লোকশিল্প তথা লোক-পণ্যের ভবিষ্যৎ
“Folk in ethnology is the common people who share a basic store for old tradition.” অর্থাৎ, পুরাতন ঐতিহ্যের অংশীদার যেসব সাধারণ মানুষ, নৃতত্বের পরিভাষায় তারা Folk বা লোক নামে অভিহিত আর শিল্প হল, মানব সত্তার আনন্দিত উপলব্ধির গভীরতম বহিঃপ্রকাশ।
সাধারণ মানুষ তাদের বেঁচে থাকার তাগিদে যে সব কর্মকান্ড করে থাকে তার ভেতরের সৌন্দর্য ও আনন্দটুকুই লোকশিল্প। সুন্দরের উপস্থাপন মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। আবহমান কালধরে নিজেদের প্রয়োজনেই মানুষ নানা রকম তৈজসপত্র, পোশাক-আষাক, ঘর-বাড়ি নির্মাণ করে আসছে। সেইসব নির্মিত জিনিসপত্রে প্রয়োজনাতিরিক্ত কিছু বিষয়ের সংযুক্তি ঘটে। যা মানুষের শিল্পিত মনের বহিঃপ্রকাশ। যেমন একটি মাটির হাঁড়ি! সাদামাটা না রেখে তাতে রড়ের নকশা করা হয়। একটি ঝুড়ি! তার বন্ধনীতেও আনা হয় নানান কারুকার্য। পোষাক-আষাকের ক্ষেত্রেই তেমনি, যেমন নকশিকাঁথা, রুমাল, শাড়িতে বা চাদরে নানা রঙের সুতার বুনন ইত্যাদি। এ সবই লোকশিল্পের নিদর্শন। এছাড়াও, দৈনন্দিন প্রয়োজনের বাইরেও কিছু জিনিস আছে যা শুধুই মানুষের ব্যক্তিগত আনন্দ থেকে তৈরী। যেমন, মাটি দিয়ে তৈরী খেলনা, বাধাই করা কাপড়ের নকশা ইত্যাদি।
বাংলাদেশের লোকশিল্পের খ্যাতি বিশ্বজোড়া কিন্তু কি এর ভবিষ্যৎ?
লোকশিল্পের প্রধান ভূ-ভাগ গ্রামাঞ্চল, আর লোকশিল্পীরা প্রধানত শ্রমজীবী মানুষ। গ্রামাঞ্চলের চাহিদা, ইচ্ছা, স্বপ্ন, অভিজ্ঞতা লোকশিল্পের নানা উপাদান; এই শিল্পের কৃৎকৌশল সামান্য। লোকশিল্পকে তিন ভাগে চিহ্নিত করা যায়: আধুনিক শিল্পের পূর্ব-অবস্থা বলে; গ্রামীণ শিল্পকর্মের নমুনা বলে; এবং শ্রমজীবী মানুষ, কৃষক, ভূমিহীন, সমাজ-অন্ত্যজদের শিল্পকর্ম বলে। তিন অর্থেই লোকশিল্প শাসনশ্রেণীর বিপরীত, পরিশীলিত শিল্পের উল্টো।
লোকশিল্পে সামাজিক ও ব্যক্তিক অভিজ্ঞতা প্রবিষ্ট, গভীর ও ব্যাপ্ত, বস্তুতপক্ষে লোকশিল্প ঐ অভিজ্ঞতার গভীরতা ও ব্যাপ্তিরই ফল। তবু শিল্পগতভাবে লোকশিল্প বিবেচিত সরল ও অভিজ্ঞতার অভাব বলে। ঐ বৈপরীত্য বোঝা দরকার। লোকশিল্পী অপেশাদার কারুকর্মী; এই তাঁর সংজ্ঞা। এই সংজ্ঞার সঙ্গে যুক্ত শাসনশ্রেণীর মতাদর্শগত পরিমন্ডল। পেশা এবং কারুকর্মের মধ্যেকার তফাৎ দুরূহ, তবু এই সীমারেখার তৎপর্য দূরস্পর্শী। কারুকর্মী ততদিন টিকে থাকেন যতদিন পর্যন্ত তাঁর কাজের বিচারের মাপকাঠিতে অংশগ্রহণ করেন বিভিন্ন শ্রেণী। পেশাদার তখনই দেখা দেয় যখন কারুকর্মীর দরকার পড়ে তাঁর শ্রেণী ত্যাগ করার এবং শাসকশ্রেণীর কাছে পৌঁছুবার। শাসকশ্রেণীর বিচারের মান ভিন্ন, সে বিচারে বিভিন্ন শেণীর অংশগ্রহণ সম্ভব নয়।
অর্থনৈতিক অবস্থা ও জীবন যাত্রার পরিবর্তনের উপর নির্ভর করে লোকশিল্পের অবস্থান। বিশ্ব এখন প্রযুক্তি নির্ভর। ঘরে ঘরে স্যাটেলাইট, মোবাইল ফোন, ফলে একটি দেশের সংস্কৃতি মুহুর্তে পৌঁছে যাচ্ছে অন্য একটি দেশের প্রত্যন্তে। অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের মত বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। যার প্রভাব পড়ছে লোক-জীবনেও। দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহারিক দিক থেকে এসেছে আমূল পরিবর্তন। মাটির হাঁড়ি-পাতিল, বাঁশের ধামা-ঝুড়ি, পাটের সিকা-দড়ির পরিবর্তে ঘরে ঘরে ঢুকে পড়েছে প্লাস্টিকের নানা বর্ণ ও আকৃতির বিভিন্ন সামগ্রী। এমনকি প্রেসার ও রাইচ কুকারও দখল করে নিয়েছে গ্রামীণ মানুষের রান্নাঘর। বিলুপ্তপ্রায় গ্রামীণ মেলা, যা লোক-পণ্যের বাজার বলে পরিচিত। তা এখন শহরের মানুষের সৌখিনতার বিষয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই পরিবর্তন দিন দিন বাড়ছে। অন্যদিকে আশঙ্কাজনক হারে কমছে লোকশিল্পের উপাদান।
প্লাস্টিক পণের উপর নির্ভরশীলতা লোক-ঐতিহ্যিক জিনিস উৎপাদন পেশার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মানুষের জীবিকায় এসেছে পরিবর্তন। ঐতিহ্যিক বিষয়ের চেয়ে, মানুষের কাছে জীবন যাপনের সহজতাই অধিক গুরুত্বপূর্ণ। ফলে এই পরিবর্তন রোধ কোনওভাবেই সম্ভব নয়। লোক যাদুঘরই প্রমাণ করে আমাদের লোকশিল্পের ভবিষ্যৎ। রাষ্টীয় পৃষ্টপোষকতায় কারুশিল্পীদের পূর্নবাসন করা হলেও, কারুপণ্য কেবল শহুরে মানুষের সৌখিনতার বিষয়ে পরিণত হচ্ছে। সৌখিনতায় লোকশিল্প হয় না, গ্রামীণ খেটে খাওয়া, শ্রমজীবী সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন চাহিদা ও কাজের মধ্য দিয়েই গড়ে ওঠে লোকশিল্প।
ছবি : ইন্টারনেট
কবি, লেখক, চিত্রশিল্পী