| 28 মার্চ 2024
Categories
গল্প ধারাবাহিক সাহিত্য

নিকোলাই গোগোলের গল্প: নাক (পর্ব-৩)

আনুমানিক পঠনকাল: 11 মিনিট

Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.comলেখক পরিচিতি: নিকোলাই গোগোল(১৮০৯-১৮৫২):

রুশ জাতীয় সাহিত্যে, বিশেষত রুশীয় সাহিত্যের স্বর্ণযুগের ইতিহাসে লেখক-নাট্যকার গোগোলের নাম অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে উচ্চারিত হয়। জন্মের পর আয়ানোভস্কি (Ianovskii) নামকরণ করা হলেও তাঁর দাদাজান নিজের বংশগৌরবের অংশ হিসেবে পৌত্রের নামকরণ করেন গোগোল। এবং কালক্রমে এ নামেই তিনি বিশ্ববাসীর কাছে অধিকমাত্রায় পরিচিতি লাভ করেন। তাঁর পুরো নাম নিকোলাই ভাসিলিয়েভিচ গোগোল। জন্মসূত্রে ইউক্রেনীয় হলেও তিনি মূলত রুশ ভাষাতেই সাহিত্য রচনা করেছেন, যেখানে ইউক্রেনীয় সংস্কৃতির যথেষ্ট প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। গোগোলের বয়স যখন দশ, তখন তাঁর ছোটো ভাই আইভানের আকস্মিক মৃত্যু হয়। সে ঘটনায় গোগোল শুধুমাত্র তার ভাইটিকেই হারাননি, একই সাথে সবচে প্রিয় বন্ধু হারানোর যন্ত্রণাও দিয়েছিল, আজীবন সে শূন্যতা যেন তাঁকে তাড়িয়ে বেড়িয়েছে।

ছাত্র জীবন থেকেই তিনি স্কুল-কলেজের ম্যাগাজিনে লেখালেখি শুরু করেন। লেখালেখির শুরুটা তিনি সম্ভবত কবিতা দিয়ে শুরু করতে বিশেষ আগ্রহী ছিলেন। যে কারণে নিজ খরচে তিনি তাঁর প্রথম মহাকাব্যিক কাব্যগ্রন্থ “হান্স ক্যুকলগার্টেন (Hanz Kuechelgarten)” প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। যা তাঁর জার্মান রোমান্স পড়ার ফলাফল হিসেবে বিবেচিত হয়। তবে তাঁর কবিতাগ্রন্থটি পাঠকের সমাদর পেতে ব্যর্থ হয়। যে কারণে গোগোল অতিমাত্রায় হতাশ হয়ে কাব্যগ্রন্থটি নিজের হাতে পুড়িয়ে ফেলেন এবং প্রতিজ্ঞা করেন জীবনে আর কোনোদিন কবিতা লিখবেন না। কবি হিসেবে সমাদৃত না হবার দুঃখটা হয়ত তিনি সেন্ট পিটার্সবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হতে পারলে ভুলে যেতেন। বিশ্বসাহিত্যের কপাল ভালো সেটাতেও তিনি সফলতা পাননি। যে কারণে লেখালেখিকেই গোগোল একমাত্র ধ্যানজ্ঞান এবং জীবিকা অর্জনের মাধ্যম হিসেবে বেছে নেন। যার ফলাফল আজও সাহিত্যপ্রেমী মানুষ উপভোগ করছেন।

মাত্র তেতাল্লিশ বছরের জীবনে নিকোলাই গোগোল বিশ্ব সাহিত্য ভাণ্ডারকে যে লেখনী উপহার দিয়ে গেছেন তার বুঝি তুলনা চলে না। তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস “ডেড সোলস” কে আধুনিক রুশ উপন্যাসের একটি উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এছাড়া তাঁর আরেক বিখ্যাত সৃষ্টি ‘দ্য ওভারকোট’ নিয়ে ফিওদর দস্তোয়ভস্কি ভূয়সী প্রশংসা করেন।

স্বল্পায়ুর জীবনে তিনি সৃষ্টি করেছেন অনেক বিশ্বমানের সাহিত্যকর্ম। তাঁর রচিত নাটক, ছোটগল্প, উপন্যাসগুলোতে সে স্বাক্ষর পাওয়া যায়। তাঁর উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে রয়েছে: ইভেনিংস অন এ ফার্ম নিয়ার ডিকাঙ্কা (১৮৩১-১৮৩২), মিরগোরোদ (১৮৩৫), দ্য ওভারকোট (১৮৪২), দ্য ইন্সপেক্টর জেনারেল (১৮৩৬), ডেড সোলস (১৮৪২)। দ্য নোজ (১৮৩৫) যা অপেরা হিসেবেও বহুল জনপ্রিয়তা লাভ করে।


কোভালিয়েভ মুখ চুন করে দাঁড়িয়ে রইলেন। কী করণীয়, কিছুই তার ভাবনাতে আসছিল না। ঠিক সে মুহূর্তে কোভালিয়েভ কোনো মহিলার কাপড়ের মৃদু খসখস আওয়াজ শুনতে পেলেন, শব্দের উৎস এক সুবেশি বর্ষীয়ান ভদ্রমহিলা তার দিকে এগিয়ে এলেন, তাঁর পরনে কারুকার্যময় লেসের পোশাক, তাঁর সাথে আছে এক ছিপছিপে গড়নের তরুণী যার পরনে সাদা ফ্রক এবং মাথার উপর চমৎকার ভাবে শোভা ছড়াচ্ছে একখানা খড়ের টুপি। তাদের পেছনে একডজন কলার আঁটা পোশাক পরিহিত, ইয়া জুলফিধারী সুবেশি দীর্ঘকায় এক ভৃত্য এসে দাঁড়ালো এবং হাতের নস্যিদানীটা খুলে ধরলো।

কোভালিয়েভ নিজের জায়গা ছেড়ে খানিকটা এগিয়ে গেলেন, শার্টের কলারটা টেনে বের করে ঘড়ির সোনার চেনটার সাথে ঝুলতে থাকা সীলগুলো ঠিকঠাক করে নিয়ে বিগলিত হাসি ছড়িয়ে বর্ষীয়ানের সাথে থাকা তরুণীটির প্রতি বিশেষ মনোযোগ দিলেন, যে তখন বসন্তের সদ্য ফোঁটা ফুলটির মতো দুলছিল এবং তার চম্পাকলির মতো আকর্ষণীয় হাতের আঙুল তুলে বারংবার তার ভ্রুর কাছে নিয়ে নাচাচ্ছিল।কোভালিয়েভ যখন তরুণীর টুপির আড়াল থেকে তার  সুডৌল, উজ্জ্বল, সুন্দর ছোট্ট চিবুক আর ফুটে থাকা গোলাপের মতো গালের একাংশ দেখতে পেলেন তখন তার হাসি এ কান ও কান ছড়িয়ে পড়লো। কিন্তু আচমকা কিছু মনে পড়ে যাওয়ায় তিনি কেমন কুঁকড়ে গেলেন। তার মনে পড়ে গেলো যে মুখের উপর তার নাকটি নেই, জায়গাটা একদম লেপাপোছা। বাড়া ভাতে কেউ বুঝি অদৃশ্য হাতে ছাই ছড়ালো। কোভালিয়েভ খুব আবেগাক্রান্ত হয়ে পড়লেন, তার চোখে পানি এসে গেলো।

তিনি যখন গোলাপী গালের শুভ্র তরুণীর দিকে মনোযোগ দিচ্ছিলেন সেই অবকাশে নাক মহাশয় কোথাও উধাও হয়ে গেছেন। সম্ভবত অন্য কোনো কাজে কিংবা কারো সাথে সাক্ষাতের ইচ্ছায় সেখান থেকে সটকে পড়েছেন।

আশেপাশে নাক মশাইয়ের টিকিটির চিহ্ন না দেখে কোভালিয়েভ ভীষণভাবে মুষড়ে পড়লেন। তিনি দ্রুত বড় দালানটায় ফিরে গিয়ে বারান্দার সারিবদ্ধ থামের আড়ালে ঠাই দাঁড়িয়ে রইলেন,এবং আরেকবার নাকের  দেখা পাওয়ার আশায় চারপাশে তীক্ষ্ণ নজর বুলাতে লাগলেন। নাকের পালকওয়ালা টুপি আর সোনালী জরির কাজ করা ইউনিফর্মের কথা কোভালিয়েভ দিব্যি মনে করতে পারলেও তার ওভারকোট, ঘোড়া বা গাড়ির রঙ, কোনোটাই খেয়াল করে না দেখায় সেসবের কিছুই মনে করতে পারলেন না। এমনকি গাড়ির পেছনের সীটে আরো কোনো আরোহী ছিলো কিনা, তাদের পরনের পোশাকই বা কেমন ছিলো, সেসব এখন মনে করাটাও ঝকমারি। তাছাড়া অসংখ্য গাড়ি রাস্তার উপর আসা যাওয়ায় ব্যস্ত ছিলো, আর সেগুলোর গতি এত দ্রুত ছিলো যে আলাদা করে কাঙ্খিত গাড়িটা চিনে নেয়াও ছিলো দুঃসাধ্য; অবশ্য অত গাড়ির ভেতর থেকে আলাদা করে চেনা গেলেই বা কী আসতো যেত- তিনি তো আর গাড়িটা থামাতে পারতেন না।

চমৎকার রোদ ঝলমলে ছিলো দিনটা। নেভস্কি অ্যাভিনিউ দিয়ে অসংখ্য মানুষের ঢল নেমেছে। নানান বয়সী নারীরা ফুটপাত দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। পুলিশের সদর দপ্তর থেকে মানুষের বর্ণিল স্রোত শুরু হয়ে অ্যানিচকভ্ ব্রিজ পর্যন্ত ফুটপাত বরাবর বয়ে চলেছে। অগনিত মানুষের ভিড়ে কোভালিয়েভ তার পরিচিত উচ্চ আদালতের এক উপদেষ্টাকে দেখতে পান, যাকে তিনি অন্যদের সামনে  সচরাচর ‘লেফটেন্যান্ট কর্নেল’ বলে সম্বোধন করে থাকেন।  সংসদের প্রধান মুহুরি তার ঘনিষ্ট বন্ধু ইয়ারাইজকিন যে কিনা বোস্টন খেলায়(তাস জাতীয় খেলা) আটের বাজিতে প্রায়শ হেরে যায়, তার মুখটাও ভেসে উঠতে দেখেন একঝলক। তার পরে দেখলেন ভিড় ঠেলে আঙুলের ইশারায় কোভালিয়েভকে কাছে ডাকছে তারই মতো ককেশাসের ‘মেজর’ পরিচয় দিতে ইচ্ছুক পরিচিত একজন।

“দূরে গিয়া মর!” নিজের মনে বিড়বিড় করেন কোভালিয়েভ। “ওহে গাড়োয়ান, আমাকে সোজা পুলিশ কমিশনারের কাছে নিয়ে চলো দেখি। বলতে বলতে একটা ছ্যাকরা গাড়িতে চেপে বসে চালকের উদ্দেশ্যে বলেন, “জোরসে ছুটো।” চালক তার পছন্দসই পথে রওনার উদ্যোগ নিতেই  তিনি বলে ওঠেন, “ও পথে না বাপু, তুমি বরং আইভানভস্কাইয়া স্ট্রিট দিয়ে চলো।”

“পুলিশ কমিশনার কি ভেতরে আছেন?” দোরগোড়া পেরোতে পেরোতে তিনি জানতে চাইলেন।

“নাহ্, তিনি তো নেই।” দারোয়ান জবাব দিলো। “মাত্রই বেরিয়ে গেলেন।”

“আহ্! ঠিক এই ভয়টাই পেয়েছিলাম।”

“হ্যাঁ তাই” দারোয়ানটা যোগ করলো, “এই কিছুক্ষণ আগেই তিনি বেরিয়ে গেলেন। আর মিনিট কয়েক আগে যদি আসতেন, তবে তাঁকে বাড়িতেই পেয়ে যেতেন।”

তখনও কোভালিয়েভ মুখের উপর রুমালটা ধরে রেখেছিলেন, সেভাবেই তিনি অপেক্ষারত গাড়িতে ওঠে রুষ্ট গলায় চেঁচালেন,

“চালাও।”

“কোন দিকে?” গাড়িচালক জানতে চাইলো।

“আরে ধ্যাৎ! নাক বরাবর চলো বাপু।”

“সোজা যাবো? কিন্তু সেটা তো সম্ভব না জনাব, কিছুদূর গিয়ে রাস্তা ডান আর বাম দুটো দিকে মোড় নিয়েছে, কোনদিকে যাবো ঠিক করে বলুন?

ছ্যাকরা গাড়ি চালকের এমন প্রশ্নে থমকে গেলেন যেন কোভালিয়েভ, খানিক কি যেন ভাবলেন  তিনি। তার এখন যা অবস্হা, তাতে বুদ্ধিমানের কাজ হবে যদি তিনি সরাসরি আইন শৃঙ্খলা বিভাগে গিয়ে একটা আর্জি পেশ করেন, যদিও এ বিভাগের সাথে পুলিশ বিভাগের সরাসরি কোনো সম্পর্ক নেই, তবুও ওদিক থেকে একটা চাপ এলে তাতে পুলিশের হুকুম অন্যান্য দপ্তরের তুলনায় দ্রুত কার্যকরী হওয়ার একটা সম্ভাবনা আছে। সরাসরি নাকের দপ্তরে গিয়ে নালিশ জানানোও বোকামির কাজ হবে, কেননা লোকটার কথাবার্তায় এটা তো স্পষ্ট, যে সে একদমই ন্যায়নীতির ধার ধারেনা। আর এ ক্ষেত্রে সে মিথ্যেও বলতে পারে, যেমন আগেও বলেছে সপাটে, সেই মুখোমুখি সাক্ষাতের সময় যেমন বললো, তার সাথে নাকি কোভালিয়েভের কস্মিনকালেও দেখা হয়নি! ভেবেচিন্তে কোভালিয়েভ আইন শৃঙ্খলা দপ্তরের শরণাপন্ন হওয়ার সিদ্ধান্তই নিলেন। সেদিকেই গাড়ি চালানোর হুকুম দেবার আগের মুহূর্তে তার মনে দুম করে আরেকটা চিন্তা খেলে গেলো, নাক বাটপার প্রথম আলাপের সময় তার সাথে সেরকম নির্লজ্জ অভাব্য আচরণ করেছে, দাগাবাজটার পক্ষে হয়ত কিছুই অসম্ভব নয়। যদি সে ক্ষমতা আর সময়ের সুযোগ নিয়ে শহর ছেড়ে পগাড়পার হয়ে যায়, তাহলে তো  অনুসন্ধানের সমস্ত তোড়জোড়ই বিফল হবে। ভাগ্য সহায়  না হলে ভোগান্তিটা পুরো একমাস ব্যাপী চলবে হয়ত।

শেষমেশ মেজর কোভালিয়েভ তার দূরদর্শিতার প্রয়োগ ঘটিয়ে ঠিক করলেন তিনি এখন সরাসরি পত্রিকা অফিসে যাবেন এবং নাক বাটপারটার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ দিয়ে পত্রিকায় একটা বিজ্ঞাপন  প্রকাশ করবেন। যাতে যে কেউ পলাতকটাকে দেখা মাত্র সনাক্ত করে তার কাছে হাজির করতে পারে, কিংবা অন্তত তার একটা হদিশ দিতে সক্ষম হয়।

সুতরাং সরাসরি পত্রিকা অফিসে যাওয়ার জন্য ছ্যাকরা চালককে হুকুম দিলেন কোভালিয়েভ, কিন্তু গোটা পথ জুড়ে বন্য এক অস্হিরতায় তিনি চালকের পিঠে ক্রমাগত আঘাত করতে করতে বলতেই থাকলেন, “জলদি  চালা নচ্ছার! আরো জোড়ে চালা খচ্চর কোথাকার!” তার খোঁচানির যন্ত্রণায় ত্যাক্ত বেচারা চালক  মাঝে মধ্যে “জী হুজুর” বলে মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে ঘোড়ার লাগামটা ধরে এমন ভাবে দাবড়ানি দিতে থাকলো যেন সে একটা শিকারী কুকুর।

ছ্যাকরা গাড়ি পত্রিকা অফিসের সামনে থামা মাত্রই কোভালিয়েভ নেমেই  রুদ্ধশ্বাসে ছুটে স্বল্পায়তনের একটা অভ্যর্থনা কক্ষে প্রবেশ করেন। সেখানে পাকা চুলের এক কেরানি, অতি ব্যবহারে জীর্ণ একটা কোট গায়ে, নাকের উপর চশমা এঁটে, দুই ঠোঁটের ভাঁজে কলমটা ধরে তার সামনে রাখা গাদাগুচ্ছের পয়সা গোনায় ব্যস্ত ছিলো।

“এখানে বিজ্ঞাপনের দায়িত্বে কে আছেন?” ঢুকেই প্রায় চিৎকার করলেন মেজর।  “এই যে ভাই শুনছেন?”

“জী ভায়া, আপনার জন্য কী করতে পারি?” পক্ককেশি কেরানিটা চোখ তুলে আগতকে সম্ভাষণ জানানোর পরমুহূর্তে আবার চোখ নামিয়ে ছড়ানো পয়সার গাদায় মন দেয়।

“আমি একটা বিজ্ঞাপন ছাপাতে চাই–“

“একটু অপেক্ষা করেন মশাই”, একহাতে কাগজের উপর কিছু সংখ্যা লিখতে লিখতে অন্য হাতে গণনা হিসাব যন্ত্রের দুটো ঘর সরাতে সরাতে বললো পক্ককেশি।

টেবিলের পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা, লেসের পোশাক পরনে ভৃত্যগোছের একজন, যার চেহারা আর হাবেভাবে এটা স্পষ্ট সে কোনো অভিজাত বাড়িতে কাজ করে; লোকটার হাতে ধরা একটা কাগজ সম্ভবত কোনো বিজ্ঞাপনই হবে। সে বেশ প্রাণবন্ত গলায় আলাপ জুড়েছে পক্ককেশি কেরানিটার সাথে,

“বিশ্বাস করেন ভাই, ওই হতচ্ছড়া কুকুরটার দাম আট আনাও হবে না এটা আমি হলফ করে বলতে পারি। আমি হলে পঞ্চাশ টাকার বেশি একটা পয়সা দিতাম না। কিন্তু বেগম সাহেবা যে ওটাকে ভালোবাসেন, সত্যিই খুব ভালোবাসেন। সেজন্যই তো যে ওটার খোঁজ দিতে পারবে, পুরস্কার হিসেবে তাকে পাঁচশ টাকা দেয়া হবে। ভদ্রতার খাতিরে যদি বলতে হয়, এই যেমন এখন আপনার আমার মধ্যে কথা হচ্ছে; তাহলে বলবো, আজকাল মানুষের রুচি বোঝা দায়!  শিকারী কুকুরের কথাই ধরেন, যেসব সৌখিন লোক তাদের পোষে, তাদের পেছনে পাঁচশো কেন, হাজার টাকাও খরচ করতে রাজী আছে যদি কুকুরটা সেরকম চালাক চতুর হয়। 

কেরানি মশাই যথেষ্ট গাম্ভীর্য নিয়ে ছোকরা কাজের লোকটার কথা শুনছিলেন আর তার বয়ে আনা কাগজে কতগুলো শব্দ আছে তা গুনে যাচ্ছিলেন। তার দুপাশে বহুসংখ্যক অপেক্ষামান বাড়ির ঠিকা ঝি, দোকানকর্মী আর পাহারাদার এবং আরো অন্যান্যরা বিজ্ঞাপনের কাগজ হাতে দাঁড়িয়ে ছিলো।

সবার হাতে যে সব বিজ্ঞাপন ধরা ছিলো, তার কোনোটাতে ভালো স্বভাব চরিত্রের কোচম্যান নিয়োগ ইচ্ছুক প্রার্থী, কোনোটায় আবার লেখা ছিলো ১৮১৪ সালে প্যারিস থেকে আমদানীকৃত অল্প সময়ের জন্য ব্যবহার করা গাড়ি বিক্রির বিজ্ঞাপন, আরেকটিতে ধোপার কাজে অভিজ্ঞতা সম্পন্ন উনিশ বছরের বুয়ার কাজে নিয়োগ পেতে ইচ্ছুক যে  ঘরের অন্যান্য কাজেও পারদর্শী।

এছাড়াও বিজ্ঞাপন হিসাবে আরো ছিলো, স্প্রিংহীন টেকসই ছ্যাকরা গাড়ি, ধুসর রঙের সতেরো বছরের তেজস্বী এক ঘোড়া, লন্ডন থেকে আনা শালগম আর মূলার বীজ, দুটো আস্তাবল আর একই সাথে চমৎকার বার্চ বা ফারগাছের বাগানের উপযোগী অনেকটা জমিসহ সমস্ত সুযোগ সুবিধা সম্পন্ন বাগান বাড়ি, ইত্যাদির বিজ্ঞাপন, তার মধ্যে আবার একটা ছিলো, পুরোনো জুতা ক্রয়চ্ছুকদের প্রতিদিন সকাল আটটা থেকে তিনটা পর্যন্ত দৈনিক নিলাম-বিক্রির ঘরে উপস্হিতের আমন্ত্রণ জানিয়ে বিজ্ঞাপন। যে ঘরটাতে বিজ্ঞাপন সমেত এত কিসিমের মানুষ জড়ো হয়েছিল, সেটা আয়তনে ছিলো বেশ ছোটো, ঘরে বাতাস চলাচলও ছিলো সীমিত, স্বভাবতই পরিবেশটা ছিলো গুমোট, কিন্তু মেজর কোভালিভের নাক না থাকায় কোনো গুমোট গন্ধ টের পাওয়া  সম্ভব ছিলো না, আর তাছাড়া সঙ্গত কারণেই তিনি নাকের উপর রুমাল চাপা দিয়ে রেখেছিলেন। নাকের কথা মনে পড়ে গেলো তার; হায় তার লাপাত্তা নাকটা এখন কোথায় আছে, একমাত্র সৃষ্টিকর্তাই জানেন তার বর্তমান হদিশ।

“একটু শুনেন ভাই,” অবশেষে অধৈর্য কোভালিয়েভ মুখ খুললেন, “আমাকে কিছু বলার সুযোগ দেয়া হোক, ব্যাপারটা জরুরী।”

“একটু পরে, একটু পরে! ওহে তোমার এতটাকা, আর তোমার হ্যাঁ, হ্যাঁ তুমি, তোমার এতটাকা এত পয়সা” বলতে বলতে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা বয়স্ক ঠিকা ঝি আর দারোয়ানদের মুখের ওপর বিজ্ঞাপনের কাগজগুলো ছুঁড়ে দিতে দিতে পক্ককেশি কেরানিটা কোভালিয়েভের দিকে ঘুরে দাঁড়ালো।

” আচ্ছা বেশ” লম্বা একটা শ্বাস টেনে কেরানিটা বললো, “আপনার কী চাই মশাই?”

“ভীষণ একটা প্রতারণা আর জালিয়াতির ঘটনা ঘটে গেছে ভায়া, যা আমি নিজেই এখনও ঠিকঠাক ঠাওর করতে পারছিনা। তবে আপনার কাছে আমার এটুকুই আর্জি আপনি শুধু বিজ্ঞাপনে ছাপিয়ে দিন যে ওই জোচ্চোরটাকে কেউ ধরে আনতে পারলে তাকে উপযুক্ত পুরস্কার দেয়া হবে।” উত্তেজিত গলায় কথাগুলো বলে থামলেন কোভালিয়েভ।

“আপনার নামধাম জানতে পারি?” নির্লিপ্ত পক্ককেশি বললো।

“না না নামটাম দিয়ে কী হবে? কী মুশকিলের কথা। এই শহরে অনেক মান্যগণ্য ভদ্রমহিলার সাথে আমার ওঠাবসা আছে, সবাই আমাকে এক নামে চেনে, স্টেট কাউন্সেলরের স্ত্রী ম্যাডাম চেখতারিয়েভা থেকে স্টাফ অফিসারের স্ত্রী পালেগইয়া গ্রিগরিয়েভনা পদেতোচিনা পর্যন্ত সবাই আমার ঘনিষ্ট। পত্রিকায় দেখামাত্র তারা আমাকে চিনে ফেলবে তারপর কেলেংকারীর সীমা থাকবে না। তার চেয়ে আপনি লিখে দেন ‘কোনো এক সরকারি কর্মকর্তা’ কিংবা ‘জনৈক মেজর’। শেষেরটাই আমার পছন্দ।”

“যে লাপাত্তা হয়েছে সেকি আপনার বাড়ির চাকরবাকর ?”

“আরে বলে কী! না, না, আমার চাকরবাকর কেউ না, সেরকম কেউ হলে তো ব্যাপারটা নিয়ে এত ঝামেলার কিছু ছিলো না। আসলে আমার কাছ থেকে পালিয়েছে…আমার মানে ইয়ে… আমার ’নাসিকা’।”

“বড়ই বিচিত্র নাম দেখছি! তারমানে এই নাসিকা নামধারী আপনার বিপুল অর্থ বগলদাবা করে পালিয়েছে, তাই তো?”

“কী মুসিবত! আপনি যা ভাবছেন ব্যাপার আদৌও তা নয়। নাসিকা মানে বোঝাতে চাইছি…আমার এক্কেবারে নিজের নাক রে বাবা..আমার নাক, নাক- দ্য নোজ! সেটা বেমক্কা উবে গিয়ে আমাকে ঘোল খাওয়াচ্ছে, কোথায় গেছে জানিনা। এক্কেবারে ভূতুড়ে কাণ্ডকারখানা!”

“কিন্তু কীভাবে সেটা হাওয়া হয়ে গেলো? ব্যাপারটায় কোথাও একটা ভজঘট আছে যেটা আমি ঠিক মতো ঠাওর করতে পারছি না বাপু।”

“পুরো বিষয়টা ভেঙে যে আপনাকে বলবো, সেটাও পারছি না। তবে আসল কথা হলো যে, সে এখন এই শহরেই এখানে ওখানে ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে আর নিজেকে দিব্যি স্টেট কাউন্সিলর হিসেবে জাহির করছে। সে জন্যই আপনাকে বিশেষ অনুরোধ করছি, অতি সত্বর এই লিখে একখানা বিজ্ঞাপন ছাপিয়ে দিন যে, তাকে দেখা মাত্র পাকড়াও করে যেন আমার জিনিস আমার কাছে সটান নিয়ে আসা হয়।

আপনিই বিবেচনা করে বলেন না মশাই, শরীরের এমন একটা দৃষ্টিগোচর এবং অতি প্রয়োজনীয় অঙ্গ ছাড়া আমার পক্ষে কীভাবে চলা সম্ভব? এটা তো আর পায়ের কড়ে আঙুলটি নয়, যে সেটা খোয়া গেলেও তেমন যায় আসে না, বুট জুতোর ভেতর পা চালান করা মাত্র মুশকিল আসান। কারো পক্ষে জানাই সম্ভব না কড়ে আঙুল আছে কি নেই। তাছাড়া প্রতি বৃহস্পতিবার স্টেট কাউন্সেলরের স্ত্রী ম্যাডাম  চেখতারিয়েভার সাথে  সৌজন্য সাক্ষাতে যাই, স্টাফ অফিসারের স্ত্রী  পালেগইয়া গ্রিগরিয়েভনা পদেতোচিনার সাথেও দেখা করি।  তার আবার নিদারুণ সুন্দরী এক মেয়ে আছে- মা মেয়ে দুজনের সাথেই আমার বেশ মাখোমাখো সম্পর্ক; সুতরাং সবদিক বিচার করে আপনিই বলেন, সেই সকল সুদর্শনাদের সান্নিধ্যে আমার পক্ষে এখন কীভাবে যাওয়া সম্ভব?”

শক্ত করে ঠোঁট কামড়ানোর ভঙ্গিই বলে দিচ্ছিলো বেচারা পক্ককেশি কেরানিটি গভীর চিন্তার আবর্তে পড়ে গেছে।

“না হে বাপু, এ ধরনের বিজ্ঞাপন  আমার পক্ষে পত্রিকায় ছাপানো সম্ভব না।” বেশ কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর পক্ককেশি বলে উঠলো।

“কেন সম্ভব নয়?”

“সম্ভব না, কারণ এ জাতীয় বিজ্ঞাপন ছাপা হলে পত্রিকার সুনাম নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকে। শহরের সবাই যদি তাদের নাক খোয়ানোর খবর ছাপতে শুরু করে তবে তো… আর পত্রিকায় এমন বিজ্ঞাপন ছাপানো হলে লোকজন বলতে শুরু করবে আমরা ভুয়া খবর ছাপি, আষাঢ়ে গালগপ্পো ছাপানোর ঝোঁক আমাদের।”

“কিন্তু  আমার খবরটা ভুয়া বা আষাঢ়ে মনে হলো কেন বলেন দেখি ভায়া? সেরকম কিস্যু এতে নেইও।”

“সেটা আপনার মনে হচ্ছে মশাই। গত সপ্তাহের ঘটনাটাই ধরেন না, আপনি যেরকম এসেছেন, একই ভাবে সেদিন একজন সরকারি কর্মচারী এক বিজ্ঞাপন নিয়ে উপস্হিত হয়েছিল; হিসাবনিকাশ করে তার বিজ্ঞাপনের জন্য খরচ ধার্য করা হলো। তার বিজ্ঞাপনের ভাষ্যটা ছিলো এমন, কালো লোমওয়ালা একটা পুড্ল(ছোট্ট কুকুর ছানা) হারানো গেছে। নিতান্তই সাদামাটা এই বিজ্ঞাপনে কিইবা থাকা সম্ভব, এমন মনে হচ্ছে না? কিন্তু ব্যাপারটা শেষ পর্যন্ত মানহানির মামলা পর্যন্ত গড়িয়েছিল। কারণ এই পুড্ল আদতে ছিলো কোনো এক প্রতিষ্ঠানের ক্যাশিয়ার- যদিও প্রতিষ্ঠানের নামটা আমার এখন মনে নেই।”

“আচ্ছা… আপনার ভোগান্তিটা অনুমান করতে পারছি, কিন্তু আমি তো ভায়া কোনো পুড্ল বিষয়ক বিজ্ঞাপন দিচ্ছি না, বিজ্ঞাপনটা সম্পূর্ণই আমার ব্যক্তিগত সমস্যা সংক্রান্ত। এককথায় খোদ নিজের সর্ম্পকে এই বিজ্ঞাপন, সেটা ভুয়া খবর হয় কীভাবে!”

“তা না হোক তবু ঘুরেফিরে সেই একই ভেজাল, এই ধাঁচের বিজ্ঞাপন ছাপানো আমার পক্ষে সম্ভব না।”

” আজব তো! আমি যে আমার নিজের নাকটি খুইয়ে বসলাম সেটা কোন ব্যাপার না!” 

“দেখুন মশাই বিষয়টা পুরোপুরি ডাক্তারী বিদ্যার আওতাভুক্ত। শুনেছি এমন কামেল চিকিৎসকও আছেন যিনি পছন্দসই যে কোনো আকারের নাক দিব্যি বসিয়ে দিতে ওস্তাদ। তবে কী জানেন, আমার ঘোরতর সন্দেহ হচ্ছে আপনি একজন রসিক লোক, এই নাক ব্যাপারটি নিয়ে আপনি নিছক মজা করছেন।”

“কসম কেটে বলছি! যা ভাবছেন তা নয় মোটেও। বিষয়টা এতদূর যখন গড়ালোই তখন আসল ব্যাপারটা আপনার কাছে খোলাসা করতেই হচ্ছে।”

“ঝামেলা পাকিয়ে কাজ কী?” খানিকটা নস্যি টেনে নেবার আগে নিজের কৌতূহলটুকুও চাপতে না পেরে কিরানিটা বললো,”তবে সেরকম সমস্যা মনে না করলে ব্যাপারটা একবার দেখালে মন্দ হতো না।”

মুখের উপর থেকে রুমালটা সরিয়ে নিলেন মেজর কোভালিয়েভ।

বড়ই অদ্ভূত ব্যাপার! সত্যিই খুব অদ্ভূত ব্যাপার! বুড়ো কেরানি বিস্ময় না লুকিয়ে চিৎকার করলো, “জায়গাটা এক্কেবারে লেপাপোছা, দেখে মনে হচ্ছে তৈরি একটা প্যানকেক; কী অবিশ্বাস্য রকমের সমান জায়গাটা!”

“তা এবার কী বুঝতে পারছেন আমি এতক্ষণ কী বোঝাতে চাইছি? এবার নিশ্চয়ই আপনার কোন আপত্তি থাকবে না বিজ্ঞাপনটি সটান ছাপাতে। এই বিজ্ঞাপনের সুবাদে আপনার সাথে পরিচিত হতে পেরে আমি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করছি।” কথা বলতে বলতে মেজর যেন একটু অতিরিক্ত তৈলাক্ত শব্দ প্রয়োগে কেরানির মন ভেজাতে চেষ্টা করলেন।

“সে তো ছাপানোই যায়, ওটা তেমন কঠিন কোনো কাজও নয়”। কেরানি বললো, “তবে বাস্তবতা হলো ভায়া, এই বিজ্ঞাপন ছাপিয়ে আপনার খুব একটা উপকার হবে বলে আমার মনে হয় না। সত্যি যদি ব্যাপারটার সুষ্ঠু ফয়সালা করতে চান, তাহলে বরং আপনি এমন একজন কব্জির জোরওয়ালা লেখকের শরণাপন্ন হোন যিনি বিষয়টাকে অসাধারণ প্রকৃতির ঘটনা হিসেবে বর্ণনা করে সরস প্রবন্ধ লিখে দেবেন। তারপর সেটা ‘মৌচাকে ঢিল’ পত্রিকায় প্রকাশের ব্যবস্হা করুন, (এই বলে কেরানি একটিপ নস্যি নিলো), কাজটা তরুণ সমাজের যেমন উপকার করবে (বলতে বলতে পক্ককেশি  হাত উল্টে নাক মুছলো) তেমনি সাধারন মানুষের কাছেও হয়ত আগ্রহের বিষয়বস্তু হয়ে উঠতে পারে।”

কেরানির বেহুদা ভ্যাজর ভ্যাজর শোনার পর মেজর সাহেব পুরোপুরি হতাশায় ডুবে গেলেন। তিনি চোখের সামনে থাকা পত্রিকার পাতায় চোখ রাখলেন, সেখানে কোনো থিয়েটারের একটা বিজ্ঞাপন, এক স্বনামধন্য সুন্দরী অভিনেত্রীর নামটা চোখে পড়া মাত্র কোভালিয়েভের ঠোঁটে হাসির রেখা দেখা দিলো, নিজের অজান্তেই যেন হাতটা পকেট হাতড়ে নোটের খোঁজে সক্রিয় হলো,( তিনি ভাবছিলেন যে কেবল স্টলগুলিতে মেজরদের পছন্দসই আসন এবং তারপরেই…) সবই ঠিক চলছিল, কিন্তু হুট করে আবারও নাকের চিন্তাটা উড়ে এসে তার সব উৎসাহে পানি ঢেলে দিলো বুঝি।

পক্ককেশি কেরানিটা পর্যন্ত কোভালিয়েভের বিপর্যস্ত অবস্হা দেখে কেমন দিশেহারা হয়ে পড়লো। সহানুভূতির সাথে এই পরিস্হিতিতে সামান্য হলেও কোভালিয়েভের দুঃখ কমানোর আন্তরিকতা নিয়ে সে সমবেদনা জানানোর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে মুখ খুললো,

“আপনার পরিণতির জন্য সত্যিই বড় দুঃখ হচ্ছে। এক চিমটি নস্যি নিয়ে দেখবেন নাকি ভায়া? এতে মাথাধরা আর বিষন্নতা কেটে যায়- দেখবেন একটু নিয়ে? এমনকি পাইলসের সমস্যা থাকলেও এতে ভালো কাজ দেয়।”

বলেই পক্ককেশি কেরানি টুপি পরা এক মহিলার ছবি আঁকা নস্যিদানীর ঢাকাটা বেশ কায়দা করে সরিয়ে কোভালিয়েভের সামনে ধরলো।

কেরানিটির এহেন হটকারী ব্যবহারে কোভালিয়েভের ধৈর্য্যের বাঁধ ভাঙলো।

তিনি বেশ উষ্মার সাথে বলে উঠলেন,  “মশকরা করছেন মশাই? আপনি কী দেখতে পাচ্ছেন না নস্যি টানার মতো কোনো উপায় নেই আমার? এমন বিষয় নিয়ে তামাশা করার রুচি আপনার হচ্ছে কীভাবে! আপনি আর আপনার নস্যির নিকুচি করি।”

বলেই তিনি রাগে জ্বলতে জ্বলতে ব্যস্তসমস্তভাবে পত্রিকা অফিস থেকে বেরিয়ে ওয়ার্ড পুলিশ ইনসপেক্টরের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন। দুর্ভাগ্যবশত কোভালিয়েভ এমন সময় গিয়ে সেখানে উপস্হিত হলেন যখন পুলিশ বাবুটি হাই তুলে শরীরে মোচড়ামুচড়ি দিয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন এখন তার অন্তত দুই ঘন্টার ঘুম বিরতিতে যাওয়ার সময়। কাজেই এটা বলার অপেক্ষা রাখে না, মেজর কোভালিয়েভ পুলিশ বাবুর দর্শন লাভের জন্য বড্ড অসময়ে গিয়ে হাজির হয়েছিলেন। প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখা ভালো পুলিশ পরিদর্শক ভদ্রলোকটি ছিলেন শিল্পকলা এবং বাণিজ্যের এক মহান পৃষ্ঠপোষক, তবে ব্যাংক নোটের প্রতি ছিলো তার জন্মের দুর্বলতা।

“ওহ্ জিনিস বটে একটা!” পুলিশ বাবুটি ব্যাংক নোট সম্পর্কে প্রায়শ তার মুগ্ধতা ঝরাতেন ওভাবে, “এমন দারুণ জিনিস আর হয় না,  কোত্থাও এর তেমন মার খাওয়ার ভয় থাকে না, খাওয়া পরারও দরকার হয় না এর, জায়গাও লাগে অল্প,  সুট্ করে পকেটে এঁটে যায় দিব্যি, পড়ে গেলেও আস্তই থাকে।”

নিস্পৃহ গলায় পুলিশ পরিদর্শক কোভালিয়েভকে অভ্যর্থনা জানিয়ে বললেন, বিকেলটা কোনো ভাবেই তদন্তের জন্য সুবিধাজনক নয় ভায়া, স্বয়ং প্রকৃতিও চায় খাওয়াদাওয়ার পর লোকজন খানিক বিশ্রাম নিক(এই বক্তব্য শুনে কোভালিয়েভের বুঝতে দেরী হলো না প্রাচীন জ্ঞানীগুণীদের বাণী সম্পর্কে পুলিশটির ভালোই জ্ঞান আছে), তাছাড়া বললেও বিশ্বাস করবো না, কোনো বিশিষ্ট ভদ্রলোকের নাক কেউ খামোখাই ছিনিয়ে নিতে পারে।”

শেষের ইঙ্গিতটা এক্কেবারে সরাসরি কোভালিয়েভের উদ্দেশ্যেই ছুঁড়ে দেয়া। বলে নেয়া ভালো যে, কোভালিয়েভ ছিলেন অত্যন্ত সংবেদনশীল মানুষ। তাকে উদ্দেশ্য করে কেউ কিছু বললে তিনি সেটা ক্ষমার চোখে দেখতে সক্ষম, কিন্তু তার পদ বা খেতাব নিয়ে কারো কোনো রকমের ঠাট্টা বা তাচ্ছিল্য তিনি সহ্য করতে পারেন না। তিনি এটাও মনে করে যে, কোনো কৌতুকনাটকে নিম্ন পদমর্যাদার সৈন্যদের নিয়ে যা খুশি দেখানো যেতে পারে, কিন্তু উচ্চপদস্থের সম্মান নিয়ে কোনো আক্রমণই বরদাস্তযোগ্য নয়। পুলিশ বাবুটির অভ্যর্থনায় স্বভাবতই তিনি যারপরনাই মর্মাহত হলেন, মাথা ঝাঁকিয়ে গাঢ়স্বরে, হাতদুটো সামনে ছড়িয়ে দিয়ে বললেন, “আপনার এমন ন্যাক্কারজনক ব্যবহার আর মন্তব্যের পর আমার আর কিছু বলার নেই।” বলেই সঙ্গে সঙ্গে তিনি সেখান থেকে বেরিয়ে এলেন।

চলবে…

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত