Categories
ইতিহাস: আম আলাপন (পর্ব-২) । সুকন্যা দত্ত
আনুমানিক পঠনকাল: 3 মিনিট
আমার কলেজে একটা আম বাগান ছিলো। তার শীতল ছায়ায় আমাদের বন্ধু- বান্ধবদের গল্পের আসর বসতো। “সেদিন ভেসে গেলে ও” মনে পুরাণে আজ ও সেই স্মৃতি উজ্জ্বল । অমৃত ফল মুঘলদের মনে ও জায়গা করে নিয়েছিলো। আমজনতার ঝুলি থেকে বাদশাহী টুকরিতে পৌঁছাতে আমের এতটুকু সময় লাগেনি।দৌলত খান লোদি বাবরকে আম খাওয়ালে সেই লোভে তিনি মেবারের রাণার সাথে যুদ্ধ লড়ে এদেশেই থেকে যান। শোনা যায় শেরশাহের তাড়নায় হুমায়ুন ভারত থেকে কাবুলে পাড়ি দিলে ও রানার মারফত আম আনাতে ভুলতেন না। সম্রাট আকবর এই অমৃত ফলের স্বাদ সুখের উল্লাসে দ্বারভাঙ্গার কাছে লক্ষ্মীবাগে প্রায় এক হাজার আম গাছের চারা রোপন করেন। জাহাঙ্গীরের প্রিয় ছিলো আম পান্না।আমের নতুন নতুন পদ রান্না হলে সম্রাট তার খানসামাদের পুরস্কৃত করতেন। সম্রাটের কথায়,”কাবুলের ফলরাজি যতই সুস্বাদু হোক না কেন,আমার মনে হয় আমের তুলনায় তা বেশি সুস্বাদু নয়”।
নুরজাহান গোলাপ জল, আম মিশিয়ে সুরা তৈরি করতেন। শাহজাহানের ও প্রিয় ছিলো আম পান্না, আমের লাজ, আমের মিঠা পোলাও। ঔরঙ্গজেবের আমের নেশায় মত্ত হয়ে পারস্যের সম্রাট শাহ আব্বাস কে এই ফল উপহারে পাঠাতেন।শাহজাহানের বন্দীদশায় তার প্রিয় বুরহানপুরের আম আসতো দক্ষিণ ভারত থেকে। এমনকি বালকানের রাজা ঔরঙ্গজেবের সাথে শান্তি চুক্তির জন্য তাকে দুশো উটের পিঠে শুকনো ফল ও পাঠিয়েছিলেন। আবুল ফজলের আইন- ই- আকবরী ও তুজুক- ঈ- জাহাঙ্গীরী থেকে সে সময়ের নানান প্রজাতির আম গাছের কথা জানা যায়,যারা একে অপরের থেকে স্বাদে- গন্ধে- আকারে পৃথক,এমনকি নিজেদের আম্র প্রীতি স্বরূপ গড়ে নিতেন আম বাগান। আকবরের পর জাহাঙ্গীর লাহোরে ( পাকিস্তান) এবং শাহজাহান ঝর্ণা কুতুব গ্রামে( বর্তমানে শম্মি তলব মেহরৌলি নামে পরিচিত ) বাগান তৈরি করান। বাহদুর শাহের সময়ে চিত্রে, মৃৎ শিল্পে, উৎসবে, ইফতারে আমের উপস্থিতি চোখে পড়ে। জাহানারা ও ঔরঙ্গজেবের সম্পর্ক সুদৃঢ় ছিলো এই মিঠা ফলের কারণে। শুধু মুঘলরাই নন, মহারাষ্ট্রের রঘুনাথ পেশোয়া সমৃদ্ধির প্রতীক স্বরূপ ১০ মিলিয়ন আমের চারা রোপন করেছিলেন। চৌসার যুদ্ধে হুমায়ুন কে হারিয়ে শের শাহ নিজের জয় কে গৌরবান্বিত করে রেখে আমের নাম দেন চৌসা।
আরো পড়ুন: আম আলাপন (পর্ব-১)
দ্বাদশ শতকে বাংলাদেশে সংকলিত সংস্কৃত ও প্রাকৃত ভাষায় কবিতার সংকলন গ্রন্থ ” সদুক্তিকর্ণামৃতে” রাজা লক্ষ্মণ সেনের মন্ত্রী কবি উমাপতি ধর আমের মঞ্জরী ও ফল নিয়ে সংস্কৃতে একটি কবিতা রচনা করেন। বাঙালির আম প্রীতির কথা জানা যায় সুকুমার সেন রচিত” বঙ্গ ভূমিকা” গ্রন্থে। সেখানে তিনি লিখেছেন, “কোন কোন বৃক্ষ ফুল ফোটাবার কালে সুগন্ধি হয়, কোন কোন বৃক্ষের কাঁচা ফল হয় সুরভিত ও সুস্বাদযুক্ত, কোন কোন বৃক্ষ আবার ফল পাকলে হয় মনোরম কিন্তু ফুল ফোটাবার কাল থেকে ফল পেকে যাওয়া পর্যন্ত আগাগোড়া মাধুর্য এ জগতে একমাত্র আম্রবৃক্ষেই প্রকটিত”।
আম নিয়ে আকবর বীরবলের একটি মজার গল্প আছে। সম্রাট আকবর তাঁর শাহী দরবারে ভোজন সভার আয়োজন করেন। বহু গন্যমান্য ব্যক্তি সেই ভোজ সভায় নিমন্ত্রিত, এমনকি ওনার সভাসদ বীরবল ও বাদ জাননি। ভোজন শেষে বীরবল নিজের উদরপূর্তির কথা আকবরকে জানালেন। সেই সময় ভোজন সভায় পরিবেশিত আমের দিকে তাকিয়ে লোভ সংবরণ করতে না পেরে বীরবল তো টুপটাপ আমের টুকরো মুখে পুরতে লাগলেন। আকবর একটু অসন্তুষ্ট হলে বীরবল বুদ্ধিমত্ত্বার সাথে জানান-
মহামান্য সম্রাট রাস্তা দিয়ে গেলে রাস্তাটি জন মানব পূর্ণ হলে ও ওনার আগমনে শূন্য হয়ে যায়। আকবর যেমন সকলের সম্রাট,আম ও তেমন ফলের সম্রাট। তাই আম দেখে পেট ও আপনা আপনি জায়গা করে দেয়। মরক্কো পরিব্রাজক ইবন বতুতা ওনার লেখায় বাংলাদেশের সুস্বাদু আমের প্রশংসা করেছেন।তবে তিনি এ ও লিখেছিলেন, আমের ছায়ায় বিশ্রাম নিলে জ্বর হয়।
আমের কথায় মনে আসে বিখ্যাত কবি আমীর খসরুর কথা। তার কবিতায় একজন নারীর বয়ানে তিনি লিখেছিলেন,-
সে বছরে একবার আমার শহরে আসে,
চুম্বন ও অমৃতে সে আমার মুখ ভরিয়ে দেয়,
তার জন্য আমি সকল অর্থ ব্যয় করি,
ও নারী, সে কি তোমার প্রেমিক পুরুষ?
না, সেটি হলো আম।
আমীর খসরু আম কে ” নঘজা তারিন মেওয়া হিন্দুস্থান” বা ভারতবর্ষের অতিশয় সুস্বাদু ফল নাম দিয়েছিলেন। এই প্রতিযোগিতা থেকে উর্দু কবি মির্জা গালিব ও বাদ যাননি। প্রতি বছর গ্রীষ্মকাল এলেই মির্জা গালিব আমের জন্য অপেক্ষা করতেন। তাঁর বন্ধুরা পশ্চিমবঙ্গের মালদা থেকে আম পাঠাতেন। পরিচিতদের কাছে বিভিন্ন ধরণের আমের জন্য বার বার প্রশ্ন করতেন।মুঘল আমলের শেষের দিনগুলির সাক্ষী ছিলেন তিনি। মুঘল যুগে সম্রাটদের প্রাসাদে নারীদের জন্য একটি বাগিচা ( জনানা বাগ) এবং পুরুষদের জন্য পৃথক একটি বাগিচা ছিলো( মর্দানা বাগ)। একদিন মির্জা গালিব, মুঘল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর ও কয়েকজন রাজ পারিষদের সাথে লাল কেল্লার বাগ-ই- হায়াত-বক্স বা মর্দানা বাগে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন কিন্তু তার দৃষ্টি ছিলো জনানা বাগের আম গাছের আমগুলোর দিকে। সম্রাট যখন তাকে প্রশ্ন করেন, তিনি কি দেখছেন,মির্জা গালিব উত্তর দেন , তিনি আমগুলো দেখছেন,কারণ কথায় আছে দানায় দানায় লেখা থাকে খানেওয়ালার নাম( “দানে দানে পে লিখা হ্যায় খানেওলাকে কা নাম”)। তিনি আর ও বলেন, তাই, আমি প্রতিটি আম ভালোভাবে পর্যবেক্ষন করে আমার প্রতিটি পূর্ব পুরুষের নাম খোঁজার চেষ্টা করছি। তাঁর সেই রসিকতার অর্থ বুঝতে পেরে, সেই দিনই সম্রাট তাঁর বাড়ীতে বাক্স ভরে আম পাঠিয়ে দেন। একদিন, মির্জা গালিব তার বন্ধু হাকিম রাজি- উদ্-দিন- খানের সাথে বাড়ীর বারান্দায় বসে গল্প করছিলেন।হাকিম সাহেব আমের বিলাসী ছিলেন না। সেই সময় একটা গাধার গাড়ী সেই পথ দিয়ে যাচ্ছিলো। গাধাটা রাস্তার পাশে পড়ে থাকা আমের খোসা শুকে চলে যাওয়ায় হাকিম সাহেব বলেন-
” দেখো, গাধা ও আম খায় না”,
মির্জা গালিব উত্তরে বলেছিলেন,
” নিঃসন্দেহে, গাধারাই আম খায় না।
আরেকদিনের কথা, মৌলানা -ফজল -ই- হক তার সকল বন্ধুদের সাথে আমের গুণাগুণ নিয়ে কথা বলছিলেন, সেই আলোচনায় মির্জা গালিব ও উপস্থিত ছিলেন। মৌলানা সাহেব মির্জা গালিব কে এ বিষয়ে প্রশ্ন করায় তিনি বলেন, আমের ক্ষেত্রে আমার কাছে দুটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ, মিষ্টতা এবং পরিমাণের আধিক্য। তারপর মৌলানা সাহেব ওনাকে আম উপহার দেন। মির্জা গালিবের একটি প্রিয় পদ হলো কালিয়াম্বা।এই পদটি শাম্মি কাবাব ও কাঁচা আম দিয়ে তৈরি করা হতো।
বাংলা ভাষায় শিক্ষকতার পাশাপাশি লেখালেখির সাথে যুক্ত। কয়েকটি ব্লগে লেখাও প্রকাশিত হয়েছে।তথ্যমূলক লেখার প্রতি আগ্রহে কলমে ফুটিয়ে তোলেন অজানাকে। লোক সংস্কৃতি, নানান দেশের খাদ্যাচরণ, ভ্রমণমূলক লেখার প্রতি প্রবল আগ্রহ রয়েছে।বিভিন্ন দেশের প্রকৃতি ও ইতিহাসের টানে চলে যান সেই মাটির কাছে। শৈশব থেকে গান গাইতে ভালোবাসেন। সম্প্রতি বাংলাদেশের একটি নাটকের জন্য রবীন্দ্র সঙ্গীত গেয়েছেন।