ভাগ্যের দোষেই বলা যায় বাধ্য হয়ে এক ধনী দম্পতির চার বছর বয়সী বাচ্চার ন্যানী, ভালো বাংলায় যাকে আয়া বলা হয় সেধরনের একটি কাজে যোগ দেই। আমার মায়ের মরণ ব্যাধি হয়েছে। চিকিৎসার জন্য টাকার দরকার। তাঁকে বাঁচাতে পারবো কিনা জানিনা, তবে চিকিৎসার ত্রুটি জনিত কারণে আমার মা মারা যান এ আমি কিছুতেই চাইনা। প্রথমে মা কে জানাতে চাইনি এই কাজের কথা। কিন্তু ন্যানীর সার্বক্ষনিক দায়িত্ব পালন করতে হলে আমাকে সেখানে গিয়েই থাকতে হবে। অনেক চেষ্টা করেছিলাম এ ব্যাপরটি এড়াতে। কিন্তু মিষ্টার ও মিসেস গোমেজ তাতে রাজী নন। বেতনটা মাত্রাতিক্ত লোভনীয়, আর নিজের যা শিক্ষাগত যোগ্যতা, তাতে এমন বেতন পাওয়া সম্ভব না বলে তাদের প্রস্তাবে রাজী হতে হলো।
মা’কে ছেড়ে যেতে হচ্ছে বলেই কাজটির বিষয়ে বলতে হলো। আমার স্বল্পবাক মা তেমন কোন উচ্চবাচ্য করেনি তা শুনে। কিন্তু তার নীরব চোখ জোড়ায় যে ব্যথার ঢেউ খেলে যেতে দেখেছি, সেটা বুকে শেলের মতোই বিঁধে আছে। আমার এক দুসম্পর্কের আন্টিকে মায়ের কাছে রেখে কাজে যোগ দেই। পিউ নামের ছোট্ট মিষ্টি মেয়েটাকে দেখাশোনার দায়িত্ব আমার। এত ছোট্ট বয়সে মেয়েটা এত আদব কায়দা জানে যে মাঝে মাঝে অবাক হতে হয়। জিজ্ঞেস করে জানতে পারি ওর বাবা ওকে এসব বিষয়ে শিক্ষা দিয়ে থাকেন। পিউয়ের বাবার প্রতি আগের চেয়েও বেশি শ্রদ্ধা এসে যায় এতে করে।
কাজে যোগ দেবার দুদিনের মধ্যেই পিউ আমার ভীষণ ন্যাওটা হয়ে যায়। ওর মা মিসেস গোমেজ দুর্দান্ত সুন্দরী বছর পঁচিশের এক তরুণী। আমার চেয়ে বছর ছয়েকের বড়। আরো একটি সন্তানের জন্ম দেবেন বলে অপেক্ষা করছেন। পিউয়ের যেন কিছুতেই অযত্ন না হয় সে কথা পইপই করে আমাকে বলা হয়েছে প্রথম দিনেই। মেয়েটা এত লক্ষী আর বুঝদার যে ওর অযত্ন চাইলেও করা সম্ভব না। মাঝে মাঝে আমার খুব ইচ্ছে করে পিউকে অনেকক্ষণ বুকে চেপে ধরে রাখি। অবাক হয়ে একটা সময় লক্ষ্য করলাম পিউয়ের মতো একটা সন্তানের কামনা আমার ভেতরে দানা বাঁধছে। নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে এভাবে ভাবনাটা আসেনি কখনো। আসলে অভাব অনটনে এতটাই জেরবার হতে হয়েছে বাবা মারা যাবার পর আমাকে আর মাকে, যে ভবিষ্যৎ বলে কিছু আছে সেটাই ভুলে গেয়েছিলাম। বর্তমানের ভুলভুলাইয়াতেই ঘুরপাক খেয়েছি কেবল।
পিউয়ের বাবা মিঃ গোমেজ স্বল্পভাষী এবং ভীষণ অমায়িক একজন মানুষ। এত মোলায়েম ভঙ্গিতে তিনি কথা বলেন তাতে মনে হয় তিনি যেন সর্বক্ষণই সর্তক থাকেন তার বিন্দুমাত্র রূঢ় শব্দের আঘাতে কেউ যেন আহত না হয়ে বসে। মাঝে মাঝে দোতলার করিডোর থেকে আমি উঁকি দিয়ে ওদের গল্পরত অবস্হায় দেখি। ওদের দু’জনের চেহারা, ব্যবহার, সব কিছুতেই প্রচণ্ড রুচির ছাপ। তাদের ব্যবহারের কারণেই আমাকে বিন্দুমাত্র অস্বস্তিতে থাকতে হয়নি কাজটা নিয়ে। বাবা বেঁচে থাকতে আমাদের বাড়িতেও কাজের লোক এসে কাজ করে যেত, এমন ভাবনা যে কারণে আর হীনমন্যতা ছড়াতে উৎসাহ পায়নি।
সপ্তাহ দুয়েক পর একদিন রাতে পিউ কে ঘুম পাড়িয়ে নিজের জন্য নির্দিষ্ট ঘরে চলে আসি। সারাদিনের পরিশ্রমের ক্লান্তি আমাকে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই ঘুমে তলিয়ে যেতে সাহায্য করে। রাত তখন ঠিক ক’টা বাজে জানি না। হঠাৎ সম্পূর্ণ অপরিচিত এক স্পর্শে চমকে উঠি। আলোআধারিতে একটা মুখ আমার মুখের কাছে ফিসফিসিয়ে কিছু বলছে। মাথাটা চক্কর দিয়ে ওঠে। প্রথমে দুঃস্বপ্ন দেখছি ভেবেছি। কিন্তু একটা উষ্ণ নিঃশ্বাসে পুড়ে যেতে যেতে বুঝলাম স্বপ্ন নয় সত্যি! এরপর প্রায় প্রতি রাতেই মিঃ গোমেজ আসতে শুরু করলেন আমার ঘরে। সত্যি বলতে কী, আমিও একটা পর্যায়ে গিয়ে রাতের ঐ সময়টার জন্য অপেক্ষা করা শুরু করলাম। দিনের আলোতে আমার পক্ষে যা পাওয়া কখনোই সম্ভব না রাতের অন্ধকারে সেটা অনায়াস হয়ে যাওয়াতেই যেন আমার সব উৎসাহ। ভালো মন্দের বিচারবুদ্ধি আমার তখন পুরোপুরিই লোপ পেয়েছে।
দেড় মাসের মাথায় টের পেলাম আমার ভেতরে ছোট্ট একটা পিউয়ের অস্তিত্ব। কোন রকম পরীক্ষা নিরীক্ষা ছাড়াই আমি কেমন স্হির সিদ্ধান্তে এসে গেলাম ভ্রুণটি কন্যা সন্তানের। আর সে দেখতেও হবে অবিকল পিউয়ের মতো। এই ভাবনাটা আমাকে কেমন এক অসম্ভবের ছবি আঁকতে প্রলুব্ধ করে রাখছে সারাক্ষণ। মায়ের কাছে ভয়ে যাওয়া ছেড়েই দিলাম প্রায়। মা ঠিক ধরে ফেলবেন আমার এই অধঃপাত! অসুখে মারা যাবার আগেই হয়ত তিনি মারা যাবেন। যে কারণে মানি অর্ডারেই টাকা পাঠিয়ে দায়িত্ব পালন শুরু করে দেই। গত পরশু মিসেস গোমেজ আরেকটি কন্যার জন্ম দিয়েছেন। আরো দিন দুয়েক পর বাড়ি ফিরবেন নার্সিংহোম থেকে। ঠিক করি আজই জানাবো মিঃ গোমেজ কে।
আমি ঠিক নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। আসলে আমার এই ব্যাপারটি মেনে নেয়া যে কারো জন্যই অসম্ভব, এই বোধটুকুই তখন আমার মধ্যে ছিল না। নিজের একটা অবাস্তব স্বপ্নকে মুঠোয় পুরে আমি তাই বেপোরয়ার মতো ব্যবহার শুরু করলাম। কিছুতেই মানতে রাজী হচ্ছি না মিঃ গোমেজের লোভনীয় প্রস্তাব।
ওর কথা মতো যদি ভ্রুণটিকে নষ্ট করে ফেলি তবে টাকার জন্য বাকী জীবনটাতে সেরকম ভাবতে হবে না। অত্যন্ত মমতা ভরেই তিনি জানালেন, তিনি তার স্ত্রীকে সত্যিই খুব ভালোবাসেন নইলে আমার ব্যাপারে একটা সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন। তাতে হয়ত আমি তার সন্তানের গর্বিত মা হতে পারতাম। ‘যে জন্মের স্বীকৃতি নেই সেটা তো কোনভাবেই সম্মানের নয় বলো তুমি?’ তার এমন কথার কোন জবাব হতে পারেনা। আমি মিঃ গোমেজের একটা কথাও অবিশ্বাস করতে পারিনা। তার আন্তরিকতায় যেন কোন ভনিতা নেই।
রাত এখন অনেক গভীর। এমনই কোন এক রাতের গভীরে আমার সন্তানটির জন্মের সূচনা হয়েছিল। যে সন্তানকে পৃথিবীতে আনতে হলে অনেক অনেক বাধা পেরোতে হবে, আর সেসব বাধা অতিক্রমের মতো শক্তি বা সাধ্য কোনটিই আমার নেই। তাই ঠিক করে ফেলি, যে পৃথিবীতে আমার সন্তান আসতে পারবে না, সেখান থেকে আমারও বিদায় নেয়া উচিৎ। শেষবারের মতো মা’কে খুব দেখতে ইচ্ছে করে। চোখ বুঁজে মায়ের মুখ স্মরণ করি। ব্যথাভরা একটা বিষন্ন মুখ ভেসে ওঠে। অজান্তেই পেটের ওপর হাত রাখি। নিজের ভেতরে একটা ছোট্ট পিউয়ের অস্তিত্ব অনুভব করতে করতে, মিঃ ও মিসেস গোমেজের প্রসাদসম বাড়ির চারতলার ছাদ থেকে ঝাপিয়ে পড়ি নীচে। যেখানে হামুখো অন্ধকার একটা খাদ ওৎ পেতে আছে আমাকে খাবে বলে।
নাহার তৃণা। জন্ম ২ আগস্ট ঢাকায়। বর্তমানে ইলিনয়ে বসবাস। মূলত গল্প লেখায় ঝোঁক। পাশাপাশি অনুবাদ, প্রবন্ধ, সিনেমা, সাহিত্য সমালোচনা লিখে থাকেন। দুই বাংলার বিভিন্ন সাহিত্যপত্রিকা এবং ওয়েবজিনে নিয়মিত লিখছেন। একুশে গ্রন্থমেলা ২০২০-এ ‘পেন্সিল পাবলিকেশনস প্রতিভা অন্বেষণে তার ‘স্টুডিও অ্যাপার্টমেন্ট’ সেরা গল্পগ্রন্থ নির্বাচিত হয়। একই বছর অন্বয় প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয় ‘এক ডজন ভিনদেশি গপ্পো’। সম্পাদিত গ্রন্থ: ‘গল্পের পুষ্পিত কুঞ্জ’(২০২১, বইয়ের হাট প্রকাশনী), ‘গল্পপাঠ নির্বাচিত জাপানি গল্প সংকলন’(যৌথ সম্পাদনা, ২০২২, কবি প্রকাশনী)। প্রকাশিতব্য অনুবাদ গল্প সংকলন, ‘দূরদেশের গল্প(২০২২, চৈতন্য প্রকাশনী)’।