Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,The history of mango 3

ইতিহাস: আম আলাপন (পর্ব-১) । সুকন্যা দত্ত

Reading Time: 3 minutes
” অ এ অজগর আসছে তেড়ে, আ এ আমটি আমি খাবো পেড়ে”…. বাংলা বর্ণ পরিচয়ের সময়ে এইভাবেই  আমার প্রথম আমের সাথে পরিচয় ঘটে।
তারপর কেটে গেছে বহু বছর তবু ও আমের নাম শুনলেই আমার স্মৃতির সপ্তডিঙা মধুকর সেই বইয়ের পাতায় পাড়ি জমায়। ” স্মৃতি সততই সুখের”, তাই আমফানে পড়ে যাওয়া আমাদের বাড়ীর বাগানের আম গাছটার ধ্বংসাবশেষটা অনাদরে পড়ে থাকলে ও তাকে ভোলা যায় না। আমার মামার বাড়ী কোচবিহারের হলদিবাড়িতে। সেই বাড়ীর আম বাগান আমাদের ভাইবোনদের লুকোচুরি খেলার জায়গা ছিলো। দিদার মুখে কতবার একটা কবিতা শুনেছি- ” আম পাকে বৈশাখে, কুল পাকে ফাগুনে”।
 
কবিতার দুলুনিতে মামার বাড়ীর দাওয়ায় বসে কাঁচা আম মাখা খেতাম।  আম কুচিয়ে তাতে সরষের তেল,নুন,কাসন্দি দিয়ে নারকেলের মালায় রেখে খেতে খেতে চোখ বন্ধ হয়ে  জিভ অসাড় হয়ে আসতো।  বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ” পথের পাচালি” তে দুর্গা ক্ষণিকের জন্য নিরুদ্দেশ হলেই সর্বজয়া জানতেন ” কোথায় কার আমতলায় জামতলায় ঘুরছে”। 
 
আমের কথা প্রথম জানা যায় তিন হাজার বছর পুরাতন ” বৃহদারণ্যক উপনিষদ ” এ এবং তারপর ” শতপথ  ব্রাহ্মণ ” এ। বৈদিক সাহিত্যে আম ” রসাল” ও  “সহাকার” নামে পরিচিত । প্রাচীনকালে সংস্কৃতে আম কে বলা হতো ” আম্র ফল”। দক্ষিণ ভারতে তামিল ভাষায় প্রথমে ” ম্যাং কে ” থেকে বিবর্তিত হয়ে হলো ” ম্যাং গে “। পরে মালয়ালাম ভাষায় সেই ম্যাং গে হয়ে উঠলো “মাংগা”। এরপর কেরালায় পর্তুগীজদের আর্বিভাবে তাদের রসনা তৃপ্ত করে ম্যাঙ্গো বিশ্বের দরবারে হয়ে উঠলো ” ফলের রাজা”।
প্রাচীন ভারতের শাসক শ্রেণি আমের সাথে সামঞ্জস্য রেখে উপাধি দিতেন। বৈশালী নগরীর রাজনর্তকী  আম্রপালি নামের মধ্যে সেই ইতিহাস লুকিয়ে আছে। আলেকজান্ডার ভারত আক্রমণ শেষে গ্রীসে ফেরার সময় ভারতবর্ষের নানান ফল সঙ্গে করে নিয়ে যান যার মধ্যে আমের কথা বাদ দেওয়া যায়না। এরপরই আমের কথা ছড়িয়ে পড়ে মালয় উপদ্বীপ, ইন্দোনেশিয়া,  ফিলিপাইন এ।
এই আম মধুসূদন দত্ত র কাছে ” বাংলার রসাল” আর রবীন্দ্রনাথের ভাষায়-
” আমের যে বর্ণ মাধুরী তা জীববিধাতার প্রেরণায় আমের অন্তর থেকে উদ্ভাসিত”।
 
বৌদ্ধযুগে শ্রমণদের পরিভ্রমণকালে তাদের ঝুলিতে আম পাওয়া যেত। গৌতমবুদ্ধের   এক শিষ্য ওনাকে   আম্রকুঞ্জ দান করেছিলেন। সেই কুঞ্জে তিনি  বিশ্রাম নিতেন। ভারতহুতের একটি ভাস্কর্যে খোদিত আছে গৌতম বুদ্ধের এক চিত্র।  ওনার রোপিত আমের আঁটি থেকে সাদা রঙের আম গাছ পরে বৃক্ষে পরিণত হয়। বৌদ্ধ ধর্ম উত্থানের সাথে সাথে বিশ্বাস ও উন্নতির প্রতীক হয়ে ওঠে আম। 
আম গাছের কথা বললে প্রেমের দেবতা মদন এর প্রসঙ্গ  চলে আসে। মনে করা হয় আম্র মুকুল হলো মদনদেবের শর। 
বর্ষা আসলে” নবধারাজলে” প্রকৃতি স্নান করে। উদ্দাম বাতাসে ” আমে জামে শিরীষ শালে”র পাতায় পাতায় নাচন লাগে। বৈশাখের কালবৈশাখী আম কুড়ানোর আমন্ত্রণ জানায়। শিলাবৃষ্টি আর কাঁচা আম কুড়োনো তো বৃষ্টিতে ভেজার অজুহাত মাত্র। 
মেগাস্থিনিস ও হিউ এন সাঙের ভারত ভ্রমণের বিবরণ থেকে জানা যায়, সে সময় মৌর্য সম্রাটরা  সড়কপথ ও রাজপথের  উভয় দিকে আম গাছ রোপন করেছিলেন। তাদের বর্ণনায় আমের অসাধারণ স্বাদের কথা উল্লেখ করায় ভারত ছাড়িয়ে বিশ্বের দরবারে আমের সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়তে থাকে।
 মধ্যযুগে আমের প্রথম পৃষ্ঠপোষক রূপে আলাউদ্দিন খিলজীর নাম উঠে আসে।ওনার শিভমা দূর্গে আম দিয়ে তৈরি ভিন্ন রাজকীয় ব্যঞ্জন পরিবেশিত হতো। 
পলাশীর যুদ্ধের ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে আমবাগান। ইতিহাসের ছায়া থেকে আবার ফিরে যাই আমার শিশুবেলার বারান্দায়।  ভাইবোনের সাথে ” আম পাতা জোড়া জোড়া, মারবো চাবুক ছুটবে ঘোড়া” খেলতে খেলতে মেঘলা দিনের কথা মনে পড়তো। আমার কাঁটা চামচের হাতেখড়ি হয়েছিলো আম খাওয়ার সুবাদে। পাকা আমের ঘ্রাণ নাকে এলেই দৌঁড়ে মায়ের কাছে চলে যেতাম। বাটি পেতে একের পর এক মুখে পুরে রসনাতৃপ্তির বাসনাদেশ এ বিচরণ করতাম।
ভারতচন্দ্রের ” বিদ্যা সুন্দর” কাহিনীতে সুন্দরের বিয়ের পরে যখন কাঞ্চীপুর ফিরে যেতে চাইলো,তখন বিদ্যা বলে,
” জ্যৈষ্ঠ মাসে পাকা আম এ দেশে বিস্তর
  সুধা ফেলে  খেতে আশা করে পুরন্দর”।
রায় গুণাকর ” অন্নদামঙ্গল” কাব্যে অন্নদার পুজোয় ব্রাহ্মণ ভোজন বর্ণনা প্রসঙ্গে লিখেছেন,
” আম্র দিয়া শৌল মাছে ঝোল চড়চড়ী।
  আড়ি রান্ধে আদারসে দিয়া ফুলবড়ী”।
আবার বিজয় গুপ্তের  মনসা মঙ্গল কাব্যে একদিকে লখীন্দরকে সাপ দংশনের পর বেহুলার বিলাপে  কবি লিখেছেন, 
” আম ফলে থোকা থোকা নুইয়ে পড়ে ডাল,
  নারী হইয়া এই যৌবন রাখিব কতকাল। “
এ থেকে লখীন্দরের সর্প দংশনের সময়কাল সহজেই অনুমান করা যায়।
আবার আর একটি অংশে তিনি লিখেছেন,
” একে একে যত ব্যঞ্জন রান্ধিল সকল
  শৌল মৎস দিয়া রান্ধে  আমের অম্বল”।
 
ঈশ্বর গুপ্ত কবির কলমে আম হয়েছে আঁব, শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে আমবু, বাল্মীকি লেখায় “চ্যুত” আর কালিদাসের লেখায় আমের পরিচিতি ” আম্র” নামে।
 
 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>