| 23 এপ্রিল 2024
Categories
গীতরঙ্গ

ঢাকাইয়া সমাজে চায়ের প্রসার । হোসাইন মোহাম্মদ জাকি

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

উনিশ শতকের ঢাকায় বিত্তশালীদের মাঝে চা জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন আর্মেনীয় ব্যবসায়ীরা। ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুনের ‘ঢাকা স্মৃতি বিস্মৃতির নগরী’ গ্রন্থে তা উল্লেখ রয়েছে।

১৮৫৭ সালে ইউরোপীয় জিনিসপত্র বিক্রি করার জন্য দোকান খুলেছিলেন জি এম সিরকোর। তিনি ছিলেন একজন আর্মেনীয়। শাঁখারীবাজারে স্থাপিত দোকানটির নাম ছিল ‘সিরকোর অ্যান্ড সন্স’। সিরকোর যে সব মহার্ঘ দ্রব্য বিক্রি করতেন তার একটি ছিল চা। ড. মো. আলমগীর রচিত ‘মুসলিম বাংলার অপ্রকাশিত ইতিহাস: ঢাকার নওয়াব পরিবারের অবদান’ শীর্ষক গ্রন্থ হতে জানা যায় চমকপ্রদ আরেকটি তথ্য। নওয়াব আবদুল গনি ১৮৬০-এর দশকে বাইগুনবাড়িতে (বর্তমান সাভার উপজেলায়) ৩০ বিঘা জমি পরিষ্কার করে সেখানে চা চাষ করেন। ১৮৬৭ সালে সেখান থেকে আড়াই মণ চা পেয়েছিলেন। নওয়াব আহসানউল্লাহ সেই চা-বাগানকে আরও উন্নত করেন। ১৮৯২ এবং ৯৩ সালে ঢাকা থেকে যথাক্রমে ৪ হাজার ৭০৯ মণ এবং ১ হাজার ৩৮৫ মণ চা-পাতা কলকাতায় রপ্তানি হয়েছিল। রপ্তানি করা এ চায়ের একটা বড় পরিমাণ উৎপন্ন হয়েছিল নওয়াবের ওই চা-বাগানে।

ড. মুহাম্মদ আবদুল্লাহ-এর লেখা ‘ঢাকার কয়েকজন মুসলিম সুধী’ থেকে জানা যায়, নওয়াব আবদুল গনি সকালবেলায় এক দফা চা খেতেন। ওই চা-চক্রে শহরের সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিরা উপস্থিত হতেন। দুপুরের খাবার শেষে খেতেন কাশ্মীরি চা। রাতের খাবার শেষে চা খেতেন আরেক দফা। এটা হতো দুধ ছাড়া চা। হাকিম হাবিবুর রহমান তাঁর ‘ঢাকা পাচাশ্ বারস্ পহেলে’ গ্রন্থে উনিশ শতকের শেষার্ধে ঢাকাইয়া সমাজ ব্যবস্থায় চা-এর অবস্থান তুলে ধরেছেন। তিনি উল্লেখ করেন, তাঁর বাল্যকালে শহরে একটিও চায়ের দোকান ছিল না। শুধু সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিরা বিশেষভাবে মোগল, আর্মেনীয় ও কাশ্মীরি লোকেরাই চা পান করতেন। এক চাওয়ালা গভীর রাতে প্রজ্বলিত সমোভার (রাশিয়ান চা-পাত্র বিশেষ। পানি-আগুনসহ বহনযোগ্য পাত্র) নিয়ে চা বিক্রি করতেন।

আঠারো শতকের শেষার্ধে রাশিয়ায় প্রস্তুতকৃত সমোভার। ছবিটি যুক্তরাষ্ট্র, মিনেপলিসের দ্য মিউজিয়াম অব রাশিয়ান আর্টের শেলডন লুসকিনের সংগ্রহশালা থেকে নেওয়া।

আঠারো শতকের শেষার্ধে রাশিয়ায় প্রস্তুতকৃত সমোভার। ছবিটি যুক্তরাষ্ট্র, মিনেপলিসের দ্য মিউজিয়াম অব রাশিয়ান আর্টের শেলডন লুসকিনের সংগ্রহশালা থেকে নেওয়া।

সেকালের ঢাকায় চায়ের প্রসার প্রসঙ্গে ‘ঢাকা কেন্দ্র’-র (শিক্ষা, গবেষণা ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আজিম বখশ একান্ত সাক্ষাৎকারে অত্র নিবন্ধের লেখককে  জানান, বাবা, মাওলা বখশ ছিলেন তৎকালীন ঢাকার বাইশ পঞ্চায়েতের অন্যতম সর্দার। পেয়ার বখশও ছিলেন স্বনামধন্য সর্দার। বাপ-দাদাদের কাছে তিনি শুনেছেন, ১৯২০ সালের দিকে চায়ের প্রচারণা হতো ঢোল বাজিয়ে। সাঁতারু ব্রজেন দাসের ফরাশগঞ্জের বাড়ির আঙ্গিনায় প্রচারণার দলটি বসে বাজনা বাজাত আর ফ্রি চা খাওয়াত। সূত্রাপুর বাজারে সে সময় ‘খাঁ সাব’ নামে একজন চা বিক্রি করে বেশ সুনাম কুড়িয়েছিলেন। সেকালে চা-পাতার ঘ্রাণটাও ছিল বেশ। দেশভাগের পর নওয়াবপুরের আমজাদিয়া, আমিনিয়া রেস্তোরাঁয় মালাই চায়ের প্রচলন শুরু হয়। দীর্ঘ সময় ধরে দুধ-চিনির মিশ্রণকে ঘনীভূত করে এই চা তৈরি হতো। পঞ্চাশের দশকে বাংলাবাজারের মোড়ে মেহেরবান রেস্টুরেন্ট চা বিক্রিতে খ্যাত হয়েছিল। এ ছাড়া ঢাকাইয়া পরিবারগুলোতে পনিরের চায়ের প্রচলন ছিল। কাশ্মীরিসহ হরেক রকমের চা পাওয়া যেত নওয়াব বাড়িতে। চায়ের সঙ্গে তাঁরা ব্যবহার করতেন জাফরান।

শিক্ষাবিদ হাফিজ জি এ সিদ্দিকী ‘ঢাকা যেভাবে চা পানে আসক্ত হলো’ নিবন্ধে লিখেছেন, ব্রিটিশ কোম্পানির কর্মকর্তা খুরশিদ আলীকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল ঢাকাবাসীকে বিনা মূল্যে চা খাওয়ানোর। সহযোগীদের নিয়ে তিনি তৎকালীন ঢাকার সূত্রাপুর, কোতোয়ালি ও লালবাগ থানায় চায়ের প্রচারসংক্রান্ত কাজগুলো তত্ত্বাবধান করতেন। প্রসারের দায়িত্ব পালন করেন। নিয়োগকৃত ‘চা-ওয়ালা’ বিকেলবেলায় নিয়মিতভাবে রাস্তার ধারে চা তৈরির সরঞ্জাম নিয়ে বসতেন। পরিবারের সবার জন্য চা সংগ্রহ করতে অনেকেই চাওয়ালার কাছে পাত্র নিয়ে যেতেন। একবার চা পানের আসক্তি হয়ে গেলে ঢাকাইয়ারা এর অভাব বোধ করবে, ব্রিটিশদের এ ধারণা সঠিক প্রমাণিত হয়েছিল যখন বিনা মূল্যে চা পরিবেশনের কার্যক্রমটি প্রত্যাহার করা হয়। তারা মহল্লার বড় কিছু মুদি দোকানে খোলা ও প্যাকেটজাত চা সরবরাহ করতে শুরু করে। ব্রুক বন্ড ছিল তখনকার সময়ে অন্যতম চায়ের ব্র্যান্ড।

১৯৪৪ সালে ‘যুগান্তর’ পত্রিকায় প্রকাশিত এ বিজ্ঞাপন। ব্রুক বন্ড চা কোম্পানির বিজ্ঞাপনে ব্যবহৃত সুবোধ বসুর তোলা একটি ভারতীয় পার্সি পরিবারের ছবি। গৌতম ভদ্রের লেখা ‘ফ্রম এন ইমপেরিয়াল প্রোডাক্ট টু এ ন্যাশনাল ড্রিংক’ শীর্ষক গ্রন্থ (২০০৫) হতে ছবিটি নেওয়া।

১৯৪৪ সালে ‘যুগান্তর’ পত্রিকায় প্রকাশিত এ বিজ্ঞাপন। ব্রুক বন্ড চা কোম্পানির বিজ্ঞাপনে ব্যবহৃত সুবোধ বসুর তোলা একটি ভারতীয় পার্সি পরিবারের ছবি। গৌতম ভদ্রের লেখা ‘ফ্রম এন ইমপেরিয়াল প্রোডাক্ট টু এ ন্যাশনাল ড্রিংক’ শীর্ষক গ্রন্থ (২০০৫) হতে ছবিটি নেওয়া।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. শাহেদ হাসান সেকালে চায়ের প্রেক্ষাপট প্রসঙ্গে স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে বলেন, কোম্পানি আমলের শেষ দিকে ঢাকায় যখন চায়ের প্রসার ঘটেনি, তখন এখানে পানীয় হিসেবে ঘোল, মাঠা ও দুধের প্রচলন ছিল। মহল্লা মহল্লায় তখন আখড়া (ব্যায়ামাগার) ছিল। এর কাছেই সাধারণত দুধের দোকান গড়ে উঠত। গোয়ালনগর থেকে পুরো ঢাকা শহরে দুধ সরবরাহ হতো। অনেকে বাড়িতে গাভি পালতেন। মৌসুম ভেদে গুড়ের রস, আখের রস, বেলের রস ও তোকমার শরবত ছিল জনপ্রিয় পানীয়। নওয়াবদের আগমনের পর জনপ্রিয় হলো লাচ্ছি ও বোরহানি। ফুলবাড়িয়ার মোড় হতে সদরঘাট পর্যন্ত চায়ের প্রচারণা শুরু করেছিল ব্রিটিশরা। মাটির পাত্রে ঢেলে তারা গরম চা বিতরণ করত। ঘোড়ার গাড়ি, ঠেলাগাড়িকে সাজিয়ে এবং ব্যান্ড বাজিয়ে তারা জনসাধারণের দৃষ্টি আকর্ষণ করত। শুরুর দিকে তেমনটা সাড়া পায়নি। পেনসিল, ক্যালেন্ডারের মতো ছোট ছোট উপহার যখন দিতে শুরু করল, তখন জনতার ভিড় বাড়ল। তত দিনে বিনে পয়সা থেকে বিক্রির বাজার উন্মুক্ত হলো। ক্রমে দুধের দোকানগুলো পরিণত হলো চায়ের দোকানে।

১৯৭০-এর নির্বাচনে বেতার ও টেলিভিশন ভাষণের আগে চা পানরত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ছবিটি প্রখ্যাত ফটো সাংবাদিক প্রয়াত লুৎফর রহমানের তোলা।

১৯৭০-এর নির্বাচনে বেতার ও টেলিভিশন ভাষণের আগে চা পানরত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ছবিটি প্রখ্যাত ফটো সাংবাদিক প্রয়াত লুৎফর রহমানের তোলা।

দেশভাগের পর ১৯৫১ সালে গঠিত হয় পাকিস্তান টি বোর্ড। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন সেই চা বোর্ডের প্রথম বাঙালি চেয়ারম্যান। রাষ্ট্রীয় উপহার হিসেবে চা প্রেরণের উজ্জ্বল স্বাক্ষর রেখেছেন তিনি। ১৯৭৩ সালের অক্টোবরে আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে আরবদের সমর্থনে মিসরকে বিমানভর্তি চা পাঠান। মিসরের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত ফিরতি উপহার হিসেবে বাংলাদেশকে ৩২টি ‘টি-৫৪’ ট্যাংক আর ৪০০ রাউন্ড ট্যাংকের গোলা উপহার দেন। নব্বই দশকে রপ্তানি পণ্য হিসেবে আমাদের চা বিশ্বের মাঝে ছিল পঞ্চম। ২০১৯ সালে এসে সেই রপ্তানিনির্ভরতা পুরোপুরি আমদানিনির্ভরতায় পরিণত হয়েছে।

রপ্তানি কমার কারণ কিন্তু উৎপাদন কম হওয়া নয়। চা উৎপাদন আগের তুলনায় অনেক বাড়লেও অভ্যন্তরীণ চাহিদা বেড়েছে তার চেয়ে বহুগুণ। বাংলাদেশ চা বোর্ড ২০১৬ থেকে ২০২৫ সাল অবধি ১০ বছরের যে সম্ভাব্য চা উৎপাদন, অভ্যন্তরীণ ভোগ, রপ্তানি ও আমদানির প্রক্ষেপণ তৈরি করেছে সেখানে দেখা যায়, ২০২৫ সাল নাগাদ আমদানি করা চায়ের পরিমাণ দাঁড়াবে রপ্তানির প্রায় ৪৪ গুণ! জাতীয় অর্থনীতির জন্য যা বিরাট অশনিসংকেত। ব্রিটিশদের চালু করা বিনে পয়সার চা খেতে খেতে আমরা ক্রমেই পাক্কা চা-খোর জাতিতে পরিণত হয়েছি। আমরা চা খাচ্ছি, নাকি চা-ই আমাদের খাচ্ছে?

১০ বছরে (২০১৬-২০২৫) সম্ভাব্য উৎপাদন, অভ্যন্তরীণ ভোগ, রপ্তানি ও আমদানির প্রক্ষেপণ

বছর সম্ভাব্য উৎপাদন মিলিয়ন কেজি (গড়ে ২.৪২% উৎপাদন বৃদ্ধি ধরে) সম্ভাব্য উৎপাদন মিলিয়ন কেজি (গড়ে ২.৪২% উৎপাদন বৃদ্ধি ধরে) রপ্তানির পরিমাণ

(সম্ভাব্য)

আমদানির পরিমাণ     (সম্ভাব্য)
২০১৬ ৬৯.০১ ৮১.৬৪ ০.৫৫ ১২.৬৩
২০১৭ ৭০.৬৮ ৮৫.৯৩ ০.৬০ ১৫.২৫
২০১৮ ৭২.৩৯ ৯০.৪৫ ০.৬৫ ১৮.০৬
২০১৯ ৭৪.১৪ ৯৫.২০ ০.৭০ ২১.০৬
২০২০ ৭৫.৯৪ ১০০.২০ ০.৭৫ ২৪.২৬
২০২১ ৭৭.৭৮ ১০৫.৪৬ ০.৮০ ২৭.৬৮
২০২২ ৭৯.৬৬ ১১১.০০ ০.৮৫ ৩১.৩৪
২০২৩ ৮১.৫৯ ১১৬.৮৩ ০.৯০ ৩৫.২৪
২০২৪ ৮৩.৫৭ ১২২.৯৭ ০.৯৫ ৩৯.৪০
২০২৫ ৮৫.৫৯ ১২৯.৪৩ ১.০০ ৪৩.৮৪

উৎস: বাংলাদেশ চা বোর্ডের রোড ম্যাপ

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত