Categories
ছোটবেলার বড় কষ্ট
আনুমানিক পঠনকাল: 7 মিনিট
ঘোর সন্ধ্যায় এক প্রবীণের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। তাঁর বয়স তখন সত্তরের বেশি, আমার ত্রিশ-বত্রিশ। কথা জমে উঠল অল্প সময়ের মধ্যেই। বুঝলাম, বেশ আলাপী মানুষ। কে আমার বাবা, কে আমার মা, কে আমার দাদা, কে আমার নানা, এইসব জিজ্ঞেস করতে করতে একসময় বলে উঠলেন, আরে তোমার বাবাকে আমি চিনি। তোমার নানাকে আমি চিনি। তোমার মায়ের নাম কি লুৎফা?
যদিও আমার মায়ের নাম লুৎফা নয়, কিন্তু আমি বুঝলাম, তিনি আমায় যথার্থই শনাক্ত করে ফেলেছেন। কারণ এই মহীয়সী লুৎফাকে আমি চিনতাম,তাঁকে কোনোদিনও না দেখেই । জ্ঞান হওয়ার পর থেকে কত বার যে শুনেছি তাঁর কথা! তিনি আমার নানা-নানির অর্থাৎ দাদু -দিদিমা’র প্রথম সন্তান ছিলেন। তবে পৃথিবীর রূপ দীর্ঘদিন ধরে ও ভালোভাবে দেখার সুযোগ তিনি পাননি। তিনি ছিলেন অকালে ঝরে যাওয়া এক ফুল।
ছোটোবেলায় যতটা মনে পড়ে তার সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয়েছিল নানির ঘরে। এটাই ছিল ও-বাড়ির সবচেয়ে বড়ো ঘর। তবে ঘর না বলে হলঘর বা মিলনায়তন বলাই ভালো। আজকালকার বাড়িতে অত বড়ো ঘর থাকে না।থাকা অবশ্য সম্ভবও নয়। কারণ অমন একটা ঘর বানানোর বদলে ওই জায়গাটুকুতেই একটা ফ্ল্যাটবাড়ি বানিয়ে ফেলা সম্ভব। তো যাহোক, কেমন করে দেখা হয়েছিল সেটাই বলতে চাইছি। কারণ তাঁর জন্ম হয়েছিল আমার পৃথিবীতে আবির্ভাবেরও ঢের আগে।
তাঁর একটা জায়গা ছিল ওই ঘরে। আরও স্পষ্ট কথায় বলা যায়, ওই ঘরের উত্তর দিকের দেয়ালে। জায়গাটায় তিনি সবসময় থাকতেন। তাঁকে দেখতে কোনো বিধিনিষেধ ছিল না। যে কেউ যখন তখন দেখা করতে পারত তাঁর সঙ্গে। কারণ তিনি তখন ছবি হয়ে গিয়েছিলেন। সেই ছবিটাই ঝোলানো থাকত দেয়ালে। সাদা-কালো ছোটো একটা ছবি (তখন অবশ্য রঙিন ছবি কী জিনিস তা আমরা জানতাম না)। শাড়ি পরে দাঁড়িয়ে থাকা ছোট্ট একটা মেয়ের ছবি ছিল সেটা। খুব ছোটোবেলায় ওই ছবি দেখিয়ে তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়েছিল। কে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন তা মনে নেই। খুব সম্ভব আমার কোনো মামা বা খালা হবেন। সেই থেকে আমি তাঁকে চিনি। তিনি আমার বড়ো খালা। আমার নানা-নানির প্রথম সন্তান।
বিংশ শতকের ষাটের দশকের কথা। আমি তখন বেশ ছোটো। একদিন নানিকে জিজ্ঞেস করলাম, বড়ো খালা কেমন করে মারা গেছেন? প্রশ্নটা শুনে কয়েক মুহূর্ত থমকে দাঁড়িয়ে রইলেন তিনি। তারপর হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন। কাঁদতে কাঁদতেই বললেন, অসুখ হয়েছিল। কিন্তু চিকিৎসা ছিল না। মেয়েটা আমার মরে গেল…
তারপর তাঁর সে কী কান্না ! আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। বারবার মনে হতে লাগল, কেন আমি এমন প্রশ্ন করে নানির মনে কষ্ট দিতে গেলাম। আমি জিজ্ঞেস না করলে তো তাঁর মনে পড়ে যেত না মেয়ের কথা। সেই প্রথম আমি বুঝলাম, আপনজনের মৃত্যু কী ভয়ংকর কষ্টের ব্যাপার! জলজ্যান্ত একটা মানুষ হঠাৎ করেই নেই হয়ে যায়। তাছাড়া নিজ সন্তানের মৃত্যুর কথা মা কোনোদিনও ভুলতে পারেন না। যত আগেকার কথাই হোক, মা-বাবা কখনো সন্তানের কথা ভুলতে পারেন না। সেই থেকেই জীবন আর মৃত্যুর মধ্যে বিভেদরেখাটা কোথায় তা’ও আস্তে আস্তে স্পষ্ট হতে শুরু করল আমার সামনে। মরে গেলে যে মানুষ হারিয়ে যায় চিরতরে সেই কথাটা গভীরভাবে দাগ কাটল মনে। মনের গহিনে প্রথমবারের মতো অন্যরকমের একটা কষ্ট অনুভব করলাম। বড়ো খালার প্রতি অন্য রকমের ভালোবাসা জেগে উঠল মনে। মনে হলো, তিনিও তো আমায় অন্য মামা-খালাদের মতো ছবির বই, ছড়ার বই, গল্পের বই, ছোটদের পত্রিকা কিনে দিতেন। হয়তো একটু বেশিই আদর করতেন।
মায়ের কাছে শুনলাম, আমার সেই বড় খালার মৃত্যু হয়েছিল ব্রিটিশ আমলে। তখনো চিকিৎসা ছিল না বহু রোগের। তাঁর সম্ভবত টাইফয়েড হয়েছিল।
নানা খুব প্রভাবশালী মানুষ ছিলেন। ১৯১১ সালে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছিলেন। এই বিশ্ববিদ্যালয়টি গোটা ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়। ১৮৫৭ সালের ২৪ শে জানুয়ারি তারিখে এটি যাত্রা শুরু করেছিল। তিনি যখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যান তখনো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়নি, এমনকি প্রতিষ্ঠিত যে হবে তারও কোনো সম্ভাবনাও স্পষ্ট হয়নি। বর্তমান বাংলাদেশ ভূখণ্ডে তখন কলেজ খুঁজতেই অণুবীক্ষণ যন্ত্রের দরকার হতো। বিশ্ববিদ্যালয় তো একটাও ছিল না। তাই তাঁকে কলকাতায় যেতে হয়েছিল। তবে সেই যাওয়া তাঁর জন্যে অনেক সুযোগ এনে দিয়েছিল। প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র থাকাকালে ১৯০৫ থেকে ১৯১১ সাল পর্যন্ত কার্যকর থাকা বঙ্গভঙ্গ বিরোধী তুমুল আন্দোলন হয়েছিল কলকাতায়। কলকাতা শহরে বড়ো বড়ো শোভাযাত্রা হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত রদও হয়েছিল বঙ্গভঙ্গ। এর মাধ্যমে পূর্ববঙ্গ ও আসাম নামের ১৯০৫ সালে গঠিত নতুন প্রদেশটির আর অস্তিত্ব থাকল না। সেই নবগঠিত প্রদেশের রাজধানী হয়েছিল ঢাকা। এর আগে মুঘল আমলে ১৬১০ সালে ঢাকা প্রথম বারের মতো গোটা বাংলার রাজধানী হয়েছিল (এর সিদ্ধান্তটা অবশ্য আরও আগে, ১৬০৮ সালে হয়েছিল)। বঙ্গভঙ্গের মাধ্যমে ১৯০৫ সালে ঢাকা হলো দ্বিতীয় বারের মতো রাজধানী। ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ হওয়ায় কলকাতা হলো গোটা বাংলার রাজধানী। তবে ১৯১১ সাল পর্যন্ত কলকাতা ছিল অবিভক্ত ভারতের (বর্তমান বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তান) রাজধানী। ভাবা যায়? অবশ্য ১৭৯৮ সালের পর থেকে তৎকালীন সিলন (এখনকার শ্রীলঙ্কা) আলাদা ক্রাউন কলোনি হিসেবে (১৮২৬ থেকে ১৮৯৬ সাল পর্যন্ত সিলন ছিল ভারতের মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির অন্তর্ভুক্ত ) ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত থাকায় কলকাতার অধীনে তা ছিল না। তবে বার্মা ( বর্তমান মিয়ানমার) ১৯৩৭ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশ ভারতের প্রশাসনের অন্তর্ভুক্ত ছিল (১৮৮৬ সালের দিকে ইংরেজরা বার্মাকে পুরোপুরি কব্জায় নিয়ে নিতে পেরেছিল)। ইংরেজরা ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটো আলাদা দেশে ভারতবর্ষকে বিভক্ত করে স্বাধীনতা প্রদান করে। ১৯১১ সালে কলকাতা থেকে ভারতের রাজিধানী দিল্লিতে চলে গিয়েছিল। ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্ট স্বাধীনতার পরেও দিল্লিতেই রইল রাজধানী। এর ছয় মাসের মধ্যেই বার্মা (মিয়ানমার ; ৪ঠা জানুয়ারি, ১৯৪৮) ও সিলন (শ্রীলঙ্কা; ৪ঠা ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৮) ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা পেয়েছিল। তো, আমার নানা বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের সময় কলকাতায় অবস্থান করে তা প্রত্যক্ষ করেছিলেন এবং স্বদেশী আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। হাটে-বাজারে গিয়ে কাপড়সহ অন্যান্য বিলেতি জিনিস পোড়ানোর কাজেও অংশ নেন।
তো, নিজের মেয়ের অসুস্থতার সেই সময়ে শহরের সবচেয়ে নামকরা মানুষদের একজন ছিলেন নানা। তাঁর টাকাপয়সারও কোনো অভাব ছিল না। মেয়েকে সুস্থ করার জন্যে অসহায় বাবা হিসেবে তিনি ছোটাছুটি করেছিলেন অস্থির হয়ে। কিন্তু বাঁচাতে পারেননি। নিরুপায় মা-বাবার সামনে চিকিৎসা না পেয়ে কাতরাতে কাতরাতে মৃত্যু হলো মেয়েটার। সদ্য ক্লাস নাইনে উঠেছিল সেই কিশোরী মেয়েটি।
আরও এক সন্তানের কথা মনে করে নানিকে বহুদিন কাঁদতে দেখেছি। তাঁর নাম আবদুল হাই। দেখতে যেমন সুদর্শন ছিলেন, তেমনি ছিল তাঁর মেধা। মৃত্যুর দিন নানার কোলে বসে নাকি বলেছিলেন, বাবা যাই।
তারপর সেখানেই ঢলে পড়েছিলেন। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই তিনি জীবন সাগর পাড়ি দিয়ে ঠাঁই নিয়েছিলেন মরণ তীরে। এই ঘটনাও ঘটেছিল ব্রিটিশ আমলে। তবে ষাটের দশকে মৃত্যুর আরও দুটো ঘটনা আমার মনে রেখাপাত করেছিল। আর সত্তরের দশকের প্রথম দিকে আমার দাদার মৃত্যু হয়েছিল। টেলিগ্রামে খবরটা এসেছিল। খবরটা শুনে আমার বাবা খুব ভেঙে পড়লেন। তবে প্রথমে শোকে পাথর হয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু পরে আমার মাকে দেখামাত্র শিশুর মতো হু-হু করে কাঁদতে লাগলেন। আমাদের বাসায় তখন বেড়াতে এসেছিলেন বাবার একমাত্র খালাতো অর্থাৎ মাসতুতো বোন, আমাদের নাইমা ফুপু (অর্থাৎ পিসি)। মাস্টার্স পরীক্ষা শেষে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এসেছিলেন। মা এবং ফুপুও কান্নায় যোগ দেয়ায় বেদনায় ভারি হয়ে উঠল পুরো বাড়ির পরিবেশ। এমনিতে প্রশাসক হিসেবে বাবা ছিলেন খুব কড়া মানুষ। শাসনটা মনে হতো একেবারে মিলিটারি শাসনের মতো কিন্তু সেটা ছিল নারকেলের মতো। বাইরের আবরণটা কঠিন ও দুর্ভেদ্য হলেও ভেতরে ছিল জলের ধারা। একেবারে শিশুর মতো মন। তবে বাইরে থেকে বোঝার উপায় ছিল না কিছুই। তাই আমরা শুধু তাঁর কঠিন দিকটারই দেখা পেতাম। বুঝতে পারতাম না যে সেটা আমাদের ভালোর জন্যেই। তো, এই রাশভারি মানুষটিই কেঁদে বুক ভাসাতে লাগলেন একেবারে শিশুর মতোই। আমার স্পষ্ট মনে আছে, আমরা তখন সরকারি বাসায় থাকি। দোতলা-নিচতলা মিলিয়ে ছিল বাসা। তিনি ভেতরের উঠোন সংলগ্ন নিচতলার বারান্দার দেয়ালে মাথা ঠুকছিলেন। এর আগে মায়ের কঠিন অসুখের সময় তাঁর গভীর উৎকন্ঠা দেখেছি। কিন্তু এভাবে কাঁদতে তাঁকে দেখিনি কখনো। দাদার মৃত্যুর ঘটনাটাও আমার কিশোরকালের এক গভীর দুঃখের স্মৃতি। দাদার বয়স প্রায় নব্বই হয়েছিল। তিনিও খুব প্রভাবশালী মানুষ ছিলেন। তিনি আমাকেও চিঠি লিখতেন। আমার নানা এবং দাদা দুজনেরই হাতের লেখা ছিল মুক্তোর মতো ঝকঝকে। তাঁরা দুজনেই পাঁচটি করে ভাষা জানতেন। সেই ভাষাগুলো ছিল-বাংলা, ইংরেজি, আরবি, উর্দু ও ফারসি। চার ভাষাতেই তাঁদের হাতের লেখা ছিল একই রকমের সুন্দর। দুজনেই ছিলেন খুব জ্ঞানী মানুষ। তাঁদের কথা শুনতেও জড়ো হয়ে যেত মানুষ। আমার বাবাও অবশ্য ফারসি বাদে অন্য ভাষাগুলো জানেন।
ষাটের দশকের আলোচিত মৃত্যুদুটো ছিল- এক. আমার নানির ছোটো বোন, অর্থাৎ আমার আরেক নানির মৃত্যু; দুই. কুষ্টিয়া জিলা স্কুলের ছাত্র থাকাকালে স্কুলের সামন দিয়ে নিয়ে যাওয়া এক মৃতদেহ দেখার দৃশ্য।
প্রথম মৃত্যুর ঘটনার সময় আমরা নানাবাড়ি বেড়াতে গিয়েছিলাম। হঠাৎ শুনলাম, ওই নানি মারা গেছেন ঢাকায়। তারপর যখন তাঁর মৃতদেহ নিয়ে আসা হলো তখন নানাবাড়িতে খুব কান্নাকাটি হলো। আমারও খুব মন খারাপ হলো। কারণ সেই নানিও খুব আদর করতেন আমাকে। মা-খালাদের সঙ্গে ও-বাড়িতে গেলে প্রায়ই রাতে থেকে যেতাম। বড়ো উঠোন আর অনেক গাছপালা ছিল বাড়িটায়। অনেক রাতেই সেই উঠোনে বসে মেঘের ফাঁকে ফাঁকে চাঁদের ছোটাছুটি দেখে আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে যেতাম। আরও বড়ো হয়ে জেনেছি, চাঁদ নয় মেঘেরাই ছোটাছুটি করত। তো যাহোক, এ বাড়ির সবাই যখন ওই নানির বাড়িতে গেলেন, আমি জেদ ধরলাম যাবার জন্যে। কিন্তু আমার সেই জেদকে কেউ পাত্তা দিলেন না। তাদের কথা ছিল, অত ছোটো মানুষের ও-বাড়িতে গিয়ে কাজ নেই। আমাকে এক কাজের মানুষের কাছে রেখে বড়োরা সবাই যখন চলে গেল আমার তখন বুক ফেটে কান্না এলো। আমার কাছে এই যেতে না পারার শোকটা অনেক বড়ো ছিল। আমার তখন বড়োদের ওপর খুব ক্ষোভ হয়েছিল। কী এমন মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যেত আমায় সঙ্গে নিলে! ওই নানির সঙ্গে আমার যে আর কোনোদিনও কোনোভাবেই দেখাসাক্ষাৎ হবে না এটা বুঝতে পেরেই আমার কষ্টটা বেশি হয়েছিল। মরে গেলে যে মানুষ চিরবিদায় নেয় সেটা ওই নানির মৃত্যুর ঘটনাই আমাকে প্রথমবারের মতো বোঝাতে পেরেছিল।
দ্বিতীয় ঘটনাটা ঘটেছিল জেলা স্কুল নামে পরিচিত কুষ্টিয়া জিলা স্কুলে পড়ার সময়। সেটাও ষাটের দশকের কথা। তখন পাকিস্তানি আমল। আমাদের ইশকুলটা বিরাট এলাকাজুড়ে ছিল। খেলার মাঠ, পুকুর, বাগান-এসবের পরেও অনেক জায়গা ফাঁকা পড়ে ছিল। পেছন দিকে ছিল একটা পুরনো পুকুরঘাট। একদিন ক্লাস শুরুর বেশ আগেই পৌঁছেছিলাম ইশকুলে। বই-পুস্তক ক্লাসে রেখে ওই পুকুরঘাটের কাছে একটা ঝাঁকড়া গাছের তলায় গিয়ে দাঁড়িয়েছি। এমন সময় কে যেন বলল, অ্যাই দেখ দেখ। মরা মানুষ নিয়ে যাচ্ছে।
কথাটা শুনেই মনটা কেমন যেন হয়ে গেল। তাড়াতাড়ি এগিয়ে গেলাম পাঁচিলের দিকে। পাঁচিলটার কাছ দিয়ে চলে গেছে পাকা বড়ো সড়ক। সেই সড়ক দিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল মৃতদেহটিকে। খাটিয়ার ওপর শুইয়ে রাখা হয়েছে দেহটি। দেখি, সাদা গোঁফ ও সাদা চুলের একজন বয়স্ক মানুষ চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছেন খাটিয়ার ওপরে। মনে হচ্ছে, একজন বুড়োমতো মানুষ ঘুমিয়ে পড়েছেন। তাই দেখে খুব কষ্ট হলো। আবার ভয়-ভয়ও করতে লাগল। এর খুব বড়ো কারণ হলো, এটাই আমার প্রথম মৃতদেহ দর্শন। এর আগে আমি কোনোদিনও নিজ চোখে কোনো মানুষের মৃতদেহ দেখিনি। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই খাটিয়া কাঁধে লোকগুলো মজমপুর রেলগেটের দিকে চলে গেল। আমরাও চলে এলাম ক্লাসের দিকে। তবে আসার সময় কারো সঙ্গে কথা বলিনি।
আরও একটা দুঃখের কথা বলি। সেটাও সেই ষাটের দশকেরই ঘটনা। আমাদের বাসা থেকে জেলা স্কুলের প্রাচীর দেখা যেত। আর প্রাচীর ঘেঁষে চলে যাওয়া রাস্তাটার তো কথাই নেই। প্রায় দিনই সেই রাস্তা দিয়ে কোট- প্যান্ট পরা এক ভদ্রলোক হ্যাট মাথায় হেঁটে যেতেন। যাবার সময় একনাগাড়ে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কী সব বলতেন। সেসব কথার এক বর্ণও বুঝতাম না। একদিন বাবাকে বললাম, লোকটা কে? সাহেব সাহেব চেহারা!
বাবা বললেন, আরে সাহেব সাহেব চেহারা কী! উনি তো সাহেবই। ইংরেজ উনি। পেশায় সম্ভবত ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন ।
– ছিলেন মানে? এখন নেই?
-আসলে ইঞ্জিনিয়ার তো সারা জীবনের জন্যই হয়েছেন। তবে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের কাজ উনি এখন তো করতে পারেন না। কারণ ভদ্রলোক মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছেন। উনি পাগল হয়ে গেছেন। শুনেছি, জগতিতে সুগার মিল নির্মাণ সংক্রান্ত কাজে তিনি এ দেশে এসেছিলেন। এখন উনি পথে পথে ঘুরে বেড়ান।
মুক্তিযুদ্ধের পরে আর ভদ্রলোকের দেখা পাইনি। শুনেছি, তাঁর দেশের সরকার তাঁকে উদ্ধার করার ব্যবস্থা নিয়েছিল। আবার এ-ও শুনেছি যে, দেশ থেকে তাঁর আত্মীয়স্বজন এসে তাঁকে ফিরিয়ে নিয়ে গেছেন। তবে যেভাবেই হোক, তিনি যে তাঁর দেশে ফিরে যেতে পেরেছিলেন এটাই সত্যি এবং এটা খুব আনন্দের ব্যাপারও। কিন্তু এতদিনের দেখা সেই লোকটাকে আর দেখতে না পাওয়ার ব্যাপারটা আমাকে খুব কষ্ট দিয়েছিল। আগে প্রতিদিনই যার সঙ্গে দেখা হতো এখন কোনোদিনই তার সঙ্গে দেখা হয় না, এটা আমি মানতে পারছিলাম না। তিনি ইংরেজ ছিলেন। বাংলা বুঝতেন না। আপনমনে যা বলে যেতেন তার সবই ইংরেজিতে। তাঁর প্রতি টান সৃষ্টি হওয়ার কোনো কারণ ছিল না। তবু কেন যে আমি বহুদিন একা একা রাস্তার পাশে গিয়ে ইংরেজ ভদ্রলোককে দেখার জন্য দাঁড়িয়ে থাকতাম তা আজও জানি না। হয়তো অজানা কারণে লোকটার প্রতি মায়া পড়ে গিয়েছিল, অথবা প্রতিদিন ইংরেজ দর্শনের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হলাম বলে মনের মধ্যে জেগেছিল সেই কষ্ট।
সেই ইশকুলে পড়ার সময়ই আমার লাল রঙের একটা ফুটবল চুরি হয়ে গিয়েছিল। বড়োই শখের ফুটবল। মামা বিদেশ থেকে এনে দিয়েছিলেন। অমন বল আশপাশের আর কারো ছিল না। তাছাড়া ডাকটিকিট সংগ্রহের নেশা হতে শুরু করেছিল সেই ছোট্টটি থাকতেই। প্রথম দিকে বিশেষ একটা খাতার মধ্যেই লাগিয়ে রাখতাম ডাকটিকিটগুলো। সেটাই ছিল আমার ডাকটিকিটের অ্যালবাম। একবার সেই অ্যালবাম থেকে শখের কিছু স্ট্যাম্প চুরি হয়ে গিয়েছিল। সেই কষ্টটাও বড় কষ্ট ছিল। কিন্তু সেসব কষ্টকে ছাপিয়ে গিয়েছিল এক অপরিচিত ইংরেজ পাগলের চলে যাওয়ার কষ্ট । মানুষের মন এমনই বিচিত্র।