়ে উঠলেন এই বাড়িরই একটি মানুষ—একক ব্যক্তিত্ব প্রাধান্য লাভ করল। তাই শান্তিনিকেতনে গড়ে উঠতে লাগল ঘরোয়া পরিবেশ। মেয়ের গড়লেন অলাপিনী সভা—আনন্দমেলা। বেরোতে শুরু করল হাতেলেখা মেয়েলি পত্রিকা শ্রেয়সী, ঘরোয়া আরো কত কী! ইন্দিরা, হেমলতা সবাই জমিয়ে বসলেন সেখানে। সুকেশীও মিশে গিয়েছিলেন সবার সাথে। যখনি দরকার পড়ত এগিয়ে আসতেন হাসিমুখে। কখনো বাড়ির মেয়েদের মিলে থিয়েটার করতেন, কখনো নানারকম বরঠকানো রান্না করে লোকেদের ঠকাতেন। একবার ক্ষিতিমোহন সেনকে ঠকিয়েছিলেন কুমড়ো কেটে তৈরি করা চাপা ফুল দিয়ে। অল্প কয়েকদিনের ইনফ্লুয়েঞ্জা জ্বরে সুকেশী। চিরবিদায় নিলেন। কৃতীন্দ্রের পুনর্বিবাহ হয় সবিতার সঙ্গে। সবিতা ভাল ছবি আঁকতে পারতেন। ১৩২৯ সালের শ্রেয়সীর পাতায় তাঁর আঁকা কিছু ছবি ছাপা হয়েছিল। এ প্রসঙ্গে হেমেন্দ্রনাথের পুত্রবধূদের কথাও সেরে নেওয়া যেতে পারে। হিতেন্ত্রের স্ত্রী সরোজিনী, ক্ষিতীন্দ্রের স্ত্রী ধৃতিমতী ও সুহাসিনী এবং ঋতেন্ত্রের স্ত্রী অলকা এসেছেন ঠাকুরবাড়িতে। তবে তিন ভাইয়ের কেউই তাদের বাবার মতো নারী প্রগতি বা স্ত্রীশিক্ষায় উৎসাহী ছিলেন বলে মনে হয় না। বরং এ সময় যেন ঠাকুরবাড়ি একটু বেশি মাত্রায় রক্ষণশীল এবং পর্দানশীন হয়ে পড়েছিল। অবশ্য এরই মধ্যে নানারকম শিক্ষার সুযোগ পেয়েছিলেন সুরেন্দ্রের স্ত্রী সংজ্ঞা, বলেন্দ্রের স্ত্রী সুশী বা সাহানা এবং রথীন্দ্রের স্ত্রী প্রতিমা।

জ্ঞানদানন্দিনীর একমাত্র ছেলে সুরেন্দ্রনাথ! চোখের মণি, আদরের দুলাল। তার বিয়ে দেবেন ডাকসাইটে সুন্দরীর সঙ্গে। যেখানে সুন্দর মেয়ে দেখতে পান তার সঙ্গেই সম্বন্ধ করেন। মাঝে মাঝে তাদের বাড়িতে এনে রেখে দিয়েছেন। ছেলের ঘোর আপত্তি বিয়েতে। কি আর হবে? কঁদতে কাঁদতে অনেক খেলনা দিয়ে সে মেয়েকে বিদায় দিতে হয়েছে। সুরেন্দ্রের বিয়ের কথা হয়েছিল কুচবিহারের রাজবাড়িতে। কেশব সেনের নাতিনী সুকৃতির সঙ্গে। তার মা সুনীতি দেবী। ঠাকুরবাড়ির সঙ্গে এদের সম্বন্ধ-বন্ধুত্ব-হৃদ্যতা অনেক পুরনো। সুতরাং এ তো সুখের কথা! কিন্তু আপত্তি করেছিলেন মহর্ষি। তিনি ব্রাহ্মণ-অব্রাহ্মণের বিবাহের ঘোর বিরোধী। কাজেই হল না। সুকৃতির বিয়ে হল স্বর্ণকুমারীর ছেলে জ্যোৎস্নানাথের সঙ্গে। তিনি বিয়ে করেছিলেন সকলের অমতে! সুরেন্দ্র ও জ্যোৎস্না ছিলেন অভিন্নহৃদয় বন্ধু। যাক সে কথা! সুরেন্দ্রের বিয়ে ঠিক হল একেবারে হঠাৎ।

মহর্ষির প্রিয় শিষ্য প্রিয়নাথ শাস্ত্রীর মেয়ে সংজ্ঞা একদিন এসেছিলেন ভাইয়ের পৈতেয় নিমন্ত্রণ করতে। নাক মুখ টিকলো, কেবল চোখ একটু বসা, তাকে সকলেরি খুব পছন্দ হয়ে গেল। নলিনীর স্বামী সুহৃং চৌধুরী জ্ঞানদানন্দিনীকে বললেন, এই ত বেশ মেয়ে হাতের কাছে রয়েছে। একেই বউ করুন-না। জ্ঞানদানন্দিনী তো এককথায় রাজী। তাই হল। সবচেয়ে খুশি হলেন মহর্ষি। তিনি আনন্দের চোটে এক চামচ ভাত বেশি খেয়ে ফেললেন। বললেন, ঢালাও হুকুম রইল, এ বিয়েতে দেবী যা চায় তাই যেন হয়। দেবী হচ্ছেন সংজ্ঞার মা। আসলে সংজ্ঞার মা ইন্দিরাও ঠাকুরবাড়ির মেয়ে, দ্বারকানাথ। ঠাকুরের সহোদর রাধানাথ ঠাকুরের বংশে শ্রীনাথ ঠাকুরের মেয়ে। তাঁর নিজের লেখা আমার খাতাও একটি সুখপাঠ্য বই।

বেশ ধূমধামের সঙ্গে বিয়ে হল। মায়ের জেদাজেদিতে বিয়ে করতে হল। বলে সুরেন্দ্র মেয়ে দেখেননি। সংজ্ঞার বয়সও তার তুলনায় খুব কম ৷ সুরেন্দ্রের একত্রিশ, সংজ্ঞার সবে বারো বিয়ে করতে যাবার আগে সুরেন্দ্র একবার। শুধু জিজ্ঞেস করেছিলেন ইন্দিরাকে, নেহাৎ বাচ্চা কি? বয়সের খুব পার্থক্য থাকলেও স্ত্রীকে পরম স্নেহে গ্রহণ করলেন সুরেন্দ্র। শুরু করলেন লেখাপড়া শেখাতে! তিনি নিজে খুব ভাল অনুবাদ করতে পারতেন। ইংরেজী বই খুলে একবারও না থেমে এমন সহজ বাংলায় বলে যেতেন যে বোঝাই যেত না মুখে মুখে অনুবাদ করছেন। ক্রমে সংজ্ঞাও শিখলেন অনুবাদ করতে। না, ইংরেজী গল্প নয়, তিনি গোটাকতক জাপানী গল্প অনুবাদ করেন। তার মধ্যে দুটো গল্প। মৎসুয়ামার আয়না ও ইউরিশিমা ছাপা হয় পুণ্য পত্রিকায়। হয়ত এ অনুবাদে সুরেন্দ্রেরও হাত ছিল নয়ত প্রথমেই অমন সহজ স্বচ্ছ সাবলীল ভঙ্গিটি আয়ত্ত করা কঠিন। সংজ্ঞার অনুবাদকে তর্জমা বলে মনেই হয় না। জাপানী গল্প অনুবাদের এই দক্ষতা ছিল সুরেন্দ্রেরও। তিনি জাপানী ঐতিহাসিক গল্প একটি বসন্ত-প্রাতের প্রস্ফুটিত সকুরা-পুষ্প অনুবাদ করে উৎসর্গ করেন সংজ্ঞাকে। এ ব্যাপারে সংজ্ঞা একটু উৎসাহী হলে আরো কিছু জাপানী গল্পের অনুবাদ সেযুগেই আমাদের হাতে এসে পৌঁছত।

ঠাকুরবাড়ির অন্যান্য বৌয়েদের মতো সংজ্ঞাও ভাল অভিনয় করতে পারতেন। রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে চলে গেলেও অভিনয়ের জন্যে প্রায়ই ডাক পড়ত ঠাকুরবাড়ির মেয়ে-বৌয়েদের। অভিনয়ে তাদের দক্ষতা তপন কিংবদন্তী। শান্তিনিকেতনের শিল্পীগোষ্ঠী ভাল করে তৈরি হয়নি। কলকাতায় বিসর্জনের অভিনয় হবে। তোড়জোড় চলছে। কবির বয়স হার মানল তার উৎসাহের কাছে। তিনি নিজে সাজলেন জম্নসিংহ। অপর্ণার ভূমিকায় চমৎকার অভিনয় করলেন সংজ্ঞার এক মেয়ে মঞ্জু শ্রী! আর সংজ্ঞা নিজে সাজলেন গুণবতী। এ অভিনয় ঘরোয়া মঞ্চে বা জোড়াসাঁকোর উঠোনে সখের অভিনয় নয়। রীতিমতো টিকিট বিক্রী করে এম্পায়ার থিয়েটারে তিন দিন অভিনয় হয়। প্রত্যক্ষদর্শী সৌম্যেন্দ্রনাথের ভাষায় গুণবতীর ভূমিকায় আমার কাকী সংজ্ঞাদেবীর অভিনয় হয়েছিল অনবদ্য। কিন্তু যেমন সাহিত্যচর্চা, তেমনি অভিনয় দক্ষতা থাকলেও কোন কিছুতে মন ছিল না সংজ্ঞার। কোথায় যেন ছিল আশ্চর্য নিরাসক্তি। জ্ঞানদানন্দিনী অনুযোগ করতেন, সংজ্ঞা সাজে না। সুরেনের খাওয়া দেখে না। কিন্তু প্রশ্রয় ছিল সুরেন্দ্রের। তিনি সংজ্ঞাকে সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছেন নানান জায়গায় নিয়ে গেছেন ভগিনী নিবেদিতার কাছে।

প্রিয়নাথ শাস্ত্রীর আধ্যাত্মিক অধিকারী হয়েছিলেন সংজ্ঞা। সংসারের প্রতি আসক্তি কম। বড় ঘর বিপুল সংসার-শ্বশুর-শাশুড়ী স্বামী ছটি সন্তান নিয়ে ভরাভর্তি সুখ তবু আসক্তির বন্ধনটা যেন সংজ্ঞার জীবনে শিথিল হ৪ে আসে। মা ছাড়াও তার ছেলেমেয়েদের অন্য সঙ্গী ছিল, ছিলেন স্নেহময়ী জ্ঞানদানন্দিনী, এবং স্নেহময় জ্যোতিরিন্দ্রনাথ। তারপর আসে একটি পরমলগ্ন। ডায়মণ্ডহারবারে নদীর ঢেউ দেখতে দেখতে তিনি এক দিব্য অনুভূতি লাভ করলেন। এক উজ্জ্বল জ্যোতির্মণ্ডল যেন তাকে দিল এক পরম আনন্দময় চিন্ময় সত্তার সন্ধান। চির বৈরাগ্যের সুর এসে বাজল সংজ্ঞার মনে।

পরের ইতিহাস সংক্ষিপ্ত। স্বামীর মৃত্যুর পর সংজ্ঞা সংসার ত্যাগ করে চলে গেলেন চির বৈরাগী সাধুদের চরণচিহ্ন অনুসরণ করে। বাধা পাননি বিশেষ। বাঞ্ছিতের সন্ধানে যার যাত্রা শুরু, তাকে বাধা দেবে কে? এলাহাবাদে ঈপ্সিত গুরু সচ্চিদানন্দ সরস্বতীর কাছে দীক্ষা নিয়ে সন্ন্যাস গ্রহণ করলেন সংজ্ঞা। গৃহজীবনের শেষ বন্ধন নামটুকু জীর্ণ পাতার মতো খসে পড়ল তার জীবন থেকে। মুছে গেল ঠাকুরবাড়ির বৌটির পরিচয়। নতুন নাম হল স্বরূপানন্দ সরস্বতী। মুণ্ডিতমস্তক গৈরিকধারিণী সংজ্ঞা হরিদ্বারে পেলেন নতুন জীবন। কাশীতে দেখেছিলেন অসীমানন্দ সরস্বতীকে—তার প্রতিষ্ঠিত রামচন্দ্রপুরের আশ্রমেও থেকেছেন অনেকদিন। মাঝে মাঝে যেতেন তীর্থে। তার আধ্যাত্মিক জীবনের তীব্র ব্যাকুলতা প্রকাশ পেয়েছে এসময়ে লেখা কয়েকটি কবিতায়। কবিতাগুলি সংকলিত হয়েছে কৃপাকণা বইতে। সংজ্ঞার কবিতা পড়লে বোঝা যায় প্রাণের তীব্র ব্যাকুলতা তাঁকে কোথায় উপনীত করেছে। ছটি সন্তানের জননী হয়েও মাতৃত্বের আকাঙ্ক্ষা তার মেটেনি কারণ তিনি চেয়েছিলেন সকলের মা হয়ে উঠতে। অনুভূতি, পরপারের সুর, হৃদয়নাথ, আঁধারে, প্রেমবৃষ্টি, মা, আনন্দমিশন, বন্দনা সব কবিতাই আধ্যাত্মিক সুরে বাঁধা। সহজ-সরল প্রাণের আকূতি বলেই পূর্ণমা বোধহয় সবচেয়ে বেশি ভাল লাগে। কৃপাকণাএখন দুষ্প্রাপ্য তাই কবিতাটি সম্পূর্ণ আকারেই এখানে উদ্ধৃত করা হল। ছোট্ট কবিতা :

নারীর দেহে এ ভবেতে হে
লভিয়া জনম আজিকে আমি।
মাতৃত্ব যে কি তাহা তো জেনেছি,
এ দেহ স্বার্থক হয়েছে স্বামী।
রেখ না মোরে ক্ষুদ্র মা করে
ধরণীতে কর গো পরিচিত,
সবারি যে মা হব গো হেথা
সে রূপে হয়ে পূর্ণ বিকশিত।
কল্যাণকামী মঙ্গলকামী
মাতৃরূপিনী আমায় হেরি
ধরার অন্যা পুত্র ও কন্যা
চারিপাশে মোর দাঁড়াক ঘেরি।

সংজ্ঞার অবিরাম তীর্থভ্রমণ, সাধুসঙ্গ, আশ্রমবাস ও বাঞ্ছিতের সন্ধানে অন্বেষণ শেষ হয়েছে এই সেদিন, পার্থিব জীবনের পরিসমাপ্তিতে।

এবার বলেন্দ্রের স্ত্রী সাহানার কথায় আসি। মাত্র তেরো বছরে বিয়ে হয়েছিল তার এবং যোলো বছরেই সব সাধ আহ্লাদ ঘুচিয়ে বিধবার শুভ্র সাজে সাজতে হল তাকে। দিন বদলেছে। তাই সাহানার বাবা ভেবেছিলেন মেয়ের আবার বিয়ে দেবেন। কিন্তু বিধবা বিবাহে মহর্ষির ঘোর আপত্তি। সম্মতি ছিল না উদারচেতা ঠাকুরবাড়ির একজনেরও। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ লক্ষ্ণৌ গেলেন সাহানাকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে ফিরিয়ে আনতে। অথচ এর কয়েক বছর পরেই তিনি বিধবা বিবাহ সম্বন্ধে নিজের মত বদলান। সাহানার দুঃখ কোনদিনই ঘোচেনি। কবির সঙ্গেই শ্বশুরবাড়িতে ফিরে এলেন তিনি, মন দিলেন লেখাপড়ায়। স্কুলের পড়া শেষ করে পাড়ি দিলেন বিলেতে। ইচ্ছে ছিল হাতেকলমে কিছু ট্রেনিং নিয়ে আসা। এ সময় বাঙালী মেয়েদের অনেকেই বিলেত যাচ্ছেন। সরলাবালা-মিত্র সরকারী বৃত্তি নিয়ে কিংবা কুচবিহারের রাজকন্যা প্রতিভা ও সুধীর এবং লর্ড সিন্হার মেয়ে রমলা নিছক বেড়াবার উদ্দেশ্যে বিলেত পাড়ি দিচ্ছেন। সাহানাও গিয়েছিলেন। কোথাও কোন আলোড়ন না তুলে তিনি। আবার কিছুদিন পরেই দুর্বল স্বাস্থ্য নিয়ে ফিরে আসেন। অল্প কিছুদিন পরে মারা যান। সাহানার কথা ঠাকুরবাড়ির কেউ কোনদিন ভাবেননি, এমনকি রবীন্দ্রনাথও নয়। একথা ভাবলে সত্যি কষ্ট হয়। মনে হয় সকলের নিষ্ঠুর ঔদাস্যে সায়াহ্নের সকরুণ সাহানা হারিয়ে গেলেন অকালে।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত