| 20 এপ্রিল 2024
Categories
সময়ের ডায়েরি

আমেরিকার স্বাধীনতা দিবসের গুরুত্ব

আনুমানিক পঠনকাল: 3 মিনিট

৪ ঠা জুলাই আমেরিকার স্বাধীনতা দিবস। ২৪৪ বছর আগে ১৭৭৬ সালের ২ জুলাই ইংল্যান্ডের শাসন থেকে পৃথক হওয়ার জন্য ভোট দিয়েছিল আমেরিকার দ্বিতীয় কন্টিনেন্টাল কংগ্রেস। এর দুইদিন পর ৪ জুলাই স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে চূড়ান্ত অনুমোদন আসে কংগ্রেসের হাত ধরেই। অবশ্য ব্রিটেনের সঙ্গে পৃথক হওয়ার জন্য চূড়ান্ত স্বাক্ষর ২ আগস্টে অনুষ্ঠিত হলেও প্রত্যেক বছর ৪ জুলাই স্বাধীনতা দিবস উদযাপন করে যুক্তরাষ্ট্র। আসলে ১৭৭৬ সালের ৪ জুলাইয়ের আগে ১৩টি উপনিবেশ একসঙ্গে ইংল্যান্ডের রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু করেছিল। ভার্জিনিয়া উপনিবেশের জেনারেল জর্জ ওয়াশিংটন ছিলেন প্রধান সেনাপতি এবং স্বাধীন আমেরিকার প্রথম প্রেসিডেন্ট (১৭৮৯-১৭৯৭)। স্বাধীনতা যুদ্ধে জয় পাওয়ার জন্য ২৫ হাজার বিপ্লবী আমেরিকানকে জীবন দিতে হয়। একইসঙ্গে ২৭ হাজার ব্রিটিশ ও জার্মান সেনার মৃত্যু ঘটে যুদ্ধে। কন্টিনেন্টাল কংগ্রেসের পাঁচজনের একটি কমিটি স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র রচনা করেন। টমাস জেফারসন, জন অ্যাডামস, বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন ছিলেন এ কমিটির অন্যতম সদস্য। টমাস জেফারসন ছিলেন মূল লেখক। রচিত ঘোষণাপত্রটি নিয়ে কংগ্রেসে তর্ক-বিতর্ক হয় এবং পরিশেষে সেটি চূড়ান্ত রূপ লাভ করে। ‘প্রতিটি মানুষই সমান এবং একই সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি’ এই বাণীকে সামনে রেখে যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার বাণী রচিত হয়েছে।

১৭৭৬ সালে ব্রিটিশদের কাছ থেকে শুধু ভৌগোলিক স্বাধীনতা নয়, সেদিন উৎপাটিত হয়েছিল সব পরাধীনতার শৃঙ্খল, বহাল হয়েছিল বাকস্বাধীনতা, পত্রিকা ও প্রকাশনার স্বাধীনতা, ধর্মীয় স্বাধীনতা, এমনকি কোনো আইন পরিবর্তনের জন্য সরকারের কাছে আবেদন করার স্বাধীনতা পেয়েছিল সবাই, আমেরিকায় বসবাসকারী প্রতিটি মানুষ। অর্থাৎ নিজেকে প্রকাশ করার যে স্বাধীনতা, সংবাদপত্র, রেডিও-টেলিভিশন তথা গোটা মিডিয়ার যে স্বাধীনতা তাও স্বীকৃতি পায়। সেদিন ব্যক্তি জেনেছিল ধর্ম পালনে রাষ্ট্র কাউকে বাধ্য বা নিষেধও করবে না। যে যার ধর্ম পালন করবে। সেদিন থেকে এখনো নিরাপদে ও নিশ্চিন্তে স্বাধীনভাবে নিজের ধর্ম পালনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রই একমাত্র শান্তির ভূমি। প্রায় আড়াই’শ বছর ধরে নানা ধর্ম-বর্ণের মানুষ সেখানে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করে চলেছে। এজন্য ২০১৬ সালে জয়ী হয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, ‘আমি সব আমেরিকানের প্রেসিডেন্ট। …আমি এজন্য এসেছি যেন আমরা একসঙ্গে কাজ করে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারি। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে আমরা সবাই আমেরিকাকে গ্রেট করার জন্য কাজ করবো।’ তাঁর এই বক্তব্যের স্পিরিট এসেছে যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র থেকে।

২.

আমেরিকার ইতিহাসে ১৭৭৬ সালের জুলাই মাসের শুরু হয়েছিল আশা জাগানিয়া অনেক বার্তা নিয়ে। সেই সালের ২ তারিখ ছিল রৌদ্রকরোজ্জ্বল ও ঐতিহাসিক। কারণ ওই দিন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য রাজনীতিবিদরা তৈরি করেছিলেন স্বাধীনতার স্তম্ভ। জেফারসনের হৃদয় তখন আন্দোলিত স্বাধীনতা ও মুক্তির নিশানায়। কংগ্রেসের ক্লোজিং সেশনে উপস্থাপিত প্রতিপাদ্য ৪ জুলাই চূড়ান্ত হয়ে যুক্তরাষ্ট্রের স্বতন্ত্র মহিমা ত্বরান্বিত হয়ে ওঠে; স্বাধীনতার ঘোষণা বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি পায়। অদ্ভুত হলেও সত্য জন অ্যাডামস এবং টমাস জেফারসন উভয়ই ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রেসিডেন্ট আর তাদের মৃত্যু হয় একই তারিখ অর্থাৎ ৪ জুলাই। সেদিন ১৮২৬ ছিল স্বাধীনতা ঘোষণার পঞ্চাশ বছর। ডিক্লারেশনে স্বাক্ষর না থাকলেও James Monroe  ছিলেন আরেক স্বাধীনতার জনক যিনি পঞ্চম প্রেসিডেন্ট হিসেবে ৪ জুলাই মৃত্যুবরণ করেন ১৮৩১ সালে। ত্রিশতম প্রেসিডেন্ট Calvin Coolidge জন্মগ্রহণ করেন ৪ জুলাই ১৮৭২ সালে। তিনি একমাত্র প্রেসিডেন্ট যিনি স্বাধীনতা দিবসে জন্মগ্রহণ করেছিলেন।

১৭৭৭ সালে প্রথম যেদিন দিবসটি উদযাপনের সূচনা হলো সেদিনকার সকালটা ছিল বর্ণিল। তেরবার তোপধ্বনি আর অভিবাদনের মধ্য দিয়ে শেষ হওয়া সেই দিনটি আজও স্মরণীয় হয়ে আছে ইতিহাসে। প্রার্থনা, বক্তৃতা, প্যারেড আর আতশবাজির সন্ধ্যাটাও ছিল মনোরম। ১৭৭৮ সালে জর্জ ওয়াশিংটন, জন অ্যাডামস আর বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন একত্রিত হন। ভোজের আয়োজন করা হয় প্যারিসেও। কারণ স্বাধীনতা যুদ্ধে ফ্রান্স ও স্পেন ছিল আমেরিকার মিত্র। দিবসটিতে আমেরিকার ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বহু শিশু আনন্দ নৃত্যে মেতে ওঠে। কার্টুন আর বাদ্যের তালে মুখরিত করে তোলে এক একটি রাজ্য।

২৪৪ বছরে উপনীত হয়ে স্বাধীনতা দিবসটি উদযাপনে বহুমাত্রিক বৈচিত্র্য এসেছে। প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানের অভূতপূর্ব জোয়ারে তবু পুরানো অনেক কিছু এখনো প্রচলিত আছে। সপ্তাহজুড়ে প্যারেডগুলো সম্পন্ন হয় সকালে, সন্ধ্যায় হয় আতশবাজি আর পারিবারিক পুনর্মিলনী; রাত্রি জেগে ওঠে সংগীতের মূর্ছনায়। কোনো কোনো শহরের সুউচ্চ টাওয়ার থেকে আলোককিরণ ছড়িয়ে পড়ে গ্রীষ্মের বাতাসে। দিবসটিতে আপনি শুনতে পাবেন দেশাত্মবোধক গান আর জাতীয় সংগীত, ‘গড ব্লেস আমেরিকা’, ‘আমেরিকা বিউটিফুল’, ‘দিস ল্যান্ড ইজ ইয়োর ল্যান্ড’ প্রভৃতি স্লোগান। কখনো বা প্রত্যন্ত অঙ্গরাজ্যের লোকায়ত সুরে যুদ্ধের কথা স্মরণ করিয়ে দেবে আপনাকে।

৩.

২০২০ সালের করোনা ভাইরাস ও বর্ণবাদের মহামারি মোকাবেলা করার পাশাপাশি আমেরিকাবাসী ৪ঠা জুলাই স্মরণ করছে। আমাদের কাছে যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা দিবস গুরুত্বপূর্ণ কেন? গুরুত্বপূর্ণ এই কারণে যে, মহামারির মধ্যেও সেখানে অবস্থানরত বাংলাদেশিরা শান্তিপূর্ণ জীবন-যাপন করছেন এবং তাদের বন্ধন ও শেকড় এখন অনেক গভীরে। বাঙালি ফজলুর রহমান খান যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগোতে অবস্থিত উচ্চতম টাওয়ারের নকশা করেছেন। সাল খান একজন খ্যাতনামা শিক্ষাবিদ। হ্যানসেন ক্লার্ক বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত প্রথম মার্কিন কংগ্রেসম্যান। এম. ওসমান সিদ্দিক ফিজিতে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত হিসেবে কর্মরত ছিলেন। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ সম্পর্ক যুক্তরাষ্ট্র ও আমেরিকান জনগণের এবং বাংলাদেশ ও বাংলাদেশি জনগণের কল্যাণ বয়ে এনেছে এবং বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক নিরাপত্তার প্রসার ঘটিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন রাজ্যে প্রায় ৫ লাখ বাংলাদেশি বসবাস করছে। বাংলাদেশেও অনেক আমেরিকান বসবাস করছেন। তাদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। দু’দেশের জনগণ কূটনৈতিক সম্পর্ক এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের প্রতি মার্কিন নীতি হল রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের প্রতি গুরুত্বারোপ। ইসলামিক রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বাংলাদেশকে উদারচেতা হিসেবেই তারা দেখে থাকেন।  আঞ্চলিক নিরাপত্তা, সন্ত্রাসবাদ দমন এবং প্রতিরক্ষা খাতে দুই দেশের যৌথ কর্মসূচি চলমান রয়েছে। দুই দেশই এ সম্পর্ক এগিয়ে নিতে চায়। এ ছাড়া, মার্কিন একাধিক বড় কোম্পানি বাংলাদেশে বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। এসব কোম্পানির স্বার্থ সংরক্ষণেও তৎপর যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশের অন্যতম বড় উন্নয়ন সহযোগী দেশও যুক্তরাষ্ট্র। শেখ হাসিনা সরকারের চলমান উন্নয়ন কর্মসূচিকে সমর্থন ও সহযোগিতা প্রদানের পাশাপাশি এ ক্ষেত্রে সুসম্পর্ক ধরে রাখতে আগ্রহী ওয়াশিংটন। আর একারণে আমরা আজকে আমেরিকার স্বাধীনতা দিবসের গুরুত্ব উপলব্ধি করতে সক্ষম।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত