| 29 নভেম্বর 2024
Categories
অনুবাদ অনুবাদিত গল্প

অনুবাদ কল্পবিজ্ঞানের গল্প: অঘটনবাজ । এইচ জি ওয়েলস

আনুমানিক পঠনকাল: 19 মিনিট

অঘটনবাজ ( The Man Who Could Work Miracles )

এইচ জি ওয়েলস 

অনুবাদক: অদ্রীশ বর্ধন

[‘The Man Who Could Work Miracles’ প্রথম প্রকাশিত হয় ‘Illustrated London News’ পত্রিকায় জুলাই ১৮৯৮ সালে। ‘Doubleday & McClure Co.’ থেকে ১৮৯৯ সালে প্রকাশিত ‘Tales of Space and Time’ সংকলনটিতে গল্পটি স্থান পায়। ১৯৩৭ সালে গল্পটি পরবর্ধিত আকারে ‘Roland Young’ অভিনীত ছায়াছবি হিসাবে মুক্তি পায়।]

ঈশ্বরদত্ত আশ্চর্য এই ক্ষমতা তার সহজাত কি না, সে বিষয়ে সন্দেহ আছে বিলক্ষণ। আমার তো মনে হয়, ক্ষমতাটা তার মধ্যে এসেছিল অকস্মাৎ। পয়লা নম্বরের নাস্তিক ছিল তিরিশে পা দেওয়ার আগে পর্যন্ত। অলৌকিক শক্তি যে আদৌ কারও থাকতে পারে, এ বিষয়ে বিশ্বাসী ছিল না মোটেই। আকারে নেহাতই খর্বকায়, চোখ দুটো গনগনে বাদামি, বেজায় খাড়া লাল চুল, গোঁফজোড়া রীতিমতো পাকানো এবং দুই প্রান্তে যখন-তখন পাক দেওয়াটা তার অষ্টপ্রহরের মুদ্রাদোষ। নাম তার জর্জ ম্যাকহুইরটার ফোদারিনগে। এ নাম যার থাকে, তাকে আর যা-ই হোক, কোনও অলৌকিক ব্যাপারস্যাপারের সঙ্গে জড়িত করা চলে না। পেশায় তো কেরানি। গলাবাজ তার্কিক। অলৌকিক কাণ্ডকারখানা ঘটা যে একেবারেই অসম্ভব, এই বিষয়টা বিষম গলাবাজি করে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়েই প্রথম মোলাকাত ঘটে গেল অলৌকিক ব্যাপারের সঙ্গেই। তর্ক চলছিল লং ড্রাগন পানশালায়। প্রতিপক্ষ টোডি বিমিসের তা যা বলেছ শব্দগুচ্ছের একঘেয়ে কশাঘাতে ধৈর্যচ্যুতি ঘটেছিল মি. ফোদারিনুগের।

এই দুজন ছাড়াও পানশালায় সেদিন হাজির ছিল জনৈক ধূলিধূসরিত সাইকেল আরোহী, বাড়িওয়ালা কক্স এবং লং ড্রাগন-এর সুরা পরিবেশন করে যে মেয়েটি–মিস মেব্রিজ। তার দিকে পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে গেলাস ধুয়ে যাচ্ছিল আপন মনে। অন্য দুই ব্যক্তি সকৌতুকে শুনছিল ফোদারিনগের নিষ্ফল গলাবাজি। মি. বিমিসেয় নিরুত্তাপ মন্তব্য এবং নিরুত্তেজ তর্ককৌশলে কোণঠাসা হয়ে পড়ে অলৌকিক ব্যাপারটাকে প্রাঞ্জল করতে প্রয়াস পেয়েছিল মি. ফোদারিনগে। বলেছিল, জিনিসটা আগে ভালো করে বোঝ। মির্যাল হল এমনই সব উদ্ভট আজগুবি ব্যাপারস্যাপার, যা নিত্যনৈমিত্তিক প্রাকৃতিক ব্যাপারস্যাপারের ঠিক উলটো ইচ্ছাশক্তির জোরে যে অঘটন ঘটানো চলে–বিশেষ ইচ্ছাশক্তি না থাকলে যা ঘটানো যায় না।

তা যা বলেছ, মি. বিমিস কুপোকাত করে দিয়েছিল তাকে আবার সেই মারাত্মক শব্দগুচ্ছ প্রয়োগে।

সমর্থনের আশায় কাতর চোখে সাইকেল-আরোহীর পানে চেয়েছিল মি. ফোদারিনগে। সে ভদ্রলোক এতক্ষণ শুনেই যাচ্ছিল নীরবে। এবার সমর্থন জ্ঞাপন করল খুকখুক করে একটু কেশে এবং মি. বিমিসের পানে এক ঝলক তাকিয়ে। এসব ঝক্কিঝামেলায় নাক গলাতে মোটেই চায় না বলে, উদাসীন রয়ে গেল বাড়িওয়ালা। মি. বিমিস কিন্তু মাথা নেড়ে মির্যাকল সংজ্ঞা মেনে নিতেই যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেয়ে গেল মি. ফোদারিনগে।

বললে বিষম উৎসাহে, যেমন ধর মির‍্যা ঘটানো যায় এইখানেই। ওই যে লম্ফটা দেখছ, ও লম্ফ কি শিখা নিচের দিকে করে কখনও জ্বলতে পারে? হ্যাঁ কি না, বলেই ফেলনা বিমিস।

তুমি তো বলেই দিলে–না, পারে না, উদাসীন জবাব বিমিসের।

আরে গেল যা! তোমার কী মনে হয়, সেটা তো বলবে।

না, পারে না।

তাহলে সমস্ত ইচ্ছাশক্তি জড়ো করে আমিই হুকুম দিচ্ছি সোজা লম্ফকে উলটো হয়ে জ্বলতে।ওহে লম্ফ! উলটে যাও! শিখা নিচের দিকে থাকুক–আছড়ে পড়ে ভেঙে যেয়ো না যেন!–এ কী!

এই যে এ কী! বিস্ময়োক্তি, এটা প্রত্যেকের গলা ফুড়ে তেড়েমেড়ে বেরিয়ে এসেছিল সেই মুহূর্তে। কেননা নিরেট বস্তুর জ্বলন্ত লম্ফ সহসা উলটে গিয়েছিল শূন্যে এবং মেঝের ওপর শূন্যে ভাসমান অবস্থায় থেকে জ্বলন্ত ছিল নির্বিকারভাবে। প্রজ্বলন্ত শিখা সটান বিস্তৃত নিচের মেঝের দিকে! যেন অতিশয় স্বাভাবিক ব্যাপার!

মি. ফোদারিনগে তখন কী করছে?

তর্জনী সামনে বাড়িয়ে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে গিয়েছে কপালে। প্রবল চেষ্টায় যেন জড়ো করে রাখতে হচ্ছে ইচ্ছাশক্তিকে তিলমাত্র বিচ্যুতি ঘটলেই আছড়ে পড়ে তুবড়ে যাবে গদ্যময় লং ড্রাগন দীপাধার। অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলেও শেষরক্ষা করতে পারবে না।

ফোদারিনগের ঠিক পাশে ছিল সাইকেল-আরোহী। বিপুল লম্ফ মেরে ছিটকে সরে গেল ঘরের অপর প্রান্তে। তিড়িংবিড়িং করে অল্পবিস্তর লম্ফ দিল প্রত্যেকেই। মিস মেব্রিজ ঘাড় ফিরিয়ে অলৌকিক দৃশ্যটা প্রত্যক্ষ করেই এমন আঁ-আঁ-আঁ করে চেঁচিয়ে উঠল যে, গোবরাট থেকে একটা বেড়াল ধড়াস করে পড়ে গেল মেঝেতে। লম্ফ দেওয়া দূরের কথা, এক চুলও নড়বার সাহস হল না শুধু ফোদারিনগের। নড়লেই যদি আছড়ে পড়ে অসম্ভব লম্ফ!

ঝাড়া তিনটে সেকেন্ড কাটল এইভাবে–থমথমে স্তব্ধতার মধ্যে শূন্যে ঝুলে রইল লম্ফশিখা নিচের দিকে করে। ফোদারিনগে আর ধরে রাখতে পারল না নিজেকে। ইচ্ছাশক্তি একাগ্র করে রাখা কি চাট্টিখানি কথা! কাতরোক্তি বেরিয়ে এল কণ্ঠ চিরে।

এবং, তৎক্ষণাৎ পপাত ধরণিতলে হল অলৌকিক লক্ষ! দড়াম করে পড়ল মেঝেতে। ঢং ঢং ঢং শব্দে কয়েকবার নেচে নিয়ে দপদপ করে শিখা নিবিয়ে।

গড়িয়ে গিয়ে স্তব্ধ হল ঘরের কোণে।

ভাগ্যিস ধাতুর তৈরি তৈলাধার ছিল লক্ষে–তাই অগ্নিকাণ্ডটা ঘটল না। পুরো ঘরখানায় আগুন লেগে যেত, তৈলাধার যদি কাচের তৈরি হত। প্রথম কথা ফুটল মি. কক্সের কণ্ঠে। বিন্দুমাত্র বাগাড়ম্বর না করে ফোদারিনগে- কে আহাম্মক বলা হল কাটছাঁট ভাষায়। প্রতিবাদ করার মতো অবস্থা তখন নেই ফোদারিনগে বেচারির। বাঁইবাঁই করে ঘুরছে মাথা। ঘরসুদ্ধ লোক একমত হল তার হাতসাফাইয়ের কারবারে এবং বেরিয়ে যেতে বললে ঘর থেকে। এবংবিধ প্রস্তাবের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারল না বিমূঢ় ফোদারিনগে।

বাড়ি ফিরল চোখ-মুখ লাল করে। কান গরম, মাথা ভোঁ ভোঁ। আসবার পথে দুধারে রাস্তার বাতিস্তম্ভগুলোর দিকে ভয়ে ভয়ে তাকিয়ে এসেছে। হাঁপ ছেড়ে বাঁচল চার্ট রো-স্থিত নিজস্ব খুদে কামরায় ঢোকার পর। মোটামুটি সুস্থিত হয়ে ভাবতে বসল উদ্ভট ব্যাপারটা নিয়ে।

কোট আর বুট খুলে বিছানায় বসে পকেটে হাত ঢুকিয়ে সেই নিয়ে সপ্তদশ সাফাই গাইল নিজের মনেই–সত্যি সত্যিই তো চাইনি উলটে যাক হতচ্ছাড়া লক্ষ!

কিন্তু উলটে তো গিয়েছিল মুখ দিয়ে কথাটা বার করার সঙ্গে সঙ্গে। কীভাবে যে ঘটল কাণ্ডটা, তা বিলক্ষণ ধোঁয়া ধোঁয়া ফোদারিনগের নিজের কাছেই। ইচ্ছাশক্তি একাগ্র করার জন্যে খুব যে একটা কস্তাকস্তি করতে হয়েছিল মনের সঙ্গে, তা মোটেই নয়। মনের কোনও প্রস্তুতিই ছিল না। ফট করে লক্ষ বেটাচ্ছেলে উলটে যেতেই ভীষণ দায়িত্বটা ধাঁ করে চেপে বসেছিল কাঁধেওলটানো অবস্থাতেই রেখে দিতে হবে হারামজাদাকে। কীভাবে –তা তো জানা ছিল না। তারপর যা ঘটে গেছে, তার কোনও যুক্তিসংগত ব্যাখ্যা ফোদারিনুগের মগজে অন্তত আসছে না।

দেখাই যাক-না অঘটনটা আবার ঘটানো যায় কি না। নিষ্কল্প তর্জনী তুলে ধরেছিল ঘরের মোমবাতির দিকে। এলোমেলো মনটাকে বেঁধেহেঁদে, জড়ো করেছিল এক জায়গায়। কাজটা নেহাতই আহাম্মকি, তা বুঝেও যাচাই করার লোভ সামলাতে পারেনি।

বলেছিল, বাপু হে, উঠে পড় তো শূন্যে।

বলেই তো থ!

শূন্যে ভেসে উঠেছে মোমবাতি।

বেশ ভাসছিল নিরবলম্বভাবে। কিন্তু মি. ফোদারিনগে খাবি খেতেই ঘটল বিপত্তি। শূন্যাবস্থান পরিত্যাগ করে দড়াম করে আছড়ে পড়ল টেবিলে। অন্ধকার ঘরে কেবল দেখা গেল নিবে-যাওয়া পলতের দীপ্তি।

ক্ষণেকের জন্যে এক্কেবারে নট-নড়নচড়ন নট-কিছু হয়ে তমিস্রার মধ্যে ভূতের মতো বসে ছিল মি. ফোদারিনগে।

তারপর পাঁজর-খালি-করা বিরাট এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে পকেট হাতড়েছিল দেশলাইয়ের খোঁজে। পায়নি। হাতড়েছিল টয়লেট টেবিলে। সেখানেও পায়নি। তারপরেই খেয়াল হয়েছিল, মির্যাকল ঘটিয়ে দেশলাইও তো আনতে পারে হাতের মুঠোয়। অন্ধকারে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলেছিল বোকা-বোকা স্বরে, এসে যাক একটা দেশলাইয়ের কাঠি হাতের চেটোয়।

টুপ করে কী যেন পড়েছিল হাতের চেটোয়। মুঠো পাকাতেই আঙুল চেপে বসেছিল একটা দেশলাইয়ের কাঠির ওপর।

বারকয়েক কাঠি জালানোর ব্যর্থ প্রচেষ্টার পর ফোদারিনগে বুঝেছিল, কাঠিটা সেফটি ম্যাচ–তাই জ্বলছে না। ছুঁড়ে ফেলে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সুড়ত করে আবার একটা ইচ্ছে ঢুকে পড়েছিল মাথার মধ্যে। ইচ্ছাশক্তি দিয়েই তো জ্বালানো যায় কাঠিমহাশয়কে। তৎক্ষণাৎ প্রয়োগ করেছিল শক্তিটাকে–কাঠি, জ্বল তো বাপু নিজে থেকে। টয়লেট টেবিলের কাপড়ের ওপর দপ করে কাঠি জ্বলে উঠতেই ধড়ফড় করে তুলে নিয়েছিল ফোদারিনগে-ফলে, নিবে গিয়েছিল কাঠি।

সম্ভাবনার ক্ষেত্রটা তখন সম্প্রসারিত হয়েছিল মাথার মধ্যে। হাতড়ে হাতড়ে মোমবাতিটা তুলে নিয়ে বসিয়েছিল শামাদানে। বলেছিল, জ্বলে ওঠ তো বাপু মোমবাতি! তখুনি দপ করে প্রজ্বলিত হয়েছিল মোমবাতির পলতে। সেই আলোয় ফোদারিনগে মশায় দেখেছিল, টয়লেট টেবিলের ঢাকনায় একটা ছোট্ট ফুটো-ধোঁয়া উঠছে ফুটোর কিনারা ঘিরে। ফ্যালফ্যাল করে সেদিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে মোমবাতির শিখায় দৃষ্টি সরিয়ে নিয়েছিল বিমূঢ় মানুষটা। অতঃপর আয়নায় দেখেছিল নিজের মুখের চেহারা এবং নিঃশব্দে বেশ কিছুক্ষণ কথা বলে গিয়েছিল নিজেরই প্রতিফলনের সঙ্গে।

প্রথম শব্দহীন প্রশ্নটা ছিল এই: মির্যাল কি একেই বলে?

ধ্যানস্থ অবস্থায় এরপর এমনই আবোল-তাবোল প্রশ্নোত্তর চলেছিল নিজের সঙ্গে, যা রীতিমতো গোলমেলে–আরও গোল পাকিয়ে দিয়ে গিয়েছিল মাথার মধ্যে। মোটের ওপর একটা বিষয় পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল। যা কিছু ঘটছে, সবই তার নির্ভেজাল ইচ্ছাশক্তির জোরেই ঘটছে। প্রথম এক্সপেরিমেন্টগুলোয় অনেক অনর্থ ঘটানোর পর পরবর্তী পরীক্ষানিরীক্ষায় হুঁশিয়ার না হয়ে পারেনি। তবে ইচ্ছাশক্তি প্রয়োগ করে এক তা কাগজ তুলেছিল শূন্যে, রং পালটেছিল এক গেলাস জলের প্রথমে গোলাপি, তারপর সবুজ। সৃষ্টি করেছিল একটা পুঁচকে গেঁড়ি এবং নিশ্চিহ্নও করেছিল অত্যাশ্চর্যভাবে। শূন্য থেকে একটা অত্যাশ্চর্য দাঁত-মাজা বুরুশ আনিয়েছিল নিজের ব্যবহারের জন্যে। এইসব করতে করতেই ঘড়িতে রাত একটা বাজতেই খেয়াল হয়েছিল, অত্যাশ্চর্যভাবে রোজকার কেরানিগিরির দফরফা হয়ে যেতে পারে পরের দিন, যদি-না এখুনি একটু ঘুমিয়ে নেয়। জামাকাপড় ছাড়তে গিয়ে শার্টটাকে মাথা গলিয়ে বার করার সময়ে হিমশিম খেতে খেতে হুকুম দিয়েছিল অজান্তেই–নিয়ে যাও আমাকে বিছানায়– বলার সঙ্গে সঙ্গে দেখেছিল, দিব্যি লম্বমান রয়েছে খাটের ওপর। তারপর হুকুম দিয়েছিল, এবার ভোলা হয়ে যাক জামাকাপড়। পরক্ষণেই দিগম্বর অবস্থায় শীতে কাঁপতে কাঁপতে ধড়ফড় করে ঝেড়েছিল নয়া হুকুম, আমার রাতের শাট এসে যাক গায়ে-না, না, খুব নরম মোলায়েম উলের রাত্রিবাস চাই। আঃ! কী আরাম! আসুক এবার আরামের ঘুম!…

রোজ যে সময়ে ঘুম ভাঙে, পরের দিন সকালে ঘুম ভাঙল সেই সময়ে। গুম হয়ে খেয়ে গেল প্রাতরাশ। একটাই চিন্তা চরকিপাক দিচ্ছে মাথার মধ্যে। কাল রাতের উদ্ভট কাণ্ডকারখানাগুলো জলজ্যান্ত স্বপ্ন নয় তো? অনেকক্ষণ পরে ইচ্ছে হয়েছিল সাবধানে আরও কিছু পরীক্ষানিরীক্ষা করার। যেমন, তিনটে ডিম খেল ব্রেকফাস্টে। ল্যান্ডলেডির দেওয়া দুটো, তৃতীয়টা বানিয়ে নিল শূন্য থেকে। অলৌকিক হাঁসের ডিম। অনেক তাজা, অনেক সুস্বাদু ডিম পাড়া হল টেবিলে, সেদ্ধও হয়ে গেল টেবিলে এবং প্লেটে এসে পড়ল অসাধারণ ইচ্ছাশক্তির দৌলতে। চাকুরিস্থলে গেল হন্তদন্ত হয়ে ভেতরের উত্তেজনাকে প্রাণপণে চেপে রেখে। সেই রাতেই ল্যান্ডলেডি অবশ্য বিস্ময় প্রকাশ করেছিল, তৃতীয় ডিমটার খোলা টেবিলে এল কোত্থেকে, ভেবে পায়নি কিছুতেই।

অফিসের কাজ কিন্তু কিছু হয়নি সারাদিনে। তাতে কোনও অসুবিধেও হয়নি। সারাদিন। নিজের অলৌকিক ক্ষমতার চিন্তায় বিভোর হয়ে থাকবার পর দিনের শেষে শেষ দশ মিনিটে প্রয়োগ করেছিল বিচিত্র ইচ্ছাশক্তিকে। সারাদিনের স্তূপীকৃত কাজ সমাধা হয়ে গিয়েছিল ওই দশ মিনিটেই! দিনটা শুরু হয়েছিল অপরিসীম বিস্ময়বোধ দিয়ে শেষ হল আত্যন্তিক উল্লাসবোধে। অতিমানুষ হওয়ার পরমোল্লাস! লং ড্রাগন পানশালা থেকে বিতাড়িত হওয়ার মূর্তিটা ওরই মধ্যে কাঁটার মতো খচখচ করে বিধতে লাগল মনের মধ্যে। ঘটনাটা সহকর্মীরাও শুনেছিল। তা-ই নিয়ে একটু-আধটু হাসিঠাট্টাও সহ্য করতে হল। ভঙ্গুর পদার্থ শূন্যে উত্তোলনের ব্যাপারে এখন থেকে সতর্ক থাকাই ভালো। তবে, ঈশ্বরপ্রদত্ত অলৌকিক ক্ষমতাটার অসীম সম্ভাবনা ধীরে ধীরে আচ্ছন্ন করে এনেছিল ফোদারিনগেকে। অন্যান্য ভেলকির ফাঁকে ফাঁকে বাড়িয়ে নিয়েছিল ব্যক্তিগত সম্পত্তিও। যেমন, একজোড়া হীরকখচিত শার্টের বোতাম। শূন্য থেকে বোতামজোড়া আবির্ভূত হতে না-হতেই সাত তাড়াতাড়ি নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিল শূন্যের মধ্যেই–একজন ছোকরা সহকর্মীকে টেবিলের দিকে আসতে দেখেই। হীরের বোম এল কোত্থেকে, এই নিয়ে জবাবদিহি করতে গিয়ে আবার না ফ্যাসাদে পড়তে হয়। অদ্ভুত ক্ষমতাটাকে রয়েসয়ে ভেবেচিন্তে হিসেব করে কাজে লাগানো দরকার। এমন কিছু কঠিন কৌশল অবশ্য নয়– সাইকেল চালানো শেখার মতোই। প্রথমদিকে একটু-আধটু দুর্ঘটনা ঘটেই–তারপর জল ভাত। কিন্তু প্র্যাকটিস তো দরকার। সেটা লং ড্রাগন পানশালায় সম্ভব নয়। আবার কেলোর কীর্তি আরম্ভ হয়ে যেতে পারে। তাই এল গ্যাস কারখানার পেছনে নিরিবিলি সরু গলিটায় –পাঁচজনের চোখের আড়ালে।

কিন্তু মৌলিকতা দেখাতে পারেনি নিরিবিলি প্র্যাকটিসেও। ইচ্ছাশক্তির বলে বলীয়ান হলেও, মানুষ হিসেবে তো ফোদারিনগে অতিশয় মামুলি টাইপের। একবার ভাবল, হাতের ছড়িটাকে বিষধর সাপ বানালে কেমন হয়? তারপর? এই ঘুটঘুঁটে অন্ধকারে অলৌকিক সৰ্পৰ্মহাশয়কে বাগে রাখবে কে? অনর্থ ঘটিয়ে বসবে যে। তার চাইতে বরং ছড়িটাকে বলা যাক ফুলের গাছ হয়ে যেতে।

হুকুমটা মুখ থেকে খসতে-না-খসতেই ফুটপাতের কিনারায় গজিয়ে উঠল ভারী সুন্দর ফুলের ঝোপ। ঠিক এই সময়ে কানে ভেসে এসেছিল ভারী বুটের শব্দ। সর্বনাশ! মির্যাকূলের জবাবদিহি করতে হলেই তো গেছে ফোদারিনগে! সাত তাড়াতাড়ি হুকুম দিয়েছিল ফুলের গাছকে–দূর হ!

বলা উচিত ছিল–ছড়ি হ! কিন্তু হুটোপাটি করতে গিয়ে বেমক্কা হুকুমটা বেরিয়ে গিয়েছিল মুখ দিয়ে। বাস! সাঁই সাঁই করে ভীষণ গতিবেগে দূরে চলে গিয়েছিল ফুল-ধরা ছড়ি এবং ক্রুদ্ধ গালাগাল ভেসে এসেছিল দূর থেকে। চলমান ফুলছড়ি দমাস করে আছড়ে পড়েছে আগুয়ান পুরুষটার গায়ে। কে রে বেল্লিক! ছড়ি ছোঁড়ার এই কি জায়গা? থুতনিটা যে আর-একটু হলে খসে যেত!

সরি, বলেই আরও ঘাবড়ে গিয়ে গোঁফে তা দিতে শুরু করেছিল ফোদারিনগে কনস্টেবল উইঞ্চকে আসতে দেখে।

ফোদারিনগেকে দেখেই চিনতে পেরেছিল উইঞ্চ। জখম থুতনিতে হাত বোলাতে বোলাতে সে কী ঝাঁপাই! লং ড্রাগন পানশালায় লম্ফ তোবড়ানোর পর আবার কী নষ্টামি আরম্ভ হল অন্ধকার গলিতে? বলি, ব্যাপারটা কী? পুলিশের ওপর হাঙ্গামা? ফাটকে ঢোকার শখ হয়েছে বুঝি? চুপ কেন? অ্যাঁ?

আমতা আমতা করে বলতে গিয়েছিল ফোদারিনগে, মিরাকলের জন্যেই নাকি ঘটছে। এইসব অদ্ভুত ব্যাপারস্যাপার। কিন্তু মুখ দিয়ে মির্যাল শব্দটা বেরতে-না-বেরতেই তেড়ে উঠেছিল কনস্টেবল উইঞ্চ।

সর্বনাশ! গুপ্ত রহস্য আর তো গুপ্ত থাকবে না! এখুনি শুরু হবে পুলিশি জেরা। নিজের ওপরেই বিষম রাগ হয়ে গিয়েছিল ফোদারিনগের। উইঞ্চের তড়পানিরও ইতি করা দরকার। ঝটিতি ঘুরে দাঁড়িয়েছিল। বলেছিল, কান ঝালাপালা করে দিলে দেখছি। মির্যাল দেখতে চাও তো? বেশ তো, দেখে যাও একটু হাতসাফাইয়ের ভেলকি! হেডস যাও– এখুনি!

বাস, ফুটপাতে আবার একা হয়ে গিয়েছিল ফোদারিনগে!

সে রাতে আর মিরাকল ঘটায়নি অঘটন ঘটানোর আজব মানুষটা। ফুলে ফুলে ভরে ওঠা ছড়িটার অবস্থা কী হল, তা নিয়েও আর মাথা ঘামায়নি। ফিরে এসেছিল শহরে। ভয়ে ভয়ে, এক্কেবারে ঠান্ডা মেরে। মুখে আর কথাটি নেই। নিঃশব্দে ঢুকেছিল নিজের শোবার ঘরে। তারপর শুরু হয়েছিল স্বগতোক্তি, জয় ভগবান! এ কী ক্ষমতা দিলে আমাকে! হুকুমের এত জোর? কল্পনাও করা যায় না! হেডস জায়গাটা কেমন, তা-ও তো ছাই জানি না।

 খাটে বসে পায়ের বুট খুলতে খুলতে এবং নিজের মনে বকবক করতে করতে শেষকালে কিন্তু বিলক্ষণ সুখীই হয়েছিল নচ্ছার কনস্টেবলটাকে ক্যালিফোর্নিয়ায় পাচার করার সুখচিন্তায়। কীভাবে পাচার হল হতভাগা এবং তারপর কী কী ঘটবে, সেসব নিয়েও আর মস্তিষ্ক ভারাক্রান্ত করেনি। শুতে-না-শুতেই সে কী ঘুম! ঘুমের মধ্যে অবিশ্যি স্বপ্ন দেখেছিল উইঞ্চকে–রেগে তিনটে হয়ে এই মারে কি সেই মারে অবস্থায় তেড়ে আসছে– কিন্তু নাগাল ধরতে পারছে না ফোদারিনগের!

পরের দিন দুটো কৌতূহলোদ্দীপক সংবাদ শ্রবণ করল অঘটন ঘটনবাজ ফোদারিনগে। কে নাকি অতীব সুন্দর একটা গোলাপ ফুলের গাছ পুঁতে গেছে লুলাবরো রোডে বুড়ো গামশটের বাড়ির ঠিক সামনেই। আর, রলিং মিল পর্যন্ত নদীতে জাল ফেলা হচ্ছে কনস্টেবল উইঞ্চের মরদেহের সন্ধানে।

সেদিন বড়ই অন্যমনস্ক ছিল ফোদারিনগেমশায়। নতুন কোনও মিরাকল ঘটায়নি। উইঞ্চের জন্যে বড় মন কেমন করছিল। তাই তার নিত্যব্যবহার্য দু-একটা জিনিস আর ক্ষুৎপিপাসা নিবারণের জন্যে সামান্য কিছু খাবারদাবার পাঠিয়ে দিয়েছিল হুকুমের জোরে তার বেশি কিছু নয়। মাথার মধ্যে হাজার চিন্তা ভোমরার মতো গুনগুন করে ঘুরপাক খাওয়া সত্ত্বেও দৈনিক কাজে ত্রুটি রাখেনি কোত্থাও। লোকে অবশ্য তা-ই নিয়েও হাসি মশকরা করেছে। কী জ্বালা, কী জ্বালা! ফোদারিনগে কেন এত অন্যমনস্ক, কেন এত চুপচাপ–তা নিয়ে তোমাদের অত ইয়ারকি মারবার দরকারটা কী শুনি? ভাগ্য ভালো, উইঞ্চের চিন্তায় বিভোর হয়ে ছিল ফোদারিনগে–নইলে অনুর্থর পর অনর্থ ঘটে যেত সেইদিনই। রেগেমেগে যদি কাউকে বলে বসত, গোল্লায় যাও, জাহান্নমে যাও!–তাহলে কী কাণ্ডটা হত বলুন তো? নরক জায়গাটা নিশ্চয় খুব আহামরি নয়!

রোববার সন্ধ্যা নাগাদ গির্জাতে গেল ফোদারিনগে মনের জ্বালা জুড়াতে। কী আশ্চর্য! ঠিক সেইদিনই অলৌকিক কাণ্ডকারখানা নিয়ে বক্তৃতা দিচ্ছিলেন বিশপমশাই। নাম তাঁর মি. মেডিগ। গুপ্তবিদ্যায় তাঁর আগ্রহ ছিল বরাবরই। আইনকানুন যেসব ব্যাপারকে রক্তচক্ষু দেখিয়ে শাসনে রাখে, সেইসব ব্যাপার নিয়েই অনেক কথা বলে গেলেন তিনি। কান খাড়া করে শুনে গেল ফোদারিনগে। গির্জাতে নিয়মিত সে আসে না। যেদিন এল, সেইদিনই কিনা মনের মতো বক্তৃতা! শুনে প্রাণ যেন জুড়িয়ে গেল। ঈশ্বরদত্ত অলৌকিক ক্ষমতাটা সম্বন্ধে নতুন দিগন্ত যেন উন্মোচিত হল বিহ্বল মনের আকাশে। ঠিক করল, বক্তৃতা শেষ হলেই দেখা করবে মি. মেডিগের সঙ্গে।

ফোদারিনগের নাস্তিকতা অবিদিত ছিল না শহরে। ভগবান-টগবান একেবারেই মানে না, ধর্ম জিনিসটা নিয়ে ফক্কড়ি করে। এহেন ছোকরা হঠাৎ কথা বলতে চায় নিরিবিলিতে–শুনে বিলক্ষণ অবাক হয়েছিলেন মি. মেডিগ। তাই সঙ্গে সঙ্গে দেখা করেননি। হাতের কাজকর্ম সেরে তাকে নিয়ে গেলেন নিজের প্রাইভেট কক্ষে। চুল্লির সামনে বসিয়ে নিজে দাঁড়ালেন দুপা ফাঁক করে খিলানের মতো ফাঁক-করা পদযুগলের ছায়া পড়ল বিপরীতদিকের দেওয়ালে। আত্মকাহিনি বলতে গিয়ে কিন্তু প্রথমদিকটায় লজ্জায় লাল হয়ে গিয়েছিল ফোদারিনগে। শুরু করবে কীভাবে, তা-ই নিয়েই পড়েছিল মহাবিড়ম্বনায়। জানি না আদৌ বিশ্বাস করবেন কি না জাতীয় দু-একটা বাক্য নিঃসরণের পর আচমকা শুধিয়েছিল মি. মেডিগকে–বলুন তো, মির‍্যা সম্বন্ধে আপনার কী অভিমত?

আচমকা প্রশ্ন শুনে জবাব দিতে একটু টালবাহানা করেছিলেন মি. মেডিগ। কিন্তু চেপে ধরেছিল ফোদারিগে–নেহাতই সাধারণ মানুষ আমি, দেখতেই পাচ্ছেন। কিন্তু আমার মতোই গোবেচারা একটা সত্তার ভেতরে যদি আচমকা ইচ্ছাশক্তি মাথাচাড়া দেয়, ইচ্ছাশক্তি দিয়ে অসম্ভবকে সম্ভব করা যায়, তখন আপনার কী মনে হবে বলুন তো?

অমন হওয়াটা অসম্ভব কিছু নয়, কায়দা করে জবাব দিয়েছিলেন মি. মেডিগ।

টেবিলের ওপর তামাকের বয়েমটা দেখিয়ে বলেছিল ফোদারিনগে, হাতেনাতে দেখিয়ে দিতে চাই, একেই মিরাকল বলে কি না। আধ মিনিট সবুর করুন প্লিজ।

বলে, কপাল কুঁচকে তাকিয়েছিল তাম্রকূট আধারের দিকে। আঙুল তুলে হুকুম দিয়েছিল বিড়বিড় করে, হও তো বাপু ভায়োলেট ফুল।

তা-ই হয়েছিল তামাকের বয়েম। পরিবর্তনটা ঘটেছিল সহসা এবং দারুণভাবে চমকে দিয়েছিল মি. মেডিগকে। ফ্যালফ্যাল করে পর্যায়ক্রমে চেয়ে ছিলেন ফোদারিনগে এবং ফুলের তোড়ার পানে। মুখে একটা কথাও বলেননি। তারপর হেঁট হয়ে ঘ্রাণ নিয়েছিলেন ফুলের। টাটকা ফুল। যেন এখুনি তুলে আনা হয়েছে বাগান থেকে।

চেয়েছিলেন ফোদারিনগের দিকে–কী করে করলেন বলুন তো?

গোঁফে টান মেরে বলেছিল ফোদারিনগে, সেইটাই জানতে এসেছি। যা দেখলেন তা কি মির্যাল, না ডাকিনীবিদ্যা? হুকুম দিয়ে অঘটন ঘটাতে পারি–দেখতেই পেলেন। কী মনে হয় আমাকে? প্রশ্ন সেইটাই–এসেছি জবাবটা জানতে।

খুবই অসাধারণ কাণ্ড।

অথচ দেখুন, এই সেদিনও এ ক্ষমতা আমার ছিল না। ইচ্ছে করলেই অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারতাম না। গত হপ্তায় ছিলাম সাধারণ মানুষ–এখন হলাম অসাধারণ। আচমকা ক্ষমতাটা এসে গেছে ভেতরে। কোথাও একটা গোলমাল ঘটেছে, ইচ্ছাশক্তিটা হঠাৎ এমন জোরদার হয়ে উঠেছে।

এ ছাড়াও আরও কিছু করতে পারেন নাকি?

বলেন কী! যা খুশি তা-ই করতে পারি। একটু ভাবতেই অনেকদিন আগে দেখা একটা ভোজবাজি মনে পড়ে গিয়েছিল ফোদারিনগের, তর্জনীশাসনে হুকুম দিয়েছিল ফুলের তোড়াকে–মাছ হয়ে যাও–না, না, লাল মাছ ভরতি গামলা হয়ে যাও–কাচের গামলা। বাঃ, এই তো চাই! দেখলেন?

আশ্চর্য! অবিশ্বাস্য! আপনি… আপনি…

যা ইচ্ছে বলব, ঠিক তা-ই হবে। দেখবেন?–ওহে মাছের গামলা, পায়রা হও তো বাপু!

পরক্ষণেই ঘরময় উড়ে বেড়িয়েছিল একটা নীল রঙের পায়রা। গোঁত খেয়ে খেয়ে গায়ের ওপর আছড়ে পড়া পাশ কাটিয়ে গেছেন মি. মেডিগ। দেখে, আবার হুকুম ঝেড়েছিল ফোদারিনগে। পায়রা নিশ্চল হয়ে ভেসেছিল শূন্যে। আবার হুকুম দিতেই পায়রা ফিরে এসেছিল টেবিলে ফুলের তোড়া হয়ে। পরের হুকুমেই দেখা গিয়েছিল কোথায় ফুলের তোড়া–এ যে সেই তামাকের বয়েম–মি. মেডিগের অতিপ্রিয় নেশার বস্তু।

শেষের দিকের মির্যালগুলো নিঃশব্দে পর্যবেক্ষণ করে গিয়েছিলেন মি. মেডিগ। তামাকের বয়েম পুনরাবির্ভূত হওয়ার পর দ্বিধাগ্রস্তভাবে তুলে নিয়ে পরখ করে ফের নামিয়ে রেখেছিলেন টেবিলে। বাঃ। বিস্ময়োক্তি ছাড়া আর কোনও শব্দ নিঃসৃত হয়নি। বদনগহ্বর থেকে। ফোদারিনগে তখন নিবেদন করেছিল লং ড্রাগন পানশালার লহ্মকাণ্ড থেকে আরম্ভ করে প্রতিটি ঘটনা। তৃতীয় ডিমের আবির্ভাব পর্যন্ত শুনেই হাত বাড়িয়ে মি. মেডিগ বাধা দিয়েছিলেন উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে–সম্ভব! সম্ভব! যদিও অসম্ভব। যদিও অবিশ্বাস্য! তবুও বলব, এসবই সম্ভব। কতকগুলো ভজঘট ব্যাপার অবশ্য থেকে যাচ্ছে, সমস্যার জট আরও বাড়ছে। যেমন, এ ক্ষমতা সাধারণ মানুষের মধ্যে এতদিন কখনও দেখা যায়নি। মিরাকল ঘটানোর ক্ষমতা পরমকারুণিক তাঁদেরই দেন, যাঁরা মানুষ হিসেবে আর পাঁচজনের মতো নয়। যেমন মহম্মদ, ভারতের যোগীরা, মাদাম ব্লাটক্সি, আরগিলের ডিউক। কদাচিৎ এই ক্ষমতা পায় অসাধারণ প্রকৃতির মানুষরাই-প্রকৃতির সাধারণ নিয়মের ভেতরে যে আরও গূঢ় নিয়মের অস্তিত্ব রয়েছে–তখনই বোঝা যায়। হ্যাঁ, হ্যাঁ আপনি চালিয়ে যান–চালিয়ে যান!

চালিয়েই গিয়েছিল ফোদারিনগে। উইঞ্চকে ক্যালিফোর্নিয়া পাচারের কাহিনি বর্ণনা করার পর বিষণ্ণ কণ্ঠে জানিয়েছিল, ইচ্ছার বিরুদ্ধেই ইচ্ছাশক্তিটা প্রয়োগ করে ফেলায় ঘটেছে। এই বিপত্তি। উইঞ্চকে সুদূর ক্যালিফোর্নিয়ায় অত তাড়াতাড়ি উড়িয়ে নিয়ে ফেলার আদৌ তার বাসনা ছিল না। কিন্তু এমন ঝাঁপাই জুড়েছিল সে, ঝোঁকের মাথায় কী বলতে কী বলে ফেলেছে। আসলে, কী বলা উচিত, আর কী বলা উচিত নয়–এই ব্যাপারটাই বারবার গুলিয়ে ফেলছে ফোদারিনগে। এই যেমন দেখা গেল মাছের গামলার ব্যাপারে। শুধু একখানা মাছ চেয়ে বসল, কিন্তু চাওয়া উচিত ছিল মাছের গামলা, শুধু গামলা নয়, কাচের হওয়া চাই! হুকুম দিতে-না-দিতে তা এত তাড়াতাড়ি ফলে যাচ্ছে যে, হুকুম ফিরিয়ে নেওয়ারও সময় পাওয়া যাচ্ছে না। উইঞ্চকে ফিরিয়ে আনাও তো এখন সম্ভব নয়। সে অবশ্য ফিরে আসতেই চাইছে। কয়েক ঘণ্টা অন্তর তা খেয়াল হতেই ফোদারিনগে নয়া হুকুম ছেড়ে তাকে ফিরিয়ে দিচ্ছে পূর্বাবস্থায়, স্রেফ আত্মরক্ষার তাগিদে। উইঞ্চ অবশ্য তা বুঝতেও পারছে না। হয়তো প্রতিবার ট্রেনের টিকিট কাটার পয়সা জলে যাচ্ছে, বিরাট লোকসান হয়েই চলেছে। কিন্তু এ ছাড়া আর কিছু করারও তো নেই ফোদারিনগের। ধাঁ করে এতটা পথ চক্ষের নিমেষে উড়ে যাওয়ার ফলে বাতাসের ঘষটানিতে হয়তো জামাকাপড় ঝলসে গেছে। ক্যালিফোর্নিয়ার পুলিশ উঞ্ছ আকৃতির উইঞ্চকে নিশ্চয় গারদে পুরে রেখেছে। সম্ভাবনাটা মনে হতেই ফোদারিনগে অবশ্য একপ্রস্থ জামাকাপড়ের অর্ডার দিয়ে দিয়েছে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে ইচ্ছাশক্তিটাকে ঠিকমতো প্রয়োগ করা নিয়ে। হুটপাট কথা বলে ফেলায় এই যে ডাইনিদের মতো, অথবা অপরাধীদের মতো কাণ্ডকারখানা ঘটিয়ে ফেলছে ফোদারিনগে, এর জন্যে মরমে মরে রয়েছে সে।

শুনতে শুনতে ভয় ভেঙে গিয়েছিল মি. মেডিগের। অনেকটা ধাতস্থ হয়ে উঠেছিলেন। ফোদারিনগেকে সান্ত্বনা এবং আশ্বাস দিয়ে বলেছিলেন, আশ্চর্য এই শক্তিকে ডাকিনীবিদ্যা বলা যায় না কোনওমতেই, অপরাধের গন্ধও নেই এর মধ্যে। খাঁটি মিরাকল বলতে যা বোঝায়, এ হল তা-ই।

প্রশস্তি শুনেও বিষাদ কাটেনি ফোদারিনগের। উইঞ্চকে কোনওরকম ঝঞ্ঝাট না পাকিয়ে ফিরিয়ে আনা যায় কীভাবে, এই সমস্যাই তুলে ধরেছিল বারবার। মি. মেডিগ কিন্তু উইঞ্চ সমস্যা নিয়ে তখনকার মতো মাথা ঘামাতে চাননি। ফোদারিনগের মতো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মানুষটাকে নিয়ে আগে ভাবনাচিন্তা করা দরকার। আশ্চর্য এই ক্ষমতার নিয়ন্ত্রিত প্রয়োগপদ্ধতি সম্পর্কে গবেষণা দরকার। ক্ষমতাটা যে অপরিসীম, তা তো দেখাই যাচ্ছে। অনেক অদ্ভুত কাণ্ডই ঘটানো যায় এই ক্ষমতা দিয়ে, আগে সেইগুলোই দেখা যাক। তারপরে এইভাবেই শুরু হয়ে গেল অবিশ্বাস্য কার্যপরম্পরা। শুরু হল গির্জার ঠিক পেছনেই মি. মেডিগের নিরিবিলি কক্ষে, ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দের ১০ নভেম্বর রবিবার রাত্রে। মি. মেডিগ প্রেরণা এবং উৎসাহ জুগিয়ে গেলেন এবং ফোদারিনগে মির্যাল-এর পর মিরাকল ঘটিয়ে চলল। তারিখটার দিকে পাঠক-পাঠিকার দৃষ্টি আকর্ষণ করা হচ্ছে বিশেষভাবে। এই কাহিনির কিছু অংশ আপত্তিকর মনে হতে পারে তাঁদের কাছে। কাগজে কিছু কিছু বিবরণ বেরিয়েছিল, পড়েও থাকতে পারেন। যাঁরা পড়েছেন, তাঁদের কেউ কেউ হঠাৎ অপ্রত্যাশিত ভয়ংকর দুর্ঘটনায় মারাও হয়তো গিয়েছিলেন বছরখানেক আগে। কাহিনি পড়তে পড়তেই যে কোনও সুস্থ বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন পাঠক অথবা পাঠিকা বুঝতে পারবেন, ঘটনাগুলো দুর্ঘটনা হলেও অপ্রত্যাশিত নয়, অবিশ্বাস্যও নয়। কাহিনিও শেষ হয়ে গেল, এমন ধারণাও করে বসবেন না দয়া করে। বরং বলা যেতে পারে, এই তো সবে জমে উঠল কাহিনি। দুই অলৌকিক ঘটনাবাজ পরমোৎসাহে নিভৃত প্রকোষ্ঠে বসে গোড়ার দিকে যেসব অলৌকিক ঘটনাগুলো ঘটিয়েছিল, তা নিতান্তই মামুলি এবং বৈচিত্রহীন, ছোট ছোট মির্যাকল। থিয়োসফিস্টদের মির্যালের মতোই অকিঞ্চিত্বর, শূন্য থেকে কাপ-ডিশ আনা অথবা বারান্দা সাজানোর জিনিসপত্র বানিয়ে নেওয়ার মধ্যে পিলে-চমকানো ব্যাপার না থাকলেও মি. মেডিগের পিলে চমকে গিয়েছিল প্রতিবারেই। ফোদারিনগে যতবারই উইঞ্চ-ঘটিত ব্যাপারটার সুচারু নিষ্পত্তি চেয়েছে, ততবারই বাধা দিয়ে বিষয়ান্তরে চলে গেছেন মি. মেডিগ। ডজনখানেক এই ধরনের ছোটখাটো অলৌকিক ঘটনাবলি সংঘটিত করার পর একটা সত্যিকারের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আগ্রহ দেখা গিয়েছিল মি. মেডিগের।

রাত তখন এগারোটা। অলৌকিক কাণ্ডকারখানার ঠেলায় খাবার কথা একদম খেয়াল নেই। খেয়াল হল পেট চুঁইছুঁই করতেই। অথচ খাবার যার আনার কথা, সেই মহিলাটির টিকি দেখা যাচ্ছে না। দায়িত্বজ্ঞানহীনা, কাণ্ডজ্ঞানহীনা এই মহিলার ওপর তেলেবেগুনে জ্বলে উঠেছিলেন মি. মেডিগ। বরাবরই কাজে ফাঁকি দিয়ে অভ্যস্ত। কিছুতেই বাগে আনতে পারেননি তিনি। খিদে মিটিয়ে দিয়েছিল ফোদারিনগে অতি সহজেই। অলৌকিক ক্ষমতার ব্যাপকতর প্রয়োগের সম্ভাবনাটা মাথায় এসে গিয়েছিল পেট চনমন করতেই। অর্ডার দিতেই শূন্য থেকে রাজসিক খানার পর খানা এসে গিয়েছিল টেবিলে। যার যেটা খেতে এবং পান করতে ভালো লাগে–ঠিক সেই সেই খাদ্য এবং পানীয় হাজির হতেই দুজনেই। বীরবিক্রমে সেসব আক্রমণ করেছিল সবার আগে। তারিয়ে তারিয়ে রসাস্বাদন করার পর আবার মগজ খুলে গিয়েছিল ফোদারিনগের। আরও ভালোভাবে অলৌকিক ক্ষমতাটাকে কাজে লাগানোর উৎকৃষ্ট একটা মতলব এসে ছিল মাথায়। প্রস্তাবটা শুনে তো প্রথমে হাঁ হয়ে গিয়েছিলেন মি. মেডিগের মতো পরমোৎসাহী পুরুষও। এ কাণ্ড যদি সম্ভব হয়। তাহলে সমাজ-সংসারের ভোল ফিরিয়ে দেওয়া যাবে যে!–না হওয়ার কী আছে? জিদ ধরেছিল ফোদারিনগে, হুকুম দিয়েছিল নিজের ইচ্ছানুযায়ী।

বিচিত্র হুকুম নিঃসন্দেহে। হাউসকিপারের মতিগতি যাতে এখন থেকে পালটে যায়, ঘরকন্নায় নজর দেয়, কাণ্ডজ্ঞান যেন ফিরে আসে… ইত্যাদি… ইত্যাদি। হুকুমের ফোয়ারা ফুরানোর আগেই অদ্ভুত আওয়াজের পর আওয়াজ শোনা গিয়েছিল ওপরতলায়। ধড়মড়িয়ে। দৌড়েছিলেন মি. মেডিগ। ফিরে এসে চোখ বড় বড় করে বলেছিলেন, আজব কাণ্ড! নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছিল মেয়েটা। ঘুমের মধ্যেই ইচ্ছাশক্তি কাজ আরম্ভ করে দিয়েছে! তোবা! তোবা!

না করার কী আছে? প্রতিবাদের সুরে বলেছিল ফোদারিনগে–জাগরণে-স্বপনে সবসময় কার্যকর হবেই আমার ইচ্ছাশক্তি।

ব্র্যান্ডি খেয়ে ঘুমাচ্ছিল মশায় নাক ডাকিয়ে। সুবুদ্ধি ফিরে এসেছে ঘুমন্ত অবস্থাতেই। ঘুম থেকে উঠেই লুকানো এক বোতল ব্র্যান্ডি বার করে আছড়ে ভেঙেছে… এখন জ্বলছে। অনুতাপে। তোবা! তোবা! তোবা!

এবার তাহলে উইঞ্চের ব্যাপারটা

 রাখুন আপনার উইঞ্চের ব্যাপার! আশ্চর্য! আশ্চর্য! আশ্চর্য! এ কী আশ্চর্য ক্ষমতা পেয়েছেন আপনি! সীমাহীন সম্ভাবনা… যতই দেখছি, ততই হতভম্ব হয়ে যাচ্ছি। শুনবেন, আরও কী কী করা যায় আপনাকে দিয়ে?

বলেই সম্ভবপর অলৌকিক ঘটনাবলির ফিরিস্তি শোনাতে শুরু করে দিয়েছিলেন মি. মেডিগ–উইঞ্চকে ভালোয় ভালোয় ফিরিয়ে আনার কথায় কানই দেননি। শুধু মুখে কথা নয়, হাতেনাতে কাজও আরম্ভ করে দিয়েছিলেন তৎক্ষণাৎ–অবশ্যই ফোদারিনগে বেচারির সহযোগিতায়। শিকেয় তোলা রইল ফোদারিনগের আসল সমস্যা। দুই মূর্তিমান অত রাতে বেরিয়ে পড়েছিল শহরময় চরকিপাক দিয়ে শহরের ভোল ফেরানোর অসম্ভব দায়িত্ব নিয়ে। ঘটেছিল বিস্ময়কর পরিবর্তনের পর পরিবর্তন। কনকনে শীতের রাতে নিথর চাঁদের নিপলক চাহনির নিচে দেখা গিয়েছিল দুই অলৌকিক ঘটনাবাজকে। হাত-মুখ নেড়ে বিষম ফুর্তিতে আটখানা হয়ে পরিবর্তনের প্ল্যান ঝেড়ে যাচ্ছেন মি. মেডিগ–প্ল্যানমাফিক অদ্ভুত অদ্ভুত ফরমাশ দিয়ে যাচ্ছে ফোদারিনগে। প্রথম প্রথম হুকুম দেওয়ার সময়ে যেটুকু দ্বিধা বা লজ্জা ছিল–এখন তা তিরোহিত হয়েছে। এখন রোমাঞ্চ-উল্লাসে মাথার চুল খাড়া হয়ে রয়েছে বললেই চলে। একরাতেই পার্লামেন্টারি ডিভিশনের সব কটা মাতালের মদ্যাসক্তির নিবারণ ঘটিয়েছিল এই দুজনে এবং জলে রূপান্তরিত করেছিল সব কটা পানশালার বিয়ার আর অ্যালকোহল (এই বিষয়টিতে প্রবল আপত্তি করেছিল অবশ্য ফোদারিনগে কিন্তু তুড়ি মেরে সব আপত্তি উড়িয়ে দিয়েছিলেন মি. মেডিগ)। রেলপথের বিস্তর উন্নতিও ঘটিয়েছিল দুই নিশাচর। ফ্লিনডারের জলাভূমি থেকে বার করে দিয়েছিল সমস্ত জল আর কাদা। ওয়ান ট্রি হিল-এর মাটির উৎকর্ষসাধনও করে ছিল দুজনে। সেই সঙ্গে অদৃশ্য করেছিল পল্লি-পুরুতের ছিনেজোঁক আঁচিল। সাউথ ব্রিজের জখম জেটি মেরামতের মতলব নিয়ে হনহন করে যেতে যেতে রুদ্ধশ্বাসে মি. মেডিগ যখন বলছেন, কাল থেকে এ জায়গা চেনা যাবে না–পিলে চমকাবে প্রত্যেকেরই কৃতজ্ঞতায় গদগদ থাকবে চিরটা কাল –ঠিক তখনই ঢং-ঢং-ঢং করে রাত তিনটে বেজেছিল গির্জার ঘড়িতে।

থমকে গিয়েছিল ফোদারিনগে–সর্বনাশ! এখন যে বাড়ি না ফিরলেই নয়। সকাল আটটা বাজলেই তো শুরু হবে কাজের রুটিন। বাড়িউলি মিসেস উইমসও যা খাণ্ডারনি—

অসীম শক্তির কৃপায় মি. মেডিগ তখন মিছরির মতোই মিষ্টি হয়ে গিয়েছিলেন। সুমিষ্ট বচনে উদাত্ত কণ্ঠে তাই বলেছিলেন, সে কী! এই তো কলির সন্ধে! সবে তো শুরু। দশের মঙ্গল করায় কত মজা পাচ্ছেন, সেটা বলুন? কাল ঘুম থেকে উঠে সবাই যখন দেখবে।

কিন্তু

আচমকা ফোদারিনগের বাহু খামচে ধরেছিলেন মি. মেডিগ। জ্বলজ্বল করে উঠেছিল দুই চক্ষু–তাড়াতাড়ি কীসের ভায়া? বলেই আঙুল তুলে মধ্যগগনের চাঁদ দেখিয়ে নিঃসরণ করেছিলেন একটাই শব্দ–জোশুয়া!

জোশুয়া? ফোদারিনগে তো ভ্যাবাচ্যাকা। মুশার উত্তরাধিকারী হিব্রু নায়ক জোশুয়ার কথা উঠছে কেন?

হ্যাঁ, হ্যাঁ, জোশুয়া! থামান চাঁদকে!

চোখ তুলে চাঁদের পানে চেয়েছিল ফোদারিনগে।

 উত্তাল উচ্ছ্বাসে ক্ষণিক বিরতি দিয়ে বলেছিল শেষকালে, বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে না?

বাড়াবাড়ি আবার কীসের? তেড়ে উঠেছিলেন মি. মেডিগ। চাঁদ থামে না ঠিকই। আপনি থামিয়ে দিন পৃথিবীর বনবন করে লাটুর মতো পাক খাওয়াটা। তাহলে দাঁড়িয়ে যাবে সময়। ক্ষতি তো কারও করছি না।

তা মন্দ বলেননি! গোঁফে তা দিতে দিতে বলেছিল ফোদারিনগে। ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিল। বেশ, তাহলে চেষ্টা করেই দেখা যাক।

বলা বাহুল্য, হুকুমটা মামুলি হুকুম নয়। এত বড় হুকুম দিতে গেলে নিজেকে আগে তৈরি করা দরকার। এই মুহূর্তে ফোদারিনগের ইচ্ছাশক্তি অবশ্য ফ্যালনা নয়, তাহলেও পৃথিবীর আবর্তন স্তব্ধ করতে হলে পুরো ইচ্ছাশক্তিটাকে কথার হুকুমের মধ্যে জড়ো করা দরকার। তাই আটঘাট বেঁধেই কাজে নেমেছিল ফোদারিনগে। কোটের বোতাম এঁটে নিয়ে ধরিত্রীকে উদ্দেশ্য করে সাধ্যমতো আত্মবিশ্বাস কণ্ঠস্বরে ঢেলে দিয়ে বলেছিল, ওহে পৃথিবী, বন্ধ কর আবর্তন।

পরক্ষণেই, ধাঁ করে শুন্যপথে ডিগবাজি খেতে খেতে ছিটকে গিয়েছিল মিনিটে ডজন। ডজন মাইল গতিবেগে। সেকেন্ডে অগণিত চক্রবর্ত রচনা করা সত্ত্বেও চিন্তা করার মতো ক্ষমতাটা লোপ পায়নি ফোদারিনগের। চিন্তার মতো জিনিস আর আছে? কখনও তরল পিচের মতো ঘোলাটে থকথকে, আবার কখনও আলোর মতো ঝকঝকে চকিত। তাই একটা সেকেন্ডের মধ্যেই চিন্তাকার্য সমাপন করে নিয়ে ইচ্ছাশক্তির প্রকাশ ঘটিয়েছিল ফোদারিনগে এইভাবে–সব কটা হাড় আস্ত অবস্থায় যেন নিরাপদে নামতে পারি। যা-ই। ঘটুক-না কেন, আস্ত শরীরখানাকে দেখে-শুনে ভালো জায়গায় নামিয়ে দাও।

মোক্ষম সময়েই ইচ্ছাশক্তি জাহির করেছিল ফোদারিনগে, আর এক পলক দেরি হলেই জ্বলে যেত নিজেই। বাতাসের মধ্যে দিয়ে অত জোরে ধেয়ে গেলে জামাকাপড় ঝলসে তো যাবেই। মুখ থেকে হুকুমটা খসতে-না-খসতেই হুড়ম করে নেমে এসেছিল মোটামুটি ভদ্রস্থভাবেই টিপির আকারে রাখা সদ্য-খোঁড়া নরম মাটির ওপর। দমাস করে নামলেও চোট লাগেনি মোটেই, হুকুমই যে ছিল তা-ই। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ঠিক পাশেই প্রচণ্ড শব্দে আছড়ে পড়েছিল একতাল ধাতু-ইট-কাঠ-পাথর, বস্তুপিণ্ডটার সঙ্গে অসাধারণ সাদৃশ্য রয়েছে বাজার চত্বরের ঘড়ি-মিনারের। মাটিতে পড়েই ঠিকরে গিয়েছিল ফোদারিনগের মাথার ওপর দিয়ে এবং বোমার মতো ফেটে গিয়ে ইট-কাঠ-পাথর হয়ে ছিটকে গিয়েছিল। দিকে দিকে। মস্ত একটা পাথরের চাঁইয়ের ওপর কোত্থেকে দড়াম করে এসে পড়ল একটা উড়ন্ত গোরু এবং নিমেষমধ্যে পিণ্ডি পাকিয়ে গেল ডিমের মতোই। দুমদাম ধড়াম-ধাম, আওয়াজের পর আওয়াজে ফোদারিনগের মাথা তখন বনবন করে ঘুরছে। জীবনে এমন প্রচণ্ড আছড়ে পড়ার শব্দপরম্পরা সে শোনেনি, একটা শব্দ কানের পরদা ফাটানোর উপক্রম করতে-না-করতেই আবার কান-ফাটানো শব্দ খাবলা মেরে নিচ্ছে যেন মগজখানাকেই। ভয়ংকর আওয়াজগুলোর ঢেউ চলে যাওয়ার পরেই এল ছোটখাটো ভাঙাচোরা আছড়ে পড়ার ক্রমশ ম্রিয়মাণ শব্দলহরি। আগাগোড়া অব্যাহত রইল কিন্তু প্রলয়ংকর ঝোড়ো হাওয়া, স্বর্গ-মর্ত জুড়ে তাণ্ডবনাচ নেচে বেড়াচ্ছে সেই মত্ত প্রভঞ্জন, ঝড় যে এত জোরালো হয়, ফোদারিনগে তা জানল সেই প্রথম। সে কী তেজ হাওয়ার। মাথা তুলে চারপাশে চোখ বোলাতেও পারছে না, মুভুখানা ছিঁড়ে উড়িয়ে নিয়ে না যায়। বেশ কিছুক্ষণ এমনই ভ্যাবাচ্যাকা অবস্থায় ছিল বেচারি, যে ভালো করে নিঃশ্বাস পর্যন্ত নিতে পারেনি। কোথায় আছে এবং কী ঘটছে, তা চোখ মেলে দেখার প্রশ্নই ওঠে না। সংবিৎ ফেরার পর প্রথমেই খুলিতে হাত বুলিয়ে দেখে নিয়েছিল, ধড়ে মুন্ডুটা এখনও আছে কি না। ফরফর করে চুল উড়ছে টের পেয়ে নিশ্চিন্ত হয়েছিল অবশেষে, যাক, মাথাটা এখনও বেহাত হয়নি।


আরো পড়ুন: অদ্ভুত অর্কিড । এইচ জি ওয়েলস । অনুবাদক: অদ্রীশ বর্ধন


লর্ড! খাবি খেতে খেতে ইষ্টনাম জপ করা ছাড়া ঝড়ের মধ্যে আর কোনও কথা ফোটেনি মুখে। তারপর অবশ্য আঁকুপাঁকু করতে করতে পাগলের মতো বকে গিয়েছিল নিজের মনে, ব্যাপারটা কী? ঝড় আর বাজ পড়ার আওয়াজে কান যে চৌচির হয়ে গেল! অথচ এক মিনিট আগেও কী মিষ্টিই না ছিল রাতটা, ফুটফুটে চাঁদের আলো! মেডিগের কথায় কান দিয়েই তো বাধিয়ে বসলাম ফ্যাসাদটা! উফ! হাওয়ার কী জোর রে বাবা! এ কী করে বসলাম নিরেট গাধার মতো! এখুনি যে পটোল তুলতে হবে সাংঘাতিক অ্যাক্সিডেন্টে!…

মেডিগটা গেল কোথায়?

 তুলকালাম কাণ্ডটাই বা ঘটল কেন?

ঝড়ে কোট উড়ছে পতপত করে চোখের সামনে। তারই ফাঁক দিয়ে যেটুকু দেখা যায়, দেখে নিল ফোদারিনগে। সত্যিই চারপাশে অত্যন্ত অদ্ভুত কাণ্ড ঘটে চলেছে। দেখে-শুনে বিলকুল কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে ফের নিজের মনেই বকর বকর করে চলে অঘটনবাজ ফোদারিনগে, আকাশটা তো দেখছি ঠিক জায়গাতেই আছে–এখনও খসে পড়েনি। কিন্তু বিকট-ভয়ানক এই ঝড় বেটাচ্ছেলে তেড়েফুঁড়ে আসছে কোন চুলা থেকে? ওই তো চাঁদ দেখা যাচ্ছে মাথার ওপর। আগে যেখানে ছিল–ঠিক সেইখানেই। দিনদুপুরের মতো আলোরও ঘাটতি নেই। ওইটুকুই কেবল আগের মতো–বাকি তো সবই ওলট-পালট–গাঁ টা গেল কোন চুলোয়? কিছুই তো চোখে পড়ছে না–বিটকেল এই ঝড়খানাই বা এল কোন নরক থেকে? ঝড় ওঠার হুকুম তো আমি দিইনি।

দুপায়ে খাড়া হওয়ার চেষ্টা করেছিল ফোদারিনগে। অত কি সোজা? ঝড়ে মাথা মুড়িয়ে পরক্ষণেই আছড়ে ফেলেছিল মাটিতে। অগত্যা গোরু-ছাগলের মতো অতিকষ্টে, চার হাত পায়ে ভর দিয়ে কোনওমতে দেহ-উত্থান ঘটিয়েছিল ফোদারিনগে। কোটখানা তখনও পতপত করে উড়ছে মাথার ওপর দিয়ে। ঘাড় ফিরিয়ে অনেক কায়দা-কসরত করে দুটি চালনা করেছিল আকাশপানে বিধুমুখী অভিমুখে। এবং, আবার স্বগতোক্তি জাগ্রত হয়েছিল বিমূঢ় কণ্ঠে, সাংঘাতিক একটা গোলমাল হয়ে গেছে কোথাও-না-কোথাও। কী সেই গোলমালটা, সেইটাই যে কচুপোড়া মাথায় আসছে না।

যেদিকে দুচোখ যায়, দেখা যাচ্ছে কেবল প্রলয়ংকর প্রভঞ্জনের দাপটে ধাবমান সাদা ধুলোর কুয়াশা। ঝড় যে এমন রক্ত জল-করা হুংকার ছাড়তে পারে, তা-ও কি ছাই জানা ছিল? এ কী সৃষ্টিছাড়া পেটের মধ্যে হাত-পা ঢুকিয়ে-দেওয়া চেঁচানি! রক্ত যে ঠান্ডা হয়ে গেল। সাদাটে ধুলোর ধাবমান পরদার মধ্যে দিয়ে দেখা যাচ্ছে শুধু পাকসাট-খাওয়া মৃত্তিকা স্তূপ আর লন্ডভন্ড ধ্বংসস্তূপ। গাছ নেই, বাড়ি নেই, চেনাজানা কোনও আকারই চোখে পড়ছে না, দিগন্তবিস্তৃত শুধু ধু ধু লন্ডভন্ডতা, বহু দূরে বিলীন হয়েছে ঘূর্ণমান ধুলোস্তম্ভ আর জলস্তম্ভের নিচেকার রক্ত-জমানো নিরেট নিঃসীম তমিস্রার গভীরে। নারকীয় এই দক্ষযজ্ঞ কাণ্ডকারখানার ঠিক ওপরেই অট্টরোলে ফেটে পড়ছে বজ্র, চোখের স্নায়ু ঝলসে দিচ্ছে অতিতীব্র বিদুৎ। ঝড়ের বেগ কিন্তু বেড়েই চলেছে পলকে পলকে। খুব কাছেই পাটকাঠির মতো পটপট করে ভেঙে-যাওয়া একটা গাছ চলেছে গড়িয়ে গড়িয়ে–একটু আগেই যাচ্ছিল বিশাল মজবুত এম মহীরুহ। তারও ওপাশে দলা-পাকানো একটা ইস্পাত-ফ্রেম ঠিকরে ঠিকরে উঠছে মাটি থেকে।

ব্যাপারটা অবশ্যই অস্বচ্ছ নয় আপনার কাছে। ফোদারিনগে তো কোটের বোতাম এঁটে নিয়ে দরাজ গলায় পৃথিবীর আবর্তন বন্ধ করার হুকুম দিয়েই খালাস, ভূপৃষ্ঠের তুচ্ছাতিতুচ্ছ সঞ্চরমাণ বস্তুগুলোর অবস্থা যে কী হবে, অর্ডার দেওয়ার আগে সেই হিসেবটা মনে মনে কষে নিলেই তো এই মহাপ্রলয়টা ঘটত না। বসুন্ধরা এমনিতেই ভীষণ বেগে পাক খেয়ে চলেছে, ভগবানের লাটুও বলা যায়। নিরক্ষরেখা বরাবর ভূপৃষ্ঠের গতিবেগ ঘণ্টায় হাজার মাইলেরও বেশি। অক্ষাংশ অঞ্চলে তার অর্ধেকেরও বেশি। ফলে, সেকেন্ডে প্রায় নমাইল বেগে সামনের দিকে আচমকা ঠিকরে গেছেন মি. মেডিগ–সেই সঙ্গে গোটা গ্রামটা, ফোদারিনগে স্বয়ং এবং আশপাশের সবকিছুই। সেকেন্ডে নমাইল বেগে ধেয়ে যাওয়া মানেটা কী, তা অবশ্যই অজানা নয় আপনার কাছে, কামান থেকে নিক্ষিপ্ত গোলারও ক্ষমতা নেই অত জোরে ছুটে যাওয়ার! আচমকা এই ভয়াবহ গতিবেগ অর্জন করে বসেছে অঘটনবাজ মানুষ দুটি আশপাশের সবকিছু সমেত। আছড়ে পড়ছে বাড়িঘরদোর, মানুষ, পশুপাখি–পড়ছে আর পঞ্চত্বপ্রাপ্ত হচ্ছে! গড়িয়ে থেঁতলে পিণ্ডি পাকিয়ে নিমেষে নিমেষে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। মহাপ্রলয় বলে একেই। চোখ দিয়ে দেখে মন দিয়ে বোঝবারও সময় দিচ্ছে না।

বলা বাহুল্য, পরিস্থিতিটা মোটেই মনঃপূত হয়নি মি. ফোদারিনগের। মির‍্যা ঘটাতে গিয়ে মহাপ্রলয় ঘটানো হয়ে গেছে–এই চৈতন্যটা বড়ই পীড়াদায়ক হয়েছিল সেই মুহূর্তে। রুদ্র প্রকৃতির করাল রূপ হাড়ে দুব্বো গজিয়ে দিয়েছিল বললেই চলে এবং দুচক্ষের বিষ হয়ে দাঁড়িয়েছিল তাবৎ মির্যাল কাণ্ডকারখানা। ছ্যা ছ্যা! এই যদি মিরাকল হয়, তাহলে সে মিরাকলের দরকারটা কী বাপ? কালো আলকাতরার মতো অন্ধকারে দৃষ্টিও আটকে যাচ্ছে–মওকা বুঝে রাশি রাশি মেঘ দঙ্গল বেঁধে ঢেকে দিয়েছে চাঁদের মুখ। কান আর সইতে পারছে না ক্রমবর্ধমান ঝড়ের হুহুংকার। মেঘ আর ঝড়ে কুস্তি চলছে সমস্ত আকাশ জুড়ে, রণে ভঙ্গ দেওয়ার পাত্র নয় কেউই। পাঁক, জলের ছিটে আর ধুলোয় সর্বাঙ্গ ঢেকে যাচ্ছে কেন দেখবার জন্যে চোখে হাত ঢাকা দিয়ে সেইদিকে চোখ ফিরিয়েই আঁতকে উঠেছিল ফোদারিনগে।

দেখেছিল, বিশাল উঁচু একটা জলের পর্বত ভেঙে পড়তে চলেছে ঠিক তার মাথার ওপরেই!

চেঁচিয়ে উঠেছিল বিকট গলায় (যদিও প্রাকৃতিক শক্তিবর্গের সম্মিলিত হুংকারধ্বনির তুলনায় তা মনে হয়েছিল মিনমিনে ভাঙা স্বর)–মেডিগ? কোথায় আপনি?

জল প্রায় মাথার ওপর!

 থাম! থেমে যাও বলছি!

 থেমে গিয়েছিল ঝুলে-পড়া জলরাশি।

বজ্র আর বিদুৎকে ধমকে উঠেছিল ফোদারিনগে, দাঁড়াও-না বাপু, ইয়ারকিটা একটু বন্ধ রাখ–ভাববার সময়টা অন্তত দাও!

থেমে গিয়েছিল বজ্রপাত এবং বিদ্যুঝলক।

 কী করা যায় এখন? লর্ড! করবটা কী? মেডিগ যদি থাকত ধারেকাছে!

 ঠিক হ্যায়, বুদ্ধি খুলে গিয়েছিল ফোদারিনগের–এবার ভুল হবে না। ঠিক অর্ডারটাই দেওয়া যাক।

চার হাত-পায়ে ভর দিয়ে, ঝোড়ো হাওয়ায় পিঠ দিয়ে মনে মনে ঝড়ের মতোই ভেবে নিয়েছিল আবার সবকিছু আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার পন্থাটা।

বলেছিল, পেয়েছি!… চালাও! না-বলা পর্যন্ত আমার হুকুমমতো যেন আর কিছু না ঘটে!… লর্ড! আগে কেন মাথায় আসেনি বুদ্ধিটা? ঝড়ের গোঙানি ছাপিয়ে ষাঁড়ের মতো গলাবাজি শুরু করেছিল ফোদারিনগে। ভয়াবহ ওই ঝড়ের আওয়াজকে কি চেঁচানি দিয়ে টেক্কা মারা যায়? নিজের কণ্ঠস্বরই শুনতে পায়নি অঘটনবাজ মানুষটা। তা-ই বলে ভাটাও পড়েনি গলাবাজিতে–শোন হে, শোন, আমার হুকুমগুলো এবার কান খাড়া করে শুনে যাও! আর যেন ভুল হয় না এক চুলও। প্রথমেই বলে রাখি, আমার কথামতো সবকিছু ঘটে যাওয়ার পর, আমার এই অলক্ষুনে অলৌকিক ঘটনা ঘটানোর শক্তি যেন একেবারেই লোপ পায়, আর পাঁচজনের ইচ্ছাশক্তির মতোই যেন হয়ে যায় আমার ইচ্ছাশক্তি, এবং এই সমস্ত বিপজ্জনক মির্যাকল যেন পত্রপাঠ বন্ধ হয়ে যায়। জঘন্য মির্যাল–দুচক্ষের বালি। না ঘটালেই হত–আহাম্মকি যা হবার তা হয়ে গেছে, আর নয়, ঢের হয়েছে। আমার দ্বিতীয় হুকুমটা এই: মির‍্যা শুরু হওয়ার আগে যেখানে যেভাবে ছিলাম, ঠিক সেইখানে, সেইভাবে ফিরে যেতে চাই। শুধু আমি নয়–হতচ্ছাড়া পাজির পা-ঝাড়া ওই লম্ফটা উলটে যাওয়ার আগে যেখানে যে অবস্থায় যা কিছু ছিল–সমস্ত ঠিক সেই সেই জায়গায় সেই সেই অবস্থায় ফিরে যাক। বিরাট কাজ বুঝছি, কিন্তু এই তো শেষ। মাথায় ঢুকেছে? না, আর কোনও মির্যাকূলের দরকার নেই। ঠিক যা ছিল তা-ই হয়ে যাক। সবকিছুই আগের মতো হয়ে যাক। লং ড্রাগনে আধ পাঁইট গেলবার আগে যেমনটি ছিল– হুবহু সেইরকম। বাস, আর কোনও হুকুম নেই!

বলে-টলে, নরম মাটির গাদায় দশ আঙুল গেঁথে ধরে, কষে চোখ বন্ধ করে ছিল ফোদারিনগে এবং চেঁচিয়ে উঠেছিল বাজখাঁই গলায়, চালাও!

নিস্তব্ধ নিথর হয়ে গিয়েছিল বিশ্বচরাচর। থমথমে নৈঃশব্দ্য। উঁচ পড়লেও যেন ওইটুকু আওয়াজও শোনা যাবে–এমনি স্তব্ধতা। চোখ-বন্ধ অবস্থাতেই ফোদারিনগে টের পেয়েছিল, দাঁড়িয়ে আছে সে দুপায়ে ভর দিয়ে খাড়া অবস্থায়।

কানে ভেসে এসেছিল উদাসীন কণ্ঠস্বর, তা যা বলেছ!

 চোখ খুলেছিল ফোদারিনগে।

দাঁড়িয়ে আছে লং ড্রাগন পানশালায়। মির্যাকল প্রসঙ্গ নিয়ে তুলকালাম কথা কাটাকাটি চলছে টোডি বিমিসের সঙ্গে। আবছা একটা অনুভূতি জাগ্রত রয়েছে মাথার মধ্যে–কী যেন চকিতে ধেয়ে গিয়েছে চেতনার ওপর দিয়ে। কিন্তু কিছুই মনে পড়ছে না। বুঝতেই পারছেন ব্যাপারটা। মির্যাকূল ঘটানোর ক্ষমতাটাই কেবল হারিয়েছে ফোদারিনগে–ফিরে পেয়েছে। আর সবকিছুই। যা ছিল, তা-ই হয়ে গেছে। এ গল্প শুরু হওয়ার সময়ে ওর মন আর স্মৃতি যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল–এখনও রয়েছে সেখানেই। কাজেই যা কিছু বলা হল এইমাত্র এবং যা কিছু বলা হচ্ছে আজ পর্যন্ত, তার বিন্দুবিসর্গ ওর জানা নেই। তার চাইতেও বড় কথা, মিরাকল জিনিসটাতে আজও ওর বিশ্বাস নেই তিলমাত্র৷

তা যা বলেছ, বলে বাঁকা হেসে চেয়ে রইল টোডি বিমিস।

জিনিসটা আগে ভালো করে বোঝ, তেড়েমেড়ে বলেছিল ফোদারিনগে, মির্যাল হল এমনই সব উদ্ভট আজগুবি ব্যাপারস্যাপার, যা নিত্যনৈমিত্তিক প্রাকৃতিক ব্যাপারস্যাপারের ঠিক উলটো, ইচ্ছাশক্তির জোরে যে অঘটন ঘটানো চলে…।

 

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত