| 18 এপ্রিল 2024
Categories
নারী

পুরোনো কলকাতার নারীর অন্দরমহল

আনুমানিক পঠনকাল: 3 মিনিট

আনন্দময় কর

মহামহিম ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায় (১৮৪৭-১৯১৯) -এর “লুল্লু ভূত” এর গপ্প আশা করি আপনারা পড়েছেন, সেই লুল্লু ভুতের আবার আমীরের সুন্দরী স্ত্রীকে নিকে করবার খুব শখ, শুধু তো শখ হলেই হবে না বাপু, ভূত বলে কি মানুষ নয়, তারও তো খানিক রূপচর্চার ইচ্ছে হয়, তো চলুন ত্রৈলোক্যনাথ বাবুর ভাষাতেই শুনি লুল্লুর রূপচর্চার বিবরণ …..
“প্রাতঃকাল না হইতে হইতে ভূত বাটী ফিরিয়া আসিয়াই, প্রথমে আপনার গর্তে গিয়া শুইলো। ঘোরতর নাক ডাকাইয়া অনেকক্ষণ নিদ্রা যাইলো। তারপর উঠিয়া হ্রদের জলে স্নান করিতে যাইলো। পাথর দিয়া, ঝামা দিয়া, বালি দিয়া, সাবাং (সে আমলের খাঁটি কলকেতিদের ভাষায় সাবাং হলো সাবান) দিয়া উত্তমরূপে গা মাজিলো । …… আপনা আপনি বলিলো “ক্রমে এইবার দুধে আলতার রং হইয়া আসিতেছে ….”

উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম অর্দ্ধে আর আজকের দিনে এই ফর্সা হবার প্রানান্ত প্রচেষ্টার মধ্যে মনে হয় না কোনো তফাৎ আছে, আছে শুধুই কালের পরিবর্তন। সেকালের কলকাতার গৃহিনীদের ত্বক পরিচর্যার ব্যাপারে পরে বলছি, চলুন পিছিয়ে যাই আরো খানিকটা সময় ….
ফ্যানি পার্কস কে মনে আছে আপনাদের? ফ্যানির হাত ধরে একটু ঘুরে দেখা যাক সেকালের কলকাতার অন্দরমহল ।তার আগে ফ্যানির পরিচয়টা দিয়ে দি আপনাদের । স্বামী চার্লস পার্কার ছিলেন কেরানি (Writer)। স্বামীর সাথে ভারতে আসেন ১৮২০ সালে, ছিলেন ১৮৪৫ সাল অব্দি। ওনার দেখা সে আমলের ভারতবর্ষের বর্ণনা উনি সুন্দর করে লিপিবদ্ধ করে গেছেন ডায়রিতে, উৎসাহীরা পড়ে দেখতে পারেন সে বই। ছোট্ট একটা কথা বলে নি এই ফাঁকে .. রাজা রামমোহন রায়ের বাড়ির দুর্গাপূজায় ফ্যানি উপস্থিত ছিলেন এবং ডাইরিতে খুব সুন্দর করে লিখে গেছেন সে কথা। চলুন এবারে ফিরে যাই সেখানে, যেখানে ফ্যানি বর্ণনা দিচ্ছেন সে আমলের অন্দরমহলের __

মার্চ ১৮২৬ – “ …. কলকাতায় এক ধনী হিন্দুর বাড়িতে নাচ দেখার নিমন্ত্রণে গিয়েছিলাম, অনুষ্ঠানের শেষে বাবু আমাকে জিজ্ঞেস করলেন বাড়ির বউ-ঝিদের সঙ্গে দেখা করতে চাই কিনা। বিশাল পর্দা সরিয়ে তিনি ভেতরে যেখানে ঢুকলেন, সেখানে ঘুটঘুটে অন্ধকার; দুজন মহিলা আমাকে হাত ধরে অনেকটা সিঁড়ি বেয়ে নিয়ে গেলেন একটি আলোকিত ঘরে, সেখানে তার স্ত্রী ও অন্যান্য মহিলারা আমার জন্যে অপেক্ষা করছিলেন। দুজন মহিলা খুবই সুন্দরী, তাদের পোশাক দেখে বুঝলাম কেন তাঁদের স্বামীরা ছাড়া আর কেউ অন্দরে ঢুকতে পারেন না। ফিনফিনে বেনারসি কাপড়ে জরির পাড়, তাদের শরীরে দুপ্যাঁচ করে জড়িয়ে কাধের ওপরে ফেলা। পোশাকটা নিতান্তই স্বচ্ছ, শরীরের কিছুই প্রায় ঢাকে না, গলা ও হাত ভর্তি গয়না। ….”

এইতো গেলো অন্দরমহলের চিত্র, এবার দেখা যাক সেকালের ত্বক পরিচর্যার ব্যাপারে (সাবাং প্রচলনের আগের পর্যায়) রাধাপ্রসাদ গুপ্ত মশায় কি বলে গেছেন …
“ …গত শতাব্দীর বাবু কালচারের বাবুরা যখন তাঁদের বিশাল গতরে চাকর দিয়ে ডলাই মলাই করে চানের আগে আধ পো তেল খাওয়াতেন তখন মেয়েদের গায়ের পরিচর্যা বিশেষ করে বড়লোকদের বাড়িতে যে একটু বিশেষ রকমের ছিল তাতে আর আশ্চর্য কি? মুখ আর গা পরিষ্কার করার জন্যে সর, ময়দা বা ডালবাটা আর তার সঙ্গে কখনও কমলালেবুর খোসা কখনও বা অন্য নানান ‘অনুপান মিশিয়ে মিহি করে একসঙ্গে বেটে মেয়েরা মাখতেন। তারপর ময়দার মতন করে বেসন মেখে গায়ে-মুখে লাগিয়ে চামড়ায় ডলে ডলে শেষ ময়লাটুকু উঠিয়ে দেওয়া হত। এই চামড়ার পরিচর্যাটা হত সাধারণত বিকেলে গা-ধোয়ার আগে। বড়লোকদের বাড়িতে এইভাবে রোজ মেয়েরা তাদের সৌন্দর্যের পরিচর্যা করলেও গেরস্থবাড়িতেও মেয়েদের জন্যে হপ্তায় একবার-দুবার এই ধরনের ব্যবস্থা ছিল। সর মাখাটা এখন আজগুবি গোছের শোনালেও যখন টাকায় ষোলো সের খাঁটি দুধ পাওয়া যেত তখন খুব একটা অসাধারণ ব্যাপার ছিল না। … ”
রসরাজ অমৃতলাল বসু মশায়ের লেখায় পাই সে কালের কলকাতার সাবান সৌখিনতার বিবরণ, সে এক আশ্চর্য্য উপখ্যান। অমৃতলাল লিখেছেন, “সাবান তখন গেরস্থরা বাড়িতে পাঁচড়া হলে কিনত আর পুজোর সময়ে বিয়ের বয়সী মেয়েরা আর বাড়ির ছোট ছোট বউরা একটু হাতে-মুখে মাখার জন্যে সাবানের আবদার করত।” এই শতাব্দীর গোড়ার দিকে অবিশ্যি বড়লোকদের বাড়িতে যুবতী মেয়েদের মধ্যে সাবান মাখার রেওয়াজ বেশ কায়েম হয়ে গিয়েছিল। আবার রাধাপ্রসাদ গুপ্ত এই বিষয়ে লিখছেন .. “স্বদেশিযুগের কথা দূরে থাক আমাদের ছোটবেলায় বাড়ির বয়স্কা মেয়েরা সাবান মাখতেন না। বিধবারা ত নয়ই। যদি কোন বিধবা লুকিয়ে চুরিয়ে একটু আধটু সাবান মাখতেন তা জানা পড়ে গেলে পাড়ায় ঢি ঢি পড়ে যেত। …”

আজ তাহলে এটুকুই থাকুক, পরে কোনোদিন সুযোগ মতো সে যুগের স্নো, পাউডার, পমেটম নিয়ে আলোচনা করা যাবে, সবার কাছে অনুরোধ রইলো যে আপনাদের সাধ্যমত সে আমলের রূপচর্চার ব্যাপারে যদি কমেন্টে আলোকপাত করেন তাহলে সমৃদ্ধ হই আমরা প্রত্যেকই। আমাদের প্রিয় কলকাতা তার প্রাচীন গন্ধ গায়ে মেখে বেঁচে থাকুক চিরকাল, ভালো থাকুন সকলে .. শুভ কামনা।

 

তথ্য ঋণ : রঞ্জিত চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত ভৌতিক গল্প সংকলন, অমৃতলাল বসুর পুরাতন পঞ্জিকা, রাধাপ্রসাদ গুপ্তের কলিকাতায় ফিরিওয়ালার ডাক ও রাস্তার আওয়াজ
ছবি: রাধাপ্রসাদ গুপ্তের কলিকাতায় ফিরিওয়ালার ডাক ও রাস্তার আওয়াজ বই থেকে নেওয়া

ডিসক্লেমার : সব ভাবনা লেখকের নিজের

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত