দশ প্রান্তের দশটি রূপকথা

Reading Time: 4 minutes

সবার কথাই সত্য হতে পারে। কিন্তু অলীক কাহিনী কারো সত্য বলে গণ্য হয় না। আবার মিথলজি কারো না কারো কাছে সত্য মনে হয়। এটা আসলে সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় বা জাতি-গোত্রের কাছে সত্য বলে গণ্য হতে পারে। বিজ্ঞান বলতে পারে এই পৃথিবী কিভাবে কাজ করে। কিন্তু মিথ আরো বেশি বলতে পারে- এটা কেন এভাবে কাজ করে। একেক সংস্কৃতি-জাতি বা ধর্মের আলাদা আলাদা মিথলজি রয়েছে। একটির মিথ অন্যদের কাছে গ্রহণযোগ্য পায় না। কিন্তু মিথলজির প্রতি আগ্রহ সবারই কম-বেশি রয়েছে। এখানে জেনে নিন বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের কয়েকটি মিথলজি। এতে বোঝা যায়, মানুষ কিভাবে বিশ্ব ও জীবনটাকে অনুভব করে।

১. নর্স মিথলজি : দেবতাদের রাজা ওডিন এবং আধাত্ম্যবাদকে এগিয়ে নিতে তার আত্মত্যাগের গল্প এটি। ওডিন ছিলেন এইসির গোত্রের প্রদান। পরে তিনি হন যুদ্ধের এবং পৃথিবীর দেবতা। তিনি আকাশ, জ্ঞান, কবিতা ও জাদুর দেবতাও বটে। তিনি উৎকর্ষতার প্রেমিক। অনেক কঠোর, আবার কোমল। ভাইকিং বীরটা তার পৌরষত্বের ভক্ত ছিল। তার একটি চোখ জ্বলজ্বলে। অন্য চোখের কোটরটি খালি। তিনি এটি জ্ঞানের জন্য ত্যাগ করেছিলেন। তিনি যে ঘোড়ায় চড়েন তার ৮টি পা। সঙ্গে থাকে তার দাঁড়কাক এবং নেকড়ে। এরা তাকে নানা তথ্য এনে দেয়। তার আরেকট নাম ওটান, যেখান থেকে ওয়েন্সডে বা বুধবার এসেছে।

২. পশ্চিম আফ্রিকান মিথলজি : স্পাইডার ট্রিকস্টার, যখন কোনো আত্মা পৃথিবীর সব জ্ঞান পেতে চায়। আনানসি মাকড়সারূপে বাস করে। একবার সে গোটা বিশ্ব ঘুরে সব জ্ঞান অর্জন করতে চাইলো। এ কাজে সফল হওয়ার পর সে একটি গাছের একেবার ওপরের একটি কুঠুরিতে আশ্রয় নেওয়া চেষ্টা চালালো। সব জ্ঞান পাত্রে ভরে গাছে চড়তে চাইলো সে। ছেলে বুদ্ধি দিলো, পাত্রটি পিঠে বেঁধে গাছে চড়তে। কিন্তু তা করতে গিয়ে পাত্রটি মাটিতে পড়ে যায়। এটা নদী এবং সেখান থেকে সমুদ্রে মিশে যায়। সেখান থেকেই জ্ঞানের কিছু কিছু সবাই পেয়েছেন।

৩. গ্রিক মিথলজি : নারীদের সৌন্দর্যের প্রতিযোগিতা যুদ্ধ ঘটিয়ে দিলো। পেলেউস এবং থেটিসের বিয়েতে আমন্ত্রিত হলেন সকল অলিম্পিয়ান দেবতা। কিন্তু নিমন্ত্রণ পেলেন না অনৈক্যের দেবতা এরিস। ক্ষোভে দেবতাদের শিক্ষা দিতে চাইলেন এরিস। তিনি অলিম্পিয়ানদের উদ্দেশ্যে একটি সোনার আপেল ছুঁড়ে দিলেন যাতে লেখা সবচেয়ে সুন্দরী রমনীর জন্য। এই আপেলের যোগ্য বলে দাবি করলেন হেরা, অ্যাথেনা এবং আফ্রোদিতি। তিনজনের মধ্যে কে বেশি সুন্দর তা বিচার করার সাহস খোদ জিউসও রাখতেন না। অবশেষে তাদের পাঠানো হলো ট্রয়ে। তারা সেখানে প্রিন্স প্যারিসকে তাদের সৌন্দর্য দিয়ে ভোলানোর চেষ্টা করলেন। একেকজন একেক লোভ দেখালেন। আফ্রোদিতি তাকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরী হেলেনকে উপহার দিতে চাইলেন। এই প্রস্তাব গ্রহণ করলেন প্যারিস। আর তখন থেকেই হেরা ও অ্যাথেনার রোষানলে পড়লো ট্রয়। তারাই ঘটালেন ট্রোজান ওয়ার।

৪. সুমেরীয় মিথলজি : আন্ডারওয়ার্ল্ডের গ্যাংয়ে যুদ্ধগুলো ধারণার চেয়ে পুরনো। দুই বোন একে অপকে দেখতে পারতেন না। একজন পৃথিবী শাসন করতেন যার নাম ইনানা। আরেকজন এরেশকিগাল, তিনি শাসন করতেন মৃতদের দেশ  আন্ডারওয়ার্ল্ড। একবার ইনানা আন্ডারওয়ার্ল্ড দেখতে চাইলেন। তিনি মিথ্যা কারণ দেখিয়ে প্রবেশ করতে চাইলেন। আসলে তার ইচ্ছা ছিল তা দখল দেওয়া। কিন্তু বিভিন্ন কারণে সন্দেহ তৈরি হয় বোনের। তবে শর্তের ভিত্তিতে ইনানা তার দেহের পোশাক ও গয়না খুলতে খুলতে একের পর এক দরজা পার হতে থাকলেন। যখন বোনের সামনে উপস্থিত হলে তখন তিন নগ্ন। এরেশকিগাল তাকে মৃত বানিয়ে ঝুলিয়ে রাখলেন। সেখানে ইনানাকে বাঁচাতে আসলেন তার স্বামী ডুমুজি। পরে ঘটনাক্রমে এমন হয় যে, ডুমুজি আধা বছর এরেশকিগালের সঙ্গে এবং বাকি সময় ইনানার সঙ্গে কাটান।

৫. জাপানি মিথলজি : একজন প্রেমময় স্বামী তার স্ত্রীর খোঁজে মৃতদের দেশে চলে গেলেন। পৃথিবীর প্রথম মানব-মানবী যথাক্রমে আইজানাজি এবং আইজানামি। ঘটনাক্রমে আইজানামি মারা গেলেন। আইজানাজি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলেন যে স্ত্রীকে ফিরিয়ে আনবেন। তিনি চলে গেলেন মৃতদের দেশ ইয়োমিতে। কিন্তু আইজানামি সে দেশের ফল ভুল করে খেয়ে ফেলেছেন। তাই আর ফিরতে পারবেন না। একটি আলো জ্বেলে সেখানে স্ত্রীকে খুঁজকে থাকলেন আইজানাজি। যখন দেখলেন ভয় পেয়ে গেলেন। তার দেহ ক্ষয়ে গেছে। পালালেন স্বামী। কিন্তু আইজানামি চাইলেন স্বামী তার সঙ্গে থাকুক। কিন্তু পালালেন স্বামী। স্ত্রী ক্ষোভের সঙ্গে বললেন, আমি প্রতিদিন ১০০০ মানুষ মেরে ফেলবো। তখন আইজানাজি বললেন, আমি প্রতিদিন ১৫০০ নতুন মানুষ সৃষ্টি করবো।

৬. আব্রাহামিক মিথলজি : অ্যাডাম, ইভ, একটি আপেল এবং সাপের গল্প। দেবতা ছয় দিনে পৃথিবী সৃষ্টি করে সপ্তম দিন থেকে একে স্থিত করলেন। প্রথম পুরুষ সৃষ্টি করলেন যার নাম অ্যাডাম। গড়লেন প্রথম নারী ইভ। ইডেনের বাগান উপভোগ করতে বললেন দুজনকে। কিন্তু একটি নিষিদ্ধ ফল খেতে মানা করলেন। এতে আগ্রহ বাড়লো ইভের। তিনি অ্যাডামকে ওই ফল খাইয়ে দিলেন। এটা খাওয়ার পরই তাদের পবিত্রতা চলে গেলো। কষ্ট পেলেন দেবতা। তাদের পাঠিয়ে দিলেন পৃতিবীতে।

৭. পলিনেশিয়ান মিথলজি : বড় ভাই সব সময়ই ঠিক। টারাঙ্গার পঞ্চম সন্তান ছিলেন মায়ুই। অনেকে বলেন তিনি মৃত জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাকে বলা হতো, সে দুর্ভাগ্য বয়ে এনেছে। এসব শুনে তার মা তাকে একটি সমুদ্রে ফেলে দেন। সমুদ্র তাকে মারেনি। তার দেখভালে দায়িত্ব দেয় আকাশের পিতা রাঙ্গির কাছে। একদিন মায়ুই তার মায়ের একটি চুল খুঁজে পান এবং চিনতে পারেন এটা তার মায়ের চুল। কিন্তু সে মা তারাঙ্গা এবং পালক বাবার দুনিয়া থেকে বাইরে যেতে চাইতেন। ভাইদের সহায়তায় তিনি সূর্যকে ফাঁসে বন্দি করে তাকে বেধড়ক পেটান। যাতে করে সূর্য ভবিষ্যতে ধীরে ধীরে সময় এগিয়ে নেয়।

৮. মিশরীয় মিথলজি : ভাই-বোনদের হিংসা ও বিশ্বাসঘাতকতার প্রাচীন গল্প। পিরামিডের মতো একটি ঢিপি আর নু এর পানি ছাড়া প্রথমে কিছুই ছিল না। পরে নীল নদে পানি আসার পর পৃথিবী স্পষ্ট হয়। আতুম এক সময় বায়ুর দেবতা শু এবং আর্দ্রতার দেবতা তেফনাতকে সৃষ্টি করেন। তেফনাত বিনিময়ে তৈরি করেন পৃথিবীর দেবতা গেব এবং আকাশের দেবী নুটকে। এই দেবী সৃষ্টি করেন ইসিস এবং অসিরিস। এরা দুজন মানব সভ্যতার প্রথম রাজা-রানি। ইসিসের স্বামী অরিসিস নীলে পাড়ে রাজ্য সাজালেন। কিন্তু তার ভাই এতে হিংসায় জ্বললেন। বুদ্ধি করে তিনি অরিসিসকে একটি বাক্সবন্দি করে তাকে কুচি কুচি করে কেটে নীলে ভাসিয়ে দিলেন। ইসিস তার স্বামীকে খুঁজলেন। তার বিভিন্ন অংশ জোড়া লাগিয়ে জাদু দিয়ে স্বামীকে ক্ষমতা দিলেন একট সন্তান জন্মদানের জন্য। তাদের সন্তান হলো যার নাম হোরাস।

৯. ইনুইট/এস্কিমো মিথলজি : সমুদ্রে যেভাবে জীবনের সৃষ্টি হয় তার গল্প। সেডনা ছিলেন সুন্দরী রমনী। একবার এক সামুদ্রিক পাখি তাকে আরামদায়ক ও বিলাসী বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দিলো। মেয়েটি পাখির সঙ্গে পালিয়ে গেলো। কিন্তু পাখি তাকে নিলো নোংরা ও দুর্গন্ধপূর্ণ পাখির বাসায়। সেডনার নতুন স্বামী তাকে দাসী বানিয়ে দিলেন। বাবাকে অনুরোধ করলেন তাকে নিয়ে যেতে। তারা নৌকায় পালালেন। কিন্তু সামুদ্রিক পাখি তাদের আটকে দিলো। সেডনার বাবা মেয়েকে বাঁচাতে তাকে সমুদ্রে ফেলে দিলেন। সেডনা আবার নৌকায় উঠতে চাইলে বাবা তার আঙুল কেটে ফেললেন। একসময় সেডনা সাগরের নিচে তলিয়ে গেলেন। পরে তার থেকেই সৃষ্টি হলো মাছ, সিল, তিনি এবং সব সাগরের প্রাণী।

১০. ব্যাবিলনের মিথলজি : টিয়ামাত ছিলেন দেবতাদের মা। তার দেহ সন্তানদের মাঝেই বিরাজ করতো। সব ঠিক ছিল। কিন্তু একবার সব সন্তান গোলমাল শুরু করলেন। পুরনো দেবতারা নতুনদের ধ্বংস দাবি করলেন। টিয়ামাত তার সন্তানদের সাবধান করলেন। আবারো ঘটলো। তখন টিয়ামাত নতুনদের ধ্বংস করতে বললেন। কিন্তু নতুনরা রুখে দাঁড়ালেন। টিয়ামাতসহ পুরনো সব দেবতাকে ধ্বংস করলেন মারডুক, এক মারাত্মক যুদ্ধের পর। টিয়ামাতের দেহ থেকে পৃথিবী ও আকাশ বানালেন মারডুক। তার অশ্রু থেকে বানালেন টাইগ্রিস এবং ইউফ্রাতেস। তার রক্ত মাটিতে মিশলে বানালেন মানুষ।

সূত্র : হিন্দুস্তান টাইমস

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>