Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,The history of mango 3

ইতিহাস: আম আলাপন (পর্ব-৩) । সুকন্যা দত্ত

Reading Time: 3 minutes
আমের সুনাম তার কাঁচা কিংবা পাকা স্বাদে। কাঁচা মিঠা হোক বা তুলতুলে নরম পরিপক্ক,  এ স্বাদের জুড়ি মেলা ভার। আম কাটলেই নীল মাছি ভনভনিয়ে হানা দেয়। আত্মীয় – পরিজন হোক বা জামাই আপ্যায়ন কিংবা পুজো পার্বনে আম ফল বা আমের পল্লব চাইই চাই। জামাই ষষ্ঠীতে জামাইয়ের পাতে পঞ্চ ব্যঞ্জনের সাথে আমের টুকরো থাকবেই। বছরের এই সময় আমের পান্না, আমসত্ত্ব,আমের সরবত, আম ক্ষীর,  দুধ- আমের বাহারি আহারে বাঙালি  পেট ভরায়।  আমার দিদা কে দেখেছি কালো পাথরের বাটিতে আম- দুধ খেতে। ফল কাটার বঁটিতে ভালো করে আম কাটার পর সেটা ধুয়ে মুছে রেখে দিতেন।  ম্যাঙ্গো দই, ম্যাঙ্গো রাবড়ি,  ম্যাঙ্গো সন্দেশ, ম্যাঙ্গো আইসক্রীম  বা বাদ দেই কেমন করে? গরমকালে কাঁচা আমের ডাল হোক বা আমের টক চাটনি , আমের জেলি হোক বা আমের মুরব্বা মন খাই খাই করবেই।  গ্রাম বাংলার কিছু কিছু স্থানে ” আমষষ্ঠী” অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে মা ষষ্ঠীর আর্শীবাদ হিসেবে সন্তানের হাতে আম তুলে দেওয়া হয়। আম মানেই চৈত্রের বারুণী উৎসব। এদিন বাঙালি বধূরা  গঙ্গায় কাঁচা আম উৎসর্গ করে।  মঙ্গল ঘট হোক বা হিন্দু বিবাহের সামাজিক রীতি,আম্র পল্লব ছাড়া সব সম্পূর্ণ।
দেবেন্দ্রনাথ সেন ওনার কবিতায় লিখেছিলেন-
” মধুর মধুর, যেন  পদ্মমধু ভ্রমর ঝঙ্কৃত
 কনকিত পাকা আম নিদাঘের সোহাগে রঞ্জিত”।
কাজী নজরুল ইসলামের লেখায় ফুটে উঠেছে বৈশাখের কচি আমের টক নিয়ে একটি কবিতা,
” কচি আম- ঝাল- টক খাইয়া গিন্নিমায়
  বৌঝির সাথে করে টক্ষাই টক্ষাই!”।
মধুসূদন দত্ত ” মধু মাখা ফল মোর বিখ্যাত ভুবনে/ তুমি কি তা জান না ললনে?” অংশে মধুমাখা ফল বলতে আমকেই বুঝিয়েছেন। ১৬৭৩ সালে কবি ফ্রাইয়ার আমের কথা প্রসঙ্গে বলেছেন,
” যদি স্বাদের কথা ধরি,তবে আমের কাছে নেকটারিন,পিচ এবং অ্যাপ্রিকট  অনেক পিছনে।”
১৭২৭ সালে কবি হ্যামিলটন লেখেন
” গোয়ার আম সবচেয়ে বড়( বোম্বাই এবং আলফান্সো) আর পৃথিবীর যে কোন ফলের চেয়ে স্বাদে, গন্ধে তৃপ্তিকর, রসনা রোচক, সরস এবং উপাদেয়।”
আমের কথা আসলেই রবীন্দ্রনাথ কে বাদ দেওয়ার উপায় নেই। আমের সময়ে জোড়াসাঁকো থেকে কুমারখালির শিলাইদহ বা শাহজাদপুরে গেলে সঙ্গে করে আম নিয়ে যেতেন। আমের ঝুরি খালি হওয়ার আগে স্ত্রী কে চিঠিতে লিখতেন,
” আমার আম ফুরিয়ে এসেছে। কিছু আম  পাঠিয়ে না দিলে অসুবিধা হবে।”
ছোটবেলায় এই আমের ভালোবাসায় লিখেছিলেন,
” আমসত্ত্ব দুধে ফেলি, 
তাহাতে কদলী দলি,
সন্দেশ মাখিয়া দিয়া তাতে……”
বৈশাখ জ্যৈষ্ঠ এলে আমের জন্য রবীন্দ্রনাথ ভীষণ খুশী হতেন।  আম কেটে খাওয়ার বদলে চুষে খেতেই ভালোবাসতেন। বাংলায় আমের সময়ে এক  জাপানি ভদ্র মহিলা টমি ওয়াডার আমন্ত্রণে দ্বিতীয় বার জাপানে যাওয়ার জন্য রবীন্দ্রনাথ ইতঃস্তত বোধ করেন। পরে অবশ্য সমাধান স্বরূপ বরফের বাক্সে আম ভরে  নিজের সঙ্গে করে  নিয়ে যান। পুত্র রথীন্দ্রনাথের কথায় জানা যায়, অসুস্থ হয়ে আমেরিকা যাওয়ার সময় মুম্বাই বন্দর থেকে তিনি এক বাক্স আলফান্সো আম কিনেছিলেন। পল্লি কবি জসীমউদ্দিন এর কবিতায় আমের কথায় সেই ঝড়ের দিনে আম কুড়ানোর ধুম পড়ে যাওয়ার কথা মনে ভেসে ওঠে..
” ঝড়ের দিনে মামার দেশে আম কুড়াতে সুখ
পাকা জামের মধুর রসে রঙিন করি মুখ”।
আম খেতে ও খাওয়াতে ভালোবাসতেন  কবি হেমচন্দ্র, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী,মহারাজা যতীন্দ্র মোহন ঠাকুর, ব্যবসায়ী বটকৃষ্ণ পাল এমন অনেকেই। 
 

আরো পড়ুন:  আম আলাপন (পর্ব-২)

 
মুর্শিদাবাদে বহু রকম আম পাওয়া যায়। ১৭০২ সালে মুর্শিদকুলি খান ঢাকা থেকে মুর্শিদাবাদে রাজধানী স্থানান্তরিত করে অনেক আম বাগান তৈরি করেন। নবাবপসন্দ, মিরজাপসন্দ, রানিপসন্দ, সারোঙ্গা, কালাসুর এমন সব নামের ছড়াছড়ি। মুর্শিদাবাদে সে সকল ঘরে দুষ্প্রাপ্য কোহিতুর আসত,সেই আমের গায়ে নাম আর খাওয়ার তারিখ লেখা থাকতো। আমের কথায় মনে পড়ে গেলো বোধিসত্ত্ব  মহাকপির গল্প।  কাশীর কাছের গঙ্গার পাশেই একটা বড় আম গাছে মহাকপি তার অনুচর বাঁদরদের সাথে বাস করতো। মহাকপি জানতেন,সেই বৃক্ষের আম  ফল এতই সুস্বাদু যে কেউ তার স্বাদ পেলে বৃক্ষটি অধিগ্রহণ করবে।  তাই মহাকপি সকল অনুচরকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, একটি আম ও যেন গঙ্গার জলে না পড়ে। কিন্তু কোন একদিন  একটি আম জলে পড়তেই তা জলে ভাসতে ভাসতে গঙ্গায় স্নানরত রাজার কাছে পৌঁছে যায়। রাজা সেই স্বাদে মোহিত হয়ে গাছটি দখল করতে বেড়িয়ে পড়েন। মহাকপি তার অনুচর প্রজাদের  অপর পাড়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য একটি সাঁকো তৈরি করেন।  সকলে পার হলে ও দেবদত্ত নিজে পার হয়েই মহাকপিকে ধাক্কা দিয়ে জলে ফেলে দেন।  এরপর মহাকপি রাজার হাতে বন্দী হলে তিনি জানান,
” মহারাজ, আপনার তো সব আছে, এটুকু না পেলে কি কিছু অসম্পূর্ণ থাকতো?”
 
 
 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>