জাপানের নদনদী সংরক্ষণে শিশুদের ভূমিকা
জাপানি ভাষায় তিনটি কথা প্রচলিত আছে: মিজুআসোবি বা জলক্রীড়া; কাওয়াআসোবি বা নদীবিহার এবং কাওয়াবুনকা অথবা নদী সংস্কৃতি। মিজুআসোবি এবং কাওয়াআসেবি মূলত এই কাওয়াবুনকারই অন্তর্গত দুটি গুরুত্বপূর্ণ রীতি প্রাচীনকাল থেকেই এদেশে প্রচলিত। জাপানের কাওয়াবুনকা বাস্তবিকই স্বতন্ত্র এক প্রকৃতিনির্ভর সংস্কৃতি। নদীমাতৃক বাংলাদেশের সঙ্গে রয়েছে অনেক পার্থক্য। বিশেষ করে, নদীবিহার এবং লৌকিক শিল্পকলার দিক দিয়ে ‘কাওয়াবুনকা’ ব্যতিক্রম বলতেই হবে। নদনদীকে ঘিরে জাপানি জাতির গ্রামীণ সভ্যতা যেভাবে ‘উকিইয়োএ’ বা ‘কাঠখোদাই চিত্রে’ বিধৃত হয়েছে তার তুলনা অন্য কোনো সংস্কৃতিতে নেই বললেই চলে।
এই কাওয়াবুনকাই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এবং যুদ্ধোত্তর প্রায় তিন দশক পর্যন্ত মানুষের বিস্মৃতির অন্তরালে চাপা পড়েছিল সঙ্গত কারণেই। কারণ যুদ্ধের ভয়াবহতার মধ্যে নদীজীবন নিরাপদ ছিল না সাধারণ মানুষের জন্য। আর যুদ্ধের পর পরাজিত, বিধ্বস্ত জাপানের তীব্র অর্থনৈতিক সংকট এবং ৫০ এর দশকে যন্ত্রসভ্যতার উত্থানের ফলে দেশের বহু ছোট বড় নদনদী ও খালবিল রাসায়নিক বর্জ্যরে ভাগাড়ে পরিণত হয়েছিল। নদীকেন্দ্রিক প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও পরিবেশ বিপর্যয় এমন চরম পর্যায়ে চলে গিয়েছিল যে, নদীর মাছ, কচ্ছপ, শামুক, গুল্ম সবই বিষাক্ত হয়ে উঠেছিল। নদী ও খালে নিক্ষিপ্ত পরিত্যক্ত ব্যবহারিক পণ্যসামগ্রীর আবর্জনার নোংরা পদার্থে ভারী হয়ে ওঠা জলপ্রবাহের নাভিশ্বাস শরীরেও এসে লাগতো। এর প্রমাণ ১৯৫৬ সালের ‘মিনামাতাবিয়োও’ বা ‘মিনামাতারোগ’ নামক জাপান কাঁপানো ভয়াবহ এক ব্যাধি যার উদ্ভব ঘটেছিল সামুুদ্রিক এবং নদীজলে মিশ্রিত কলকারখানা থেকে নিঃসৃত রাসায়নিক বর্জ্য থেকে। আক্রান্ত ৫২ জনের মধ্যে ১৭ জন তৎক্ষণাৎ মৃত্যুবরণ করেছিলেন। ১৯৬৫ সালেও এই রোগের উপসর্গ ধরা পড়ে ২৬ জনের মধ্যে এবং ৫ জন মারা যান। এখনো কেউ কেউ এই রোগে ভুগছেন। কোম্পানি ও সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষতিপূরণের মামলা চলেছিল সুদীর্ঘকাল। ভুক্তভোগীরা রন্ধনকৃত নদীর মাছ, শামুক, গুল্ম থেকে এই স্নায়ুবৈকল্যরোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। সারাবিশ্বব্যাপী এই ঘটনা ব্যাপক প্রচার লাভ করেছিল। এর ফলে বিরূপ প্রভাব দেখা দিয়েছিল নদীভিত্তিক মৎস্য এবং অভ্যন্তরীণ পর্যটন ব্যবসার ক্ষেত্রে। জাপানে নদীভিত্তিক পর্যটন অতীতকাল থেকেই বিখ্যাত। যুদ্ধের পর বেশ কিছু নদীতে বড় বড় বাঁধ দেবার ফলে জলপ্রবাহ, বন্যা নিয়ন্ত্রিত হয়েছে ঠিকই কিন্তু সাংস্কৃতিক ও অর্থনেতিক ক্ষতিই হয়েছে বেশি বলে স্থানীয় নাগরিক এবং গবেষকদের ভাষ্য।
১৯৮৪ সালে আমি জাপানে এসে পরিবেশ এবং নদীদূষণ নিজ চোখেই প্রত্যক্ষ করেছি। যদিওবা ১৯৬৪ সালে অনুষ্ঠিত ‘টোকিও অলিম্পিক’কে কেন্দ্র করে আধুনিক টোকিও গড়ে উঠছিল, দেশের বড় বড় নগরগুলো দ্রুত অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির কারণে নগরায়নের যুদ্ধে অবতীর্ণ কিন্তু পরিবেশ সচেতনতা তখনো নাগরিকদের মধ্যে জাগ্রত হয়নি তেমন করে। যুদ্ধপূর্ব বহু গ্রন্থে মুদ্রিত এবং আলোকচিত্রে দৃশ্যমান যেসব মনোমুগ্ধকর বর্ণনা পড়ার এবং নয়নাভিরাম নদীসৌন্দর্য দেখার অভিজ্ঞতা ছিল তার কিছুই দেখতে পাইনি ১৯৯০ সাল পর্যন্ত। প্রকৃতপক্ষে, এদো যুগ (১৬০৩-১৮৬৮), মেইজি যুগ (১৮৬৮-১৯১২), তাইশোও যুগ (১৯১২-১৯২৬) এবং শোওয়া যুগের (১৯২৬-১৯৮৯) প্রথম ভাগে অর্থাৎ ধারাবাহিকভাবে ২৪০ বছরের যে স্বতন্ত্র এক ‘কাওয়াবুনকা’ এইদেশে গড়ে তোলা হয়েছিল তা ভেঙ্গে পড়েছিল উপরোক্ত কারণে।
মার্কিনী ও ইউরোপীয় আচার-আচরণ এবং সস্তা জনপ্রিয় ফ্যাশন-কুশন জন্মগতভাবে প্রকৃতিপ্রেমী জাপানি জাতিকে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। কারো দুদন্ড সময় বা ইচ্ছে ছিল না নিজেদের মূল্যবান সংস্কৃতির দিকে চোখ ফেরানোর। বলা যায় অর্ধ শতাব্দীকাল আমেরিকার সংস্কৃতি জাপানকে শ্বেতাঙ্গ-সংস্কৃতির মায়াজালে তীব্রভাবেই আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। সেই মায়াপর্দা ছিন্ন হতে শুরু করে বিশ্বপরিবেশ সমস্যার সূত্র ধরে। এবং পরিবেশদূষণ দূরীকরণের প্রথম পদক্ষেপই হয় ‘কাওয়াবুনকা’ তথা ‘নদীসংস্কৃতি’কে পুনরুদ্ধারের মধ্য দিয়ে। ঐতিহ্যকে পুনরায় ফিরিয়ে আনা এবং অভ্যন্তরীণ পর্যটনশিল্পকে সমৃদ্ধ করার লক্ষ্যে এ যাবৎ দুরন্ত মার্কিনী অন্তঃসারশূন্য স্বপ্নের পেছনে ছুটেচলা ক্লান্ত একদল বয়স্ক নাগরিক চিন্তাভাবনা শুরু করেন ৯০ দশকের প্রারম্ভ থেকেই। আমেরিকা ও ইউরোপে প্রাকৃতিক বিপর্যয় এবং পরিবেশ দূষণরোধকল্পে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ, আন্দোলনের প্রভাব জাপানি জনগণ এবং সরকারকেও প্রভাবিত করতে থাকে এই সময় থেকেই। রাজধানী টোকিওর নদনদীকেন্দ্রিক প্রকৃতি ও পরিবেশ পুনরুদ্ধার সম্পর্কে সামাজিক আন্দোলন গড়ে ওঠে এখানে সেখানে। গণমাধ্যমগুলো সরব হয়ে ওঠে। কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, গবেষক, বিজ্ঞানী, ব্যবসায়ী এবং পরিবেশবাদী কর্মীরা সভা-সেমিনার, চিত্রকর্ম, আলোকচিত্র প্রদর্শনীর মাধ্যমে আবালবৃদ্ধবনিতাকে সচেতন করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। একই সঙ্গে স্থানীয় পৌর প্রশাসনকে চাপ প্রয়োগ করতে থাকেন নগরসংলগ্ন নদ-নদীগুলোকে পরিষ্কার, জলশোধন এবং প্রাকৃতিক পরিবেশ গড়ে তোলার জন্য। নদনদীতে কল-কারখানাগুলোর তরল বর্জ্য ফেলার জন্য সমালোচনায় মুখ হয়ে ওঠে পরিবেশবাদী কর্মীরা। বিভিন্ন উপশহর, মহল্লা ও পাড়ায় ‘কাওয়া মামোরু কাই/নদী সংরক্ষণ সমিতি’; ‘কাওয়া কিরেই নি সুরু কাই/নদী পরিষ্কার সংস্থা’; ‘কাওয়া অ আরুকু কাই/নদীধরে হাঁটা সংস্থা’; ‘কাওয়া অ কানগায়েরু কাই/নদীভাবনা সমিতি’; ‘কাওয়াবুনকা গাতারু কাই/নদীসংস্কৃতি বর্ণিত সংস্থা’ ইত্যাদি গড়ে ওঠা শুরু হয়। আর এখন তো সারা দেশের প্রতিটি প্রদেশ ও জেলাই শুধু নয়, গ্রাম, দ্বীপ, উপশহর, পাড়া, মহল্লা থেকে শুরু করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পর্যন্ত গড়ে উঠছে প্রকৃতি ও পরিবেশ সচেতনতাবোধ। বিগত দুই দশকেই জাপান কী পরিমাণ প্রকৃতি ও পরিবেশ রক্ষার্থে, ঐতিহ্যবাহী নদীসংস্কৃতিকে ফিরিয়ে আনতে এবং পরিবেশরক্ষা ও উন্নয়ন সংক্রান্ত বাণিজ্য গবেষণায় উন্নতি সাধন করেছে তা সচক্ষে প্রত্যক্ষ না করলে অবিশ্বাস্য বলে মনে হওয়াই স্বাভাবিক। নিজের দেশের এই বিরাট সাফল্যই আজকে জাপানকে অনুন্নত ও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বিপর্যস্ত দেশ ও অ লে সবুজ সৃষ্টির লক্ষ্যে কাজ করার সাহস ও শক্তি যুগিয়েছে। মানুষের দ্বারা যে নগর ও গ্রামকে প্রাকৃতিকভাবে সবুজ ও সুন্দর করা সম্ভব তা জাপানিরা ক্রমাগত সাধনা ও প্রযুক্তির সাহায্যে প্রমাণ করে চলেছেন। নিঃসন্দেহে আমাদের জন্য এক পরীক্ষিত দৃষ্টান্তমূলক দেশ হচ্ছে জাপান। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জাপানের প্রকৃতি এবং প্রকৃতিজাত সংস্কৃতির টানেই পাঁচ বার এইদেশে এসেছিলেন ১৯১৬-২৯ সাল পর্যন্ত।
মূলত, এই সবুজ সৃষ্টির পেছনে মূল যে চালিকাশক্তিটি কাজ করেছে তা হলো: শিশুভাবনা। শিশুরা আগামী দিনের পিতামাতা, কর্মী এবং রাষ্ট্রচালক। তাদের হাতেই দিয়ে যেতে হবে পরিবার, সমাজ, প্রতিষ্ঠান, ভূমি ও রাষ্ট্রকে। এই যে হিউম্যান রিসাইকল বা মানবজন্মের ঘূর্ণাবর্তন সেখানকার প্রধান শক্তিই (এনার্জি) হচ্ছে: মাটি। মাটির ভিতরেই রয়েছে প্রাণ। প্রাণের আধার জল। জলের উৎস মেঘ। বৃষ্টিকে ধারণ করে পাহাড়, বৃক্ষ-বন-জঙ্গল। সেই বৃষ্টিজলের প্রবাহ হচ্ছে নদ-নদী। যে কারণে নদীকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে সকল সভ্যতা। মানুষ নদী মাতৃক। নদী মানেই জলবায়ু। এই উপলদ্ধি থেকেই জাপানিদের বক্তব্য হচ্ছে: ‘আমাদের শিশুপ্রজন্ম তথা বংশধরকে রক্ষার জন্যই প্রকৃতি ও পরিবেশ আগে রক্ষা করতে হবে। জলবায়ু সমস্যা সম্পর্কে শিশুদেরকে শেখাতে হবে, সচেতন করতে হবে কারণ এর বিকল্প নেই। জলবায়ুর বাস হচ্ছে নদনদী। নদনদী রক্ষা পেলেই শিশুরা সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হবে। সুস্থশিশু সুস্থকর্মী হওয়ার প্রথম শর্ত। এই জন্য শিশুরা যাতে বিশুদ্ধ জলবায়ুজাত নদনদীতে, জলাশয়ে, নদী সংলগ্ন বনে-জঙ্গলে ও পাহাড়ে বিচরণ করতে পারে, প্রকৃতির গঠন ও প্রাণী রহস্য উদঘাটনে আগ্রহী হয়ে ওঠে তার জন্য বিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতে প্রকৃতি ও পরিবেশ বিজ্ঞান ভিত্তিক বিষয়াদি রাখা হয়েছে, পরিবর্তনশীল সমাজের সঙ্গে সমন্বয় রেখে আরও কী কী বিষয় সংযুক্ত করা যায় পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে।’
পিতামাতা তো বটেই, পরিবেশবাদী কর্মী, শিক্ষক, গবেষকরা ছাত্র-ছাত্রীদেরকে মাঠময়দান, পাহাড়, নদনদী, জলাশয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। তাদেরকে প্রকৃতি, নদ-নদী ও পর্বতগঠনের মহারহস্য ব্যাক্ষ্যা করছেন। নদ-নদী শুধু যে আমোদ ভ্রমণ বা খেলাধুলা করার জন্য নয়, এদের ভূমিকা মানবসমাজে কি রকম, শহর-নগর বিনির্মাণে কি ভূমিকা রাখে তাও ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দিচ্ছেন। তারা বলছেন: ‘এক একটি বড় নদী এক একটি সভ্যতা। সেসব নদীকে কেন্দ্র করে সৃষ্টি হয়েছে বৈচিত্র্যময় কৃষিকাজ, খাদ্যরীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, জলক্রীড়া, গীত, বাদ্য-নৃত্য-নাটক, স্মৃতিকথা, রূপকথা, চিত্রকর্ম, শিল্পকর্ম, মৃৎশিল্প, কারিগরি, সুতোবোনা, বস্ত্রশিল্প, কল্পিত জন্তু, প্রাণীর কাহিনী, জলব্যবসা কত কি! কেন নদনদীকে নিয়মিত পরিষ্কার ও সুন্দর রাখতে হবে? কেন ভালোবাসতে হবে? কেন নদীকে নিয়ে ভাবতে হবে? কারণ, নদ-নদীজাত বিশুদ্ধ জলবায়ু আমাদের জীবনে অপরিহার্য। এই জলবায়ুর ভিতরে রয়েছে আমাদের পূর্বপুরুষের নিঃশ্বাস, জীবন ও কর্মের স্মৃতি। এসব আমাদের জাতীয় সংস্কৃতি ও ইতিহাস। সংস্কৃতি ও ইতিহাসকে জেনে রাখতে হবে, স্মরণ করতে হবে, সংরক্ষণ করতে হবে। এই ধারাবাহিকতাই হচ্ছে ঐতিহ্য। তাই ‘কাওয়াবুনকা’ আমাদের দেশের অহংকার।’
অন্যদিকে নদীসংরক্ষণ সংস্থা হিসাবে দিন দিন বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে এনজিও, এনপিও, গবেষণা সংস্থা, ফাউন্ডেশন এবং নাগরিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। যাদের অধিকাংশেরই লক্ষ্য হচ্ছে শিশুপ্রজন্মকে সচেতন করে তোলা। যেমন অইসুকা; য়োশিনোগাওয়া মিননানো কাই/য়োশিনো নদী সর্বজন সংস্থা; ওয়াটার স্কেপ কমিটি; চি ইকি কানকিয়োও সেইকাৎসুকা কিয়োওগিকাই/আ লিক পরিবেশ ও জীবযাপন পরিষদ; চিকুগোগাওয়া মারুগোতো হাকুবুৎসুকান/চিকুগো নদী সম্পূর্ণ জাদুঘর; আরা নদী অ কিরেই নি সুরু কাই/ আরাকাওয়া নদী বিশোধন সংস্থা; মিজুবে কিবান কিয়োওকাই/ জলাধারভিত্তিক সমিতি; নিহোন নো গাওয়া তো সাইগাই কেনকিউ কাই/ জাপানের নদনদী এবং বিপর্যয় গবেষণা সংস্থা; জাপান ওয়াটার নেটওয়ার্ক; মেই সুই দাইজেন কাই/ উত্তম জল ও মহাপ্রকৃতি সংস্থা; সারিগাওয়া অ কানগায়েরু কাই/সারি নদী ভাবনা সমিতি; আওমোরি নো গাওয়া অ আই সুরু কাই/আওমোরি’র নদীপ্রেম সমিতি; কাপ্পা ক্লাব/ জলদেও ক্লাব; ৎসুরুমিগাওয়া রিউইকি নেটওয়ার্ক/ ৎসুরুমি নদী অববাহিকা নেটওয়ার্ক; আওই ইউমে কাই/ছনীল স্বপ্ন সংস্থা; হিনোগাওয়া রিউইকি কোওরিউকাই/ হিনো নদী অববাহিকা প্রীতি সমিতি; শিজুওকা কেন্ রিউইকি নেটওয়ার্ক/শিজুওকা জেলা অববাহিকা নেটওয়ার্ক/ আরাকাওয়া ক্লিন এইড অ্যাসোসিয়েশন/আরা নদী বিশোধন সাহায্য সমিতি/ দাই চি অ মামোরু কাই/পৃথিবী সংরক্ষণ সংস্থা/ কাওয়া তো উমি নো কানকিয়োও মামোরু কাই/ নদী ও সামুদ্রিক পরিবেশ সংরক্ষণ সংস্থা; মিজু নো গাক্কোও/ জল বিদ্যালয়; কামাদোগাওয়া শিজেন ওওকোকু/কামাদোগাওয়া প্রকৃতি রাজ্য; নিহোন ইয়াচোও নো কাই/ জাপান বন্যপাখি সংস্থা; নিহোন নো মিজু অ কিরেই নি সুরু কাই / জাপানের জল বিশোধন সংস্থা; আতারাশিই কাজে/ নতুন বাতাস; এ সীড (বীজ) জাপান প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। এছাড়া ভূমি ও যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের অধীনে রয়েছে একাধিক সংস্থা। তবে সবচেয়ে উৎসাহব্যঞ্জক বিষয়টি হচ্ছে যে, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি থাকার কারণে এবং এই সমৃদ্ধিকে ভবিষ্যতে ধরে রাখার লক্ষ্যে সর্বত্রই ছোট বড় নদনদী, হ্রদ, জলাশয়, পুকুর ইত্যাদিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠছে সংরক্ষণ সংগঠন। এটাকে একটি নীরব বিপ্লব বলা যেতে যার সংবাদ বাংলাদেশের মানুষের কাছে এখনো পৌঁছেনি। সম্ভবত বিশ্বের আর কোনো দেশে নদনদী বা জলসম্পর্কিত আ লিক এত বেশি সংস্থা-সমিতি-সংগঠন-ফাউন্ডেশন গড়ে ওঠার কথা জানা নেই। এইসব সংস্থাগুলোর সঙ্গে নির্ভুলভাবে জড়িত আছে স্থানীয় পৌর প্রশাসন, শিক্ষা পরিষদ এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ। ফলে এসবের চালিকাশক্তি হবে ধারাবাহিক প্রজন্ম অনুযায়ী শিশুরা। সর্বত্র সবুজ সৃষ্টির এই প্রবণতায় বসে নেই বড় বড় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান। তারাও এগিয়ে আসছে শিশু-কিশোরদেরকে প্রকৃতি সম্পর্কে বিশেষ করে পাহাড় ও নদী পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নকরণ স্বেচ্ছাসেবায় উৎসাহিত করার জন্য। এক্ষেত্রে মিৎসুবিশি, মারুবেনি, সানয়োও, টোকিও গ্যাস কোম্পানি, টোকিও ওয়াটার সাপ্লাই কোম্পানি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সর্বপ্রকার গণমাধ্যম, প্রকাশনা সংস্থাগুলোও শিশুদেরকে পরিবেশ রক্ষা, পণ্যের রিসাইক্লিং পদ্ধতি, প্রকৃতি-পাহাড়-বন-নদী-সমুদ্র পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার বিষয়ে সচেতন করে তুলতে সচিত্র সংবাদ, প্রতিবেদন, অঙ্কনচিত্র, আলোকচিত্রের অ্যালবাম প্রকাশ করছে।
শুধু তাই নয়, নদীপ্রিয় শিশুদেরকে প্রবীণরা জড়ো হয়ে বলছেন নদীর গল্প। এই নদীর গল্পবলা জানি না আর কোনো দেশে এভাবে হয় কিনা। ঐতিহ্যবাহী পোশাক ও প্রসাধনীতে সজ্জিত হয়ে প্রবীণরা বলছেন তাদের শৈশব ও কৈশোরে নদনদীতে কীভাবে খেলাধুলা এবং বিচরণ করতেন গ্রীষ্ম-বর্ষা-হেমন্তে; কি কি উৎসব-পূজো-পার্বন অনুষ্ঠিত হতো ঘটা করে; কি কি মাছ ধরতেন কীভাবে ধরতেন; কল্পিত ভয়ানক জীবজন্তু ‘কাপ্পা’র ভয়ে কী রকম প্রকম্পিত হতেন ইত্যাদি অভিজ্ঞতার কথা বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গিমা এবং অভিনয়ের মাধ্যমে। শিশুরা বিস্ময়ভরা চোখে সেইসব রূপকথা শোনে! তারা শুনে অবাক হয়ে যায় যে, ২৫/৩০ বছর আগেও রাজধানী টোকিও প্রতিবছরই আরাকাওয়া, সুমিদাগাওয়া, এদোগাওয়া, কানদাগাওয়া, নাকাগাওয়া প্রভৃতি নদনদীর প্লাবনে শহরতলি ভাসতো। রাস্তা, অলিগলিতে হাঁটু পরিমাণ জল এসে প্রবেশ করতো। মানুষজন ঘরের চালে উঠে আশ্রয় নিতো! এটাও ছিল নদীকেন্দ্রিক নাগরিক জীবনযাপনের একটি অংশ। ৭০-৮০’র দশকে বন্যা নিয়ন্ত্রণকল্পে নদীগুলোর দু’তীর কংক্রিটের দেয়াল দিয়ে বেঁধে ফেলা হয়েছে। এখন আর বন্যা হয় না। কিন্তু সেই উষ্ণস্মৃতি আজও মুছে যায়নি।
জাপানের বিভিন্ন জেলায় প্রতি বছর নৌকোবাইচ ছাড়াও ঐতিহ্যবাহী জলক্রীড়া অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। এই জলক্রীড়ার মধ্যে ‘কিবা-নো-কাকুনোরি’ খুবই বিখ্যাত। বিগত ৪০০ বছর ধরে টোকিওর কোতো ওয়ার্ডের কিবা শহরের ফুকাগাওয়া নদীর উপর বাঁশভাসানো মে নানা ধরনের শারীরিক কসরৎ দেখান স্থানীয় ক্রীড়াবিদরা। এই ক্রীড়ায় বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরাও স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে অংশগ্রহণ করে থাকে। প্রবীণরা এই খেলা শিক্ষা দিয়ে থাকেন স্থানীয় ছেলেমেয়েদেরকে। অনুরূপ বিজ্ঞান শিক্ষকরা যন্ত্রপাতি, রাসায়নিক সরঞ্জামসহ ছাত্রছাত্রীদেরকে নিয়ে অগভীর পাহাড়ি নদনদীর জল, মাটি, শামুক, গুল্ম, উদ্ভিদ, শ্যাওলা, মাছ, ব্যাঙ, সাপ, কীটপতঙ্গ এবং অনুপ্রাণী সংগ্রহ করার জন্য নিয়মিত বেরিয়ে পড়েন। সংগৃহীত এইসব উপাদান নদীর তীরে না হয় বিদ্যালয়ের গবেষণাগারে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন। কাজেই শিশুবয়সেই ছাত্র-ছাত্রীরা বুঝতে সক্ষম হয় নদী ও বাস্তব্যবিদ্যা বা ইকোলজির সম্পর্ক কেন অপরিহার্য! কি কারণে নদনদী না থাকলে প্রকৃতির মধ্যে লুকিয়ে থাকা রোগজীবাণু, বিষাক্ত পদার্থগুলো মানবদেহকে ক্রমাগত আক্রান্ত করতো নদীর বায়ুপ্রবাহ, কীটপতঙ্গ এবং বৃষ্টির জলে সেসব জীবাণু দূরীভূত হয় ইত্যাদি তথ্য তুলে ধরেন। নদীর জল ও মাটি কতখানি কলুষিত হচ্ছে, প্রাণীগুলোর প্রজনন ঠিক আছে কিনা নিয়মিত পরীক্ষা করে দেখান শিক্ষকরা। শুধু গবেষণাই নয়, সেইসঙ্গে প্রতি সপ্তাহে বা মাসে বিভিন্ন জায়গায় নদ-নদীর আবর্জনা পরিষ্কারের কর্মসূচী তো বাঁধা আছেই। নেতৃত্ব দেন শিক্ষকরা।
প্রতিষ্ঠান ছাড়াও শিশু-কিশোর নিজেরা দল বেঁধে নদনদীকে জানা ও সংরক্ষণকল্পে উদ্যোগী হয়ে পৌর গ্রন্থাগারে গিয়ে নদী বিষয়ক গ্রন্থ, ম্যাগাজিন পাঠ, বিভিন্ন পরিবেশ উন্নয়ন সংস্থার সভা-সেমিনারে অংশগ্রহণ এবং নদীসংস্কার প্রকল্পে কাজ করে থাকে। সরকারি ও বেসরকারি নদী ও পরিবেশ সংরক্ষণ সংস্থা কর্তৃক আহুত নদী সৌন্দর্যের ওপর আলোকচিত্র, প্রবন্ধ রচনা, অঙ্কনচিত্র, কবিতা-গান লেখা প্রতিযোগিতায়ও তারা নিয়মিত অংশ নেয়। সাম্প্রতিককালে জাপানে প্রতি বছরই কোনো না কোনো সংস্থা কর্তৃক ‘জল ও শিশু’ শীর্ষক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। সেখানেও সাংবাদিক সেজে শিশুরা জল ও নদীবিষয়ক সম্মেলনে অংশগ্রহণ করে বিদ্যালয়ের শিক্ষককে প্রতিবেদন পেশ করে থাকে। এরকম উল্লেখযোগ্য কয়েকটি সম্মেলন হলো: ‘আকুয়া মেট্রোপলিস ওসাকা ২০০৯’, গত বছর দক্ষিণা ল শিল্পনগরী এবং নদীমাতৃক মহানগর ওসাকাতে অনুষ্ঠিত হয়। প্রায় দু’মাসের জন্য অনুষ্ঠিত এই জলসম্মেলনটি ব্যাপক আলোড়ন তোলে জাপানব্যাপী। তাতে শিশু ও তরুণ-তরুণীদের অংশগ্রহণ ছিল অনুষ্ঠানের মূল আকর্ষণ। একই বছর ফুকুওকা শহরেও অনুষ্ঠিত হয়েছে ‘চিলড্রেন’স ওয়ার্ল্ড ওয়াটার ফোরাম ফলো আপ ফুকুওকা ২০০৯’। আবার ২০০৯ সালেই তুরস্কের ইস্তানবুল শহরে অনুরূপ ফোরাম অনুষ্ঠিত হয়, সেখানেও জাপানি ছাত্র-ছাত্রীরা বিশেষ ভূমিকা রাখে। এর আগের বছর ২০০৮ সালে টোকিওতে অনুষ্ঠিত হয়েছিল এই আন্তর্জাতিক ফোরাম। বিভিন্ন দেশের ছাত্র-ছাত্রীরা এসেছিল জলবায়ু, পরিবেশ এবং নদীসংরক্ষণ বিষয়ে সভা-সেমিনার ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠনাদিতে অংশগ্রহণ করার জন্য।‘চিলড্রেন’স ওয়ার্ল্ড ওয়াটার ফোরাম’ দু’টোর আয়োজক ছিল ‘কাওয়াগাওয়া কানকিয়োও কানরি জাইদান’ বা ‘নদনদী পরিবেশ নিয়ন্ত্রণ ফাউন্ডেশন’ নামক আন্তর্জাতিকমুখী একটি জাপানি সংস্থা। এরকম ফাউন্ডেশন আরও রয়েছে জাপানে যারা শিশু ও তরুণ প্রজন্মকে উৎসাহিত করছে জল তথা নদনদীর বৈশ্বিক ভূমিকা সম্পর্কে সচেতন হতে। কেননা বর্তমান জলবায়ু সমস্যাকে আন্তর্জাতিকভাবে মোকাবেলা না করলে নয়, তাই আগামী দিনের বিশ্বনাগরিক শিশুদেরকেও সমানভাবে বয়স্কদের সঙ্গে এগিয়ে আসতে হবে। সংস্থাগুলো আয়োজন করছে বিভিন্ন ওয়ার্কশপও, সেখানে কিভাবে নদীপরিষ্কার, জল পরিশোধন, জলের উত্তম ব্যবহার, পর্বত ও বনরাজি থেকে জলসৃষ্টির ব্যবস্থা করা যায় আলোচনা ও পন্থা-পদ্ধতি সম্পর্কে শিশু শিক্ষানবিশরা শিক্ষালাভ করছে। বস্তুত এইসব আয়োজনের ফলেই নদীতীরে খেলাধুলা, সঙ্গীতানুষ্ঠান, নাটক, মাছধরা ইত্যাদির পাশাপাশি পাহাড়ি নদীর তীরে ক্যাম্প-লাইফও নদীপ্রিয় তরুণদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে ক্রমশ। নদনদীর সঙ্গে মিশে থাকার কোমল একটা অনুভব লক্ষ করা যাচ্ছে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে। সর্বত্রই এখন নদনদীকে ঘিরে উৎসব-উৎসব আমেজ যাকে আরও এক ধাপ উজ্জ্বল করেছে বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের আনন্দঘন বর্ণিল অংশহগ্রহণ।
এদেশে রয়েছে নদীভিত্তিক অনেক উৎসব, মেলা ও সমাবেশ, বিশেষ করে ‘হিনামাৎসুরি’ বা জাতীয় ‘কন্যাদিবস’ উৎসব, ‘কোদোমো নো হি’ বা জাতীয় ‘বালকদিবস’ উৎসব, ‘ওবোন’ নামক ধর্মীয় উৎসবের সময় হানাবি বা আতসবাজি পোড়ানোর যে ব্যয়বহুল মহাআয়োজন হয় তাতে রয়েছে নদীর অবিচ্ছিন্ন সম্পৃক্ততা। ভারতীয় সংস্কৃতিতে নদী ও শিশুসম্পর্কিত কোনো উৎসব আছে বলে জানা নেই। ‘কোদোমো নো হি’র প্রতীক সিল্ককাপড়ে তৈরি ‘কোই’মাছ বা ‘জাপানি কার্প’ আকৃতির বড় বড় খোল যাকে বলে ‘কোই নোবোরি’ এদেশে বাতাসে উড়তে দেখে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিস্মিত হয়েছিলেন ১৯১৬ সালে! এগুলো তৈরির এক বিশাল গ্রামীণ সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে প্রাচীনকাল থেকে অবশ্যই নদীকে কেন্দ্র করে। সিল্ক কাপড়ে মাছ অঙ্কিত এই খোল নদীর স্বচ্ছজলে ধুয়ে ফেলাটাই রীতি। তারপর নদীর জলে, তীরে, মাঠে-ময়দানে, গৃহের এখানে সেখানে এই খোল উড়ানো হয় মে মাসের পাঁচ তারিখে। এক সপ্তাহ ওড়ে এই ‘কোই নোবোরি’। নদীর স্রোতের বিপরীতে যেভাবে কোইমাছ উজিয়ে যায় সেই দৈহিক শক্তি বা প্রবৃদ্ধির সঙ্গে তুলনা করে জাতীয় শিশুদিবসে এই খোল ওড়ানো হয়। এরকম ‘বালক ও নদী সম্পর্কিত সংস্কৃতি’ পৃথিবীর আর কোন্ দেশে দেখি!
সাম্প্রতিককালে স্থানীয় পৌর প্রশাসন শিশু-কিশোররা যাতে গ্রীষ্ম ও বর্ষাকালে জলসংস্পর্শে সময় কাটাতে পারে তার জন্য উদ্যানে নদীর মতো জলপ্রবাহ সৃষ্টি, মজেযাওয়া নদীকে খুঁড়ে তুলে সেখানে লুপ্তনদীটিকে পুরনো আদল দিচ্ছে। যেমন টোকিওর কাৎসুশিকা-ওয়ার্ডের বিলুপ্ত হিকিফুনে গাওয়া। এই নদীটির কোথাও কোথাও উদ্যান, কোথাও ঝর্না, কোথাও কোথাও সুইমিং পুল আবার কোথাও কোথাও গ্রামীণ প্রতিবেশ তৈরি করা হয়েছে। যা সত্যি মনোমুগ্ধকর! এখানে গ্রীষ্ম ও বর্ষাকালে ছেলেমেয়েরা জলক্রীড়া ছাড়াও প্লাস্টিকের জালি, বড়শি দিয়ে ছোট-ছোট মাছ, চিংড়ি, কাঁকড়া, জাপানি জারি-কাঁকড়া ধরে জলপাত্রে রেখে লালন করে। নদী থেকে আহরিত কচ্ছপের বাচ্চা, বাজার থেকে কিনে আনা নানা রঙের গোল্ডফিস পোষ্যপ্রাণী হিসাবে লালনপালন করা জাপানি শিশুদের এক ঐতিহ্যবাহী আনন্দদায়ক খেলা।
জাপানি শিশুরা এখন জানে যে, বৃষ্টি ও জল না থাকলে নদী থাকবে না, নদী না থাকলে গ্রীষ্ম-বর্ষা নিরানন্দময় কাটাতে হবে। এই যে বিদ্যালয়ের শ্রেণীকক্ষে রক্ষিত অ্যাকুরিয়ামে কচ্ছপের বাচ্ছা, গোল্ডফিস, জারি-কাঁকড়া, চিংড়ি, মাছ খেলে চলেছে স্বচ্ছজলের মধ্যে এই দৃশ্যও আর থাকবে না। নদী আছে বলেই তা সম্ভব হচ্ছে। কাজেই প্রকৃতি ও পরিবেশকে নিয়ে ভাবতে হবেই! এটা খুবই আশ্চর্যের বিষয় যে, নার্সারির শিশুরা পর্যন্ত নদী পরিষ্কার কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ করছে! এই যে তাদের মনের কোমল জমিনে সমাজের অভিভাবক শ্রেণী নদীসম্পর্কে সচেতনতা এবং বৈচিত্র্যময় জগৎ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছেন এটা তাদের বিরাট সাফল্য স্বীকার না করে উপায় নেই। বাংলাদেশের ব্যর্থতাটা এখানেই! আজকে শিশু-কিশোরদের দ্বারাই অনেক দূষিত নদনদী পরিষ্কার হয়ে উঠছে, স্বচ্ছজলের প্রবাহ ফিরে আসছে ফিরে আসছে সুস্বাদু মাছ আয়ু, বেলেমাছ, নিজিমাসু, সালমন, কোইমাছ, কচ্ছপ প্রভৃতি। শ্যাওলা, জলজ উদ্ভিদ গজিয়ে উঠছে। প্রজাপতি, কীটপতঙ্গ এমনকি জোনাকিও ফিরে আসছে। যেমন টোকিওর অদূরে অবস্থিত তামাগাওয়া নদী। কয়েক বছর আগেও এই নদী ছিল একেবারেই নোংরা, দূষিত ও দুর্গন্ধময়। সুবিখ্যাত কেইও বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপকের উদ্যোগে বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী এবং স্থানীয় অধিবাসীরা মিলে দীর্ঘ সময় লাগিয়ে বিপুল পরিমাণ ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কার করে নদীটিকে তার পূর্বজীবন ফিরিয়ে দিয়েছে বলেই আজকে নদীবিহারের উপযুক্ত হয়ে উঠেছে। এরকম প্রকৃতিপ্রেমী শিক্ষক এখন প্রচুর আত্মপ্রকাশ করছেন। গঠন করছেন ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে পরিবেশ সংস্থা। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকজন পরিবেশবাদী কর্মী তাঁদের চমৎকার কর্মকান্ডের জন্য মানুষের স্বীকৃতি অর্জন করেছেন, তাঁদের কয়েকজন হলেন, পরিবেশবাদী কাজুইয়োশি ফুজিতা, সমাজসেবিকা এমিকো সুজুকি, প্রকৃতিপ্রেমী তোশিও ফুজিমোতো, লেখিকা নোরিকো কাতোও, পরিবেশবিষয়ক লেখক ও সাংবাদিক নাকামোতো কেন্, আন্তর্জাতিক পরিবেশ কর্মী ও পর্বতারোহী নোগুচি কেন্, পরিবেশকর্মী ইমাই মিৎসুরু, আন্তর্জাতিক সঙ্গীতজ্ঞ রিউইচি সাকামোতো প্রমুখ। এঁদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোড়ন তুলেছেন খ্যাতিমান অ্যালপিনিস্ট নোগুচি কেন্, যিনি হিমালয়কে পরিশুদ্ধ করার প্রকল্প নিয়ে কাজ করা ছাড়াও সম্প্রতি বাংলাদেশে গিয়েছিলেন পরিবেশদূষণ পর্যবেক্ষণ করার জন্য। পুরনো ঢাকার দিকে নদীর দূষণ দেখে ব্যথিত হয়েছেন। তিনি জাপানের সর্বত্র কাজ করে যাচ্ছেন পরিবেশ রক্ষা, বিশেষ করে পাহাড় ও নদীর ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কার করে নিভাঁজ নিষ্কলুষ সবুজ সৃষ্টির লক্ষ্যে। বলা নিঃস্প্রয়োজন তাঁর কর্মীবাহিনী আর কেউ নয়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রীরাই। এরকম পরিশ্রমী প্রকৃতিপ্রেমী গতিশীল পরিবেশ কর্মী নোগুচির জন্মের দিকে তাকিয়ে আছে যেন বাংলাদেশ!
মোদ্দাকথা, জাপানে নদীভাবনা এখন আর শুধুমাত্র দায়িত্বশীল বয়স্কসমাজের জন্যই শুধু সীমাবদ্ধ নয়, শিশু-প্রজন্ম তথা বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরাও নদীচিন্তা, নদী সংস্কৃতিকে জানা, সংরক্ষণকল্পে ক্রমশ আগ্রহী হয়ে উঠছে। জাপানি শিশুদের কাছ থেকে তাই বাংলাদেশের শিশুরাও উৎসাহিত হতে পারে নিজেদের নদীমাতৃক পরিচিতিকে উপলদ্ধি করতে যা এখন বিলুপ্ত হওয়ার পথে বললে কি অতিরিক্ত বলা হবে?
শিশুসাহিত্যিক, কথাসাহিত্যিক ও গবেষক