| 23 এপ্রিল 2024
Categories
অনুবাদ অনুবাদিত প্রবন্ধ

প্রাচীন ভারতে অতিমারী ও মড়কের দেবী ‘শীতলা’

আনুমানিক পঠনকাল: 7 মিনিট

মূল: বিবেক ভট্টাচার্য্য
ভাষান্তর: অদিতি ফাল্গুনী

গর্ভবতী নারীদের উপর ভর হওয়া
অশুভ আত্মাদের বিপত্তারিনী,
গুটি বসন্ত ও অসংখ্য রোগের বিনাশিনী,
সব ভক্তের মাতৃকা,
শ্বেত চন্দনকাঠের মত অঙ্গ শীতলকারীনী,
সেই যক্ষিনী শ্রেষ্ঠা ও বহু সন্তানের জননীর
আমি বন্দনা করি।
(ভবরত্ন বিরচিত একটি স্তোত্র, সংস্কৃত থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন মিরান্ডা শ)।

দ্বিতীয় এবং ষষ্ঠ শতকের মধ্যবর্তী সময়ে একের পর এক ধারাবাহিক কিছু মড়ক গোটা রোমক সাম্রাজ্যকে অস্থিতিশীল করে তুলেছিল। এই মড়কগুলোর প্রথমটি ছিল আন্তোনাইন বা আন্তোনীয় মড়ক যা দেখা দিয়েছিল ১৬৫-১৮০ খ্রিষ্টাব্দে এবং দ্বিতীয় মড়কটি ছিল জাস্টিনিয়ানের মড়ক যা ৫৪১-৫৪২ খ্রিষ্টাব্দে দেখা দেয়। প্রথম মড়কে গোটা ইউরোপ এবং এশিয়া জুড়ে প্রায় পঞ্চাশ লক্ষ মানুষ মারা গেছিল এবং দ্বিতীয় মড়কটি আরো প্রাণ সংহারী হিসেবে দেখা দিয়েছিল। ইতিহাসবিদেরা মনে করেন যে প্রথম অতিমারীটি গুটি বসন্ত বা হাম হয়ে থাকবে এবং দ্বিতীয়টি সম্ভবত: ছিল ব্যুবোনিক প্লেগ। যেটা পরিষ্কার যে এই দুই অতিমারীই মূলত: রোমক সাম্রাজ্যের ধ্বংস ও বিনাশ ডেকে এনেছিল। কিন্তÍ ভারতের সাথে এই দুই অতিমারীর সম্পর্ক কি? তাই ত’ বলবেন আপনারা? এর উত্তরেই রয়েছে চমকপ্রদ নানা বিষয়। যেমন, আন্তোনীয় মড়ক ছড়িয়ে পড়ার সময়েই দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম এক ‘অতিমারী’ বা ‘মড়কের দেবী’র শৈল্পিক বিবরণ খুঁজে পাওয়া যায়। এই দেবীর নাম ছিল হারীতি। খ্রিষ্ট সভ্যতার উন্মেষ নাগাদ দক্ষিণ এশিয়ায় হারিতী হয়ে উঠেছিলেন যক্ষিনী থেকে বৌদ্ধ ধর্মের পরিত্রাতা এক দেবী। ‘মূলসর্বস্ব বিনয়’ গ্রন্থে হারীতিকে দানবদের মা বলে ডাকা হচ্ছে এবং তাঁর দানব সন্তানেরা সদ্যোজাত শিশুদের চুরি করা ও ভক্ষণ করার জন্য কুখ্যাত ছিল। বৌদ্ধ নানা কিংবদন্তী অনুযায়ী, হারিতী গৌতম বুদ্ধের দৃষ্টান্তে অনুপ্রাণিত হয়ে একটা সময়ে তাঁর জীবনাচারের নানা ভুল বুঝতে পারেন এবং তখন তিনিই হয়ে ওঠেন বৌদ্ধ সঙ্ঘগুলোর প্রধান রক্ষাকর্ত্রী। দানবী বা যক্ষিনী থেকে দেবী হয়ে ওঠার পর হারিতী পরিণত হন প্রাচুর্যের দেবীতে যিনি কিনা মায়েদের স্বাস্থ্যবান শিশু লাভের বর দেন। এছাড়াও হারিতী বিভিন্ন অসুখ বিশেষত: গুটি বসন্ত থেকে আরোগ্যদায়িনীর ভূমিকাও পালন করতেন।

সপ্তম শতকে চৈনিক পরিব্রাজক আই সিং ভারত উপমহাদেশের যতগুলো বৌদ্ধ সঙ্ঘে তিনি ভ্রমণ করেছেন, তার সবগুলোতেই হারিতীর বিগ্রহ দেখার অভিজ্ঞতা লিপিবদ্ধ করেছেন। ভিক্ষু ও সাধারণ মানুষেরাও নানা আড়ম্বরে তাঁকে পূজা করতেন। চৈনিক এই পরিব্রাজক তাঁর ভ্রমণপঞ্জী ‘ভারত ও মালয় দ্বীপপুঞ্জে আচরিত বৌদ্ধ ধর্মের বিবরণ (আ রেকর্ড অফ বুড্ডিস্ট রিলিজিয়ন এ্যাজ প্র্যাক্টিসড ইন ইন্ডিয়া এ্যান্ড দ্য মালয় আর্কিপেলেগো)’ গ্রন্থে আরো জানান যে শিশুদের সুস্থতা ও সুষ্ঠু সন্তান প্রসবের জন্য হারিতীকে নানা পূজাচারে তুষ্ট করতে হতো। আই সিংয়ের সমকালীন আর এক চৈনিক পরিব্রাজক ও বিখ্যাত পর্যটক হিউয়েন-সাং গান্ধার অঞ্চলে হারিতীকে উদ্দেশ্য করে নিবেদিত একটি বৌদ্ধ স্তপ দেখতে পান (পেশওয়ার এবং পেশওয়ার সংলগ্ন বর্তমান পাকিস্থানের কিছু এলাকা) যেখানে কিনা হারিতী স্বয়ং বুদ্ধের হাতে দীক্ষা নিয়েছিলেন বলে মনে করা হতো। হিউয়েন-সাং আরো জানান যে এই অঞ্চলের নারীরা তাদের সন্তানের ভালোর জন্য এই স্তÍপে এসে হারিতীর পূজা করতেন।

খুবই কৌতূহলোদ্দীপক বিষয় হলো কুশাণ সাম্রাজ্যের (প্রথম থেকে তৃতীয় খ্রিষ্টাব্দ) নানা সাম্রাজ্যের অবশেষ থেকে হারিতীর ভিন্ন ধাঁচের বিগ্রহ পাওয়া যাচ্ছে যেখানে কিনা তিনি রোমক মাতৃকার চেহারায় কোন শিশুকে ধারণ করে আছেন। উল্লেখ্য যে তখন পেশোয়ার ছিল কুশাণ সাম্রাজ্যের মূল রাজধানী। এই সাম্রাজ্য মধ্য এশিয়া থেকে উত্তর প্রদেশ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল এবং একইসাথে ছিল ইন্দো-গ্রিক শৈল্পিক রীতির জন্মভূমি। পরবর্তী সময়ে মধ্যযুগের ভারতীয় শিল্পকলাতেও এই ইন্দো-গ্রিক রীতি তার প্রভাব রাখতে সক্ষম হবে। এছাড়াও এই কুশাণ সাম্রাজ্যের সংস্কৃতিই মহাযান বৌদ্ধ ধর্মের উদ্গাতা হিসেবেও পরে ভূমিকা রাখে। (পাকিস্থানের স্করাহ ধেরি এলাকায় পাওয়া হারিতীর একটি দ্বিতীয় শতকের বিগ্রহ যেখানে তাঁকে তাঁর সন্তানাদি পরিবেষ্টিত অবস্থায় দেখা যাচ্ছে)।

কুশাণ সাম্রাজ্যের ধ্বংসাবশেষের প্রত্নতাত্ত্বিক নানা খনন থেকে আন্তোনীয় মড়কের সময়ে প্রাপ্ত হারিতীর নানা ভাস্কর্য বা বিগ্রহ পাওয়া গেছে। এমন একটি বিগ্রহই মিলেছে হিউয়েন-সাং কথিত পেশওয়ারের একটি প্রত্নতাত্ত্বিক এলাকায়। ঐতিহাসিক এতিয়েন লামোত্তে, তাঁর ১৯৫৮ সালে প্রকাশিত বই ‘হিস্ট্রি অফ ইন্ডিয়ান বুড্ডিজম: ফ্রম দ্য অরিজিন টু দ্য শক এরা’-য় লিখেছেন যে দ্বিতীয় শতকে নির্মিত এই বিগ্রহের বেদিতে একটি প্রার্থনা মন্ত্র রয়েছে আর সেটি হলো: ‘গুটি বসন্তকে আকাশে উড়িয়ে দাও।’ পুরাতাত্ত্বিক এ.ডি.এইচ বিভারের মতে, এটি কোন কাকতালীয় বিষয় ছিল না। তাঁর গবেষণামূলক রচনা ‘হারিতী এ্যান্ড দ্য ক্রনোলজি অফ দ্য কুশাণাস’-এ বিভার জানাচ্ছেন যে কুশাণ সাম্রাজ্যের সেই দিনগুলোতে হারিতীর বিগ্রহের সংখ্যার এত বৃদ্ধি এটাই নির্দেশ করে যে ভক্তরা মড়কের সংক্রমণ থেকে রক্ষা চাইছিলো (১৯৭০, ব্যুলেটিন অফ দ্য স্কুল অফ ওরিয়েন্টাল এ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজ, ইউনিভার্সিটি অফ লন্ডন)। এ কথা সুবিদিত যে আন্তোনীয় এবং জাস্টিনিয়ান মড়ক বহু দেশ-দেশান্তর এবং এমনকি সমুদ্রের বাণিজ্য পথ অতিক্রম করে দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়া পার করে ভূমধ্যসাগরীয় এলাকা অবধি ছড়িয়ে পড়েছিল।

বিভার আরো লিখছেন, ‘এমন বিপুল এলাকা জুড়ে দূর্যোগের ছড়িয়ে পড়ায় কুশাণ সাম্রাজ্যের ভূমিকা যথেষ্ট প্রত্যক্ষ বা স্পষ্ট। দ্বিতীয় খ্রিষ্টাব্দে গোটা দক্ষিণ এশিয়া ব্যস্ত হয়ে উঠেছিল গুটি বসন্তের সংক্রমণ নিয়ে। আজো সে পরিস্থিতির ব্যত্যয় ঘটেনি। পাকিস্থানের স্কারাহ ধেরিতে পাওয়া ১৩৬ খ্রিষ্টাব্দের এই বিগ্রহের তারিখ যদি সঠিক হয়ে থাকে, তবে বলতেই হবে যে সম্রাট কনিষ্কের সময়েই এই মহামারী বেড়ে চলছিল। অল্প কয়েক বছরের ভেতরেই এই সংক্রমণ বেড়ে গিয়ে অতিমারীর রূপ লাভ করে এবং গান্ধার অঞ্চলে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের ভেতর দেবী হারিতীর বিগ্রহ নির্মাণের উন্মাদনা বেড়ে চলে। খুব দ্রুতই রেশম পথের ক্যারাভান পথে বা যাত্রাবিন্দুগুলোয় এই ভাইরাসের সংক্রমণ দেখা দেয়। পারস্য উপসাগর ও লোহিত সাগরের পোতাশ্রয়গুলোতেও ছড়িয়ে পড়ে এই ভাইরাস। একথা উল্লেখ করা তাই মোটেও বিষ্ময়কর হবে না যে রোমকেরা ১৬৫ খ্রিষ্টাব্দে স্তেসিফোনে এই ভাইরাসের মোকাবিলা করেছিল।’

ঐতিহাসিক আলফ্রেড ফুশার ১৯১৫ সালে রচিত তাঁর বই ‘নোটস অন দ্য এ্যানশিয়েন্ট জিওগ্রাফি অফ গান্ধারা’-য় জানাচ্ছেন যে পেশওয়ারের হারিতী স্তÍপের পাশে একটি মাটির ঢিপিকে আজো সেখানকার স্থানীয় মুসলিম এবং হিন্দু মহিলারা খুব সম্মান করেন এবং সেই মাটির ঢিপি থেকে নারীরা মাটি নিয়ে বাসায় গিয়ে সন্তানের জন্য তৈরি মাদুলি বা তাবিজের ভেতর সেই মাটি পুরে দেন যেন বাচ্চাদের গুটি বসন্ত না হয়। ভারতে, বিগত বহু শতক ধরেই, হারিতীকে রোগ সংক্রমণ এড়াতে ব্যতিব্যস্ত ভক্তরা পূজা দিয়ে এসেছে। ভারত থেকে বৌদ্ধ ধর্ম নেপাল, চীণ এবং জাপানে ছড়িয়ে পড়ার সময় হারিতীর অর্চনাও ছড়িয়ে পড়ে সেসব দেশে। ভারতে জ্বর কমিয়ে রোগীকে বিশেষত: নবজাতক শিশুকে শীতল করার জন্য হারিতীর বিশেষ জনপ্রিয়তা ছিল। দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৌদ্ধ সঙ্ঘগুলোয় বিশেষত: উত্তর প্রদেশের মথুরা, উড়িষ্যার রত্নগিরি, বিহারের সারণ, বাংলাদেশের রাজশাহী, মহারাষ্ট্রের অজন্তা-আওরঙ্গাবাদ-ইলোরা এবং অন্ধ্র প্রদেশের সালিহুন্দ্রাম, নাগার্জুনকোন্ডা ও বজ্জান্নাকোন্ডায় এই দেবীর বিগ্রহ রয়েছে।

আমি যখন ২০১৩ সালে বজ্জান্নাকোন্ডার জমকালো এক ঐতিহাসিক এলাকা পরিদর্শন করি, তখন সেখানে বেলে পাথরে গড়া হারিতীর এক বিশালাকায় বিগ্রহ দেখতে পাই। স্থানীয় মানুষেরা এই বিগ্রহকে ‘আম্মা’ বলে ডাকে এবং গোটা এলাকার গর্ব এই বিগ্রহ। গবেষক শ্রীপদ্মা হল্ট, তাঁর ২০১১ সালের গবেষণামূলক রচনা ‘হারিতী: ভিলেজ অরিজিনস, বুড্ডিস্ট ইলাবোরেশনস এ্যান্ড শৈভিতি এ্যাকোমোডেশনস (এশিয়ান এ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজ, কিওটো ইউনিভার্সিটি)’-এ অন্ধ্র প্রদেশের লোক দেবীদের উপর করা তাঁর মাঠ গবেষণা বিষয়ে লিখেছেন। জ্বর কমানো ও সন্তান দানের দেবী হিসেবে এরুকাম্মা, পোচাম্মা ও পেদ্দাম্মা নামে পরিচিত তিন দেবীর বিগ্রহ মূলত: বৌদ্ধ দেবী হারিতীরই বিগ্রহ।

শ্রীপদ্মা আমাদের আরো জানাচ্ছেন যে হারিতীর মতই জাপানে রয়েছেন এক জাপানী দেবী কারিতেই। কারিতেই বা কারিতেইমো (জাপানী ভাষায় মো অর্থ মা) জাপানের নারায় তোদাই-জি বৌদ্ধ মন্দিরে অষ্টম শতকে পূজিতা হতেন। বর্তমানে ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে স্বীকৃত এই মন্দিরটি ৭৩৫-৭৩৭ খ্রিষ্টাব্দে জাপানে ছড়িয়ে পড়া গুটি বসন্তের সংক্রমণ ঠেকাতে এক রাজকীয় ডিক্রি বা আদেশের বলে এই মন্দিরের নির্মাণ কাজ শুরু হয় ও ৭৫২ খ্রিষ্টাব্দে মন্দির পরিপূর্ণ ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। ভারতে জ্বরের বিস্তার ঠেকাতে আরো কিছু দেবী আছেন যাঁদের ভেতর থেকে আমি মাত্র দু’জনের নাম করব; এঁদের একজন হলেন পর্ণশবরী ও অন্যজন হলেন শীতলা। পর্ণশবরী হলেন বৌদ্ধ তান্ত্রিক বা বজ্রযান দেবী। সম্ভবত: আদিবাসী নানা সংস্কৃতি (শবর-কোল-ভীল প্রমুখ) থেকে এই দেবীর রূপকল্পনা এসেছে যেহেতু তাঁর নামের আক্ষরিক অর্থ দাঁড়ায় ‘পাতায় আবৃতা আদিবাসী নারী।’ জ্বর ও গুটি বসন্তের বিনাশকারিনী হিসেবে পর্ণশবরী ভারতের যেসব এলাকায় পূজিতা হন, সেই এলাকাগুলো মিলে যায় জ্বর ও গুটি বসন্ত নির্মূলকারিণী আর এক দেবী শীতলার এলাকার সাথেও- পূর্ব ভারত তথা বাংলা ও উড়িষ্যা।

গবেষক মিরান্ডা শ তাঁর মেধাবী গ্রন্থ ‘বুড্ডিস্ট গডেসেস অফ ইন্ডিয়া (২০০৬)’-এ জানাচ্ছেন যে বাংলাদেশে ঢাকার বিক্রমপুরে (একাদশ শতক) প্রাপ্ত পাল যুগের শিল্পকলা থেকে বা বজ্রযান মন্ত্র বা ‘সাধনামালা’র মত ধ্যান প্রণালীতে পর্ণশবরীর উল্লেখ পাওয়া যাচ্ছে। পত্রাবৃতা ও হাতে একটি পাতার ঝাড়– নিয়ে সব ব্যাধি ও ঠান্ডা-জ্বরকে তাড়ানো এই দেবী যেন সব ব্যাধি বা আপদ-বালাইয়ের পিঠে চেপে বসেছেন। আর এক শৈব দেবতা গণেশের মতই। পর্ণশবরীর পূজা একদিকে যেমন সব রোগ-ব্যাধি তাড়ায়, অন্যদিকে তান্ত্রিক বিদ্যার গুপ্ত অর্থ অনুযায়ী এই দেবী বাহ্যিক রোগ-ব্যাধির পাশাপাশি আমাদের অন্তর্গত নানা ভুল বোঝাবুঝি-মোহ-ভ্রান্তিরও অবসান ঘটায়। কালপ্রবাহে ভারতে পর্ণশবরীর পূজার ধারা বিলুপ্ত হয়ে গেলেও তিব্বতী বৌদ্ধ ধর্মে তিনি আজো এক মুখ্য দেবী হিসেবে রয়ে গেছেন।

পর্ণশবরীকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে একসময় তাঁরই সহচরী হিসেবে যাঁকে দেখা যেত, সেই শীতলা আজ ভারতে ‘জ্বর সারানোর’ সর্বমান্য দেবী হিসেবে স্বীকৃত। পাথর কুঁদে খোদাই করা শীতলার বিগ্রহগুলোয় তাঁকে প্রায়ই দেখা যায় গাধার পিঠে চড়া অবস্থায় এবং হাতে একটি ঝাড়– ধরা যা দিয়ে তিনি সব রোগ-ব্যাধি তাড়ান।

‘শীতলা’ নামের অর্থই হলো ‘যিনি সবাইকে শীতল করেন।’ পর্ণশবরীর বিগ্রহে শীতলাকে যেমন দেখা যেত, আজো তাঁর বিগ্রহ তেমনটাই দেখতে: একটি গাধার পিঠে উপবিষ্টা এবং হাতে একটি ঝাড়– নিয়ে তিনি সব জ্বর-বালাই তাড়াচ্ছেন। তাঁর পরবর্তী সময়ের এবং হালের প্রতিমাগুলোতেও মাঝে মাঝেই তাঁর হাতে নিম পাতা অথবা একটি মাটির কলস দেখতে পাওয়া যায়।


আরো পড়ুন: শীতলা দেবী করোনায় আজও প্রাসঙ্গিক । ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়


গবেষক ফ্যাব্রিজিয়ো এম. ফেরারি রচিত গবেষণা পত্র ‘ওল্ড রিচ্যুয়ালস ফর নিউ থ্রেটস: পজেশন এ্যান্ড হিলিং ইন দ্য কাল্ট অফ শীতলা (ইন রিচ্যুয়াল ম্যাটার্স: ডাইন্যামিক ডাইমেনসনস ইন প্র্যাক্টিস, সম্পাদনা- উট হাকসেন এবং ক্রিস্টিন ব্রোসিয়াস, ২০১৯)’-য় ফ্যাব্রিজিওশীতলাকে ‘গুটি বসন্তের দেবী’ হিসেবে দেখার ওরিয়েন্টালিস্ট বা প্রাচ্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গিকে অবশ্য খারিজ করে দেন। ফ্যাব্রিজিও লিখেছেন যে পশ্চিম বাংলায় মাঠ গবেষণার সময় তিনি দেখেছেন যে গ্রামের মানুষ শীতলাকে ‘বসন্ত রঙের অধিষ্ঠাত্রী দেবী’ হিসেবে বা ‘বসন্ত মাসের জ্বরকে নিয়ন্ত্রণকারীনী দেবী’ হিসেবে উল্লেখ করছেন। ‘…শীতলাকে রোগের সাথে এক করে দেখা ঠিক হবে না, যদিও গুটিবসন্তের দেবী তকমাটি তাঁর গায়ে সেঁটে আছে। গুটি বসন্ত, হাম আর জ্বর স্বাধীণভাবেই টিঁকে থাকে, এই সব রোগের বীজাণু আমাদের দেহে রয়েছেও- অক্রিয়ভাবে হলেও। শীতলা শুধু এই বীজাণুসমূহ নিয়ন্ত্রণ করেন। তাঁর নামের অর্থও তাই,’ তিনি বলেন। ফ্যাব্রিজিও আরো জানান যে, বাঙ্গালী সমাজে আরো অনেক রোগ-ব্যাধি বা মড়কের দেবী রয়েছে। যেমন, হিন্দুদের ভেতর মা ওলাই চন্ডী বা মুসলিমদের ভেতর ওলা বিবি। রয়েছেন রক্তবতীর মত রক্তের সংক্রমণের দেবীও। খুবই কৌতূহলোদ্দীপকভাবে ফ্যাব্রিজিও লক্ষ্য করেছেন যে শীতলাকে মাঝে মাঝে ষষ্ঠী, মনসা বা সর্পদেবী এবং হারিতী ও পর্ণশবরীর সাথেও মিলানো হয়।

আরেকটি কৌতূহলোদ্দীপক বিষয় হলো যে গুটি বসন্তের ভ্যাকসিন আবিষ্কৃত হবার আগে শীতলা পূজায় ‘বিষে বিষক্ষয়’ ব্যবস্থার প্রয়োগ হিসেবে কোন সুস্থ ব্যক্তিকে কিছুদিন আগে অসুস্থ হওয়া কোন বসন্ত রোগীর শুকনো পুঁজ দিয়ে হাল্কা ভাবে সংক্রমিত করা হতো এই আশায় যে এরপর এলাকায় বসন্ত ছড়িয়ে পড়লেও ইতোমধ্যে তার দেহে এন্টি-বডি বা প্রতিরোধ ক্ষমতা সৃষ্টি হবে। ফেরারি জানাচ্ছেন, শীতলা পূজার পুরোহিতরা সাধারণত; ‘নিচু জাতের হয়ে থাকেন যেমন মালিন (মালী) বা নাপিত। এদের টিকা দানকারী বা দেহুরিও বলা হয়,’। এই পূজার সময় মন্ত্র পাঠ হবে বা গলায় নানা শব্দ করা হবে যেন দেবী নিজেই রোগ সংক্রমিত করা হচ্ছে যার দেহে, তার দেহের প্রতি আকর্ষণ বোধ করেন এবং নিজেকে সেই রোগীর দেহে স্থাপণ করেন।

একটি নির্জন কক্ষে রোগীকে সরিয়ে নেয়া হবে। তবে তাকে সবাই পাহারাও দেবে। জ্বরের কাঁপুনী উঠলে বোঝা যাবে যে শীতলা এই রোগীর দেহে প্রবেশ করেছেন। এরপর রোগী নিজেই দেবী শীতলা হয়ে উঠবেন এবং তাঁকে তুষ্ট করতে ঠান্ডা বা শীতল জল বা চরণামৃত পান করানো হবে, দেয়া হবে নিরামিষ অথবা অ-নিরামিষাশী খাবার। নির্জনাবাস কক্ষ বা মন্দিরের বাইরে, মেয়েরা আল্পনা আঁকবে এবং জনতা শীতলা-পালা থেকে নানা কাহিনী বা গল্প গানের সুরে গাইবে। জ্বর কমে গেলে এবং রোগী শীতল হলে, শীতলার কাজ শেষ।

আজ যেহেতু আমরা এক অতিমারীর সময়ে বাস করছি, ভারতের অতিমারীর এই দেবীর কাহিনী সত্যিই চমকপ্রদ। অন্তত: এটুকু আমরা বুঝতে পারি যে এই সেদিন পর্যন্ত রোগ-ব্যাধি ছিল মানব জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। অন্তত:পক্ষে ভারতে হু হু করে বাড়তে থাকা জ্বর থেকে বা ঘাতক রোগ-ব্যাধির হাত থেকে বাঁচাতে আমাদের ছিল দেবী শীতলার শীতল স্পর্শ।

সূত্র: দ্য মিন্ট, ১৭ই এপ্রিল ২০২০।

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত