| 29 মার্চ 2024
Categories
ধারাবাহিক সাহিত্য

ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহল (পর্ব-২)

আনুমানিক পঠনকাল: 19 মিনিট

যোগমায়ার সঙ্গে যোগাযোগ ছিন্ন হওয়ায় মহর্ষির ছেলেমেয়েরা খুব দুঃখ পেয়েছিলেন। বড় মেয়ে সৌদামিনীর দুঃখই যেন বেশি। তিনি স্বামী পুত্র কন্যা নিয়ে জোড়া কোর বাড়িতেই জীবন কাটিয়েছেন। কাকীমা ছিলেন তার সুখ-দুঃখের সঙ্গিনী। এবার মহর্ষিপরিবারের সব ভার পড়ল একা সৌদামিনীর ওপর। বাংলা দেশে স্ত্রীশিক্ষা প্রসারের একেবারে গোড়ার দিকে সৌদামিনী একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন যদিও এর জন্যে তাঁর নিজের কৃতিত্ব খুব বেশি ছিল না।

আগেই বলেছি, ঠাকুরবাড়ি এবং আরও পাঁচটা সম্ভ্রান্ত পরিবারে মেয়েদের লেখাপড়া শেখানো হত। গ্রামাঞ্চলে সে সুযোগ ছিল না। দু-একজন দুঃসাহসিকা ছাড়া কেউ সাহস করে পুঁথিপত্র নিয়ে বসতে পারত নাকি? মনে তো হয় না। সুদূর পল্লী গ্রামের গৃহবধূ রাসসুন্দরী একটু-আধটু লেখাপড়া শিখেছিলেন। তিনি ঠাকুরবাড়ির কেউ নন, এমনকি এই পরিবারের সংস্পর্শেও আসেননি তবু বাঙালী মেয়েদের মধ্যে তিনিই লিখেছিলেন প্রথম আত্মজীবনী। এই প্রথম নিজের কথা লেখার মতো বিশেষ ঘটনাটি আমরা ঠাকুরবাড়িরই কোন মহিলার কাছে আশা করেছিলুম। যাইহোক, রাসসুন্দরীর পক্ষে লেখাপড়া শেখা সহজ ছিল না, ঘরের দরজা বন্ধ করে শিখতে হত। না হলে শোনা যেত বৃদ্ধদের খেদোক্তি, বুঝি কলিকাল উপস্থিত হইয়াছে দেখিতে পাই। এখন বুঝি মেয়েছেলেতে পুরুষের কাজ করিবেক। এতকাল ইহা ছিল না। একালে হইয়াছে। এখন মাগের নামডাক। মিনসে জড়ভরত। এই তিক্ত মন্তব্য শুনতে শুনতে রাসসুন্দরীর মনে হত, যেন বিদ্যার আর কোন গুণ নাই, বিদ্যায় কেবল টাকা উপার্জন হয়। রাসসুন্দরীর মতো লুকিয়ে লুকিয়ে পড়তে হয়েছে সত্যেন্দ্রনাথের স্ত্রী জ্ঞানদানন্দিনীর মাকেও। তিনি রাত্রিবেলা দরজা বন্ধ করে হিসেব কিতেব চিঠিপত্র লিখতেন। শিবনাথ শাস্ত্রীর মা গোলকমণি দেবীও নানা উপায়ে লেখাপড়া শিখেছিলেন। পাবনার প্রমথ চৌধুরীর দিদি প্রসন্নময়ী তো ছোটবেলায় বালকবেশে কাছারি বাড়িতে সরকারের কাছে পড়তে যেতেন। তার পিসীদের মধ্যে তিনজন ভগবতী, কৃষ্ণসুন্দরী ও মৃন্ময়ী বেশ লিখতে পড়তে পারতেন কিন্তু ছোট পিসী বালবিধবা কাশীশ্বরী ছিলেন পণ্ডিত মহিলা। ছোট ছেলেমেয়েরা তার কাছে লেখাপড়া শিখতে যেত। প্রসন্নময়ী লিখেছেন, কাশীশ্বরী তীর্থ ভ্রমণ করিয়া হঠি তর্কালঙ্কার সাজিয়া মুণ্ডিত মস্তকে গ্রামে ফিরিয়া আসিয়া এক পাঠশালা খুলিয়া বসিলেন। এ প্রসঙ্গে হটি বিদ্যালঙ্কার, হটু বিদ্যালঙ্কার কিংবা চণ্ডীচরণ তর্কালঙ্কারের মেয়ে দেবময়ীর কথাও স্মরণীয়। কিন্তু এদের ব্যতিক্রম হিসেবেই ধরা হত। বেশির ভাগ মেয়েই লেখাপড়ার সুযোগ পেতেন না।

তুলনামূলকভাবে কলকাতার অবস্থা বেশ ভাল। সেখানে পালা করে বৈষ্ণবী এসে লেখাপড়া শেখাত। কিছুদিন পরে বৈষ্ণবীর স্থান গ্রহণ করে ইংরেজ গৃহশিক্ষিকারা। রাজা নবকৃষ্ণ, রাধাকান্ত দেববাহাদুর, ব্রহ্মানন্দ কেশবচন্দ্র সেন, প্রসন্নকুমার ঠাকুর, রাজা বৈদ্যনাথ রায় নিজেদের অন্তঃপুরে লেখাপড়া শেখাবার ব্যবস্থা করেছিলেন। তবে সে শিক্ষা নিভৃতে, অন্তরালে। প্রসন্নকুমারের মেয়ে হরসুন্দরী ও পুত্রবধূ বালাসুন্দরী নানা বিদ্যায় পারদর্শিনী হয়ে ওঠেন। অকালমৃত্যু না হলে হয়ত জ্ঞানেন্দ্রমোহন ঠাকুরের স্ত্রী বালাসুন্দরীই বাংলা দেশে স্ত্রী-স্বাধীনতার সূচনা করে যেতেন। বৈদ্যনাথ রায়ের স্ত্রীকে পড়াতে সেন্ট্রাল ফিমেল স্কুলের মিসেস উইলসন। ঠাকুরবাড়িতেও বিদেশিনী শিক্ষয়িত্ৰী মিস গোমিস এসেছিলেন, কিন্তু বাড়ির মধ্যে এ ধরনের শিক্ষয়িত্ৰী রাখার মধ্যে বিশেষ সাহসের কিছু ছিল না।

এ সময় তোড়জোড় চলছিল মেয়েদের জন্যে একটা ভাল স্কুল খোলার। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ছাড়াও এ ব্যাপারে উৎসাহ ছিল রাজা দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়, রামগোপাল ঘোষ, মদনমোহন তর্কালংকার, ও আরো অনেকের। তাঁরা মেয়েদের জন্য স্কুল খোলার পক্ষপাতী ছিলেন। বাধা এসেছিল প্রচণ্ডভাবে। এই গেল গেল রবের মধ্যেই স্থাপিত হয়েছিল বেথুন স্কুল। অবশ্য প্রথমে স্কুলের নাম ছিল হিন্দু ফিমেল স্কুল। দেশীয় পণ্ডিতদের সাহায্যে স্কুলটি স্থাপন করেন ভারতহিতৈষী জন এলিয়ট ড্রিঙ্কওয়াটার বীটন। স্কুলটি প্রথমে খোলা হয়েছিল রাজা দক্ষিণারঞ্জনের সুখিয়া টীটের বাড়ির বৈঠকখানায়। এই স্কুলেই পড়তে এসেছিলেন পাঁচ বছরের ছোট্ট মেয়ে সৌদামিনী। সেটা ১৮৫১ সাল। তার দু বছর আগে ১৮৪৯ সালের সাতই মে হিন্দু ফিমেল স্কুল প্রতিষ্ঠা হয়েছে। খুব স্বাভাবিক ভাবেই আমরা আশা করতে পারি ঠাকুরবাড়ির কোন মেয়ে তার প্রথম ছাত্রী হবেন। তা কিন্তু হয়নি। এই স্কুলের প্রথম দুটি ছাত্রী মদনমোহন তর্কালংকারের দুই মেয়ে কুন্দমাল ও ভুবনমালা। মেয়েদের স্কুলে পাঠাবার জন্যে তাঁকে নিজের গ্রামে সমাজচ্যুত হতে হয়। ঐ দুজনের সঙ্গে আরো উনিশটি মেয়ে স্কুলে ভর্তি হন।

কিন্তু সামাজিক ঝড় উঠতে দেরি হল না। এসব ঝড় তোলে খবরের কাগজেরা। সমাচার চন্দ্রিকা নানারকম ওজর আপত্তি তুলেছিল। সরলমতি বালিকাদের স্কুলে পাঠানো উচিত নয়, তাতে ব্যভিচার সংঘটনের শংকা আছে। কামাতুর পুরুষেরা সুযোগ পেলেই তাহাদিগকে বলাৎকার করিবে, অল্পবয়স্ক বলিয়া ছাড়িয়া দিবে না, কারণ খাদ্যখাদক সম্বন্ধ। অথচ হিন্দু ফিমেল স্কুলের গেও মেয়েদের স্কুল ছিল। ১৮১৯ সালের মে-জুন নাগাদ খোলা হয় জুভেনাইল স্কুল। প্রথমে ছাত্রী ছিল আটটি, পরে দাঁড়ায় বত্রিশটিতে! পরে ভিজ সোসাইটি অনেক কাজ করে। ১৮২১-এ মেরী এ্যান কুক কলকাতায় এসে কতকগুলো অবৈতনিক স্কুল খোলেন। একবছরের মধ্যেই তিনশো মেয়ে লেখাপড়া শুরু করে। ১৮৭২-এ এই সংখ্যা দাঁড়ায় ছশোতে। শ্রীরামপুর, ঢাকা, বীরভূম, চট্টগ্রামেও মেয়েদের স্কুল খোলা হল। ১৮৪৭ সালে প্রথম হিন্দু ছাত্রীদের জন্যে খোলা হয় একটি স্কুল, কলকাতার কাছেই বারাসতে। তবু নতুন স্কুলটি নিয়ে যথেষ্ট হৈ চৈ হল। এমন কথাও লেখা হল যে, যারা ঐ স্কুলে মেয়েদের পড়তে পাঠাচ্ছেন তাঁরা মান্য ও পবিত্র হিন্দু কুলোদ্ভব নাও হতে পারেন। দেখতে দেখতে বেথুনের ছাত্রী সংখ্যা কমে গিয়ে দাঁড়াল সাতটিতে। বিপক্ষদলও চুপ করে ছিলেন না এমনকি সংবাদ প্রভাকর পর্যন্ত এসব উক্তির প্রতিবাদ জানাল। কে মান্য আর কে মান্য নন সে নিয়েও তর্ক চলতে লাগল, তবু কাগজের তর্কাতর্কি এক জিনিষ আর বাস্তবে ঘটে আর এক জিনিষ। ধনীমানী সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিরা ইতস্ততঃ করতে লাগলেন। দু-একটা উদাহরণের প্রয়োজন হলে ডাক পড়ল সৌদামিনীর। পাঁচ বছরের সুন্দর ফুটফুটে মেয়েটি পেশোয়াজ পরে খুড়তুত বোন কুমুদিনীর সঙ্গে স্কুলে যাবার জন্যে তৈরি হল। দেবেন্দ্রনাথ সৌদামিনীকে স্কুলে পাঠালেন শুধু দৃষ্টান্ত দেখাবার জন্যে। তিনি জানতেন তার দেখাদেখি আরো অনেকে নিজের মেয়েদের স্কুলে পাঠাবেন। তার অনুমানে ভুল হয়নি। ১৮৫১ সালের জুলাই মাসে সৌদামিনী স্কুলে ভতি হলেন বাঙালী মেয়েদের পড়াশোনার পথ সহজ করে দেবার জন্য। বিপত্তি? হ্যাঁ, তাকে নিয়েও বিপদ হয়েছিল বৈকি। তার ধবধবে ফর্সা শ্বেত পাথরের মতো গায়ের রঙ দেখে একবার পুলিশ এসে ধরেছিল চুরি-করা ইংরেজ মেয়ে ভেবে।

সৌদামিনীর লেখাপড়া ঠিক কতটা এগিয়েছিল জানা যায়নি। মহর্ষি পরিবারে তিনি ছিলেন গৃহরক্ষিতা অর্থাৎ গৃহের রক্ষয়িত্ৰী। সমস্ত কিছু দেখাশোনা করে তার হাতে সময় থাকত কম। শুধু কি দেখাশোনা? বোনেরা কোথাও যাবে, তাদের নিখুত করে চুল বেঁধে দিতে হবে। বাড়িতে কোন উৎসব হবে, সুন্দর করে ফুল কেটে আলপনা দিতে হবে। সব দিকে মহর্ষির সতর্ক দৃষ্টি। তাই বিশাল পরিবারের আদর্শ গৃহিণী হয়ে সৌদামিনী অন্যদিকে নজর দিতে পারতেন না। তার নিজের লেখা বলতে দু-একটি ব্ৰহ্মসঙ্গীত আর একটি মাত্র স্মৃতিকথা পিতৃস্মৃতি ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যায়নি। তোমারে পূজিব অকিঞ্চন গানটি হয়ত অনেকেই শুনেছেন। পিতৃস্মৃতিও দুষ্প্রাপ্য নয়। পড়ে মনে হয়, ইচ্ছে করলে সৌদামিনী আরও অনেক কিছুই দিতে পারতেন কিন্তু দিয়েছেন শুধুমাত্র কয়েকটি সেকেলে ছবির টুকরো। বেথুনে পড়ার কথাই যারা যাক না। সৌদামিনী লিখেছেন :

কলকাতায় মেয়েদের জন্য যখন বেথুন স্কুল প্রথম স্থাপিত হয় তখন ছাত্রী। পাওয়া কঠিন হইল। তখন পিতৃদেব আমাকে এবং আমার খুড়তুত ভগিনীকে সেখানে পাঠাইয়া দেন। হরদেব চাটুজ্জ্যেমশায় আমার পিতার বড় অনুগত ছিলেন, তিনিও তাহার দুই মেয়েকে সেখানে নিযুক্ত করিলেন। ইহা ছাড়া মদনমোহন তর্কালংকার মহাশয় ও তাঁহার কয়েকটি মেয়েকে বেথুন স্কুলে পড়িতে পাঠাইয়া দেন। এইরূপে অল্প কয়েকটি মাত্র ছাত্রী লইয়া বেথুন স্কুলের কাজ। আরম্ভ হয়।

এ যেন শুধুই খবর। তফাৎ এই যে, এ কথা তৃতীয় ব্যক্তির রিপোর্ট না হয়ে বেথুনের একেবারে প্রথম দিকের একটি ছাত্রীর লেখা নিজের কথা। অথচ সৌদামিনী কত খবরই না দিতে পারতেন। বেথুনে-পড়া মেয়েদের নিয়ে তো কম ছড়া আর প্রহসন লেখা হয়নি। বলাবাহুল্য সৌদামিনীকেও কতকটা বিরুদ্ধ আবহাওয়ার মধ্যে দিয়েই এগোতে হয়েছে। যেমন হায়-হায় করে উঠলেন গুপ্ত কবি যত ছুড়িগুলো তুড়ি মেরে কেতাব হাতে নিচ্ছে যবে। তখন এ. বি. শিখে বিবি সেজে বিলাতি বোল কবেই কবে। যদিও ঈশ্বর গুপ্ত স্ত্রীশিক্ষা বিরোধী ছিলেন না বরং উৎসাহীই ছিলেন বলা চলে। লেখা শুরু হল বেথুনে-পড়া। অতএব বিপথগামিনীদের নিয়ে নানারকম প্রহসন—স্বাধীন জেনানা, বৌবাবু, পাশ করা মাগ, শিক্ষিত বউ, মাগ-মুখো ছেলে, শ্ৰীযুক্তা বৌবিবি, পাশ-করা আদুরে বৌ, কলির মেয়ে ও নব্যবাবু, বরবদল, পণ্ডিত মেয়ে, ফচকে ছুঁড়ির কীর্তিকাণ্ড, হুড়কো বৌ-এর বিষমজ্বালা, কলির বৌ হাড়-জ্বালানী, মাগসর্বস্ব, বেহদ্দ বেহায়া, মেয়েছেলের লেখাপড়া আপনা হতে ডুবে মরা—নামের শেষ আছে! বিষয়বস্তু সবারই এক, বক্তব্যও একটাই, গেল গেল সব গেল। সব লেখা হয়েছে পঞ্চাশ বছর পরে। এমন কি বিশশতকের গোড়ার দিকেও। সৌদামিনী যে এই জাতীয় সামাজিক বাদানুবাদের খবর রাখতেন না তা নয়। তাঁর লেখা থেকেই জানতে পারি জোড়াসকোয় মহর্ষিভবনের কম্পাউণ্ডের ওপারেই ছিল দেবেন্দ্রনাথের পিসতুত ভাই চন্দ্রবাবুর বাড়ি। ঠাকুরবাড়ির মেয়েরা খোলা ছাদে ঘুরে বেড়াচ্ছে দেখে তিনি একদিন এসে বললেন, দেখ দেবেন্দ্র, তোমার বাড়ির মেয়েরা বাহিরে, খোলা ছাতে বেড়ার আমরা দেখতে পাই, আমাদের লজ্জা করে। তুমি শাসন করিয়া দাও না কেন? সৌদামিনী জানিয়েছেন, আমাদের বাড়িতে যখন দুর্গোৎসব ছিল ছেলেরা বিজয়ার দিনে নৃতন পোশাক পরিয়া প্রতিমার সঙ্গে সঙ্গে চলিত—আমরা মেয়ের। সেইদিন তেতলার ছাদে উঠিয়া প্রতিমা বিসর্জন দেখিতাম, তখন বংসরের মধ্যে সেই একদিন আমরা তেতলার ছাদে উঠিবার স্বাধীনতা পাইতাম। উদারপন্থী দেবেন্দ্রনাথ এর মধ্যে কোন দোষ দেখতে পাননি, তার চেয়েও বড় কথা তিনি বুঝেছিলেন দিন-বদলের পালা শুরু হয়েছে। তাই হেসে বলেছেন, আমি আর কিসের বাধা দিব। যাহার রাজ্য তিনিই সমস্ত ঠিক করিয়া লইবেন।

তবে সৌদামিনীর পিতৃস্মৃতি পড়ে দেবেন্দ্রনাথকে নব্যপন্থী ভাবলে ভুল করা হবে। যতক্ষণ না ছেলেমেয়েরা মন্দের দিকে যাচ্ছে ততক্ষণ কিছু বলতেন না। হিন্দু সমাজের বহু সংস্কার তিনি ব্রাহ্ম হয়ে ও নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেছেন। বিধবা বিবাহ, অসবর্ণ বিবাহ, মেয়েদের অবাধ স্বাধীনতা কোনটাই তার সমর্থন পায়নি। আবার পারিবারিক প্রথা বা স্ত্রী-আচরাকে নির্মূল করার জন্যেও তার কোন আগ্রহ ছিল না। কারণ তিনি জানতেন, এই সব তুচ্ছ প্রথা আর আচারের তলা দিয়ে বয়ে চলেছে বাঙালীর নিজস্ব প্রাণধারা, ওপর থেকে টান দিলে তার মূল যাবে ছিঁড়ে, রস যাবে শুকিয়ে। তখনকার পরিস্থিতিতে স্থির মস্তিষ্কে এই ধরনের চিন্তা করে দুটো বিপরীতমুখী স্রোতের মধ্যে দিয়ে সংসার তরণীখানিকে পার করে নিয়ে যাওয়াই ছিল অসাধারণ কৃতিত্বের কথা। সুখের বিষয়, দেবেন্দ্রজীবনের অনেক অন্তরঙ্গ ছবিই আমরা সৌদামিনীর প্রবন্ধ থেকে পেতে পারি। যেমন পিতৃঋণ শোধ করার পরে দেবেন্দ্রনাথ সামান্যতম ঋণকেও ভয় করতেন। সৌদামিনী তাঁর পিতৃস্মৃতিতে লিখেছেন :

তিনি সামান্য পরিমাণ দেনাকেও অত্যন্ত ভয় করিতেন। তাঁহার ছেলের কেহ ঋণ করিয়া তাহাকে সাহায্যের জন্য ধরিলে তিনি বলিতেন, আমি কি চিরদিন কেবল ঋণ শোধই করিব? মহর্ষির ব্যয় সংকোচের কথাও আছে, তিনি একবারে চারি আনা মূল্যের অধিক সামগ্রী আহার করিতেন না। যাহার পিতার ডিনার তিন শত টাকার কমে হইত না। তিনি চারি আনা মূল্যের ডিনার খাইয়া তৃপ্ত হইতেন।…সমস্ত গাড়িঘোড়া বিক্রয় করিয়া ফেলিলেন, কেবল বাটির মহিলাদিগের যাতায়াতের জন্ঠ একটিমাত্র পালকি রাখিলেন। সৌদামিনী না জানালে এর অনেক কথাই জানা যেত না কোনদিন।

সৌদামিনীর ছোট বোনেদের মধ্যে সুকুমারী অল্প বয়সে মারা গিয়েছিলেন। কিন্তু তিনিও তার দিদির মতো একটি ঐতিহাসিক ঘটনার সঙ্গে নিজে কোন ভূমিকা না নিয়েও জড়িয়ে পড়েছেন। দেবেন্দ্রনাথ সুকুমারীর বিয়ে দিয়েছিলেন ব্রাহ্মধর্ম অনুসারে অর্থাৎ বিবাহ অনুষ্ঠানে শালগ্রাম শিলা বর্জন করে। তখনও ব্রাহ্মবিবাহ আইন প্রচলিত হয়নি। সুকুমারীর বিয়েই প্রথম ব্রাহ্মবিবাহ। এই বিয়ে হয় ১৮৬১ সালের ২৬শে জুলাই। তার আগে ব্রাহ্মদের গার্হস্থ্য জীবনের কোন কাজে স্বতন্ত্র অনুষ্ঠান পদ্ধতি প্রস্তুত করা হত না। এই বিয়ে নিয়ে প্রচণ্ড আলোড়ন শুরু হয়। অনেকে এ বিয়েকে অসিদ্ধ বলে মনে করতেন। এভাবে মেয়ের বিয়ে দেওয়া এবং হিন্দুমতে পিতৃশ্রাদ্ধ না করায় দেবেন্দ্রনাথ তার আত্মীয়-পরিজনদের কাছ থেকে আরোই দূরে সরে গেলেন।

সৌদামিনী-সুকুমারীর বোন স্বর্ণকুমারী বাংলাসাহিত্যে প্রথম সার্থক লেখিকা। অবশ্য স্বর্ণকুমারীর আরো একজন দিদি ছিলেন শরৎকুমারী নামে। তিনি রান্নাঘর এবং রূপচর্চাকেই প্রাধান্য দিয়েছিলেন। স্বর্ণকুমারীর ছোট বোন শম রীও দু-একটি ক্ষেত্রে অভিনয় করা ছাড়া বিশেষ কিছুই করেননি। কিন্তু স্বর্ণকুমারী যেন সব দিক থেকে এক বিরল ব্যতিক্রম। তার সোনলি ছটায় Fরবাড়ির অন্দরমহল আলোকিত। স্বর্ণকুমারীর সাফল্য ও কৃতিত্বের সঙ্গে ওতপ্রাতভাবে জড়িয়ে আছেন আরো একজন মহিলা, তিনি ঠাকুরবাড়ির মেজো বৌ জ্ঞানদানন্দিনী। যদিও তিনি এ বাড়ির মেয়ে নন, বিবাহসূত্রে এসে পড়েছেন ঠাকুরবাড়ির অঙ্গনে। কিন্তু ঠাকুরবাড়ির কৃতিত্ব ও ঐতিহ্য থেকে তাঁকে আলাদা করে দেখবে কে? এখানকার শিক্ষাদীক্ষা চিন্তাভাবনা সব কিছুর সঙ্গেই যে তিনি জড়িয়ে-মিশিয়ে আছেন। সত্যি কথা বলতে কি, জ্ঞানদা নন্দিনীই তো সবার আগে সবরকম বাধা-নিষেধের বেড়া টপকে বৃহত্তর জগতে এসে মেয়েদের মুক্তির পথ খুলে দিয়েছেন। তারপর পর্দা আর আবরু ঘোচাতে মেয়েদের বিশেষ বেগ পেতে হয়নি। তাই স্বর্ণকুমারীর সঙ্গে, বা বলা যায় তার আগেই জ্ঞানদানন্দিনীর প্রসঙ্গ সেরে নেওয়া যেতে পারে। তবে এঁদের কাউকেই আলাদা করে দেখা যায় না কারণ এরা এসেছেন একই সময়ে, একই সঙ্গে এবং একই পরিবারের সদস্য হয়ে।

জ্ঞানদানন্দিনী মহর্ষি পরিবারের মেজো বৌ। স্বাভাবিকভাবেই বড় বৌয়ের কথা মনে পড়বে। দার্শনিক দ্বিজেন্দ্রনাথের স্ত্রী সর্বসুন্দরীর ভূমিকা ঠাকুরবাড়িতে খুব স্পষ্ট হয়ে উঠতে পারেনি। এক-একজনের লেখায় তিনি হঠাৎ-হঠাৎ উঁকি মেরে গেছেন চওড়া লাল-পেড়ে শাড়ির পাড় থেকে। ঘোমটার সীমানা বুঝি চিবুক ছাড়িয়ে উঠত না তাই তার ছোটখাট দেহটি একেবারে মিশে গেছে অন্দরমহলের থামের আড়ালে। তার স্বল্পায়ু জীবনের অধিকাংশই তো কেটেছে। পরের সেবায়। শাশুড়ী-ননদ-জা আত্মীয়স্বজন সবাইকে আপন করে নিতে নিতে এবং ছেলেমেয়েদের দেখাশোনা করতে করতে তিনি হারিয়ে গিয়েছিলেন বিরাট পরিবারের অসংখ্য মানুষের মধ্যে। সেকালে তো মেয়েদের জীবন এমনি করেই কাটত। কিন্তু জ্ঞানদানন্দিনী হারিয়ে ফুরিয়ে যাবার মতো মেয়ে ছিলেন না। তীক্ষ্ণ জেদী একরোখা মেজাজ ও অদম্য প্রাণ প্রাচুর্য নিয়ে তিনি মেয়েদের অগ্রগতির অনেকটা পথই খুলে দিয়েছিলেন। সব কাজে সহায় ছিলেন তাঁর স্বামী, প্রথম ভারতীয় আই. সি. এস. অফিসার সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর।

জ্ঞানদানন্দিনীর বাবা গৌরীদান করেছিলেন সাত বছরের মেয়েকে। তখন তার অক্ষর-পরিচয় সবে শুরু হয়েছে গ্রামের পাঠশালাতে। তারপর সবার যা হয় তাই হল। পুতুলখেলার ঘর সাজাতে সাজাতে নিজেই একদিন মোমের পুতুলটি সেজে ঢুকে পড়লেন রাজবাড়ির মতো সদর-অন্দর-দেউড়ি-দালানওলা বিরাট বিশাল ঠাকুরবাড়িতে। পায়ে গুজরি-পঞ্চম, মাথায় এক গলা ঘোমটা। সেই ঘোমটাখানি হয়ত দুহাতে সন্তর্পণে তুলে ধরে ভীত-চকিত হরিণীর দুটি কাজলটানা ব্যাকুল চোখ বারবার পথ খুঁজেছিল পিছন ফিরে চাওয়ার। বলাবাহুল্য পায়নি। ঠাকুরবাড়ির কোন্ বৌ তার পূর্ব জীবনের সংস্কার মনে রাখতে পেরেছে? কিন্তু এগিয়ে যাবার জন্যে নতুন পথ খুঁজে পেয়েছিলেন জ্ঞানদানন্দিনী। সে একটা ইতিহাস!

শুধু প্রথম ভারতীয় সিভিলিয়ান অফিসার নয়, বাংলার স্ত্রী-স্বাধীনতার পথিকৃৎ সত্যেন্দ্রনাথ তার লজ্জাবতী বালিকাবধূটিকে সব বিষয়ে ভারতীয় নারীর আদর্শ করে তুলতে চেয়েছিলেন। বিলেতে গিয়ে তিনি দেখলেন স্বাধীনচেতা বিদেশিনীদের। ঘরে-বাইরে তাদের অবাধ বিহার—স্বচ্ছন্দ, সুন্দর, সাবলীল। কই কোথাও তো ছন্দপতন ঘটছে না। সব গেল সব গেল রব তুলে রসাতলে যাচ্ছে না বিলিতি সমাজ। তাহলে? যে মেয়েরা জীবন-উদ্যানের পুষ্প তাদের আলো-বাতাস থেকে বঞ্চিত করে ঘরের মধ্যে শুকিয়ে মারলে কি মঙ্গলের সম্ভাবনা?

সত্যেন্দ্র স্বপ্ন দেখতে শুরু করলেন। তিনি অন্তঃপুরের ঝরকা ভেঙে ফেলছেন, তার স্ত্রী এসেছেন কালাপানি পাড়ি দিয়ে বিলেতে। মন জাগবার আগেই মনের মানুষ বলে তার পরম আদরের জ্ঞেনুমণি যাকে বরণ করে নিয়েছেন, জগৎসভায় স্বয়ম্বরা হয়ে সকলের মধ্যে বেছে নিয়ে তাকেই আবার পরিয়ে দিচ্ছেন প্রেম-পারিজাতের বরণমালা। শুরু হল স্ত্রীকে গড়ে তোলার সাধনা। লেখা চলল চিঠির পর চিঠি।

তোমার মনে কি লাগে না আমাদের স্ত্রীলোকেরা এত অল্প বয়সে বিবাহ করে যখন বিবাহ কি তাহারা জানে না, ও আপনার মনে স্বাধীনভাবে বিবাহ করিতে পারে না। তোমার বিবাহ তো তোমার হয় নাই, তাহাকে কন্যাদান বলে। তোমার পিতা কেবল তোমাকে দান করিয়াছেন। সাগর পার থেকে আসা চিঠি জ্ঞানদানন্দিনীর কানে কানে শোনায় নতুন খবর :

আমরা স্বাধীনতাপূর্বক বিবাহ করিতে পারি নাই। আমাদের পিতামাতারা বিবাহ দিয়াছিলেন। জ্ঞানদানন্দিনীর বুক কাঁপে, কি বলতে চায় চিঠি, তুমি যে পর্যন্ত বয়স্ক, শিক্ষিত ও সকল বিষয়ে উন্নত না হইবে, সে পর্যন্ত আমরা স্বামী-স্ত্রী সম্বন্ধে প্রবেশ করিব না। এসব চিঠির উত্তরে জ্ঞানদানন্দিনী কি লিখতেন কে জানে? তার লেখা একটি চিঠিও পাওয়া যায়নি। সত্যেন্দ্রর চিঠিতে অন্তরঙ্গ সম্বোধন থাকলেও তার ভাষা কেতাবী ধরনের সাধুভাষা, হয়ত সে সময় দাম্পত্য পত্রালাপের ভাষাও সাধুভাষাই ছিল। হেমেন্দ্রনাথকেও সাধুভাষা ব্যবহার করতে দেখা গেছে, তবে রবীন্দ্রনাথ চিঠি লিখতেন মুখের ভাষায়। এক একটি চিঠিতে ঝরে পড়ত সত্যেরে মনের কথা :

এখানে জনসমাজে যাহা কিছু সৌভাগ্য, যাহা কিছু উন্নতি, যাহা কিছু সাধু সুন্দর, প্রশংসনীয়—স্ত্রীলোকদের সৌভাগ্যই তাহার মূল।…আমার ইচ্ছা তুমি আমাদের স্ত্রীলোকের দৃষ্টান্তস্বরূপ হইবে কিন্তু তোমার আপনার উপরই তাহার অনেক নির্ভর।

অবশ্য সত্যেন্দ্রর স্বপ্ন সফল হল না সেবারে। দেবেন্দ্রনাথ তাঁর প্রস্তাব সরাসরি নাকচ করে দিলেন। সব ইচ্ছে কি পূর্ণ হয়? বাড়ির বৌ রইলেন বাড়ির মধ্যেই। তাঁর পড়াশোনা নতুন করে শুরু হল সেজ দেওর হেমেন্দ্রনাথের কাছে। বাড়ির অন্য মেয়ে-সৌদের সঙ্গে লজ্জায় জড়সড় হয়ে ঘোমটা টেনে বসতেন জ্ঞানদানন্দিনী, হেমেন্দ্রর এক একটা ধমকে চমকে চমকে উঠতেন। এমনি করেই তার পড়া এগোল মাইকেলের মেঘনাদবধ কাব্য পর্যন্ত।

ইতিমধ্যে দেবেন্দ্রনাথ আর একটি উল্লেখযোগ্য কাজ করে ফেললেন। মেয়েদের শিক্ষা ঠিকমতো এগোচ্ছে না দেখে তিনি তাদের পড়াবার জন্যে ব্রাহ্মসমাজের নবীন আচার্য অযোধ্যানাথ পাকড়াশীকে গৃহশিক্ষক হিসাবে নিয়োগ করেন। সেই প্রথম একজন অনাত্মীয় পুরুষ ঠাকুরবাড়ির অন্তঃপুরে প্রবেশ করলেন। তিনি বাড়ির ছোট ছোট মেয়ে এবং বৌয়েদের স্কুলপাঠ্য বইলি বেশ যত্ন করে পড়াতেন। এসময় কেশবচন্দ্র সেন কিছুদিন সপরিবারে ঠাকুরবাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। এভাবে মেয়েদের লেখাপড়া শেখানোর পদ্ধতিটি তার খুব ভাল লেগেছিল।

জ্ঞানদানন্দিনীর সাধনার নেপথ্য ইতিহাসটি খুব পরিষ্কার নয়। সবাই জানি, তিনি স্বামীর স্বপ্নকে সফল করেছিলেন। কিন্তু কী সেই স্বপ্ন? মেয়েরা পুরুষের পাশে এসে দাঁড়াবেন শিক্ষায় যোগ্যতায় সমমর্যাদা নিয়ে, এই তো। আজকের দিনে এর গুরুত্ব অনুভব করাও শক্ত। কারণ জ্ঞানদানন্দিনী যা করেছেন তা এমনিতে হয়ত খুব কষ্টকর নয় কিন্তু প্রথম কাজ হিসাবে অসম্ভব রকমের কঠিন। আজ যখন শুনি, তিনি প্রথম বাঙালিনী, যিনি বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলেন তখন সবটাই হাস্যকর বলে মনে হয়। কী এমন শক্ত কাজ? সাহসেরই বা দরকার। কী? এ নিয়ে এত হৈচৈ করারই বা কী আছে? তবু হৈচৈ হয়েছিল।

সত্যেন্দ্রনাথ বিলেত থেকে ফিরলেন। তাঁর কর্মস্থল ঠিক হল মহারাষ্ট্র। এখন, সে যুগের নিয়ম ছিল ছেলেরা চাকরি করতে বাইরে যেত, ছেলের বৌ থাকত শ্বশুরবাড়িতে। সত্যেন্দ্র স্ত্রীকে কর্মস্থলে নিয়ে যাবার জন্যে অনুমতি চাইলেন। তিনি থাকবেন প্রবাসে, আর চার দেয়ালের অন্ধকূপে বন্দিনী হয়ে থাকবেন জ্ঞানদানন্দিনী? তাও কি হয়? অনেক দুঃখ পেয়েছেন তিনি। প্রগতিবাদী ছেলের বদলে তাকেই সহ করতে হয়েছে সমস্ত পারিবারিক অবাঞ্ছিত পরিস্থিতিকে। জ্ঞানদানন্দিনীকে লেখা সত্যেরে দু-একটা চিঠি থেকে আভাস পাওয়া যায় যে তার মায়ের সঙ্গে জ্ঞানদানন্দিনীর সম্পর্ক মাঝে মাঝে তিক্ত হয়ে উঠত। মহর্ষি-পত্নী তার মেজ বৌমাটির সঙ্গে কথাও বন্ধ করে দিতেন। সত্যেন্দ্রনাথের মেয়ে ইন্দিরার অপ্রকাশিত আত্মকথার পাণ্ডুলিপি শ্রুতি ও স্মৃতিতে দেখা যাবে সত্যেন্দ্র বিলেত গিয়েছেন বলে তার মা মেজ বৌয়ের গয়না দিয়ে তাঁর নিজের দুই মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন। এই গয়না নেওয়ার প্রকৃত কারণ যাই হক না কেন, মনে হয় অর্থাভাব নয়, কারণ পরে মহর্ষি এ কথা শুনে খুন রাগ করেন ও জ্ঞানদানন্দিনীকে একটি হীরের কন্ঠি গড়িয়ে দেন। অবশ্য জ্ঞানদানন্দিনীর গয়নার ওপর কোন ঝোঁক ছিল না, তিনি শুধু ভালবাসতেন পলার গয়না পরতে। যাক সে কথা। এবার সত্যেন্দ্রর প্রার্থনা মঞ্জুর হল। মহর্ষি বাধা দিলেন না।

আপত্তি অবশ্য উঠেছিল। বাড়ির বৌ বাইরে যাবে কী? কোন বাড়ির বৌ কি গেছে? তা কি কখনো হতে পারে? বাড়ির পুরুষেরাও যে যখন তখন অন্দরমহলে যেতে পারে না। বিয়ের আগে পর্যন্ত বাইরেই থাকে, বিয়ের পর মশন একখানা আলাদা শোবার ঘর হয় তখন রাতে শুতে আসে। নাহলে বহির্জগতের ছোঁয়া-বঁচানো অন্তঃপুরের শুচিতা নষ্ট হবে যে। এই সাবেকী কালের নড়চড় হত না কোন বাড়িতে। ধিক্কারের ঘূর্ণীঝড় উঠল। মা গেকার মতো আরেকবার ধমক লাগালেন ছেলেকে, তুই মেয়েদের নিয়ে মেমেদের মতে গড়ের মাঠে ব্যাড়াতে যাবি নাকি? সত্যেরে মনে হয় কীই-বা এমন ক্ষতি হয় তাতে? এই পর্দা প্রথা আমাদের নিজস্ব নয়, মুসলমানী রীতির অনুকরণ। তাছাড়া ঠাকুরবাড়িতে কয়েদখানার মতো নবাবী বন্দোবস্তের দরকারই বা কী?

তাঁর এসব ভাল লাগে না। লাগে না বলেই তো কয়েক বছর আগে সেই হাস্যকর-হালকা অথচ দুঃসাহসিক কাজটি করতে পেরেছিলেন। এখন ভাবলেও হাসি পায়। বিয়ের কিছুদিন পরের কথা। সত্যেন্দ্রের তখন অল্প বয়স–ঘোর র‍্যাডিক্যাল। সব কাজের সঙ্গী প্রাণের বন্ধু মনোমোহন ঘোষ। হঠাৎ একদিন তার ইচ্ছে হল বন্ধুর স্ত্রীকে দেখবার। এমন কি অপরাধ?

সত্যেন্দ্র রাজী। কিন্তু দেখাবেন কি করে? জ্ঞানদানন্দিনীর বাইরে যাবার জো নেই, অন্য পুরুষও অন্দরে আসতে পারবে না। এমন কি পুরুষ ভৃত্যও না। তাহলে? দিনরাত অনেক শলা-পরামর্শ ফন্দি-ফিকির খাটিয়ে শেষে একটা ব্যবস্থা হল। সে যেমনি দুঃসাহসিক তেমনি রোমাঞ্চকর। জ্ঞানদানন্দিনীর মুখেই শোনা যাক:

ওঁরা দুজনে পরামর্শ করে একদিন বেশি রাতে সমান তালে পা ফেলে বাড়ির ভেতরে এলেন। তারপরে উনি মনোমোহনকে মশারির মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে নিজে শুয়ে পড়লেন। আমরা দুজনেই মশারির মধ্যে জড়োসড়ো হয়ে বসে রইলুম; আমি ঘোমটা দিয়ে একপাশে আর তিনি ডোম্বলদাসের মতো আরেক পাশে। লজ্জায় কারো মুখে কথা নেই। আবার কিছুক্ষণ পরে তেমনি সমান তালে পা ফেলে উনি তাকে বাইরে পার করে দিয়ে এলেন।

খুব সহজ ছিল না ব্যাপারটা। দেউড়ি দালান পার হয়ে সবার চোখ এড়িয়ে বন্ধুকে আনতে হয়েছিল অন্দরমহলে। পদে পদে ধরা পড়ার সম্ভাবনা সত্ত্বেও সত্যেন্দ্র যে এতদুর এগিয়েছিলেন সে শুধু তিনি প্রগতিবাদী ছিলেন বলে।

এবার তো মহর্ষি স্বয়ং অনুমতি দিয়েছেন। মন খুশিতে টইটুম্বুর। প্রাণে খুশির তুফান উঠেছে। সত্যেন্দ্র স্ত্রীকে বোম্বাই নিয়ে যাবেন, স্ত্রী-স্বাধীনতার দ্বার খোলবার এক মহা সুযোগ উপস্থিত। গোছগাছ শুরু হয়ে গেল। কিন্তু জ্ঞানদানন্দিনী কি পোশাক পরে বাইরে বেরোবেন? ঘরের কোণে বন্দী মেয়েদের সাজপোশাক নিয়ে এতদিন কেউ মাথা ঘামায়নি, শুধু একখানি শাড়ি পরলেই চলে যেত। নিজের পুরনো কথা বলার সময় জ্ঞানদানন্দিনী জানিয়েছেন, শীতকালে তারা এই শাড়ির ওপর জড়াতেন একটি করে চাদর। পুরাতনী থেকে আমরা এরকম আরো অনেক খুঁটিনাটি খবর পেয়েছি। কিন্তু মনে প্রশ্ন থেকে গেছে, এতদিন পর্যন্ত বাঙালী মেয়েরা অন্য কোন পরিচ্ছদ ব্যবহার করতেন না কেন? সত্যিই কি তাঁরা শাড়ি ছাড়া আর কিছুই পরতেন না। বাংলাদেশে বেশ অনেকদিন ধরেই মুসলমান শাসন শুরু হয়েছিল। নবাব-হারেমের দু-একটা ছবিতে মেয়েদের বেশ রুচিশোভন পোশাক পরতেও দেখা গেছে। সেই পোশাকটি কি বাঙালী মেয়েরা গ্রহণ করতে পারতেন না? সাধারণতঃ দেখা গেছে বাঙালী পুরুষদের চলায়-বলায় পোশাকে-আশাকে রুচিতে-বিলাসে সর্বত্রই মুসলমানী ছাপ পড়েছে। তাহলে মেয়েরা কেন বাদ পড়লেন? পেশোয়ার্জের ব্যবহার তো ছিল। যাই হোক, জ্ঞানদানন্দিীর জন্যে তখনকার মত ফরাসী দোকানে ফরমাশ দিয়ে বানানো হল কিম্ভুতকিমাকার ওরিয়েন্টাল ড্রেস। পরাও খুব কষ্টকর। জ্ঞানদাননিনী তো নিজে নিজে পরতেই পারলেন না। তবু ঐ পরেই কানরকমে তৈরি হলেন! প্রথমবারের এই পরিচ্ছদ-সমস্যা জ্ঞানদানন্দিনীকে এত বিব্রত করেছিল বলেই তিনি মেয়েদের সাজপোশাক নিয়ে ভাবতে শুরু করেন। আধুনিক বাঙালী মেয়েদের রুচিশোভন সাজটি তার সেই চিন্তার ফসল। সে আরো পরের কথা। আপাততঃ যাত্রার কথাটা সেরে ফেলি।

সত্যেন্দ্র প্রস্তাব করলেন, বাড়ি থেকেই গাড়িতে ওঠা যাক। এবারও সবাই ছি ছি করে উঠতে দেবেন্দ্রনাথও রাজী হলেন না। সেকালে মেয়েদের গাড়ি চড়া ভারি নিন্দনীয় ব্যাপার ছিল। তিনি বললেন, মেয়েদের পালকি করে যাবার নিয়ম আছে তাই রক্ষা করা হোক। অসূর্যস্প কুলবধু কর্মচারীদের সামনে পায়ে হেঁটে দেউড়ি পেরোবে এতটা ভাবতে বোধহয় মহর্ষিরও ভাল লাগেনি। সাবেকী পালকি জ্ঞানদানন্দিনীকে বোম্বাইগামী জাহাজে চাপিয়ে দিলে। এই শেষ। এরপরে তিনি আর কোনদিন পালকি চাপেননি।

বোম্বাইয়ে পুরো দুবছর কাটিয়ে অপরূপ বেশবাসে সেজে জ্ঞানদানন্দিনী আবার যেদিন কলকাতার মাটিতে পা দিলেন প্রকৃতপক্ষে সেই দিনটিতেই শুরু হল বাঙালী মেয়েদের জয়যাত্রা। তখন সবে সত্তরের দশক আরম্ভ হয়েছে! সর্বত্র বইছে এক উন্মাদনার হাওয়া। তবে বাংলাদেশে পর্দার কড়াকড়ি শিথিল হতে সময় লেগেছিল। ততদিন যে জ্ঞানদানন্দিনীকে একাই সব লাঞ্ছনা-গঞ্জনা সইতে হয়েছে তা নয়, তার সঙ্গী হয়েছিলেন ঠাকুরবাড়ির অন্য মেয়েরা, এবং কয়েকজন ব্রাহ্মিক। মহিলা। অবশ্য যেদিন তিনি বোম্বাই থেকে ফিরলেন সেদিন তার পাশে কেউ ছিল না। স্বর্ণকুমারী সেই মুহূর্তটিকে একটি কালির আঁচড়ে জীবন্ত করে তুলেছেন, ঘরের বৌকে মেমের মতো গাড়ি হইতে সদরে নামিতে দেখিয়া সেদিন বাড়িতে যে শোকাভিনয় ঘটিয়াছিল তাহা বর্ণনার অতীত। বাড়ির পুরনো চাকরদের চোখ দিয়ে দরদর করে নেমে এসেছিল অশ্রুধারা। নিজের পুরনো ঘরটিতে ফিরেও জ্ঞানদানন্দিনী যেন একঘরে হয়ে রইলেন। সমবেদনায় করুণ স্বর্ণকুমারী দেখতেন বাড়ির অন্যান্য মেয়েরা বধূঠাকুরাণীর সঙ্গে অসংকোচ খাওয়া-দাওয়া করিতে বা মিশিতে ভয় পাইতেন। এই রকম পবৃিস্থিতিতে জ্ঞানদানন্দিনীর আচার-আচরণ দুঃসাহসিক বৈকি।

তিনি সত্যন্দ্রনাথের কথামতো গেলেন লাটভবনে, নিমন্ত্রণ রাখতে। সেখানে তাকে দেখে সবাই প্রথমে ভেবেছিলেন ভূপালের বেগম, কারণ তিনিই তখন একমাত্র বেরোতেন। ভোজসভায় ছিলেন পাথুরেঘাটার প্রসন্নকুমার ঠাকুর। তিনি তো ঘরের বৌকে প্রকাশ্য রাজসভায় আসতে দেখে রাগে-লজ্জায় দৌড়ে পালিয়ে গেলেন। আগে কোনো হিন্দু রমণী গভর্ণমেন্ট হাউসে যাননি। এখনই বা যাবার দরকার কি ছিলো? সে কথা সনাতনপন্থীরা বুঝবেন কি করে? বুঝেছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ। তাই পুলকিত হয়ে লিখেছেন, সে কী মহাব্যাপার! শত শত ইংরেজ মহিলার মাঝখানে আমার স্ত্রী সেখানে একমাত্র বঙ্গবালা! যতই হৈচৈ হোক না কেন রোগটা বড় ছোঁয়াচে। একটি দুটি করে আরো দরজা খুলতে শুরু করল।

জ্ঞানদানন্দিনী যে শুধু মেয়েদের পথের কাঁটা ঘুচিয়েছিলেন তা নয়, পুরুষের মনের বাধাও অনেকটা দূর করেছিলেন। প্রত্যক্ষ প্রমাণ জ্যোতিরিন্দ্রনাথ। সমবয়সী এই দেওরটি তার অত্যন্ত স্নেহের পাত্র। কিন্তু প্রথমে জ্যোতিরিন্দ্র নব্যপন্থী ছিলেন না বরং একটু রক্ষণশীল ছিলেন বড় দাদা দ্বিজেন্দ্রনাথের মতো। কেশব সেনকে ব্যঙ্গ করে প্রহসন লেখার মধ্যেই তার মনোভাবটি ধরা পড়েছিল কিন্তু মেজ দাদা আর মেজ বৌঠানের সাহচর্য তাঁকে নিয়ে গিয়েছিল নতুন পথে।

জ্ঞানদানন্দিনী আমাদের ঠিক কী দিয়েছিলেন সেটা সবার কাছে তেমন স্পষ্ট নয়। বাঙালী নারীর পথিকৃৎ হবার জন্যে তাকে আরো এগোতে হয়েছে। তিনি একাকিনী দু-তিনটি শিশু নিয়ে সাত সমুদ্র পাড়ি দিয়ে বিলেত গিয়েছিলেন। যেখানে একলা যেতে ছেলেদেরও বুক কেঁপে উঠত। কালাপানি পার হয়ে বিলেত যাওয়া, বাপরে সে কি সহজ কথা! দু-দুজন কৃতী পুরুষ, রামমোহন আর দ্বারকানাথ গেলেন বিলেতে, কিন্তু ফিরলেন কই? সত্যেন্দ্রকে পাঠাবার সময়েই সবাই ভেবে অস্থির হয়েছিল, আর এ তো বাড়ির বৌ! যৎসামান্য ইংরেজী বিদ্যের পুজি নিয়ে সে কালাপানি পাড়ি দিলে কোন্ সাহসে? প্রসন্নকুমারের পুত্র প্রথম বাঙালী ব্যারিষ্টার জ্ঞানেন্দ্রমোহন ঠাকুর জাহাজঘাটে এসে তো হতবাক। অস্ফুটে শুধু বললেন, সত্যেন্দ্র এ কী করলেন? নিজে এলেন না।

এক এক সময় মনে হয় জ্ঞানদানন্দিনী বিলেত গিয়েছিলেন কেন? শুধু সত্যেন্দ্রর সেই অচরিতার্থ যৌবন স্বপ্ন সফল করবার জন্যে, না সব বিষয়ে ভারতীয় নারীর আদর্শ হয়ে ওঠার জন্যে? বেশ অবাক লাগে যখন শুনি তিনি বিলেত গিয়েছিলেন শুধু স্ত্রী-স্বাধীনতার সঙ্গে পরিচিত হতে দেশে ফিরি তিনি তার অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাতে পেরেছিলেন। খুলে দিয়েছিলেন সম্ভাবনাময় নতুন উষার স্বর্ণদ্বার। অবশ্য এ কথার অর্থ এই নয় যে আর কেউ সে সময় কিছুমাত্র করেননি বা চালচলনে বিদেশিয়ানা নিয়ে আসেননি। রামবাগানের দত্ত পরিবারের তরু ও অরু লেখাপড়া শিখতে বিদেশে গিয়েছিলেন। গিয়েছিলেন মেরী কার্পেন্টারের অনুরোধে রাজকুমারী বন্দ্যোপাধ্যায়ও। আরো দু-চার জনকে খুঁজে পাওয়া যাবে না তা নয়, তবে তারা বাঙালী-সংস্কৃতির সঙ্গে ঠিক যেন মিশে যাননি। পুরোপুরি সাহেব হয়ে-যাওয়া পরিবারগুলোর সঙ্গে দেশের হৃদয়ের যোগ কম ছিল। তাই আন্দোলন সৃষ্টি করেছিলেন জ্ঞানদানন্দিনী।

সর্বপ্রথম ঠাকুরবাড়ির মেয়েদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন ব্রাহ্ম সমাজের মেয়েরা। কিছুদিন ধরেই ব্রাহ্ম সমাজ-মন্দিরে মেয়েরা যোগ দেবার অনুমতি পেয়েছেন। তাঁরা বসতেন চিকের আড়ালে স্বতন্ত্র আসনে। হঠাৎ ১৮৭২ সাল নাগাদ কয়েকজন আচার্যকে জানালেন তারা তাদের বাড়ির মেয়েদের নিয়ে পর্দার বাইরে বসতে চান। যেমন কথা তেমন কাজ। অন্নদাচরণ খাস্তগির ও দুর্গামোহন দাস তাদের স্ত্রী ও মেয়েদের নিয়ে এসে বসলেন সাধারণ উপাসকদের মধ্যে, পুরুষদের সঙ্গে। এতে অন্যান্য ব্রাহ্মদের আপত্তি ছিল না। কেশব সেন বাধ্য হয়ে পর্দা ছাড়াই মেয়েদের উপাসনা-মন্দিরে বসবার অনুমতি দিলেন। এইভাবে প্রকাশ্যে পর্দার বিরোধিতা শোনা গেল। জগদানন্দ মুখোপাধ্যায় ১৮৭৯ সালে প্রিন্স অব ওয়েলসের সঙ্গে নিজের পরিবারের মহিলাদের সাক্ষাতের অনুমতি দিলেন। সে নিয়েও কত কাণ্ড হল!

বাইরে বেরোবার জন্যে জ্ঞানদানন্দিনী বাঙালী মেয়েদের দিলেন একটি রুচিশোভন সাজ। অবশ্য দেশী ধাঁচে শাড়ি পরা যে খারাপ ছিল তা নয় তবে তাতে সৌষ্ঠব ছিল না। বোম্বাইয়ে গিয়ে তিনি প্রথমেই জবরজং ওরিয়েন্টাল ড্রেস বর্জন করে পাশী মেয়েদের শাড়ি পরার মিষ্টি ছিমছাম ধরনটি গ্রহণ করেন। নিজের পছন্দমতো একটু অদল-বদল করে জ্ঞানদানন্দিনী এই পদ্ধতিটাকেই বজায় রাখলেন। স্বর্ণকুমারীর ছোট মেয়ে সরলা দেখেছিলেন ছোটবেলায় তার মা এবং মেজমামী দেশে ফিরলেন নতুন ধাঁচের শাড়ি পরে, বাড়িশুদ্ধ সব মেয়েই সেটি গ্রহণ করতে ব্রাহ্মিকারাও তার প্রতি আকৃষ্ট হলেন।

বোম্বাই থেকে অনা বলে ঠাকুরবাড়িতে এই শাড়ি পরার ঢংয়ের নাম ছিল বোম্বাই দস্তুর কিন্তু বাংলাদেশে তার নাম হল ঠাকুরবাড়ির শাড়ি। জ্ঞানদানন্দিনী বোম্বাই থেকে ফিরে এ ধরনের শাড়ি-পরা শেখানোর জন্যে কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন। অনেক সম্ভ্রান্ত ব্রাহ্মিকা এসেছিলেন শাড়ি-পরা শিখতে, সবার আগে এসেছিলেন বিহারী গুপ্তের স্ত্রী সৌদামিনী। অবশ্য তখনও তার বিয়ে হয়নি। শাড়ির সঙ্গে জ্ঞানদানন্দিনী শায়া-সেমিজ-ব্লাউজ-জ্যাকেট পরাও প্রচলন করেন। এ প্রসঙ্গে মনে রাখা দরকার, অন্যান্য ব্রাহ্মিকারাও বাইরে বেরোবার সাজের কথা ভাবছিলেন। মনোমোহন ঘোষের স্ত্রী সরাসরি গাউন পরতেন। ঠাকুরবাড়িতেও ইন্দুমতী পরতেন গাউন। কিন্তু সব বাঙালিনী গাউন পরতে রাজী নন বলে দুর্গামোহন দাসের স্ত্রী ব্ৰহ্মময়ী পরতেন একটা জগাখিচুড়ি-মার্কা পোশাক। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ যেমন স্বদেশী পোশাক তৈরি করবার জন্যে পাজামাতে কেঁচা আর সোলার টুপির সঙ্গে পাগড়ির মিশ্রণ ঘটিয়েছিলেন তেমনি ব্রাহ্মিকার মেমসাহেবদিগের গাউনের উপরিভাগে আঁচল জুড়িয়া এক প্রকার আধা বিলাতি আধ দেশী। পরিচ্ছদ সৃষ্টি করেন। বোম্বাই দস্তুর নতুনত্বের গুণে সবাইকে আকৃষ্ট করল। তবে এতে মাথায় আঁচল দেওয়া যেত না বলে প্রগতিশীলার একটি ছোট টুপি পরতেন। তার সামনেটা মুকুটের মতো, পেছনে একটু চাদরের মতো কাপড় ঝুলত। জ্ঞানদানন্দিনীর টুপি পরা ছবি আমি দেখিনি তবে মাথায় শাড়ির আঁচলে ছোট্ট ঘোমটা টানা প্রবর্তন করেন তার মেয়ে ইন্দিরা, তখন সাবেকী ধরনে শাড়ি পরার গৌরব আবার ফিরে এসেছে।

এখনকার আধুনিকারা যে ভাবে শাড়ি পরেন সেই ঢংটি জ্ঞানদানন্দিনীর দান নয়। বোম্বাই দস্তুর-এ যেসব অসুবিধে ছিল সেগুলো দূর করবার চেষ্টা করেন কুচবিহারের মহারাণী কেশব-কন্যা সুনীতি দেবী। তিনি শাড়ির ঝোলানো অংশটি কুঁচিয়ে ব্রোচ আটকাবার ব্যবস্থা করেন। তার সঙ্গে তিনি মাথায় পরতেন স্প্যানিশ ম্যাটিলাজাতীয় একটি ছোট্ট ত্রিকোণ চাদর। তার বোন ময়ূরভঞ্জের মহারাণী সুচারু দেবী দিল্লীর দরবারে প্রায় আধুনিক শাড়ি পরার টংটি নিয়ে আসেন। এটিই নাকি তার শ্বশুরবাড়ির শাড়ি পরার সাবেকী ঢং। বাস্তবিকই উত্তর ভারতের মেয়েরা, হিন্দুস্থানী মেয়েরা এখনও যে ভাবে সামনে আঁচল এনে সুন্দর করে শাড়ি পরে তাতে ঐ ধরনটিকেই বেশি প্রাচীন মনে হয়। বাঙালী মেয়ের অধিক স্বাচ্ছন্দ্যগুণে এটিকেই গ্রহণ করলেন তবে জ্ঞানদানন্দিনীর আঁচল বদলাবার কথাটি তারা ভোলেননি তাই এখন আঁচল বাঁ দিকেই রইল। কিছুদিন মেমেদের হব স্কার্টের অনুকরণে হব করে শাড়ি পরাও শুরু হয় তবে অত আঁটসাট ভাব সকলের ভাল লাগেনি। শাড়ির সঙ্গে সঙ্গে উঠল নানান। ফ্যাশানের লেস দেওয়া জ্যাকেট ও ব্লাউজ। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, বিলিতি দরজীর দোকান থেকে যত সব ছাঁটকাটা নানা রঙের রেশমের ফালির সঙ্গে নেটের টুকরো আর খেলো লেস মিলিয়ে মেয়েদের জামা বানানো হত।

এই বিচিত্রবেশিনীরা সাধারণ হিন্দু সমাজের চোখে ছিলেন যোগেন বসুর মডেল ভগিনীর মতো বিচিত্র জীব। জ্ঞানদানন্দিনী নিজে অবশ্য এ বিষয়ে কিছু বলেননি তবে তার দুই ননদ সৌদামিনী আর স্বর্ণকুমারীর রচনা থেকে জানা যায় তাদের পথ মোটেই কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। তারা যখন সেমিজ, জামা, জুতো, মোজা পরে গাড়ি চড়ে বেড়াতে বেরোতেন তখন চারদিকে ধিক্কারের ঘূর্ণীঝড় উঠত। শুধু ধিক্কার নয়, শাড়ির সঙ্গে জ্যাকেট পরে বাইরে বেরোলে তাদের বিলক্ষণ হাস্যভাজন হতেও হত। হিন্দুদের সেলাই-করা জামা পরে কোন শুভ কাজ করতে নেই। তাই পোশাক-পরিচ্ছদ নিয়ে আরো কিছুদিন গণ্ডগোল চলেছিল। তবে যুগ বদলেছে, তাই মুসলমানী পোশাককে তাঁরা যেমন অন্তঃপুরে ঢুকতে দেননি তেমনি করে ব্রাহ্মিকাদের পোশাককে বাধা দিতে পারলেন না। নতুন ধরনের শাড়ি পরার ঢংএর নামই হয়ে গিয়েছিল ব্রাহ্মিক। শাড়ি। তবে বিয়ে-টিয়ের সময় সনাতন নিয়মই চলত। গগনেন্দ্রনাথ ১৯০১ সালে যখন তাঁর ন বছরের মেয়ে সুনন্দিনীকে সম্প্রদান করতে যাচ্ছেন তখনও বরপক্ষের একজন আপত্তি জানিয়ে বলেন, সেলাই-করা কাপড় পরে তো মেয়ে সম্প্রদান হয় না। গগনেন্দ্র যখন গৌরীদানই করছেন তখন আর নিয়মটুকু মানতে দোষ কি? গগনেন্দ্র জানতেন সে কথা। ঠাকুরবাড়ির ছেলে হলেও তাঁর বাড়িতে সনাতন হিন্দু নিয়মই চলে আসছে। তাই তিনি স্বভাবসিদ্ধ উদারভঙ্গিতে হেসে বলেছিলেন, দেখুন মেয়ের গায়ে কোন জামা নেই। সত্যিই তো! সমবেত বরযাত্রীরা দেখলেন মেয়ের গায়ে জামা নেই বটে তবে শাড়িটা এমন কায়দায় পরানো হয়েছে যে জামা নেই বোঝাই যায়নি। শিল্পী গগনেন্দ্র নিজস্ব পরিকল্পনা দিয়ে মেয়েকে সাজিয়েছিলেন। কনে সাজাবার এই ঢংটি সবার খুব পছন্দ হয়েছিল।

বেশবাসে আধুনিকতা আনা ছাড়াও জ্ঞানদানন্দিনী আর দুটি জিনিসের প্রবর্তক—বিকেলে বেড়াতে বেরোনো আর জন্মদিন-পালন। এ দুটিই তিনি বিলেত থেকে আমদানী করেছিলেন। ছেলে ও মেয়ের জন্মদিনে বাড়ির সমস্ত ছোটরা নিমন্ত্রিত হত। আমোদ-প্রমোদে জ্ঞানদানন্দিনী চাকরবাকরদেরও বঞ্চিত করতেন না। সুরেন্দ্রের জন্য বর্ষাকালে তাই সে সময় বাড়ির সব ভৃত্যের জন্যে আসত ছাতা আর ইন্দিরার জন্ম শীতকালে তাই পরিচারকেরা পেত একখানি করে কম্বল। জ্ঞানদানন্দিনীর উৎসাহেই সরলা-হিরন্ময়ীরা প্রথম রবীন্দ্র জন্মোৎসব পালন করেন সত্যেরে ৪নং পার্ক টীটের বাড়িতে। সেই উৎসবের দিন জানা গেল জ্যোতিরিন্দ্রের জন্মদিনও কাছাকাছি কোন এক তারিখে। পরের বছর থেকে জ্ঞানদানন্দিনীর উৎসাহে তারও জন্মদিন পালনের ব্যবস্থা হয়। তবে এই অনুষ্ঠানে জন্মতিথির সংখ্যা অনুসারে মোমবাতি জ্বালানো শুরু করেন স্বর্ণকুমারীর বড় মেয়ে হিরন্ময়ী।

জ্ঞানদানন্দিনীর ব্যক্তিস্বাতন্ত্রের আরো একটু পরিচয় আছে। সত্যেন্দ্র বোম্বাই থেকে কলকাতায় ফিরে আসার পরে জ্ঞানদানন্দিনী একান্নবর্তী ঠাকুরবাড়িতে যৌথ পরিবারের একজন হয়ে থাকতে চাননি। তিনিই প্রথম জোড়াসাঁকোর বাড়ি ছেড়ে অন্য বাড়িতে উঠে যান স্বামী-পুত্র-কন্যাকে নিয়ে। বাঙালী জীবনে এর আগে এই স্বাতন্ত্র্য দেখা যায়নি। তখন মেয়ের বিয়ে হলে জামাইকেও ঘরজামাই করে রাখা হত এবং তাদের জন্যে আলাদা মহলের ব্যবস্থা হত। আমাদের আধুনিক জীবনের পারিবারিক ছকটি জ্ঞানদানন্দিনীই নিজের হাতে গড়ে দিলেন। এটি ভাল না মন্দ সে বিতর্কে না গিয়েও বলতে পারি পারিবারিক গণ্ডির ছোট সীমাকেই আমরা ভালবাসতে শুরু করেছি। তবে জোড়াসাঁকো থেকে চলে এলেও ঠাকুরবাড়ির সঙ্গে জ্ঞানদানন্দিনীর যোগ কিছুমাত্র শিথিল হয়নি। পারিবারিক যে কোন কাজে তার অপরিসীম উৎসাহ ছিল। যখন যার যা প্রয়োজন নিঃসংকোচে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন মেজ বৌয়ের কাছে। কিশোর। রবীন্দ্রনাথ বিলেতে গিয়ে উঠবেন কার কাছে? না, মেজ বৌঠানের কাছে। জোড়াসাঁকোয় প্রফুল্লময়ী বুক-ভরা কান্নার বোঝা নামিয়ে হাল্কা হবেন কার কাছে? না, মেজদির কাছে। রেণুকা অসুস্থ, মাতৃহীন দুটি শিশুকে রবীন্দ্রনাথ কোথায় রেখে যাবেন? কেন, জ্ঞানদানন্দিনী তো রয়েছেন। অবনীন্দ্রকে ছবি আঁকার উৎসাহ দিলেন কে? কে আবার, জ্ঞানদানন্দিনী! প্রতিমার জন্যে আর্টের টিচার খুঁজে দেবেন কে? জ্ঞানদানন্দিনী ছাড়া আর কে আছে? সব দায়িত্ব সব ভার তাকে দিয়ে সবাই নিশ্চিন্ত।

শুধু বড়দের নয়, ছোটদের কথাও অত বড় বাড়িতে জ্ঞানদানন্দিনী ছাড়া আর কেই-বা ভেবেছেন। তাদের মধ্যে সুপ্ত প্রতিভার সন্ধান করে তাদের জাগাবার চেষ্টাও তিনি কম করেননি। বাড়ির ছোট ছেলেমেয়েদের জড়ো করে তিনি একটা পত্রিকা বার করলেন বালক নামে। সুধীন্দ্র, বলে, সরলা, প্রতিভা, ইন্দিরা অনেকেরই সাহিত্যচর্চার প্রথম হাতে-খড়ি হয় বালকে। স্বয়ং সম্পাদিকা অর্থাৎ জ্ঞানদানন্দিনী নিজে অবশ্য লিখেছিলেন একটিমাত্র রচনা। তিনি কনটেমপোরারি রিভিউ থেকে ডেবাগোরিও মোগ্রিয়েভিং-এর সাইবেরিয়া থেকে পলায়নের রোমাঞ্চকর কাহিনীটি অনুবাদ করেন আশ্চর্য পলায়ন নামে।

শুধু পত্রিকা প্রকাশ নয়, ছেলেদের ছবি আঁকায় উৎসাহ দিয়ে জ্ঞানদানন্দিনী বসিয়েছিলেন একটা লিথো প্রেস। বেশির ভাগ খরচ দিতেন তিনি নিজে। ছোটদের জন্যে তার আরো একটি দান আছে। নাতি সুবীরেন্দ্রের জন্যে দুখানি রূপকথাকে নাট্যরূপ দিয়েছিলেন তিনি। সাত ভাই চম্পা ও টাক ডুমাডুম। রূপকথাকে নাট্যরূপ দেওয়া শক্ত, বিশেষ করে দ্বিতীয়টিকে। কিন্তু শিশুমনে এর আবেদন অপরিসীম। জ্ঞানদানন্দিনী এত সুন্দর করে শিয়ালের নাক কাঁটার গল্প বলেছেন যে বহুশ্রুত গল্পটিকেও বারবার শুনতে ইচ্ছে করে, আর মনে হয়, আহা, সব রূপকথাগুলো কেন র হাতের ছোঁয়ায় নতুন হয়ে উঠল না। শিয়াল যখন বলে—ওগো না গো না-তোমার কিছু ভয় নেই—আর যদিই বা একটু আধটু কেটে যায়, তাতে আমার চেহারা খারাপ হবে না। আমার ত আর মানুষের মতো ন্যাড়া নাক নয়, কাঁটার দাগ রোঁয়ার ভিতরে দিব্যি ঢাকা থাকবে। তখন শিশুমন কল্পনার সিঁড়ি বেয়ে উধাও হয়ে যায় রূপকথার রহস্যজগতে। তাই নাকুর বদলে নরুণ পেলুম তাকডুমা ডুমডুম তাদের কাছে হয়ে ওঠে আদি কবিতা।

ছোটদের কথা এমন করে খুব কম মায়েরাই ভেবেছেন। জ্ঞানদানন্দিনীর অন্যান্য প্রবন্ধেও দেখা যাবে শিশুচিন্তার প্রাধান্ত। তার লেখা তিনটে প্রবন্ধ ভারতী পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। তার মধ্যে একটির নাম কিন্টার গার্ডেন। দ্বিতীয়টির নাম স্ত্রীশিক্ষা। অর্থাৎ প্রথমটি শিশুশিক্ষা ও দ্বিতীয়টিতে নারীশিক্ষার কথা বলা হয়েছে। তবে স্ত্রীশিক্ষারও মূল উদ্দেশ্য জ্ঞানদানন্দিনীর মতে আদর্শ জননী হওয়া। শিশুকেন্দ্রিক রচনা ছাড়াও তার লেখা আরও দুটি রচনা আমরা পাই। একটি মারাঠী রচনার বঙ্গানুবাদ ভাউ সাহেবের খবর—তৃতীয় পানিপথের যুদ্ধের পটভূমিতে লেখা কাহিনী। আর একটি হল ইংরাজনিন্দা ও স্বদেশানুরাগ নামক প্রবন্ধ।

জ্ঞানদানন্দিনী ভারতের প্রথম আই. সি. এস অফিসারের স্ত্রী, উচ্চবিত্ত ইঙ্গবঙ্গ সমাজের সঙ্গে তার হৃদ্যতা, নিজেও বিলেত ঘুরে এসেছেন। সুতরাং বিলিতি হাব-ভাব রুচি-চিন্তার সঙ্গে তার মিল হওয়াই স্বাভাবিক। অথচ জ্ঞানদানন্দিনী নিজে সাহেবিয়ানা বেশি পছন্দ করতেন না। একটি নারীর পূর্ণ আত্মবিকাশের জন্য যতখানি পশ্চিমী রীতি গ্রহণ করা উচিত তিনি ঠিক ততটুকুই নিয়েছিলেন। তাই গড়ের মাঠে হাওয়া খেতে কিংবা জামা-জুতো পরে গাড়ি চড়ে বেড়াতে তার যেমন আপত্তি ছিল না তেমনি বাধা ছিল না স্বদেশের মঙ্গল চিন্তায়। তবে তিনি ভুয়ো ইংরেজনিন্দা করে সারাজীবন ইংরেজের অনুগ্রহ ভিক্ষা করে কাটিয়ে দেওয়াকে তীব্র ভাষায় ভৎসনা করে স্বদেশবাসীকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে বলেছেন। তিনি জানতেন, আমাদের জাতীয় যথার্থ স্থায়ী উন্নতি আমরা ভিন্ন কাহারও দ্বারা সাধিত হইতে পারে না।

জ্ঞানদানন্দিনীকে আমরা সব কাজেই এগিয়ে আসতে দেখেছি। এমনকি অভিনয় করার বেলায়ও তার ডাক পড়ত। সব কাজেই তার অনায়াস পটুতা। দেওরদের মাথায় পাগড়ি বেঁধে দেওয়ার জন্যে যেমন তাঁর ডাক পড়ত তেমনি সবাই তাকে খুঁজত নাটকের মহল দেবার সময়। ঠাকুরবাড়িতে নাটক-পাগল লোকের অভাব ছিল না। সেখানে কথায় কথায় থিয়েটার দেবার বা নাটকাভিনয়ের কথা শোনা যায়। মনে হয় বাঈ-নাচের পরিবর্তে এটি গৃহীত হয়েছিল। জোড়াসাঁকো থিয়েটার উঠে গেল, জোড়াসাঁকোর উঠোনের ঘরোয়া অভিনয় বন্ধ হল তবু নাট্যামোদী মানুষের মন চাপা রইল না। তাই নতুন করে যখন রাজা ও রাণী লেখা হল তখন জ্ঞানদানন্দিনীর বাড়িতেই বসল নাটকের মহলা। ভূমিকাও প্রায় ঠিকঠাক :

রাজা বিক্রম–রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
রাণী সুমিত্রা—জ্ঞানদানন্দিনী দেবী
দেবদত্ত–সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর
নারায়ণী—মৃণালিনী দেবী
কুমার–প্রমথ চৌধুরী
ইলা—প্রিয়ম্বদা দেবী

অন্যান্য ভূমিকায় ঠাকুরবাড়ির অন্যান্য ছেলেরা। অভিনয় দারুণ জমেছিল। সবাই ভাল অভিনয় করেছিলেন। লোকে কাকে ছেড়ে কাকে দেখে? সেই ভিড়ের মধ্যে মিশে গিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে অভিনয় দেখে গেল পাবলিক স্টেজের কয়েকজন অভিনেতা অভিনেত্রী। তারপর? সে এক দারুণ ব্যাপার। প্রত্যক্ষদর্শী অবনীন্দ্রনাথ। তিনি জানিয়েছেন, পাবলিক স্টেজে রাজা ও রাণী অভিনয় দেখার নিমন্ত্রণ পেয়ে তারা গিয়েছিলেন সেখানে। গিয়ে একেবারে তাজ্জব বনে গেলেন রাণী সুমিত্রা স্টেজে এল, একেবারে মেজ জ্যাঠাইমা। গলার সুর, অভিনয়, সাজসজ্জা, ধরনধারণ হুবহু মেজ জ্যাঠাইমাকে নকল করেছে। এমারেল্ড থিয়েটারের এই অভিনয় খুব জনপ্রিয় হয়েছিল আর রাণী সুমিত্রা সেজে জ্ঞানদানন্দিনীকে নকল করেছিল যে অভিনেত্রী তার নাম গুলফম হরি। রাজার ভূমিকায় মতিলাল সুর, কুমারের ভূমিকায় মহেন্দ্রলাল বস্তু ও ইলার ভূমিকায় কুসুমকুমারীর (হাড়কাটা) অভিনয়ও ভাল হয়েছিল।

এই অভিনয়কে কেন্দ্র করে অবশ্য আরো একটা ঘটনা ঘটেছিল। ঝড় তুলেছিল বঙ্গবাসী পত্রিকা। ঠাকুর বাড়ির নতুন ঠাট নাম দিয়ে একটা প্রবন্ধ ছাপা হল, তাতে ঐ নাটকের পাত্রপাত্রীদের তালিকা এবং ব্যক্তিগত জীবনে তাদের পারস্পরিক সম্পর্কের কথা স্পষ্ট করে লিখে কোন কোন নিষিদ্ধ সম্পর্কে স্বামী-স্ত্রী সাজা হয়েছে সেটা দেখিয়ে দেওয়া হয়। আগেই বলেছি, রাজা ও রাণীর ভূমিকায় অভিনয় করেন রবীন্দ্রনাথ ও জ্ঞানদানন্দিনী অর্থাৎ দেবর-বৌদিদি আর দেবদত্ত ও নারায়ণী সাজেন সত্যেন্দ্রনাথ ও মৃণালিনী অর্থাৎ ভাশুর-ভ্রাতৃবধু। কিন্তু এসব ছোটখাট ব্যাপারের দিকে তাকাতে হলে জ্ঞানদানন্দিনীকে অনেক আগেই থেমে যেতে হত।

নিজে লেখা ছাড়াও অপরকে উৎসাহ দিয়ে লেখানোর দিকে জ্ঞানদানন্দিনীর ঝোঁক ছিল বরাবর। ছোটদের কথা তো আগেই বলেছি। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সংস্কৃত নাট্যানুবাদের মূলেও ছিলেন তার এই মেজ বৌঠান। তার আগে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ একটিও সংস্কৃত নাটক পড়েননি। জ্ঞানদানন্দিনীর অনুরোধে তাকে শকুন্তলা পড়ে শোনাতে গিয়ে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ মুগ্ধ হয়ে সংস্কৃত নাটক অনুবাদে হাত দিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথকে ও ছোটদের জন্যে লিখতে উৎসাহ দিয়েছিলেন জ্ঞানদানন্দিনী। তাঁর বালকের জন্যই কবি ছোটদের লেখায় হাত দিতে বাধ্য হন। কথায় কথা বাড়ে : আমরা আর একটি কথা বলে জ্ঞানদানন্দিনীর প্রসঙ্গ থেকে অন্য প্রসঙ্গে যাব। তিনি তো অনেক কাজেই উৎসাহী ছিলেন। একবার বোম্বাই থেকে ফিরে করলেন কি, একরকম জোর করেই একজন ফটোগ্রাফার ডাকিয়ে শাশুড়ী, জা, ননদ, ও বাড়ির অন্যান্য মেয়ে বৌয়েদের ফটো তুলিয়ে ফেললেন। সেদিন তার আগ্রহ আর উৎসাহ না থাকলে অনেকেই হয়ত ক্ষণকালের আভাস থেকে চিরকালের অন্ধকারে হারিয়ে যেতেন। ধারণা গড়ে নেবার মতো একটা সামান্য ছবিও আমাদের চোখের সামনে এসে পৌঁছত না। কে বলতে পারে, হয়ত রবীন্দ্রনাথের ছবি কবিতাটা লেখাই হত না কোনদিন। একাকিনী জ্ঞানদানন্দিনী এভাবেই অনেকটা এগিয়ে দিয়েছিলেন বাঙালী মেয়েদের।

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত