অনিরুদ্ধ সরকার
চাকরি নেই, পেটে খাবার নেই থাকার জায়গা অবধি নেই… আছে দুচোখ ভরা স্বপ্ন। দেশ বিদেশ ঘোরার স্বপ্ন। অ্যাডভেঞ্চার করার অদম্য ইচ্ছে আর আসীম মনোবল। সেই মনোবল যখন একদিন ভেঙে গেল তখন মাদ্রাজের সমুদ্রতটে দাঁড়িয়ে আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছিল সেই আত্মঘাতী বাঙালি। তারপর! সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছে সেই বাঙালি যুবক, ঠিক তখনই দেবদূতের মত সেখানে হাজির হয়েছিলেন এক ফিরিঙ্গি সাহেব। তাঁর দুই নাতির দেখাশোনার কাজ দিলেন সেই বাঙালীকে। কিছুদিন সেই চাকরি করলেন তারপর সেই বাউণ্ডুলে যুবক ফিরে গেলেন কলকাতায়, নিজের কলেজের অধ্যক্ষ আটসন সাহেবের কাছে। বাউন্ডুলেপনার জন্য একদিন ছেড়েছিলেন ঘর-বাড়ি ।আর সেখান থেকে কীভাবেই তিনি হয়েছিলেন ব্রাজিলের মত একটা দেশের প্রথম বাঙালি লেফটেন্যান্ট, তাঁদের পদাতিক দলের প্রথম সার্জেন্ট এবং কীভাবে এই বীর রক্ষা করেছিলেন রিও-ডি-জেনেরো শহরকে। সে গল্প সত্যিই আশ্চর্যের। কে এই বাঙালি ? যার বুদ্ধিতে, বীরত্বে রক্ষা পেয়েছিল রিও ডি জেনেরো শহর। আর তাঁর নামের সঙ্গে জুড়ে গেছিল, ‘রিও ডি জেনেরোর রক্ষাকারী’ নামটি। এই বাঙালির নাম ‘সুরেশ বিশ্বাস’। যাকে নিয়ে খুব একটা আলোচনা হয় না বললেই চলে। অথচ শিশুসাহিত্যিক ময়ূখ চৌধুরী সুরেশ বিশ্বাসকে নায়ক করে লিখেছিলেন ‘বঙ্গদেশের রঙ্গ’, বনফুল লিখেছিলেন ‘বিশ্বাস মশাই’। সত্যজিৎ রায়ের ‘ছিন্নমস্তার অভিশাপ’, বিমল মুখার্জির ‘দু’চাকায় দুনিয়া’-তেও আমরা বাঙালি অভিযাত্রী সুরেশ বিশ্বাসকে খুঁজে পাই। ঘরপালানো বাউণ্ডুলে সুরেশ সুদূর ব্রাজিলে গিয়ে কীভাবে হয়ে উঠলেন বাঙালির বীর প্রতিনিধি সে গল্প কিন্তু বেশ আশ্চর্যের।
১৮৯৩ এর সেপ্টেম্বর রিও-ডি-জেনেইরো, ব্রাজিল। আমেরিকা তখন ভয়াবহ নৌবিদ্রোহে নাকাল। রাজধানী রিওকে ঘিরে একযোগে গোলা ছুঁড়ছে গোটা বিশেক যুদ্ধজাহাজ। থেমে থেমে গর্জে উঠছে উপকূলস্থ দুর্গ-কামান। বিদ্রোহীদের সাথে পাল্লা দিয়ে ব্রাজিলের সেনাও চালাচ্ছে পাল্টা আক্রমণ,বিদ্রোহীরা ততক্ষণে বুঝে গেছে, এভাবে সম্ভব নয়! পরিকল্পনা পাল্টে তারা নাথেরয় নামে শহরতলির দিকে অগ্রসর হল এবং সহজে দখলও নিয়ে নিল। এদিকে নাথেরয় রক্ষণের দায়িত্বে থাকা সেনাপতি বেশ চিন্তান্বিত কারণ, তাঁর হাতে তখন মাত্র পঞ্চাশজন সেনা। তিনি বুঝলেন এই সামান্য সেনা নিয়ে তিনি যুদ্ধ জিততে পারবেন না। চারিদিকে খোঁজ পড়ল। অবশেষে খোঁজ মিলল এক পরাক্রমশালী বাঙালির, নাম সুরেশচন্দ্র বিশ্বাস, লেফটেন্যান্ট সুরেশচন্দ্র বিশ্বাস! যিনি পঞ্চাশজন সৈন্য নিয়েই নাথেরয় পুনরুদ্ধার করলেন। দমন করলেন বিদ্রোহ।
আজ সেই অদ্বিতীয় সেনানায়ক, কিংবদন্তী বঙ্গবীর সুরেশচন্দ্র বিশ্বাসের গল্প। যাকে বাঙালি প্রায় ভুলতে বসেছে। গল্পের শুরু ১৮৬১ সালে, আজ থেকে প্রায় ১৫৮ বছর আগে। নদিয়ার নাথপুর গ্রামে জন্ম সুরেশের। পিতা গিরিশচন্দ্র বিশ্বাস ছিলেন সামান্য বেতনের সরকারি চাকুরে। শোনা যায়, সুরেশের পূর্বপুরুষেরা নীলবিদ্রোহে বেশ অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন। ছোটোবেলা থেকেই বেশ দুরন্ত ও ডাকাবুকো ছিল সুরেশ। রামায়ণ-মহাভারত আর ইতিহাসের বীরদের গল্প নিয়ে তার আগ্রহ ছিল অপরিসীম। নদিয়া থেকে কলকাতার বালিগঞ্জে থিতু হল সুরেশের পরিবার। সুরেশ ভর্তি হল লণ্ডন মিশন কলেজে কিন্তু পড়াশোনা! একেবারে মন নেই সেখানে। সারাদিন কাটে তাস পিটিয়ে আর বখাটেপনা করে। আর চোখে স্বপ্ন দেশ বিদেশ ঘোরার। যার উড়ু উড়ু মন তার কি আর ক্লাসরুমে মন বসে। তাস খেলে, আড্ডা দিয়ে রংবাজি করে ক্লাসে যাওয়ার কি আর সময় হয়। বাবা শুনলেন ছেলের বখাটে-বাউণ্ডুলেপনার কথা। ছেলেকে সুপথে আনার অনেক চেষ্টা করলেন বাবা। আর তাতে ছেলে বিগড়ালো বৈ শুধরালো না। কমলো না বাউণ্ডুলেপনা। অবশেষে একদিন বাবার ওপর অভিমান করে গৃহত্যাগী হল বাউণ্ডুলে সুরেশ। গ্রহণ করল খ্রিস্টধর্ম। বাড়ি ছাড়বার পর মাথার ওপর নতুন আশ্রয় হিসেবে সুরেশ পেল কলেজের অধ্যক্ষ মি.আটসনকে। কলেজ হোস্টেলে বিনা পয়সায়থাকা-খাওয়ার বন্দোবস্ত করে দিলেন অধ্যক্ষ আটসন সাহেব। বসে বসে স্বপ্ন দেখে তো আর দিন চলে না। সুরেশের পথ চলা শুরু হল। চাকরির চেষ্টা শুরু করল সুরেশ। সদাগরী অফিস, সরকারি অফিস, রেল, ডক, জেটি, মুটে-মজদুরি কোথাও যেতে বাদ দিল না সুরেশ কিন্তু ‘চাকরি মিলল না’। সব আশা ছেড়ে হতাশ হয়ে চুপ করে গেল সে যখন , তখন স্পেন্সেস হোটেলে ট্রাভেল গাইডের একটি চাকরি জুটল সুরেশের কপালে। কাজের সুবাদে অনেক ইউরোপীয় সাহেব-মেমদের সান্নিধ্যে আসার সুযোগ পেল সুরেশ। অবসর সময়ে বিভিন্ন বিখ্যাত পর্যটক ও অভিযাত্রীদের ভ্রমণকাহিনীও পড়তে শুরু করল সে। অবধারিতভাবেই বিলেতে পাড়ি জমানোর ইচ্ছা তার মাথায় চেপে বসল নেশার মতন কিন্তু বিলেত যাব বললেই তো আর যাওয়া যায় না! অবশেষে গতানুগতিক চাকরিতে ইস্তফা দিল সে আর চেপে বসল রেঙ্গুনগামী জাহাজে।
রেঙ্গুনে কাটল বেশ কিছুদিন। সেখানে বেশিদিন মন টিকিল না, সুরেশের পরবর্তী গন্তব্য ঠিক হল মাদ্রাজ। যেদিন রাতে মাদ্রাজ রওনা হবে সে, সেদিন সন্ধ্যায় শেষবারের মত রেঙ্গুনের পথে হাওয়া খেতে বের হয়েছে সুরেশ। হঠাৎ কোথা থেকে হৈ-হল্লা শুনতে পেলেন। সে গিয়ে দেখল আগুন লেগেছে একটি বাড়িতে, দোতলার জানালা থেকে ভেসে আসছে এক নারীর আর্ত-চিৎকার। নিজের প্রাণ বাজি রেখে সুরেশ বীরের মত রক্ষা করল সেই মগ রমণীর প্রাণ। সুরেশের বীরত্বে মুগ্ধ হয়ে মগ মেয়েটি ভালোবেসে ফেলল সুরেশকে। সুরেশও যে টান অনুভব করল না , এমনটা নয়। প্রেম হল, আনন্দ হল কিছুদিন যাওয়াও স্থগিত হল কিন্তু ভবঘুরে , ছন্নছাড়ার কি আর মন একজায়গায় টেকে। প্রেমের মায়া কাটিয়ে একদিন সুরেশ উঠে পড়ল মাদ্রাজগামী জাহাজে। এদিকে মাদ্রাজেও বেশীদিন মন টিকল না সুরেশের । বিশ্বভ্রমণের স্বপ্ন যে তাঁর। দেশ বিদেশ ঘুরতে হবে। চাকরি নেই, খাবার নেই স্বপ্ন তো আর পেট ভরে না। তাই একদিন সমুদ্রতটে দাঁড়িয়ে আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত যখন নিয়েই ফেলেছে সুরেশ, তখন এক ফিরিঙ্গি সাহেব এসে বাঁচাল সুরেশকে। দুই নাতিকে দেখাশোনার কাজ দিল সুরেশকে। কিছুদিন এই চাকরি করে সুরেশ ফিরে গেল কলকাতায় পুরনো কলেজের অধ্যক্ষ আটসন সাহেবের কাছে।
কলকাতায় মন টিকছে না। মনের মত চাকরিও পাচ্ছে না সে। সময় পেলেই বই পড়াতে সে ব্যস্ত। এদিকে মন তার পড়ে রয়েছে বন্দরে, সমুদ্রে। তাই সুযোগ পেলেই জেটিতে জেটিতে ঘুরে বেড়াতে শুরু করল সুরেশ। মদ খাইয়ে জাহাজীদের সাথে ভাব জমাতে শুরু করল সে, আর নানা দেশের গল্প শুনে তাঁর মন হারিয়ে যেতে লাগল আর এভাবেই দেখতে দেখতে একদিন বিলেত যাবার স্বপ্ন সত্যি হয়ে গেল তাঁর। বি. এস. এন কোম্পানির এক জাহাজের ক্যাপ্টেনকে পটিয়ে সহকারী স্টুয়ার্ডের চাকরি নিয়ে প্রায় ১৭ বছর বয়সে দেশ ছাড়ল সুরেশ। লণ্ডন পৌঁছেই বোসেন নামক এক জাহাজী বন্ধুর সাহায্যে ইস্ট অ্যাণ্ড পল্লীতে সস্তায় একটি ঘর ভাড়া নিল সে। যদিও, সেখানে বেশিদিন থাকা হল না তাঁর। চাকরি পাবার আগেই তাঁকে হতে হত গৃহহীন। অভাবের তাড়নায় সুরেশকে কখনও খবরের কাগজ বিক্রি করতে হল, কখনও বা মুটে-মজদুরের কাজ করতে হল। এরমধ্যে ঘটেছিল আবার এক প্রণয় কাহিনি। বিবাহিতা সেই নারীর প্রেম থেকে বাঁচতে শহরটাই অবশেষে ছেড়ে দিল সুরেশ। তারপর ফেরিওয়ালার জীবন। ইংল্যাণ্ডের পল্লী গ্রামে গ্রামে গাঁয়ে হরেক রকম জিনিস ফেরি করতে লাগল সুরেশ। আর ফেরি করার ফাঁকে ফাঁকে গণিত, জ্যোতিষ, রসায়ন ইত্যাদি নানা বিষয়ে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে লাগল সে।
ঘুরতে ঘুরতে একদিন সে পৌঁছে গেল কেন্ট প্রদেশে। সেখানে এক সার্কাস দল খেলা দেখাচ্ছিল। সুরেশের তখন সাধ হল, সার্কাস দলে নাম লেখাবে। যেমন ভাবা, তেমন কাজ। সার্কাস দলের সবচেয়ে শক্তিশালী পালোয়ানকে দশ মিনিটে ধরাশায়ী করে সার্কাসে চাকরি পেয়ে গেল সুরেশ। বেতন নির্ধারিত হল সপ্তাহে ১৫ শিলিং। হিংস্র পশু বশ করা এবং বাঘ-সিংহের খেলা দেখানোয় অল্প সময়েই বেশ পারদর্শিতা অর্জন করে ফেলল সুরেশ। এদিকে সার্কাস দলেও প্রেম হানা দিল সুরশের কাছে। যথারীতি সেখানেও প্রত্যাখ্যানের সেই একই গল্প। সার্কাস দলেরই এক জার্মান সুন্দরীর প্রেমনিবেদনেও মন গলল না এই বাঙালি বীরের। ততদিনে বিশ পেরিয়ে একুশে পা দিয়েছে আমাদের বাউণ্ডুলে বীর সুরেশ। ওই বয়সেই বাঘ-সিংহের খেলা দেখিয়ে ব্রিটেন থেকে নিজের খ্যাতিকে বিস্তৃত করে ফেলেছে সে বিশ্বজুড়ে। তারপর জার্মানির হামবুর্গে বিশিষ্ট পশুপ্রশিক্ষক গাজেনবার্ক সাহেবের পশুশালায় মোটা বেতনের চাকরি পেল সুরেশ । সেখানে ‘ফ্যানি’ নামের একটি বাঘকে শৈশব থেকে প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করে সে। বাঘটি সুরেশের কাছে কুকুরের চেয়েও অনুগত হয়ে ওঠে অল্পদিনেই। সেখানে একটি হাতিকেও অল্পদিনেই পোষ মানিয়ে ফেলে সে। পশুপ্রশিক্ষণে ক্রমেই অদ্বিতীয় হয়ে উঠতে লাগল সুরেশ। তাঁর প্রশিক্ষিত পশু চড়া দামে বিক্রি হতে লাগল বাজারে। ভাগ্যের ফেরে হঠাৎই একদিন সার্কাসের সেই জার্মান যুবতীর সাথে দেখা হয়ে গেল সুরেশের! অতৃপ্ত অবেগ নিয়ে আবার সুরেশের ঘনিষ্ঠ হল সে। এবার সুরেশ আর না বলল না। কিন্তু ভাগ্যের ফের! সেই জার্মান তরুণীর একাধিক প্রেমিক সুরেশকে হত্যার জন্য আততায়ী নিযুক্ত করল। হামলায় সুরেশ বাঁচল এক-দুবার। অবশেষে প্রাণ বাঁচাতে একরকম বাধ্য হয়েই এক সার্কাস দলের সাথে সে পাড়ি দিল আমেরিকায়। সেখানে নানা জায়গায় খেলা দেখিয়ে ১৮৮৫ সালে মেক্সিকো হয়ে ব্রাজিলে পৌঁছে গেল সে। এর আগে আগে কোনো বাঙালি ব্রাজিলের ওই অঞ্চলে পা রাখেনি। আর এখান থেকেই গল্প নিল আলাদা একটা মোড়।
নন অ্যাকাডেমিক সুরেশে ততদিনে ইংরেজির পাশাপাশি পর্তুগিজ ভাষাসহ সাতটি ভাষায় যথেষ্ট দক্ষ। ব্রাজিলের প্রাকৃতিক শোভায় মুগ্ধ হয়ে সেখানেই বসবাস করার সিদ্ধান্ত নিল বাউণ্ডুলে সুরেশ। সেখানকার রাজকীয় পশুশালায় একটি চাকরিও জুটিয়ে নিল সে। আর সেখানে চাকরিরত অবস্থায় সে গ্রিক ও ল্যাটিন সাহিত্য, গণিত, দর্শন, রসায়ন ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে বিস্তর চর্চা শুরু করল । ‘লা ক্রনিকা’ পত্রিকা থেকে জানা যায়, সুরেশ আমেরিকার বিভিন্ন জায়গায় বিবিধ বিষয়ের ওপর বক্তৃতা দেওয়া শুরু করে সেসময়। এই সময়েই ডেসডিমোনা নামে এক স্থানীয় চিকিৎসকের মেয়ের প্রেমে পড়ে সুরেশ। আর সেখানেই বাউণ্ডুলে জীবনে অবশেষে একটু থিতু হয় সুরেশ। বিয়ে হয় সুরেশের সাথে ডেসডিমোনার। আর ডেসডিমোনার অনুপ্রেরণাতেই সেদেশের সৈন্যদলে যোগ দেয় বাঙালি যুবক সুরেশ। ১৮৮৭ সালে কর্পোরাল, পরবর্তীতে পদাতিক দলের প্রথম সার্জেন্ট এবং ১৮৯৩ সালে প্রথম লেফটান্যান্ট পদে উন্নীত হন আমাদের সুরেশ। ঘরপালানো বাউণ্ডুলে সুরেশ সারা বিশ্বে স্থাপন করেছিলেন তাঁর অমর কীর্তি, সুদূর ব্রাজিলে তিনি হয়ে উঠলেন বাঙালির বীর প্রতিনিধি, ‘রিও ডি জেনেরোর রক্ষাকারী।’