| 29 মার্চ 2024
Categories
ইতিহাস

এক খলনায়কের কাহিনী

আনুমানিক পঠনকাল: 7 মিনিট

মধ্য ইউরোপের আল্পসের মাঝখানে ছোট্ট একটি দেশ অষ্ট্রিয়া। এই দেশের সীমান্তবর্তী ব্রাউনাউ শহরে ১৮৮৯ সালের ২০ শে এপ্রিল জন্মগ্রহন করে এমন এক ব্যক্তিত্ব যিনি পরবর্তীকালে পৃথিবীর ইতিহাসকে এক নতুন পথে চালনা করেছিলেন। ইনি হলেন ইতিহাসের সবচেয়ে ঘৃণিত ব্যক্তি অ্যাডলফ্ হিটলার। অ্যালইস হিটলার ও ক্লারা পোলজের চতুর্থ সন্তান ছিলেন অ্যাডলফ্। শোনা যায় ছোটবেলায় একদিন ইন নদীর তীরে বাবার সাথে ঘুরতে ঘুরতে তিনি জিজ্ঞাসা করেন নদীর ওপারে যাওয়া যায় না কেন। উত্তরে বাবা বলেছিলেন যে ওটা ওদের দেশ নয়। ওটা জার্মানি, ওটা ভিনদেশ। আসলে জন্মসূত্রে অ্যাডলফ্ ছিলেন অষ্ট্রিয়ান জার্মান। তাই জার্মানি তাদের ভিনদেশ ছিল। অথচ এই ছোট্ট ছেলেটাই একদিন জার্মানির সর্বময় কর্তা হয়ে উঠেছিলেন। যার কাঁধে ভর করে জার্মানি ইউরোপ তথা গোটা বিশ্বের মানচিত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান অর্জন করেছিল। ঐ সময়তেই বাবার কাছে নেপোলিয়ান সম্পর্কেও অবগত হোন ছোট্ট অ্যাডলফ্। নেপোলিয়ানের জার্মানদের ওপর অত্যাচারের কাহিনি তার কাছে পরিষ্কার হয়। শোনা যায় ঐটুকু বয়সেই তার মনে এক প্রবল জাত্যাভিমান জন্ম নেয়।

হিটলারের বাবা একজন সরকারি কর্মচারী ছিলেন। হিটলারের যখন বছর তিনেক বয়স তখন কর্মস্থলে পদোন্নতি হওয়ায় তারা পাসু (Passau) নামের শহরে চলে আসেন। এর দুইবছর পরে অ্যালইসের বদলি হয় লিনজ্ (Linz) শহরে। এই লিনজ্ শহর হিটলারের খুব প্রিয় ছিল। এই শহরেই তার স্কুলজীবন অতিবাহিত হয়। ছোটবেলায় হিটলার পড়াশোনায় বেশ ভালোই ছিলেন। তবে তার একগুঁয়েমি মনোভাবটাও সেই ছোট বয়স থেকেই পরিপূর্ণভাবে ছিল। অনেক ঐতিহাসিকের মতে তার বাবার কড়া শাসন ও বদমেজাজের জন্য হিটলার ছোট বয়স থেকেই অত্যন্ত জেদী ও একগুঁয়ে হয়ে ওঠে। হিটলারের বাবা চাইতেন সে তারই মতো সরকারি চাকুরে হোক, কিন্তু হিটলারের ইচ্ছা সে চিত্রশিল্পী হবে। বাবার ওপর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য তিনি নবম শ্রেণির মূল পরীক্ষায় অবতীর্ণ হন। হিটলার তার আত্মজীবনী “মাইন ক্যাম্ফ”এ (Mein Kampf) স্বীকার করেছেন এইকথা। ফলত তার বিদ্যালয়ের পাঠ ঐ নবম শ্রেনীতেই সমাপ্ত হয়। কিন্তু তাতে তার বিন্দুমাত্র দুঃখ ছিল না। কারণ চিত্রশিল্পী হওয়ার প্রবল স্বপ্ন তার মনে। অনেক মনস্বাত্বিকরা হিটলারের বেপরোয়া নিষ্ঠুরতার জন্য তার বাবার বদমেজাজকেও দায়ী করেছেন।

একজন অষ্ট্রিয়ান জার্মান হওয়া সত্ত্বেও হিটলারের মন প্রাণ ভরে ছিল জার্মানি। ঐ কৈশোর বয়স থেকেই জার্মান জাতীয়তাবাদী চিন্তা ভাবনা তার মনকে নাড়া দিত। শোনা যায় ঐ সময় হিটলার তার সমবয়সী একটি মেয়ের প্রতি আকৃষ্ট হন এবং প্রেম নিবেদন করেন। যদিও সেই মেয়েটির নাম জানা যায় না। ছোটবেলা থেকেই নির্মমতা ও পাশবিকতা তার মধ্যে পরিলক্ষিত হয়েছিল। যুবক হিটলার তার বান্ধবীকে খুশি করার জন্য একটা কুকুরকে নির্মমভাবে মেরেছিলেন। অপরকে পীড়ন দিয়ে তার থেকে তৃপ্তিলাভ হিটলারের খুব পছন্দ ছিল। তবে হিটলারের মাতৃভক্তি ছিল অপরিসীম। মা ক্লারা ক্যান্সারে আক্রান্ত হলে তার দেখভালের সমস্ত দায়িত্ব নেন তিনি। ছোট ভাই বোনদের দেখাশোনা, ঘর-দোরের কাজ, রান্নাবান্না ও সাথে মায়ের সেবা-যত্ন সব নিজের হাতে করতেন তিনি। মায়ের মৃত্যুতে একেবারে ভেঙে পড়েছিলেন হিটলার। তার মায়ের চিকিৎসক পর্যন্ত হিটলারের গভীর মাতৃভক্তির কথা স্বীকার করেছেন। এই ব্যাপারে হিটলার নেপোলিয়ান ও আমাদের স্বদেশীয় ঈশ্বরচন্দ্রের মতোই একনিষ্ঠ ছিলেন।

ভিয়েনার (Vienna) একাদেমী অফ্ ফাইন আর্টসে ভর্তির আবেদন প্রত্যাখিত হওয়ার পর তার আর্টস্কুলে পড়ার স্বপ্ন চিরতরে ভেঙে যায়। কিন্তু একগুঁয়ে স্বভাবের হিটলার ছবি আঁকা বন্ধ করলেন না। বরং সেটাকেই জীবিকা করার জন্য লড়াই শুরু করলেন। এক বন্ধুর পরামর্শ মতো তিনি তার ছবিগুলো ট্যুরিষ্টদের কাছে বিক্রি করতে থাকেন। ১৯০৭ এ হিটলার ভিয়েনা এসেছিলেন। ভিয়েনায় এসে সিগমন্ড ফ্রয়েডের লেখা তাকে বিশেষ আকর্ষন করে। বলাবাহুল্য ভিয়েনায় আসার পর হিটলার তার পরবর্তী জীবনপথ তৈরী করেছিলেন। এমনকি ইহুদী বিদ্বেষের বিষ এই শহরেই তার মধ্যে সঞ্চারিত হয়েছিল। পরবর্তীকালে ঐ ইহুদী নিধনের যে নির্মমতা হিটলার স্থাপন করেছিলেন তা তাকে পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম ঘৃণিত চরিত্রে পরিণত করে। ভিয়েনার মেয়র কার্ল লুয়েগার ছিলেন চরম ইহুদি বিদ্বষী। হিটলার তাকে ভীষন মান্যিগন্যি করত। ইহুদি বিদ্বেষের বিষ তখন ইউরোপের সর্বত্র ছড়িয়ে ছিল। ক্যাথলিকরা ইহুদিদের হোলোকষ্ট(Holocaust) বলত। বিভিন্ন দৈনিকেও তখন ইহুদি বিরোধী নানা লেখা প্রায়ই প্রকাশিত হত। সেইসব লেখা পড়ে হিটলারের মনে ইহুদি বিরোধীতা আরো প্রকট হতে থাকে। মূলকথা হল হিটলারের জন্মের পূর্বেই ইউরোপে ইহুদি বিদ্বেষ যথেষ্ট তীব্রভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল।

ইহুদি বিদ্বেষের মূল কারন ছিল অর্থনৈতিক স্বার্থ ও দ্বন্দ্ব। পৃথিবীর সব ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িকতার মূলে যে অর্থনৈতিক স্বার্থ কাজ করেছে তা বারবার প্রমাণিত হয়েছে। এমনকি আজকের পৃথিবীতেও এই ধারা বহমান। ইহুদি বণিকরা অনেক কম দামে তাদের মাল বিক্রি করত। আর তাতে অন্য বণিকদের অসুবিধা হত। তাই ধনী বণিকেরা ধর্মের দোহাই দিয়ে সাধারণ মানুষদের ইহুদি বিরোধীতায় উৎসাহিত করে। এরই ফলস্রুতি ছিল গোটা ইউরোপ মহাদেশ জুড়ে ইহুদি বিদ্বেষ। হিটলারের ইহুদি নিধনে সেইসব বণিক শ্রেণি যে অতিশয় খুশি হয়েছিল তা বলা যায়। কিন্তু তথাপি হিটলারের ওপর সমস্ত দোষারোপ করে তারা তাদের দায় এড়িয়ে যেতে চেয়েছিলেন। ১৯০৯ সালে অষ্ট্রিয়া সরকার যখন হিটলারকে সামরিক বাহিনীতে অংশগ্রহণ করতে বলে, তখন তিনি মিউনিখ চলে আসেন। এতদিনে জার্মানিতে পা রাখেন হিটলার। এও ইতিহাসের এক পরিহাস। আলেকজান্ডার গ্রিসের মানুষ ছিলেন না, নেপোলিয়ান ফরাসী ছিলেন না, স্ট্যালিন রুশ ছিলেন না, ঠিক তেমনি হিটলার জার্মানির মানুষ ছিলেন না। অথচ এরা প্রত্যেকেই বিদেশকে স্বদেশ মনে করে তার জন্য সর্বস্ব দিয়েছেন।

১৯১৪ সালে জার্মানি যখন রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে তখন হিটলার জার্মান বাহিনীতে যোগ দেয়। হিটলারের কাজ ছিল যুদ্ধে সৈনিকদের দরকারি জিনিস সরবরাহ করা। সেইসময় প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুকে তিনি খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন। ১৯১৬ সালে যুদ্ধে তিনি আহত হন। পাঁচ মাস শয্যাশায়ী থাকার পরে তিনি সুস্থ হয়ে ফের যুদ্ধে যোগ দেন। এতটাই ছিল তার দেশপ্রেম। আবার তিনি আঘাত পান। তার চোখে বিষাক্ত গ্যাস লাগে। তিনি সাময়িকভাবে অন্ধ হয়ে পড়েন সেইসময়। ঠিক তখনি হাসপাতালে শুয়ে শুয়ে হিটলার স্থির করেন যে তিনি রাজনীতিতে যোগ দিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করবেন। হিটলারের উত্থানের একটি বিশেষ কারণ ছিল ভার্সাই সন্ধির(Treaty of Versailles) বিরোধীতা করা। এই সন্ধি জার্মানিকে চিরদিনের জন্য অর্থনৈতিক ও সামরিকভাবে পঙ্গু করার কৌশল ছিল। ফ্রান্স ও ইংল্যাণ্ডের মিলিত ষড়যন্ত্র ছিল এই ভার্সাই সন্ধি।

এমনই এক দুঃসহ পরিস্থিতিতে হিটলারের রাজনৈতিক মঞ্চে আগমন। তার আবেগপ্রবন বক্তৃতা অচিরেই তাকে জনগণের মধ্যে আকর্ষিত ও গ্রহনযোগ্য করে তুলেছিল। অত্যন্ত স্পষ্ট ও সহজ ভাষায় তার বক্তৃতা জনমানসে আলোড়ন সৃষ্টি করে। তার প্রতিটি কথায় তিনি ভার্সাই সন্ধির কুপ্রভাবের কথা উল্লেখ করেন। তারসাথে ইহুদি বিদ্বেষ ও কমিউনিস্ট বিরোধী মনোভাবও ফুটে ওঠে তার ভাষনে। তিনি ইহুদি ও কমিউনিস্টদের গোটা পৃথিবীর শত্রু বলে অভিহিত করেন। এই বছরেই তিনি DAP( German Worker’s Party) পার্টির হয়ে তার বক্তব্য রাখেন। তার আবেদনে সাড়া দিয়ে শ্রোতারা অর্থ দিয়ে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন। এরপর থেকে চারিদিকে তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়তে থাকে। হিটলারকে যারা অর্থ সাহায্য করেছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন আমেরিকার ফোর্ড মোটরগাড়ি নির্মাতা হেনরি ফোর্ড। ১৯২০ সালে DAP পার্টির নতুন নামকরন হয় NSDAP( National Socialist German Worker’s Party)। হিটলার নিজে ঐ পার্টির প্রতীকচিহ্ন তৈরী করেন যা দেখতে স্বস্তিকা চিহ্নের মতো। পরবর্তীকালে NSDAP পার্টি থেকে হিটলার তার কুখ্যাত নাৎসী (Nazi) বাহিনী গঠন করেন। ১৯২৩ সালে হিটলার মিউনিখে অভ্যুত্থানের ডাক দেন। এরফলে পরবর্তীতে তিনি গ্রেপ্তার হন। ১৯২৮ সালে আদালতে হিটলার যে বক্তব্য পেশ করেন তাকে আত্মপক্ষ সমর্থন না বলে একটি সুস্পষ্ট রাজনৈতিক মত ও আদর্শ প্রচারের পরিকল্পনা বলা যেতে পারে। তিনি বলেন জার্মান জাতিকে চলতে থাকা দুরাবস্থা থেকে উদ্ধার করার উদ্দেশ্যে তারা একত্রিত হয়েছিলেন। শত্রুদের মুষ্টি থেকে জার্মানিকে মুক্ত করতে চেয়েছিলেন। এমন গভীর আত্মবিশ্বাসের সাথে তিনি কথাগুলো বলেন যে সাধারণ মানুষের কাছে এই অজানা,অচেনা সাধারণ সৈনিকটি এক মহান নেতা হিসাবে প্রতিভাত হন। ধীরে ধীরে সমগ্র জার্মান জাতি তার মধ্যে তাদের প্রকৃত নেতাকে খুঁজে পান। হিটলারই পারে জার্মানিকে মুক্তির পথ দেখাতে এই বিশ্বাস মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে থাকে।

এরপরেও আদালত হিটলারকে তেরো মাসের কারাবাসের নির্দেশ দেন। জেল থেকে মুক্ত হয়ে তিনি আবার রাজনীতিতে যোগ দেন। এইসময় সারা বিশ্বজুড়ে প্রবল আর্থিক মন্দা (The Great Depression) হিটলারকে তার রাজনৈতিক শক্তি পুনরায় মজবুত করে গড়ে তোলার সুযোগ এনে দেয়। ১৯৩২ সালের নির্বাচনে হিটলার তার প্রতিপক্ষ হিন্ডেনবুর্গের কাছে পরাজিত হলেন। হিন্ডেনবুর্গ প্রেসিডেন্ট পদে পুনরায় নির্বাচিত হলেন। কিন্তু কয়েকমাসের মধ্যে দেশের আর্থ-সামাজিক পরিকাঠামো ভেঙে পড়ে। এই পরিস্থিতিতে একদিন বাধ্য হয়ে হিন্ডেনবুর্গ হিটলারকে জার্মানির চ্যান্সেলার পদ নিতে আহ্বান জানান। বলাবাহুল্য সেইসময় হিটলারের দল ছিল জার্মানির সবচেয়ে শক্তিশালী বিরোধী পার্টি। ১৯৩৩ সালে হিটলার চ্যান্সেলার পদে শপথ নিলেন। তখন তার বয়স ৪৪ বছর। শুরু হল ইতিহাসের এক নতুন অধ্যায়। জন্ম নিল এক দুর্দোন্ডপ্রতাপ,অত্যাচারী শাসক।

হিটলারের চরিত্রের আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল। এত অত্যাচারী এক ব্যক্তি যে ভালো প্রেমিক হতে পারে তা হিটলারকে না দেখলে বোঝাই যেত না। হিটলার কিন্তু মেয়েদের খুব সম্মান করতেন। হিটলার তার সৎবোন অ্যাঞ্জেলার মেয়ে গেলীর সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে আবদ্ধ হন। সম্পর্কে গেলী তার ভাগ্নী। শোনা যায় গেলীকে তিনি চোখে হারাতেন। এককথায় স্বার্থপর,বিকারগ্রস্ত প্রেমিকের মতো গেলীকে তিনি নিজের কাছে রেখে দিতেন। হিটলারের এই অত্যধিক আধিপত্য গেলীর কাছে দুঃসহনীয় হয়ে উঠছিল। শেষে এই শৃঙ্খল থেকে মুক্তি পেতে সে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। মনস্তাত্ত্বিকরা বলেন গেলীর মৃত্যু হিটলারকে আরো বদমেজাজি ও নিষ্ঠুর করে তুলেছিল যার প্রভাব পরবর্তীকালে পরিলক্ষিত হয়। গেলীর মৃত্যুর পর হিটলারের জীবনে আসে এভা ব্রাউন। তবে এভাকে গেলীর জায়গা তিনি কখনোই দিতে পারেননি বলে মতভেদ আছে। যদিও এই এভা ব্রাউনকেই হিটলার তার মৃত্যুর আগের দিন বিয়ে করেছিলেন। শোনা যায় হিটলার নিরামিষাশী ছিলেন। রাজনীতিতে আসার সময় থেকেই তিনি নিরামিষাশী হয়ে পড়েন। এইসময় তিনি মদ্যপান ও ধূমপান পরিত্যাগ করেন।

চ্যান্সেলার হওয়ার কিছুদিন পরে হিটলার রাইখস্ট্যাগে এক নতুন আইন প্রণয়ন করেন। এই আইনের নাম Enabling Law। জার্মানি কে বাচাতে তার এই আইন প্রণয়ন বলে তিনি দাবী করেছিলেন। আসলে এই আইনের দ্বারা হিটলার হয়ে ওঠেন জার্মানির সর্বময় কর্তা। এই আইনকে হাতিয়ার করেই তিনি স্বেচ্ছাচারী শাসন ব্যবস্থার প্রবর্তন করেন,যদিও গোটা প্রক্রিয়াটাই হয়েছিল গণতান্ত্রিক নিয়ম মেনে। গণতন্ত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠতা যে স্বৈরতান্ত্রিক শাসনকেই ডেকে আনে তার প্রমাণ এই Enabling Law। এরপর হিটলারের লক্ষ্য ছিল ইউরোপের ক্ষমতা দখল। তিনি মুসোলিনির সাথে কমিউনিস্ট বিরোধী চুক্তি করলেন, জাপানকেও সঙ্গে নিলেন। প্রতিষ্ঠিত হল রোম-বার্লিন-টোকিও অক্ষশক্তি।

স্বদেশে হিটলার যতই অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়েছেন ততই তার নির্মমতা বেড়েছে। শুধু ইহুদি নয়, যারাই তার বিরোধীতা করতেন তাদের চিহ্নিত করে সরিয়ে দেওয়া হত পৃথিবী থেকে। যদিও ইতিহাস সাক্ষী যে বিরোধীদের কন্ঠ রুদ্ধ করতে কোনো রাষ্ট্রনায়কেরই কখনো হাত কাঁপেনি। স্ট্যালিনও রাশিয়ায় একই পথ অবলম্বন করেছিলেন। তবে তারা খুব সাবধানে এটা করত, আর হিটলার বুক ফুলিয়ে এই অপকর্ম সাধন করত। বহু ইহুদি ও কমিউনিস্ট জার্মানিতে নিহত হলেন। অনেকে প্রাণ বাঁচাতে অন্যত্র পালিয়ে যায়। গোটা জার্মানি জুড়ে তৈরী হলো কনসেনট্রেশন ক্যাম্প। যেখানে বিষাক্ত গ্যাস চেম্বারে বহু মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল। বৃদ্ধ,মহিলা এমনকি শিশুরাও রেহাই পায়নি।

১৯৩৯ সালে হিটলারের নজরে এল পোল্যান্ড। সেই বছরের ১লা সেপ্টেম্বর হিটলার পোল্যান্ড আক্রমণ করে। এই দিনটিকেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা বলে ধরা হয়। কিছুদিনের মধ্যে পোল্যান্ড পরাস্ত হয়। এরপর ধীরে ধীরে
অস্ট্রিয়া,চেকোশ্লোভাকিয়া,রুমেনিয়া,ডেনমার্ক,সুইডেন,হল্যান্ড, বেলজিয়াম,নরওয়ে হিটলারের কাছে আত্মসমর্পণ করে। গোটা ইউরোপ জুড়ে হিটলার ইহুদি নিধন যজ্ঞ চালায়। প্রায় ষাট লক্ষ ইহুদিদের তিনি হত্যা করেছিলেন যা সেই সময়ের গোটা পৃথিবীর ইহুদি জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ।

১৯৪১ এর অক্টোবরে হিটলারের বাহিনী মস্কো আক্রমণ করে। প্রসঙ্গত বলি এই বছরেই সুভাষচন্দ্র বোস হিটলারের কাছে ব্রিটিশদের সাথে লড়াইয়ের সাহায্য চেয়ে আবেদন করেন। হিটলার তাকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। রাশিয়া আক্রমণ হিটলারের জীবনে কাল হয়ে আসে। প্রতিটা শুরুর যেমন শেষ থাকে তেমনি রাশিয়া আক্রমণ হিটলারের পতন ডেকে আনে। স্ট্যালিনের অসাধারণ নিপুণতা ও রাশিয়ার প্রবল ঠান্ডা এই দুইয়ের সাঁড়াশি আক্রমণে হিটলারের বাহিনী তাদের শক্তিক্ষয় করতে থাকে। শেষে জার্মান সৈন্য রাশিয়ায় আত্মসমর্পণ করে। ঐদিকে আলেকজান্দ্রিয়ার কাছে ভূমধ্যসাগরের তীরবর্তী যুদ্ধে অক্ষশক্তিকে মিত্রশক্তির কাছে পরাজয় স্বীকার করতে হয়। এই পরাজয় অক্ষশক্তির ওপর চরম আঘাত আনে।

ইতালিতে মুসোলিনীর পতনে হিটলার আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। হিটলার বুঝলেন ফ্যাসিষ্ট ইতালিতে যা ঘটল তা জার্মানিতেও হতে পারে। অন্যদিকে ইংল্যাণ্ড ও ফ্রান্স জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনা করেছে। হিটলারের ভাগ্যাকাশে এক গভীর দুর্যোগের ঘনঘটা দেখা দিল। এরইমধ্যে অনেকবার তার প্রাণনাশের চেষ্টা চালানো হয়েছে। কিন্তু প্রতিবার তিনি প্রাণে বেঁচে যান। শেষপর্যন্ত চারিদিকের আক্রমণে হিটলারের পরাজয় আসন্ন। মিত্রশক্তি তার ওপর জাঁকিয়ে বসেছে। একদিন খবর আসে মুসোলিনীর প্রাণদন্ড দেওয়া হয়েছে মিলানে (Milan)। দিনটা ছিল ২৯ এপ্রিল,১৯৪৫। ধীরে ধীরে রুশ বাহিনী বার্লিনের দখল নিচ্ছে। রাইখস্ট্যাগে রুশ পতাকা ওঠা শুধু সময়ের অপেক্ষা। প্মাদ গুনলেন হিটলার। কিছুতেই আত্মসমর্পণ করা যাবে না। জীবনের ঐ শেষ মুহূর্তে তিনি তার দীর্ঘদিনের সঙ্গিনী এভা ব্রাউনকে বিয়ে করেন বার্লিনের এক গোপন বাঙ্কারে। পরেরদিন ৩০ এপ্রিল,১৯৪৫ এ রুশ বাহিনী তাদের দুজনের আধপোড়া মৃতদেহ উদ্ধার করে। এইরকম নরপিশাচের এইরুপ অমানবিক মৃত্যু হয়ত স্বয়ং ঈশ্বর নির্ধারণ করেছিলেন। পতন ঘটল নাৎসী জার্মানির এবং সেই সাথে ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।

এই প্রসঙ্গে কয়েকটি কথা বলা আবশ্যক। হিটলার কিন্তু কোনো রাজবংশে বা কোনো অভিজাত বংশে জন্মাননি। জার্মানির জনসাধারণ এক অনামী সৈনিককে ক্ষমতার শীর্ষে বসিয়েছিলেন। সমগ্র জার্মানবাসী তাকে ফুয়েরার(Fuhrer) হিসাবে গ্রহন করেছিলেন। তারা হিটলারের ওপর নির্ভর করে মুক্তির পথ,নবজাগরনের পথ খুঁজতে চেয়েছিলেন। এমনকি হিটলারের নির্মমতাও তার জনপ্রিয়তায় তেমন কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি। হিটলারের ঐ গণ নিধনের কেউ কোনো বিরোধীতা করেনি। কোনো দেশ তা নিয়ে বিন্দুমাত্র উষ্মা প্রকাশ করেনি। তারা তাদের স্বার্থের কথা চিন্তা করেছেন। অতএব তারাও পরোক্ষে এটা সমর্থন করে। অন্যায় যে সহে সেও সমান দোষী – একথা আমাদের সবার জানা। যুদ্ধে হিটলারের জয় হলে এই ইতিহাস হয়ত অন্যভাবেই লেখা হত। তাই হিটলারই শুধু দোষের ভাগী নয়। পৃথিবীর সব দেশেই এই হিটলারেরা লুকিয়ে আছে। তাই আমাদের অনেক সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে ভবিষ্যতের নেতা বাছার সময়। আর কোনো হিটলার যাতে এই গ্রহে না আসে। যদি তা আবার ঘটে তবে মানবতার পক্ষে অভিশাপ ডেকে আনবে।

 

 

 

 

 

 

 

কৃতজ্ঞতা: উইকিপিডিয়া ও স্বপন মুখার্জীর লেখা ‘হিটলার’

 

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত