Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com

মহেন্দ্র সিং ধোনি হয়ে ওঠার রূপকথা

Reading Time: 4 minutes

মহেন্দ্র সিং ধোনি নামটাই যথেষ্ট। তাঁর সম্পর্কে কিছু বলার আগে আর কোন গৌরচন্দ্রিকার প্রয়োজন হয় না বলে আমার মনে হয়। অবশেষে অবসর নিলেন ভারতীয় ক্রিকেট টিমের মিস্টার কুল ক্যাপ্টেন। তাঁর এই অবসরকে নিয়ে তৈরি হয়েছে নানা গুঞ্জন। কেন অবসর নিলেন ধোনি? ধোনির অবসর নিয়ে নানা জল্পনা-কল্পনার শেষ নেই ভারতে।

কারণ যাই হোক, তা নিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ করার জন্য কলম ধরিনি। বর্তমানে মাহির জীবনী নিয়ে একটি বিশাল বাজেটের সিনেমা তৈরি হয়েছে। কিন্তু সেই সিনেমায় কি সত্যি উঠে এসেছে একজন নিম্নবিত্ত টিকিট কালেক্টরের আজকের মহেন্দ্র সিং ধোনি হয়ে ওঠার সেই দীর্ঘ জীবন পরিক্রমা। হয় তো না। আজ সেই চিত্র তুলে ধরব বলেই কলম ধরেছি। টাইম ম্যাগাজিনের লেখক চেতন বাগত ধোনি সম্পর্কে লিখেছিলেন ‘তিনি শুধু ভারতকে বিশ্বকাপ ট্রফি এনে দেননি, ১২০ কোটি ভারতীয়কে শিখিয়ে দিয়েছেন কিভাবে বিশ্বকে জয় করা যায়।’ কিন্তু এই ধোনিই এক সময় রেলের টিকেট চেকার ছিলেন। ভারতের উত্তরাঞ্চলের আলমোড়া জেলার তলসালম একটি অচেনা অখ্যাত গ্রাম। খুব ভাল চাষাবাদ না হওয়ায় অল্প লেখাপড়া জানা পন সিং একটি চাকরির আশায় চলে গেলেন উত্তর প্রদেশের লখনউয়ে। সেখানে কাজ না জোটায় পন সিং চলে গেলেন ঝাড়খণ্ডের বোকারো।

কিন্তু এখানেও কোন কাজ জুটল না। তাই আবার একটা কাজের আশায় পাড়ি জমালেন ঝাড়খণ্ডেরই রাঁচিতে। ১৯৬৪ সালে যোগ দিলেন স্টিল কোম্পানিতে। এরপরে ১৯৮১ সালে পন সিং আর দেবকীর কোল আলো করে জন্ম নিল মহেন্দ্র সিং ধোনি। রাঁচিতেই পড়াশুনো শুরু হলো স্টিল কোম্পানির স্কুলে। প্রথম দিকে স্কুলে ফুটবল খেলতেন ধোনি। পছন্দ ছিল গোলকিপার হওয়া। এরপরে নেশা চেপে বসল ব্যাডমিন্টন, হকি এবং টেবিল টেনিসে। স্কুলের বাঙালী ক্রীড়া শিক্ষক ক্রিকেট দল তৈরি করতে গিয়ে উইকেটকিপার না পেয়ে শরণাপন্ন হলেন ধোনির। ধোনি রাজি হয়ে গেল। আর এভাবেই স্কুলে শুরু হলো প্রথম ক্রিকেট খেলা। শুরুতেই স্কুলের ক্রীড়া শিক্ষক বুঝলেন, একে দিয়ে কাজ হবে। ব্যস, ধোনি পড়াশুনোর সঙ্গে মেতে রইলেন ক্রিকেট নিয়ে। কিন্তু শুরুর সেই উইকেটকিপার কিছুদিনের মধ্যেই হয়ে গেলেন ভাল ব্যাটসম্যান। তখন ঝাড়খণ্ড জেলা বলে কিছু ছিল না, ধোনির বয়স যখন ১৫ বছর তখন সুযোগ পান বিহার দলে। বয়সের কোঠা ১৯ এর ঘরে পৌঁছলে অভিষেক ঘটে ‘রনজি ট্রফিতে’। এরপর সুযোগ হয় ‘পূর্বাঞ্চল’ টিমে। ক্রিকেটের সফলতার পাশাপাশি পড়াশোনায়ও ভাল ছিলেন ধোনি। শিক্ষাজীবনে কখনও খারাপ ফলাফল করেননি। তবে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করার পর গসনা কলেজে ভর্তি হলেও পরীক্ষা দেয়া হয়নি। তবে ধোনি বিভিন্ন দেশের সাম্মানিক ডি-লিট পেয়ে ডক্টরেট ডিগ্রী পেয়েছেন।

আগেই বলেছি ধোনি এক সময় রেলের টিকেট চেকারের কাজ করতেন। রেল বিভাগের হয়ে ক্রিকেট খেলতে গিয়েই লম্বা চুলের এই তরুণ নজরে পড়ে যান সবার। অবশ্য ম্যাচ খেলতে গিয়ে চাকরি হারিয়েছিলেন তিনি। সেটাই যেন জীবন বদলে দিল ধোনির। বিহারের অনুর্ধ-১৯ দলে ধোনি খেলেছেন সেই ১৯৯৮-৯৯ সালে। এরপর বিহার জাতীয় দল হয়ে খেলতে খেলতেই ডাক মেলে ভারতীয় এ দলে। মহেন্দ্র সিং ধোনির অধিনায়কত্বে ভারত ২০০৭ শাহে আইসিসি বিশ্ব ২০ ২০, ২০০৭-০৮ সালের সিবি সিরিজ, ২০০৮ সালের ব্রডার-গাভাস্কার-ট্রফি, ২০১০ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ২-০ ব্যবধানে একটি সিরিজ ও ২০১১ বিশ্বকাপ জয় করেছে। তার অধিনায়কত্বেই ভারত টেস্টের র‌্যাঙ্কিংয়ে এক নম্বরে উঠে এসেছিল। এখনও পর্যন্ত টেস্ট এবং ওয়ান-ডে ইন্টারন্যাশনালে তার রেকর্ড ভারতীয় অধিনায়কদের মধ্যে সেরা। আইপিএল ও চ্যাম্পিয়ন্স লীগে তিনি চেন্নাই সুপার কিংস দলের অধিনায়কত্ব করছেন। তার নেতৃত্বে ভারতীয় দল প্রথম শ্রীলঙ্কা ও নিউজিল্যান্ডের মাটিতে ওয়ানডে ইন্টারন্যাশনাল সিরিজ জয় করেছে এবং ভারত কুড়ি বছর পর অস্ট্রেলিয়াকে টেস্টে হারাতে সক্ষম হয়েছে।

ধোনি একাধিক সম্মান ও পুরস্কার পেয়েছেন। তিনি ২০০৮ ও ২০০৯ সালে আইসিসি একদিনের বর্ষ সেরা বিশ্ব ক্রিকেটারের স্বীকৃতি পান। তিনিই প্রথম ভারতীয় যিনি এই পুরস্কার পেয়েছেন। এছাড়া তিনি ভারতের সর্বোচ্চ ক্রীড়া সম্মান রাজীব গান্ধী খেল রতœ পুরস্কার ও দেশের চতুর্থ সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মান পদ্মশ্রী পেয়েছেন। একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট রেটিংয়ে জানুয়ারি ২০১০ সালে ধোনি সর্বোচ্চ র‌্যাঙ্কিংধারী খেলোয়াড়ের অধিকারী ছিলেন। ২০০৯ সালে ক্রিকেটের বাইবেল নামে পরিচিত উইজডেনের স্বপ্নের টেস্ট একাদশ দলের অধিনায়ক হিসেবে ঘোষিত হন এবং ফোরবস ম্যাগাজিন কর্তৃক বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ধনী ১০ ক্রিকেটারের মধ্যে শীর্ষস্থানীয় হিসেবে মনোনীত হন মহেন্দ্র সিং ধোনি।

২০০৯ সালে ধোনি আইসিসি ওয়ার্ল্ড টেস্ট এবং আইসিসি ওডিআই দলের অধিনায়ক হিসেবে তার নাম ঘোষিত হয়। ২০১১ সালের বিশ্বকাপ ক্রিকেটের চূড়ান্ত খেলায় তিনি মাত্র ৭৯ বলে ৯১ রান করে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে অসাধারণ ব্যাটিংশৈলী প্রদর্শন করলে ভারতীয় দল চ্যাম্পিয়ন হয়। ওই খেলায় ধোনি ম্যান অব দ্যা ম্যাচের সম্মানজনক পুরস্কার লাভ করেন। মহেন্দ্র সিং ধোনি ২০১০ সালের ৪ জুলাই বিয়ে করেন কলকাতার মেয়ে সাক্ষী রাওয়াতকে। এর দুই বছর আগে কলকাতার তাজ বেঙ্গল হোটেলে শিক্ষানবিস হিসেবে কর্মরত থাকা অবস্থায় ধোনির সঙ্গে সাক্ষী রাওয়াতের পরিচয় হয়। সাক্ষী রাওয়াত হোটেল ব্যবস্থাপনা নিয়ে পড়াশোনা করেছেন। ২০১১ সালে ধোনিকে ভারতের সামরিক বাহিনী লেফটেন্যান্ট কর্নেলের পদমর্যাদা প্রদান করে। ধোনির বড় শখ দেশী-বিদেশী কুকুর পোষা। আর আছে ভিডিও গেম খেলার নেশা। কিশোর কুমারের হিন্দী গানের ভক্ত ধোনি সিনেমা দেখায় উৎসাহী নন। দুধ খেতে খুব ভালবাসেন ধোনি। আর ভালবাসেন আলু-ভুজিয়া। এমনিতে আগে মাছ-মাংস না খেলেও, এখন দেশে-বিদেশে ঘুরতে গিয়ে দুনিয়ার কোন খাবারেই আর অরুচি নেই ধোনির। তবে কলকাতায় এলে ইলিশ মাছ ভাজা দিয়ে ভাত তার বেশ পছন্দের খাবার।

বলিউড অভিনেতা জন আব্রাহামের ভক্ত বলেই এক সময় লম্বা চুল রেখে নজর কেড়ে নিয়েছিলেন মহেন্দ্র সিং ধোনি। হয়ে ওঠেন ফ্যাশন আইকন। বাইক ভালবাসেন তিনি। সময়-সুযোগ মিললেই মোটরসাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। রাঁচিতে তার গ্যারেজে রয়েছে ৪টি গাড়ি। সঙ্গে ২৩টি হাইস্পিড মোটরসাইকেল। মহেন্দ্র সিং ধোনি। ভারতীয় অধিনায়ক যিনি ২০০৭ সালে ভারতকে টি২০ চ্যাম্পিয়ন, ২০১১ সালে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন এবং ২০১৩ সালে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জিতিয়েছেন। এ সকল ট্রফির রাজসাক্ষী ধোনি আর তার হাত ধরেই আসে এসব ট্রফি। বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন দলের অধিনায়ক ধোনি টি২০ চ্যাম্পিয়ন করানোর পর থেকে এ অধুরা থাকা চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জয়ের আশা ব্যক্ত করেন। অবশেষে তাও পূরণ করে একমাত্র অধিনায়ক হিসেবে তিনটি ট্রফি গড়ে তোলার গৌরব অর্জন করেন। টি টোয়েন্টি বিশ্বকাপ, ৫০ ওভারের ক্রিকেটের বিশ্বকাপ, আইপিএল, চ্যাম্পিয়ন্স লিগ টি টোয়েন্টি, টেস্ট এবং ওয়ান ডে ক্রিকেটে বিশ্ব র‌্যাংকিংয়ে সেরা দলকে নেতৃত্ব দেয়ার পর এবার চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিও হাতে তুললে ভারতীয় ক্রিকেটের সর্বকালের সেরা ক্যাপ্টেনের জায়গায় সে বসে পড়বে অনায়াসেই।

একমাত্র রিকি পন্টিং তার সঙ্গে তুলনীয়। পন্টিংয়ের সময়ে অস্ট্রেলিয়া টেস্ট ও ওয়ানডে দুই ধরনের ক্রিকেটেই এক নম্বরে থেকেছে। কিন্তু টি টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ভাগ্য হয়নি পন্টিংয়ের। তাই তো ধোনি সর্বকালের সেরা একজন অধিনায়ক।

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>