| 20 এপ্রিল 2024
Categories
প্রবন্ধ লোকসংস্কৃতি

দেবী কালী ও পুতুল প্রসঙ্গে । সৌরভ বেরা

আনুমানিক পঠনকাল: 8 মিনিট

শব্দই ব্রহ্ম। একথা সত্য হলে কালী নামোচ্চারণের মধ্য দিয়ে ভক্তি-ভয়-ভাবের সঞ্চার ঘটে। অনুসন্ধানে পার্বতী উমা, সতী এবং দুর্গা চণ্ডিকার ধারা মিলে পুরাণ তন্ত্রাদিতে যে এক মহাদেবীর প্রকাশ ও বিবর্তনের ধারা দেখতে পাই, তা আর একটি ধারার সৃষ্টি করে—কালিকা বা কালী ধারা। শক্তি ধারা। বিভিন্ন ক্ষেত্রে দেবীর রূপ বর্ণনা দেখে বোঝা যায়, দেবী অনার্য উদ্ভূত। জীবই শিব—এই সত্য থেকেই তন্ত্রতত্ত্বের উদ্ভব। ‘শাক্তদর্শন’ নামে কোনও দর্শন ছিল কিনা, থাকলেও তার অবলুপ্তি কোন সময়ে সে বিষয়ে বিশেষ কিছু তথ্য পাওয়া যায় না। তবে পণ্ডিত পঞ্চানন তর্করত্ন তাঁর আজীবনপাত করা তন্ত্রতত্ত্বের পাঠ ও গবেষণায় একটি তর্কের অবসান ঘটিয়েছেন। শাক্তদর্শন মতে শক্তিই ‘ব্রহ্ম’ এবং তিনি চণকাকৃতি— জড়-বেতন প্রকৃতি পুরুষ; একে অপরকে জড়িয়ে ধরে অবস্থান করছেন। যার মধ্য দিয়ে মিলনে এক অভিন্ন সত্তার সৃষ্টি। অর্ধনারীশ্বর আদপে এই মিলনের প্রতিমূর্তি। তবে তন্ত্রদর্শনের মূল প্রবক্তা শিব তাঁর রমণীসহচরী। কালীকে তাঁর অস্তিত্ব বুঝিয়েছেন! শিব সর্বপ্রাণীকে ‘কলন’ বা গ্রাস করেন বলে তিনি মহাকাল। আবার তিনি মহাকালকে ‘কলন’ বা গ্রাস করেন তিনি কালী। মানুষের জীবনচর্চা পৃথিবীর নানা জীবের, নানা পরিচ্ছেদের উপসংহার হলে দেবীরূপে পূজিতা কালিকার ভিতর নানা মনুষ্য অনুভবের প্রকাশ বিদ্যমান। সংসারে সত্যম-শিবম্‌-সুন্দরম্‌ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অশুভ শক্তিকে বিনাশ এবং শুভ শক্তির উদয়কে নিশ্চিত করতে দেবী আবির্ভূতা। তিনি কখনও সন্তানদাত্রীরূপে, কখনও বা কার্যসিদ্ধিদাত্রীরূপে পূজিতা। দেবীর রূপের প্রকাশ বা দেবীর মূর্তিতত্ত্ব বিষয়ে বিভিন্ন সূত্র থেকে ভিন্ন বর্ণনা পাওয়া যায়। আনুমানিক ত্রয়োদশ শতকের গ্রন্থ বৃহদ্ধর্ম পুরাণে দেবী কালীর বর্ণনা পাওয়া যায়। শায়িত শিবের উপর দাঁড়ানো এক শ্যামবর্ণা, দিগম্বরী, মুক্তকেশী, স্বাস্থ্যবতী নারী। তাঁর রক্তলোলুপ মুখ থেকে জিভ বেরিয়ে এসেছে। গলায় মুণ্ডমালা, কোমরে কাটা হাতের কোমরবন্ধনী। গায়ে নানাবিধ অলংকার। দেবীর চার হাতের মধ্যে ডান দিকের উপরের হাতে খড়্গ, তার নীচের হাতে কাটা মাথা আর বাঁ-দিকে উপরের হাতে তিনি বরদান এবং তার নীচের হাত দিয়ে অভয়দান করছেন। যা বর্তমান সমাজে প্রচলিত কালীমূর্তির অনুরূপ বলা চলে। মার্কণ্ডেয় পুরাণে দেবীকে অম্বিকা চামুণ্ডা বলে সম্বোধন করা হয়েছে। দেবী চামুণ্ডার উল্লেখ পাওয়া যায় মহাকবি কালিদাসের ‘কুমারসম্ভব’ মহাকাব্যে। আনুমানিক সপ্তম শতাব্দীর গ্রন্থ ‘বিষ্ণুধর্মোত্তর’ পুরাণে দেবী ভদ্রকালীর বাহন সিংহ।

ভারতবর্ষব্যাপী দুর্গাপূজার পর কার্তিকী অমাবস্যায় দীপান্বিতা অমাবস্যায় দীপালি বা দীপাবলি বা দেওয়ালি উৎসব পালিত হয়। উৎসব পালনের মাঙ্গলিক নিয়মকানুন রাজ্য তথা অঞ্চল ভেদে পরিবর্তিত। বাঙালির দেওয়ালি উৎসব প্রধানত কালীপূজাকেন্দ্রিক। এই সময় মূলত উত্তর শ্রেণির গৃহিণীরা লক্ষ্মী ও অলক্ষ্মীর পূজা করেন। ‘লক্ষ্মী ও অলক্ষ্মী’ তৈরির লোকাচার পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, অতি স্বাভাবিক ভঙ্গিমায় পুতুল তৈরির আঙ্গিকে সরল নান্দনিক রূপের প্রকাশ। সন্তানের পুতুল তৈরি শেখার প্রাথমিক পাঠ শুরু হয় মায়ের হাত ধরে। সহজাত প্রবৃত্তি থেকে অনুকরণ অনুসরণের মাধ্যমে শিশুর অজান্তেই তা ঘটতে থাকে। লোকাচারের মধ্য দিয়ে আদি জনজাতির প্রবহমাণ ধারার সূত্র অনুসন্ধান একটি বিষয় হলে, শিশুশিক্ষার প্রারম্ভে লৌকিক ক্রিয়াচার সার্বিকভাবে প্রজন্মের লালন এবং পরবর্তী ক্ষেত্রে দেশীয় সংস্কৃতির ধারক-বাহক গড়ার প্রাক্‌-পর্যায় প্রস্তুত করে। মা-দিদির হাতে পুতুল গড়তে দেখে শিশুমনে সহজাত উৎফুল্লতা তাকে পুতুল গড়তে প্রলুব্ধ করে। টেপা পুতুল বা অতি স্বাভাবিক ভঙ্গিমায় মাটিকে একটি পুতুলে রূপান্তর করার প্রচেষ্টা থেকেই কিছু স্বাভাবিক গড়নের প্রচলিত পুতুল তৈরি হতে দেখা যায়।

জীবনের প্রবহমাণ ধারার উৎস সন্ধানে ক্ষেত্রসমীক্ষা থেকে উঠে আসা তথ্য মণি-মাণিক্যের থেকে কোনও অংশে কম নয়। আর সেই তথ্য বিচার-বিশ্লেষণ-অনুধাবনের মধ্য দিয়ে উঠে আসে যত্ন করে রাখা প্রগাঢ় সত্য। দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার কুলতলি থানার অন্তর্গত একটি গ্রাম সোনাটিকারি। পল্লিসমাজের চিত্র সেখানে অতি সুন্দর। প্রকৃতি নিজের হাতে যেন ওয়াল পেন্টিং করেছে। মাঠের সবুজ ঘাসের সঙ্গে আকাশের সখ্যতা, পাশে সারি সারি তাল-নারকেল গাছের সারি প্রভৃতির কোলে মাথা রাখতে ইচ্ছা করে। ওই গ্রামের চাষি কৈবর্ত মাহিষ্য সম্প্রদায়ের মহিলা ভবানী মণ্ডল। প্রবীণা এই মহিলাকে পুতুল তৈরির বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে, তিনি ‘লক্ষ্মী-অলক্ষ্মী’ তৈরির কথা বললেন। লোকাচার হিসেবে কালীপূজার সন্ধ্যায় লক্ষ্মী ও অলক্ষ্মী তৈরি এবং তাঁর পূজা করেন। পিটুলির সঙ্গে কাঁঠালি কলা মেখে, ওই মাথা দিয়ে যম, যমের বউ ও যমের ছেলে তৈরি করা হয়। তৈরির কৌশলে কোনওরূপ জটিলতা নেই। হাতের চাপে, মুঠোয় পিটুলি মাখা মণ্ড একটি স্বাভাবিক আকার ধারণ করে। আঙুলের চাপে চোখ-নাক তৈরি হয়। হাত বলতে শরীরের দু-পাশে হালকাভাবে টিপে করা হয়। যমের বউয়ের মাথায় খোঁপা থাকে,যম তুলনামূলক বড়ো আকারের হয়, তারপর যমের বউ এবং ছেলে সব থেকে ছোটো আকারে করা হয়। এরপর চলে পুতুলকে সাজানোর কাজ। পিটুলি মাখার সঙ্গে সিঁদুর মিশিয়ে হয় লাল রঙের মণ্ড, হলুদ গুঁড়ো মিশিয়ে হয় হলুদ এবং সিমপাতার রস মিশিয়ে হয় সবুজ রঙের মণ্ড। একে একে পুতুল সেজে ওঠে। যমকে গলায় মোটা সুতোর মতো হলুদ রঙের পিটুলি মাখার হার পরানো হয়। হাতের শুরুতে হলুদ রঙের পিটুলির মোটা সুতো। তারপর ক্রমান্বয়ে লাল ও সবুজ রঙের পিটুলির সুতো পরানো হয়। যমের বউয়ের মাথায় লাল পিটুলি দিয়ে সিঁদুর, কপালে পিটুলির লাল টিপ, নাকে পিটুলির লাল নাকছাবি, গলায় লাল পিটুলির হার আর হাতে যমের ন্যায় অনুরূপ সাজ। যমের ছেলের ক্ষেত্রেও একই সাজ, শুধুমাত্র গলার পিটুলির হারটি সবুজ রঙের করা হয়। কলার খোল বা পেটোতে (৮-৯ ইঞ্চি সাইজের) প্রথমে যম তারপর যমের ছেলে তারপর যমের বউ—এইভাবে বসানো হয়। পিটুলি মাখা দিয়ে তৈরি হয় শুক প্রদীপ। যেটি আদপে চতুর্মুখ প্রদীপ। এরপর কলার খোলে রেখে তার চারপাশ দিয়ে রঙিন পিটুলি দিয়ে সাজানো হয়। সব শেষে তৈরি হয় ‘অলক্ষ্মী’। এঁড়ে বাছুরের গোবরকে দলা পাকিয়ে আঙুলের চাপে চোখ-নাক করে মাথায় দেওয়া হয় গৃহিণীর মাথার ঝরা চুল, মাথার সিঁথিতে থাকে সিঁদুর আর ধুতিতে হলুদ মাখিয়ে রঙিন করে ঘোমটা দেওয়ার মতো অলক্ষ্মীকে পরিয়ে দেওয়া হয়। যে পেটোতে অলক্ষ্মীকে বসানো হয় তার মধ্যে দেওয়া হয় একটুকরো আখ, কাঁচা তেঁতুল, গোটা হলুদ আর একটি মাটির প্রদীপ। সমস্ত কাজ শেষে চলে ‘অলক্ষ্মী’ বিদায়ের পালা। গৃহিনী বাড়ির ছোটো ছোটো বাচ্চাদের নিয়ে, ভাঙা কুলো আখ দিয়ে বাজাতে বাজাতে ঘাটের কাছে ওই পেটো রেখে আসেন। রাখার সময় বলেন, ‘অলক্ষ্মী দূর হ, ঘরের লক্ষ্মী ঘরে আয়’। নিয়ম আছে, এরপর আর ওই দিকে তাকাতে নেই। বাড়ি ফিরে গৃহদেবতার কাছে যম, যমের বউ, যমের ছেলেকে রাখা পেটোটি রেখে লক্ষ্মীপূজা আরম্ভ হয়। অঞ্চল ও জাতিভেদে বা শুধুমাত্র অঞ্চলভেদে এই ক্রিয়াচারের মধ্যে কিছু রদবদল লক্ষ করা যায়। দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার নোদাখালী থানার চণ্ডীপুর গ্রামের মাহিষ্য রায় পরিবারে যে রীতি দেখা যায়— তাতে পেটোতে সুপারি, আখের টুকরো, মোমবাতি দেওয়ার রীতি আছে। এখানে একটি ছেলে পুতুল ও একটি মেয়ে পুতুল তৈরি করে মেয়ে পুতুলটির মাথায় গৃহিণীর মাথার ঝরা চুল দিয়ে কেশবিন্যাস তৈরি হয়। এক্ষেত্রে ক্রিয়াচারের মূল ভাবনা একই থেকে রীতি পরিবর্তিত। সুতরাং লোকাচারকে কেন্দ্র করে লোকায়ত শিল্প গড়ে ওঠা এবং পুতুল তৈরির আনন্দ শৈশবের উন্মাদনাকে তরান্বিত করে। শিশুমনে এক পুতুল তৈরির নেশা তৈরির মাধ্যমে জীবনমুখী মূল্যবোধ গড়ে তোলে, যা প্রকৃতপক্ষে যুগে যুগে সমাজদর্শনের মূল্যবোধের ভিত স্থাপন করে চলেছে।

পশ্চিম মেদিনীপুরের মির্জাবাজারের কুমোর পাড়ায় দেওয়ালির আগে দেওয়ালি পুতুল তৈরি হয়। এই অঞ্চলের বিশ্বনাথ পাল দেওয়ালি পুতুলশিল্পী হিসেবে বেশ পরিচিত নাম। এখানকার পুতুলগুলির গড়ন, রূপ বর্ণনা লক্ষ করলে বোঝা যায়, এর প্রাচীনত্বের দিকটি। অন্ধ্রপ্রদেশ-সহ তৎসংলগ্ন অঞ্চল বা রাজস্থানে সপ্তাদশ শতাব্দীতে ধাতুর তৈরি যে সমস্ত ‘দীপলক্ষ্মী’ তৈরি হতো তার সঙ্গে এই অঞ্চলের দেওয়ালি পুতুলের বিশেষ সাদৃশ্য। প্রসঙ্গত, ঝাড়খণ্ডের ঘরন্দা তৈরির রীতিকে কেন্দ্র করে যে আদলের পুতুল তৈরি হতে দেখা যায় তা দেওয়ালি পুতুলের ছাপ বহন করে। পুতুলের গড়নকে কেন্দ্র করে অনুভবের বিষয়টি যদি আলাদা মাত্রা পায়, সেক্ষেত্রে দেওয়ালি পুতুলের গড়নে আনন্দের অনুভব লক্ষণীয়, যা প্রকান্তরে শিল্পীর নিপুণ পুতুল রূপায়ণের প্রতিফলন। ছাঁচের তৈরি মুখে একটি মিষ্টতা মাখা অভিব্যক্তি, পরনের ঘাঘরা-ব্লাউজ, হাত দুটি গৌর-নিতাইয়ের মতো তুলে মাথায় প্রদীপকে ধরে আছে। প্রদীপের সংখ্যা পাঁচ-দশ থেকে পঞ্চাশটি পর্যন্ত লক্ষ করা যায়। আবার কোনও ক্ষেত্রে তা-ও পাশের দিকে নামানো। তার গায়ে প্রদীপ লাগানো, দেখতে অনেকটা চালচিত্রের আকার ধারণ করে। বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের পোশাক-পরিচ্ছদের সমকালীন আঙ্গিক প্রভাবিত করেছে পুতুলের পরিচ্ছদে। তাই শাড়ি পড়া দেওয়ালি পুতুলের দেখা মেলে।

পূর্ব মেদিনীপুরের এগরা থানার পশ্চিম সাঁই-এর শাঁখারি সম্প্রদায়ের মানুষ গালা পুতুলশিল্পী বৃন্দাবন চন্দ-এর হাতে ‘দীপলক্ষ্মী’ ফরমটি পুরুষ পুতুলে রূপান্তর এক অভিনব ঘটনা। তিনি একটি পুরুষ পুতুলের মাথায়, কাঁধের দু-পাশে ও দু-হাত দিয়ে ধরা একটি প্রদীপরূপে এটিকে গড়েছেন। রঙের বৈচিত্র্য সেই অর্থে তাঁর কাজের ধারা অনুসারী। সামনে লাল আর পিছনে কালো রঙের সঙ্গে হলুদ গালার সুতোর কাজ। পুতুলের গাল সেই অর্থে নেই। নীচের দিকে ‘ছুঁচে টানা ঢেউ’ নকশা। এর পাশাপাশি নারীরূপেও পুতুলটি গড়েন। সেক্ষেত্রে লাল রংটি কোমর পর্যন্ত করে বাদবাকি অংশ কালো রঙের করেন। নারী বোঝাতে তৈরির সময় বুক এবং রঙের সময় বুকে অলংকরণ করে দুটি পুতুলের সত্তা স্বতন্ত্র করে তোলেন। একইভাবে নীচের দিকে থাকে ‘ছুঁচে টানা ঢেউ’ নকশা। কর্মশালায় বৃন্দাবনবাবু বাচ্চাদের তৈরি দেবপুতুলরূপে কালীকে গালা রং করেছেন এবং প্রতিমারূপে দুর্গা ঠাকুর করেছেন গালার রঙে।

দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার বিষ্ণুপুর থানার বায়রাহাটের গালা পুতুলশিল্পী অমরেন্দ্রনাথ বেরা নিজস্ব আঙ্গিকে দেবপুতুলরূপে কালীকে তৈরি করেন। নান্দনিক দিক-প্রধান এই পুতুল নীল রঙের উপরে সোনালি, হলুদ বা লাল রঙের গালার সুতোর কাজে কালীকে আরও মায়াবী করে তোলেন। কিছু ক্ষেত্রে প্রাথমিক রংগুলি ছাড়াও কিছু মিশ্রিত রঙের ব্যবহার দেখা যায়। দেবপুতুলরূপে দেবী কালীকে তৈরির বিষয়ে শিল্পীর ব্যক্তিগত বিশ্লেষণ— আজকের কালী, শাস্ত্র-বর্ণিত হলেও হিন্দুকরণের পূর্বে আর্যদের অনার্য বিদ্বেষের প্রতিবাদে দেবীকালী খড়্গহস্ত হয়েছিলেন। সেখানে শিবের ভূমিকা-সহ কালীকে আত্মস্থ করে হিন্দুত্ব ধারা পুষ্টি লাভ করেছিল।

দুর্গা, কালী… ইত্যাদি শক্তিদেবীর মূল হিসেবে শবর-ওঁরাও ইত্যাদি আদিবাসীদের দেবী চাণ্ডী বা চণ্ডীর সঙ্গে সম্পর্ক বলে অনেকেই মনে করেন। সেই হিসেবে অন্যান্য দেবদেবীর (মনসা, শীতলা ইত্যাদি) যেমন প্রতিকী রূপ নুড়ি-পাথর ইত্যাদিতে দেখা যায় তেমনই কালীরও থাকা স্বাভাবিক। উত্তরবঙ্গের শ্মশানকালী সেরকমই। স্বভাবত দেবী কালী তাঁর শক্তির প্রাবল্য এতটাই ছিল যে তিনি অনতিবিলম্বেই শাস্ত্রে গৃহীত হয়ে গিয়েছিলেন। পুতুল বা প্রতিকীরূপ থেকে মূর্তিরূপে তার প্রকাশের তেমন দরকার হয়নি বলেই শিল্পী মনে করেন। এই হিসেবে লোকশিল্পীদের হাতে তৈরি দেবপুতুল শুধুমাত্র গড়ন বৈশিষ্ট্যে বিশিষ্ট।

প্রদীপ হাতে কিছু পুতুল প্রসঙ্গে শিল্পী বললেন— দেবী কালীর উদ্‌যাপন বা স্মরণ উৎসব উপলক্ষে প্রদীপ জ্বালানো লোকশিল্পী দেখলেন উৎসব পালনকারিণীর সঙ্গে জড়িয়ে। দেখা গেল একাধিক প্রদীপ জ্বালিয়ে তিনি দেবীর ক্রোধ প্রশমনের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করেছেন। অর্থাৎ হতে পারে সমস্ত কামনা-বাসনা তাঁরা বিসর্জন দিতে প্রস্তুত। এ প্রসঙ্গে হুদুমদেও দেবতাকে প্রসন্ন করার যে প্রত্যক্ষ কৃত্যাদি তারই প্রতিকীরূপ দীপদান। অর্থাৎ হতে পারে প্রতিকীমৈথুন প্রস্তাব।

পূর্ব মেদিনীপুরের কেশববাড়ি গ্রামের পুতুলশিল্পী ছবি চিত্রকর। মেয়েলি ঢঙে পুতুল গড়ে, পুড়িয়ে আর্থ ব্যবহার করে রং করেন। পুতুলের বেস কালার সাদা করে তাতে লাল, হলুদ, নীল রং ব্যবহার করে পুতুলকে রঙিন করে তোলেন। বাঁশপাতার মতো সরু চোখ আঁকেন কালো রঙে। অনেক ক্ষেত্রে চোখের ভিতরে সাদা রঙের প্রয়োগ করেন, অনেক ক্ষেত্রে বাদ থেকে যায়। নীল (টার্কিশ ব্লু) গায়ে সাদা রং এবং হলুদ গায়ে লাল রং ব্যবহার করে গয়না, আঙুল, ঠোঁট ইত্যাদি করেন। সরলরেখার গতিশীল প্রয়োগ অতি সহজেই অনেক কথা বলে দেয়। পুতুলের মুখের আদল অনেকটা ছুঁচো বা নেউলের মতো করে গড়েন এবং মাটি চেপে তুলনামূলক বড়ো কান তৈরি করেন। যা দেখে মিশরীয় সভ্যতার একাধিক প্রত্ন সংগ্রহের কথা মনে করায়। রঙের প্রয়োগে দক্ষিণ দিনাজপুরের মুখোশ বা একাধিক আদিবাসী গোষ্ঠীর রং নির্বাচন ও প্রয়োগের সঙ্গে সাদৃশ্য লক্ষ করা যায়। মেয়েলি ঢঙে তৈরি দু-কোলে ও মাথায় প্রদীপ নিয়ে লোকায়ত শিল্প আঙ্গিকে পুতুল অনেক কথা বলে যায়। আর একটি দেবপুতুল কালী। গলার মালা। হাতে কোনও অস্ত্র নেই। পুতুলের নিম্নাংশে ফার্ন পাতার মতো অলংকরণযুক্ত ঘাঘরা। এ দেবী কালীর এক অন্য রূপ। বিবর্তন ধারায় শিকড়ের সাথে তাঁর যেন সহবস্থান।

বাঁকুড়া জেলার পাঁচমুড়া গ্রামের পুতুলশিল্পীরা যে সমস্ত পুতুল তৈরি করেন তার বিষয় বৈচিত্র্যের তালিকা বেশ দীর্ঘ। এই দীর্ঘ তালিকায় একাধিক পুতুলের রূপসজ্জা দেখলে আদিম জনগোষ্ঠীর কথা মনে করায়, এক অর্থে এই সমস্ত পুতুল চলমান ইতিহাস। চোখ ড্যাবা ড্যাবা, গলা কিছুটা লম্বা, নামমাত্র বুকের গঠন ধরে মেয়ে পুতুল বোঝানোর প্রচেষ্টা সফলভাবে প্রকাশিত। সরু কোমর থেকে নিম্নাংশ ক্রমশ চওড়া হয়ে পুতুলের সামগ্রিক ভারসাম্য বজায় রেখে হাতে ছোট্ট প্রতিকী প্রদীপ। বেয়ারির মাধ্যমে কিছু অলংকরণের মধ্য দিয়ে পুতুলশিল্পীর পরিমিতিবোধ দৃঢ়ভাবে প্রকাশ পায়। এই ধরনের পুতুল আদপে দীপলক্ষ্মী বা দেওয়ালি পুতুলের সংস্করণ। পুতুল তৈরির প্রতিকী পর্যায় বিশ্লেষণ করলে হয়তো অন্য কোনও দৃষ্টিভঙ্গি থেকে নতুন ভাবনার প্রকাশ পাবে।

ওড়িশার বালাসোরে সাবিত্রী চতুদর্শী ব্রতের সঙ্গে পুতুলের বিয়ের বিষয়টি সংশ্লিষ্ট হয়ে গেছে। পুতুলের বিয়ের ছাদনাতলা তৈরি থেকে মাঙ্গলিক ক্রিয়াচারে, বৈবাহিক ক্রিয়াচারের সম্পূর্ণ প্রতিফলন দেখা যায়। উৎসব শুরু হয় দোলপূর্ণিমা থেকে। কনে দেখা, আশীর্বাদ, লগ্নধরা, গায়ে হলুদ ইত্যাদি সব কিছুই। তার আগে রামনবমীতে হয় ত্রিবেণীসঙ্গম থেকে মাটি এনে বর-কনের মূর্তি গড়া— ‘গড়ন’, বুদ্ধপূর্ণিমায় লগ্নধরা বা আশীর্বাদ। শুক্লা জ্যৈষ্ঠ দশমীতে মঙ্গলম। একাদশীতে বিয়ে। তারপর বিশাল শোভাযাত্রা হয় বর-কনের পালকি নিয়ে। শেষদিন ভোজনপর্ব। বর-কনে বা জৌকণ্ডি, শিব-কালী, শিব-পার্বতী প্রভৃতি নানারূপে বর-কনে হন। প্রতি বছর বর-কনে পরিবর্তিত। বর-কনের বাবা-মা হওয়ার রীতিও দেখা যায়। রূপ এক থেকে নাম বা চরিত্রের পরিবর্তন ঈশ্বরবাদের নানারূপের ইঙ্গিত বহন করে।

দশটি পুতুল পরপর সাজালে কেটি দৃষ্টিনন্দন ছন্দ তৈরি হয়। ‘বনদুর্গা’ পুতুলের বিষয়ে বলতে গেলে পুতুলের গড়ন প্রায় একইপ্রকার, শুধু বিষয়গুলি আলাদা। কোনটির মাথায় ঝুড়িতে ফল (কাদার ডেলা পাকিয়ে গোল করে, প্রতিকী), কোনওটির ডান হাতে প্রদীপ বা কোনওটির কোলে ছেলে। পুতুলের গড়ন সম্পর্কে বলতে গেলে আঙুলের ভারী চাপে নাক তৈরির মাধ্যমে মুখাবয়ব তৈরি হয়। মাটির ছোটো ডেলা দিয়ে চোখ বানানো হয় এবং তাতে রিফিল বা ওই ধরনের কোনও কিছু দিয়ে একটা ছোটো বৃত্ত (রিলিফে) করা যায়। যা পুতুলের ড্যাবা ড্যাবা চোখে এক দৃঢ়তা আনে। ঠোঁট সেই অর্থে করা হয় না। গলার রিলিফের দ্বারা বৃত্ত করে হার বানানো হয়েছে এবং কোমরে বেয়ারির দুটি দাগ দেওয়া হয়, যা আদপে কোমর বোঝাতে ব্যবহৃত। ‘বনদুর্গা’ পুতুল দেবী দুর্গার প্রতিকী বা দেবী কালিকার প্রতিকী বা বনদেবী স্বতন্ত্র একটি দেবী সে বিষয়ে নানা দ্বন্দ্ব আছে। বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলার নান্নার গ্রামে এক নমঃশুদ্র বাড়িতে ‘শ্রীশ্রীবুড়াকালী’ নামে বনদুর্গা প্রতিষ্ঠিতা আছেন।১ উত্তর দিনাজপুরের রায়গঞ্জের পতিতবন্ধু পাল এ যাবৎ পর্যন্ত বনদুর্গা পুতুল তৈরি করেন।

রায়গঞ্জ শহরের পার্শ্ববর্তী গ্রাম রাখাল কালী। এখানে চৈত্রসংক্রান্তিতে ‘শ্মশানকালী’ নামে এক কালীপূজা হয়। কালীপূজাকে কেন্দ্র করে মেলা বসে। দেবীর রূপের প্রকাশে অভিনবত্ব লক্ষণীয়। ডান দিকের উপরের হাতে খড়্গ, তার নীচের হাত লাঙল ধরার মুদ্রা এবং বাঁ-দিকের উপরের হাতে দেবী অভয়দান করছেন এবং নীচের হাতে লাঠি। সৃষ্টি ও পালনের প্রতিফলন পাওয়া যায় দেবীমূর্তিতে।

কালা জাদু বা গুপ্তবিদ্যায় পুতুলের ব্যবহার লক্ষণীয়। সেই সঙ্গে শক্তিকে আরাধ্য করে কার্যসিদ্ধির প্রয়াসে কালীধারার প্রভাব ও প্রসার লক্ষ করা যায়।

বাংলার প্রায় সমস্ত পটুয়া ছাঁচে অথবা হাতে কালীমূর্তি তৈরি করেন, যা থেকে বোঝা যায় কালীঠাকুরের অধিক জনপ্রিয়তা। 

 

 

 

১. এই তথ্যটি ড. কমিনী কুমার রায় মহাশয়ের ‘বাংলার লোকদেবতা ও লোকাচার’ গ্রন্থ থেকে গৃহীত।

 

 

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত