যুগের সাথে তাল মিলিয়ে মানুষ চেষ্টা করেছে নিজের শরীরের প্রতি যত্নবান হবার। তারই নিমিত্তে সাধারণ মানুষ ও গবেষক এবং পুষ্টিবিদদের প্রবল আগ্রহেই যুগে যুগে আবিষ্কৃত হয়েছে নতুন নতুন ডায়েট প্যাটার্ন। তারই প্রেক্ষিতে আজকে আমরা আলোচনা করবো এই দশকের সর্বআলোচিত এবং বহুল জনপ্রিয় ডায়েট প্যাটার্ন ‘কিটো ডায়েট’ নিয়ে।
১০০ বছর আগের বাচ্চাদের ড্রাগ-অপ্রতিরোধ্য খিচুনি প্রতিরোধে কার্যকরী বলে প্রমানিত এই কিটো ডায়েট, যা ১৯৭০ সালের দিকে ডা: আতকিন্স এর হাত ধরে ওজন কমানোর উপযোগী ডায়েট হিসেবে মানুষের নজরে আসে। একবিংশ শতাব্দীর শুরুতেই যা ব্যাপক হারে পরিচিতি লাভ করে গবেষক,পুষ্টিবিদ এবং সাধারন মানুষের কাছে।
কিটো এর জনপ্রিয় হবার মূল কারন হলো দুটি :
১. পরীক্ষিতভাবে প্রচন্ড দ্রুততার সাথে ওজন হ্রাস।
২. টাইপ-২ ডায়েবিটিস এ আক্রান্ত ব্যক্তির আলাদাভাবে “ইনসুলিন” এবং ওষুধ প্রয়োগ না করার দাবি করে এই ডায়েট।
কিন্তু এই দাবিগুলোর ভিত্তি কতটুকু তা জানার আগে চলুন জেনে নেই কিটো ডায়েট কি?
কিটোজেনিক ডায়েট হলো একটি উচ্চ ফ্যাট, পর্যাপ্ত প্রোটিন এবং নিম্নমাত্রার কার্বোহাইড্রেট খাবার সমন্নিত ডায়েট, যা রক্তে কিটোন বডি নিঃসরণ করে। সাধারনত আমাদের দেহের কোষগুলো শক্তির উৎস হলো ব্লাড গ্লুকোজ। কিন্তু যখন আপনার শরীরে কিটো ডায়েট করার ফলে রক্তে গ্লুকোজের ঘাটতি হয়, ঠিক তখনই আপনার শরীরের চর্বিগুলো ভেংগে কিটোন কনায়ে রূপ নেয়, এই প্রক্রিয়াটিকে বলে কিটোসিস। একবার যখন আপনার দেহ কিটোসিস পর্যায় চলে যাবে, তখন রক্ত শর্করা বা গ্লুকোজের বদলে আপনার দেহের কোষগুলোর শক্তির প্রধান উৎস হিসেবে কাজ করবে এই কিটোন বডিস গুলো। সাধারনত কিটো শুরু করার ২-৪ দিনেই ওজন কমতে শুরু করে যদি আপনি দিনে ২০-৫০ গ্রাম শর্করা ঘাটতি রাখেন। আপনি যখন আবার এই ডায়েট বাদ দিয়ে শর্করা নেয়া শুরু করবেন, তখন আবার দেহের কোষগুলো আগের মত ব্লাড গ্লুকোজ থেকেই শক্তি নিবে।
কিটো ডায়েটের মাধ্যমে ওজন খুবই দ্রুততার সাথে কমে, এই কথাটা সম্পূর্ণভাবে ঠিক এবং ৬৫০০০ পপুলেশন নিয়ে করা গবেষনা কর্তৃক প্রমাণিত। কিন্তু তারপরও কেন অন্যান্য বারের মতো এ বছরও “US News & World Report” কর্তৃক করা তালিকা অনুযায়ী ৩৫ টি ডায়েটের মধ্যে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে এবং সমন্নিতভাবে করা তালিকায় সবচেয়ে নিচে অবস্থান করছে কিটো ডায়েট এবং কেনই বা পুষ্টিবিদেরা একে সর্বকালের খারাপ ডায়েট বলে চিহ্নিত করছেন?
আসুন জেনে নিই :
১. ক্রমহ্রাসমান আয়ু :
৬৫,০০০ পপুলেশনের উপর করা গবেষনা মতে, কিটো ডায়েটে থাকা মানুষের মধ্যে হার্টঅ্যাটাক এর সম্ভাবনা বেড়েছে ৪৫%, ব্রেইন স্ট্রোকের সম্ভাবনা বেড়েছে ৪৮% এবং ক্যান্সার ঝুঁকি বেড়েছে ৩৮%।
২. হৃদরোগের ঝুঁকি বৃদ্ধি :
কিটো ডায়েট সর্বনিম্ন মানের ডায়েট হিসেবে তালিকাভুক্ত হবার আরো একটি কারন হলো, এটি আপনার হার্ট এর জন্য প্রচন্ড ভাবে হানিকর। এটি কোলেস্টেরলের মাত্রাকে ভীষণভাবে বাড়িয়ে দেয়। আর তাই উচ্চমাত্রার (প্রায় ৭০-৮০%) স্নেহ এবং লাল মাংস সমন্নিত দীর্ঘমেয়াদী ডায়েট আমাদের হার্টকে ঠেলে দিচ্ছে এক ভয়ংকর ঝুঁকির সামনে। বাড়িয়ে দিচ্ছে বিভিন্ন ধরনের হৃদরোগের সম্ভাবনা।
৩. ডায়াবেটিস রোগীদের নানান জটিলতার সৃষ্টি :
কিটো ডায়েট হতে পারে টাইপ-২ ডায়েবেটিসের রোগীদের জন্য ভয়ংকর। কারন ডায়েবেটিস নিজেই একটি কিটোজেনিক অবস্থা। সাধারণ মানুষের তুলনায় ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের ‘মূত্র পরীক্ষা’ করে সাধারণত কিটোন কনার আধিক্য দেখা যায়। এক্ষেত্রে যদি কিটো ডায়েট করার মাধ্যমে ডায়াবেটিক পেশেন্টদের শরীরে কিটোন কনার পরিমাণ আরো বাড়িয়ে দেয়া হয়, তবে তারা ‘ডায়াবেটিক কিটো এসিডোসিস’ নামক ভয়াবহ অবস্থায় চলে যেতে পারে ।
কিটো ডায়েট ডায়েবিটিক রোগীদের ব্লাড সুগার নিয়ন্ত্রনে রাখবার দাবি করলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা দেখা যায় রোগীকে ‘হাইপোগ্লাইসেমিক’ (ব্লাড সুগারের হঠাৎ নিম্নমুখীতা) করে তুলছে।
কিটো দাবি করে টাইপ ২ ডায়েবেটিক রোগীদের ইনসুলিনের প্রয়োগ বন্ধ করবার। কিন্তু তা বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমানিত নয় এবং ক্ষেত্র বিশেষে চিকিৎসকের পরামর্শ না মেনে ইনসুলিন ব্যবহার বন্ধের মাধ্যমে মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকির সম্মুখীন হয়েছে রোগীরা ।
৪. কিডনি পাথর সৃষ্টির নিয়ামক :
যেহেতু কিটো ডায়েটের মাধ্যমে শরীরে প্রচুর পরিমানে কিটোন বডি উৎপন্ন হয় এবং একই সাথে স্বাভাবিকের তুলনায় প্রচুর প্রোটিন (প্রায় ২০%) এই ডায়েটে নেয়া হয়, সে ক্ষেত্রে মূত্রের সাথে প্রয়োজনের তুলনায় অধিক কিটোন বডি এবং ইউরিক এসিড নিঃসরিত হয়ে মূত্রকে অধিক অম্লীয় করে ফেলে। যা কিডনিতে পাথর সৃষ্টির একটি অন্যতম ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করে।
‘Journal of Child Neurology’ তে প্রকাশিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে ; ১৯৫ টি খিচুনি শিশু রোগী যাদের কে কিটো ডায়েট দেয়া হয়েছে , তাদের মধ্যে ১৩ জনের কিডনিতেই পাথর হয়েছে পরবর্তীতে।
যেসব ব্যক্তি কিডনির সমস্যায় ভুগছেন, তাদের জন্য কিটো সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ।
৫. সুস্থ মানুষের টাইপ-২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি :
সাম্প্রতিককালে ‘Children’s Hospital Zurich’ এর ইঁদুরের উপর চালানো একটি কিটো ডায়েট গবেষনায় পরিলক্ষিত হয়েছে, কিটো ডায়েট আমাদের শরীরের স্বাভাবিক ইনসুলিন (আমাদের প্যানক্রিয়াস থেকে নিঃসরিত একটি হরমোন) এর কাজকে প্রতিহত করে, যার কারনে ব্লাড সুগার ঠিকভাবে নিয়ন্ত্রিত হয় না। যা পরবর্তিতে ইনসুলিন রেজিস্টেন্স বা ইনসুলিন প্রতিরোধ্যতা সৃষ্টি করতে পারে এবং যা টাইপ ২ ডায়েবেটিস এর ঝুঁকি প্রবলভাবে বাড়িয়ে দেয়।
৬. কিটো ছেড়ে দেবার পর দ্রুতহারে ওজন লাভ :
বেশ কিছু গবেষণা দ্বারা প্রমানিত হয়েছে, কিটো শুরু করবার পর আপনার দেহের মেটাবলিজম এর পাথওয়ে ‘গ্লুকোনিওজেনেসিস’, ‘গ্লাইকোজেনেসিস’ থেকে পরিবর্তিত হয়ে ‘কিটোজেনেসিস’ এ রূপ লাভ করার দরুন আপনার ওজন দ্রুততার সাথে কমে এবং একই সাথে আপনার মেটাবলিজম হয়ে যায় মন্থর। কিটো ছেড়ে দেবার পর আবার শর্করা গ্রহন শুরু করার সময় মেটাবলিজম আগের মতো শর্করা বেইসড হলেও,এর গতি বেশ কিছুদিন মন্থর থাকে। যার ফলে ওজন এই সময় দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পেতে থাকে।
এবার নিজেরাই চিন্তা করুন, এতো বেশি স্বাস্থ্য ঝুঁকির সম্ভাবনা যেই ডায়েটে, শুধুমাত্রা ওজন কমানোর নিমিত্তে তা অনুসরন করা কতটুকু যুক্তিযুক্ত? আজকে হয়তো কিটো অনুসরণ করে আপনার ওজন কমছে, কিন্তু ভবিষ্যতে এর মাধ্যমে আপনার স্বাস্থ্যহানীর ভয়াবহতা সম্পর্কে আপনি ভেবেছেন কী?
কিটো ডায়েবেটিস, হৃদরোগ, কিডনি জটিলতায় ভোগা রোগীদের জন্য তাই সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ।
কিন্তু আপনি যদি ওজন কমানোর জন্য কিটো একান্তই করতে চান, এবং যদি আপনি কোন শারীরিক জটিলতায় না ভুগে থাকেন, তবে আপনি পুষ্টিবিদ দ্বারা নির্ধারিত ‘মডিফাইড কিটো ডায়েট’ অনুসরণ করতে পারেন।
মনে রাখবেন, না জেনে শুধু সৌন্দর্যচর্চার জন্য ডায়েট না করে সুস্থ থাকতে ডায়েট করুন। ডায়েট করার আগে ডায়েট সম্পর্কে জানুন, স্বাস্থ্য ঝুঁকি সম্পর্কে অবগত হোন। কারন আপনার অজ্ঞতা হয়তো হতে পারে ভবিষ্যতে আপনার জীবনের জন্য হুমকি স্বরূপ।
চট্টগ্রাম মেডিকাল কলেজ
এমবিবিএস, ৩য় বর্ষ