| 29 মার্চ 2024
Categories
গীতরঙ্গ

বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যায় মানুষের ভূত দেখার কারণ

আনুমানিক পঠনকাল: 5 মিনিট

এই তো গেল বছরের কথা। ত্রিশ বছর বয়সী অ্যামেথিস্ট রিয়েলম নামে এক তরুণী The Sun এবং ITV-কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, “আমি ভূতের সঙ্গে সহবাস করেছি!” শুনেই নড়েচড়ে বসেন সকলে। ভূতের সঙ্গে সহবাস, এও কী সম্ভব? শুধু তাই নয়, মেয়েটি দাবি করে সে এক বা দুজন নয়, প্রায় বিশজন ভূতের সাথে একান্তে সময় কাটিয়েছে। এর মধ্যে আবার একজনের সঙ্গে তার পরিচয় হয়েছে বিমানের টয়লেটে। যার সঙ্গে তিনি এখন সত্যি সত্যি প্রেম করছেন!

আমাদের মধ্যে অনেকেই আছেন যারা প্রায়সময় দাবি করেন তারা ভূত দেখেছেন। কেউ স্বপ্নে তো কেউ আবার বাস্তবে। কিন্তু অ্যামেথিস্ট রিয়েলমের এই ঘটনা শোনার পর প্রায় সারা পৃথিবীতেই আলোড়ন পড়ে যায়। পক্ষে বিপক্ষে অনেকেই অনেক কিছু বলতে শুরু করেন। কেউ কেউ এটাকে সত্য বলেই মনে করেন আবার কেউ কেউ এটাকে পাগলামি ছাড়া আর কিছু নয় বলেই মনে করেন।

https://imaginary.barta24.com/resize?width=700&quality=75&path=uploads/news/2019/Sep/01/1567299450123.jpg
◤ ভূতের সঙ্গে সহবাস করেছেন বলে দাবি এ তরুণীর ◢

এই ঘটনা সত্য না বা মিথ্যা, সেটা আজকের আলোচনার বিষয় নয়। আমাদের আজকের আলোচনার বিষয়—ভূত দেখা বিষয়ে বিজ্ঞান কী বলে

ইচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায়, আমাদের মধ্যে অনেকেই আছেন যারা জীবনে একবার হলেও ভূত দেখার অভিজ্ঞতার শিকার। যেহেতু ব্যক্তিগত জীবনে আমি কখনো এমন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হইনি তাই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকে লেখাও গেল না। সত্যি বলতে, আমাদের প্রায় অধিকাংশেরই ভূতসংক্রান্ত অভিজ্ঞতা এভাবেই আসে, অর্থাৎ আমরা নিজেরা যতটা না এ ব্যাপারে বাস্তব অভিজ্ঞতাপ্রাপ্ত হই, তারচেয়ে বেশি হই অন্যের থেকে শুনে। অমুককে অমুক জায়গায় ভূতে ধরেছে বা অমুক ওখানে ভূত দেখেছে এমন হাজারও গল্পে ভরে আছে আমাদের শৈশব-কৈশোর এমনকি যৌবনও। তাই স্বাভাবিকভাবেই আমাদের কৌতূহলী মন জানতে চায় আসলেই কি ভূত বলে কিছু আছে? 

এ ব্যাপারে জানতে গেলে ভূতে বিশ্বাসীরা শুরুতেই একটা ধাক্কা খাবেন। বিজ্ঞানীরা বহুদিন আগে ভূতের অস্তিত্ব নাকচ করে দিয়েছেন। কিন্তু তবুও শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে চলে আসছে এই বিতর্ক। ভবিষ্যতেও চলবে বলেই ধারণা করা হয়। যার কারণ এক গবেষণায় দেখা গেছে পৃথিবীর ৩০% মানুষ এখনো ভূত ও অতিপ্রাকৃতিক ঘটনায় বিশ্বাস করেন। আর এই বিশ্বাসের পালে হাওয়া দিতে প্রায়ই উড়ে আসে বেশ কিছু ভিডিও। অনলাইনে প্রায়সময় কিছু ভিডিও ভাইরাল হয় যেখানে দেখা যায় অতিপ্রাকৃতিক ঘটনা ঘটছে এবং দাবি করা হয় এসব সত্য। সেসব ঘটনা আবার ব্যাপক সাড়াও ফেলে। লাইক, শেয়ার আর পক্ষ-বিপক্ষের নানান মন্তব্যে হাউজফুল হয়ে থাকে ভিডিওগুলো। আর এরও একটাই কারণ, এখনো অনেকে মনে করেন ভূত বলতে আসলেই কিছু আছে।

আমরা প্রত্যেকেই এমন কিছু লোককে চিনি বা জানি বা তাদের গল্প শুনেছি, যারা ভূত দেখেছেন। অনেকে আবার এমনও আছেন যারা ভূত পালেন বলেও দাবি করেন। হোক সেটা কল্পনায় বা বাস্তবে। যারা স্বচক্ষে ভূত দেখার দাবি করেন তারা কেন এমন দাবি করেন? এ ব্যাপারে জ্ঞান তার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যায় বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রদান করেছে। এগুলোর কয়েকটি নিয়ে আলোচনা করা হলো।

বনের বাঘে খায় না, মনের বাঘে খায়

এই প্রবাদটি আমাদের দেশে খুব প্রচলিত। আর ভূতে বিশ্বাস বা ভূত দেখার ব্যাপারেও বিজ্ঞানীরা এই কথাটিকেই মনে করেন সবচেয়ে বড় একটি কারণ। ভূত বিশ্বাসীদের মনে গেঁথে থাকে ভূত। আর আমাদের মনে এই ভূতের অস্তিত্ব সবার আগে ঢুকিয়ে দেন আমাদেরই মা, বাবা, দাদা, দাদি কিংবা এমনি কাছের মানুষেরা। যারা প্রায়সময় ঘুম পাড়ানোর জন্য কিংবা কান্না থামানোর জন্য আমাদেরকে ভূতের ভয় দেখান। আর আমাদের অবচেতন মনও এসবকে ধীরে ধীরে সত্য বলে মেনে নিতে শুরু করে। আমাদের মানসিক কাঠামোতেও ভূত তার পাকাপাকি একটা জায়গা করে নেয়।

এ ব্যাপারে The Houran and Lange model মতবাদটি বলছে, একজন মানুষই অপর একজনকে ভূত দেখতে উদ্বুদ্ধ করেন। যদি একজন মানুষ কোথাও ভূত দেখেছেন বলে দাবি করেন, তাহলে ভূতে বিশ্বাসী মানুষেরা সে কথার শোনার পর সেই নির্দিষ্ট জায়গায় ভূত দেখবেনই। এটা বাস্তবের থেকেও বড়, অবচেতন মনের ক্রিয়ায় হয়ে থাকে।

বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে মানুষের আচরণ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। এমনি একটি পরীক্ষা করা হয় ১৯৯৭ সালে। প্রাচীন ও পরিত্যক্ত এক থিয়েটারে ২২ জন মানুষকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তাদের মতিগতি তথা মনোভাব দেখার জন্য। বিজ্ঞানীরা তাদের যাচাই বাছাই করার জন্য দুটি আলাদা ভাগে ভাগ করেন। এদের মধ্যে ১১ জনকে বলা হয়েছিল থিয়েটারটির পুনর্নির্মাণ হবে। বাকি ১১ জনকে বলা হয়েছিল, সাবধানে থাকতে, কারণ এই পোড়ো থিয়েটারে এমন কিছু ঘটনা ঘটে, বুদ্ধিতে যার ব্যাখ্যা মেলে না।

যেই ভাবা সেই কাজ। গভীর রাতে থিয়েটারের বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্নজন ঘণ্টা চারেক কাটিয়েছিলেন। দুই দলের অভিজ্ঞতায় প্রথম ১১ জন জায়গাটকে বড্ড নোংরা, সাপখোপ থাকতে পারে, পুনর্নির্মাণ না করে নতুন বানানো উচিত, থিয়েটার পুনর্নির্মাণ করতে খরচ অনেক বেশি হবে, এখন এই নকশা চলে না ইত্যাদি ইত্যাদি অভিমত ব্যক্ত করেন। আর অপর ১১ জন কী বলেছেন জানেন? তারা সেখানে বিভিন্ন লোকের পায়ের আওয়াজ শুনেছেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ আবার কিছু একটা উড়ে যেতেও নাকি দেখেছেন!

বুঝতেই পারছেন ব্যাপারটা যতটা না বাস্তবিক, তার চেয়ে বেশি কাল্পনিক। সাধারণভাবে, ভূতে বিশ্বাস আছে এমন লোকেরাই এখানে সেখানে ভূত দেখে বেড়ান। কোনো পুরনো বাড়ি, বাঁশঝাড় কিংবা গভীর কোনো জঙ্গল দেখলে তারা নিজেরাই নিজের মনের মধ্যে ভূতের একটা ছবি আঁকা শুরু করেন এবং একটা ভৌতিক পরিবেশ তৈরি করে ফেলেন।

ভূত দেখা বিষয়টি সম্পূর্ণ মানসিক

বিজ্ঞান বিভিন্ন গবেষণার মাধ্যমে প্রমাণ পেয়েছে, যারা প্রচণ্ড ভূতে বিশ্বাসী, ভূতের অস্তিত্বের ব্যাপারে নিঃসন্দেহ, এমনকি নিজেরাও ভূত দেখে টেখে থাকেন, তাদের ওপর কাজ করে এক বিশেষ বৈদ্যুতিক তরঙ্গ। ডি পিজ্জাগালি নামে এক বিজ্ঞানী ২০০০ সালে একটি পরীক্ষা করে এই বিষয়টি সামনে নিয়ে আসেন। পরীক্ষায় তিনি দেখিয়েছিলেন, ভূতে বিশ্বাসীরা তাদের মস্তিষ্কের ডান গোলার্ধে নিজের ওপর অতিরিক্ত আস্থা পোষণ করেন। অর্থাৎ ভূতে অবিশ্বাসীদের তুলনায় ভূতে বিশ্বাসীদের মস্তিষ্কের ডান দিকে বৈদ্যুতিক ক্রিয়া বেশি সক্রিয়। আর যার ফলে নিজের ভূত দেখার অদম্য আগ্রহের সঙ্গে তাল মিলিয়ে, সামনের দেখা স্বাভাবিক জিনিসকে ভূতুড়ে করে তোলে মস্তিস্কের ডান গোলার্ধের এই অতি সক্রিয় তরঙ্গগুলি।

একা থাকলেই মানুষ ভূত দেখে

খেয়াল করলে দেখা যাবে যারাই বলেন যে তারা ভূত দেখেছেন, বেশিরভাগই কিন্তু ভূত দেখার সময় একা থাকেন। সমবেত বা দলবদ্ধ অবস্থায় ভূত দেখার অভিজ্ঞতা হয়েছে এমনটা খুব বেশি শোনা যায় না। আপনি নিজেও হয়তো জীবনে দুয়েকবার ভূত দেখেছেন। মনে করে দেখুন তো, তখন কি দুপুর তিনটা বাজছিল নাকি রাত তিনটা? বুঝতেই পারছেন যখন মানুষ নির্জন, অচেনা জায়গায় থাকে, সাধারণত তখন তারা ভূত দেখেন।

রাতের আঁধারে আমাদের একাকিত্ব ও একাকিত্বের ভয় মনে অন্য কারো উপস্থিতি জানান দেয়। ঘাড়ে কারো গরম নিঃশ্বাস, পার্কের গাছটার নড়ে ওঠা, ছাদে কারো পায়ের আওয়াজ টের পাই। এভাবেই তৈরি করে নিই আমাদের মনগড়া ভূতুড়ে পরিবেশ, আমরা নিজেরাই।

তড়িৎচৌম্বকীয় ক্ষেত্র (Electromagnetic Fields)

ইনফ্রাসাউন্ড নামে একটি তড়িৎচৌম্বকীয় ক্ষেত্র রয়েছে যা আমাদের ভূত দেখায় বা ভৌতিক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি করায়। কানাডার নিউরোসায়েন্টিস্ট ড. পারসিঙ্গার এবং তার লরেনটিয়ান ইউনিভার্সিটির টিম ইনফ্রাসাউন্ডের সঙ্গে ভূতের সম্পর্ক নিয়ে ব্যাপকভাবে গবেষণা করেছেন। যেখানে তারা গড হেলমেট নামক একটি যন্ত্র তৈরি করেন। এই হেলমেট মাথায় পরলে এটি তাঁদের মস্তিষ্কের নির্দিষ্ট একটি অংশকে চৌম্বকীয় সিগনাল ছুড়ে উদ্দীপ্ত করে। ভূতে বিশ্বাসীদের এটা পরতে দিলে তারা অবাস্তব অকল্পনীয় দৃশ্য প্রত্যক্ষ করেন। দেখা গেছে, নির্জন জায়গায় যতক্ষণ ভূত বিশ্বাসীরা হেলমেটটি পরে ছিলেন, সেই সময়ের মধ্যে তাদের অনেকে ভূত দেখেছেন বা ভূতের ছায়া দেখেছেন। কেউ কেউ তো যিশুকে দেখেছেন বলেও দাবি করেন! যদিও আদতে তা ছিল ইনফ্রাসাউন্ডের এফেক্ট।

◤ ইনফ্রাসাউন্ডের এফেক্টে ভূতে বিশ্বাসীরা ভূত দেখে ◢

ভূত আছে কি নেই এই বিতর্ক একদিনের না, এবং এক দিনে শেষও হবার নয়। তবে এটুক বলে দেওয়া যায়, যদি ভূত বলে কিছু থেকে থাকে তবে সেটা আছে মানুষের চিন্তায়, মানুষের মস্তিষ্কে, কোনো পুরনো দালান, নির্জন রাস্তা কিংবা রাতের অন্ধকারে নয়।

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত