| 19 এপ্রিল 2024
Categories
প্রবন্ধ সাহিত্য

তারা খোঁজার গল্প

আনুমানিক পঠনকাল: 8 মিনিট

খুব ছোটবেলায় বয়সের তুলনায় ভারি একটা বই পড়তে গিয়ে পড়ে গেলাম একটা মহা ঝামেলায়। তখন সব ধরনের বই পড়া নিষেধ। কিন্তু আমি একদিন সুযোগ বুঝে বই এর আলামারি ঘেটে বের করলাম শহীদুল্লাহ কায়সারের উপন্যাস ‘সংশপ্তক’। ওখানে একটা শব্দ আছে – ‘ছেনালী মাগী’ – গ্রামে সালিশ বসেছে, সেখানে হুরমতিকে গালাগাল করা হচ্ছে। আমি শব্দটির অর্থ বুঝতে পারছি না। অথচ মনের ভেতর অজানা শব্দের অচিন অর্থ আমাকে খুঁচিয়ে মারছে – ‘আমাকে খুঁজে বের কর’। কোনও পথ খুঁজে না পেয়ে অবশেষে ভয়ে ভয়ে, কিন্তু নির্ভরযোগ্য ভেবে গেলাম সেজভাই’র কাছে। বড় তিন ভাই’র মধ্যে ছোট বলে সেজ ভাইকে আমরা ছোট ভাইয়া বলে ডাকতাম।
– ছোট ভাইয়া, ‘ছেনালী মাগী’ মানে কি?
– খানিকটা বিব্রত হয়ে ভাইয়া প্রশ্ন করে, ’এ শব্দ তুমি কোথায় পেলে?’
আমি তাতে আরো ভয় পেয়ে চুপ করে থাকি। ফের প্রশ্ন,
– তুমি কি এসব শব্দ কোন বন্ধুর কাছ থেকে শিখেছ?
আমি তখন কিছুটা আন্তাজ করতে পেরে গেছি, ঘটনা খুব একটা ভালো কিছু ঘটবেনা ।
– না, মানে একটা বইতে, আমি মাথা চুলকাই।
– কী বই? নাম কি?
– সংশপ্তক। খানিকটা আশার আলো দেখতে পাই। আমি বইটার নাম বলি।
– বইটা নিয়ে এসো।
আমি এক দৌড়ে বইটা নিয়ে আসি এবং ভাইয়া যতক্ষণ বই এর পাতা উল্টায় ততক্ষণ রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করি। কিছু পাতা এদিক সেদিক উল্টিয়ে বই এর পাতা থেকে চোখ তোলে ভাইয়া। বুঝতে পারি বইটা ভাইয়ার পড়া নয়। পাতা উল্টিয়ে কিছুটা ধারণা নেয় সে বইটার বিষয়ে,
-এসব বড়দের বই তুমি আর পড়বে না। যে সব বই তোমার পড়ার উপযোগী সেসব বই তোমাকে তো পড়তে দেয়াই হয়, হয় না?
আমি মাথা নিচু করে চোখের জল লুকাই। বইটা ভাইয়া নিজের কাছে রেখে দেয়।
খুব ছোটবেলায় যখন ছেলেমেয়েরা বই এর পাতার চেয়ে রঙিন প্রজাপতির পেছনে ছুটতে পছন্দ করে বেশি, তখন আমার বই এর সাথে প্রগাঢ় বন্ধুত্ব। কারণটা আমার মা। যে কোন জন্মদিনে আমি মায়ের কাছে বই উপহার পেতাম। তাও একটা দুটো নয়। একসাথে অনেকগুলো প্রায় ছটা সাতটা রঙবেরঙের ছবি আঁকা কখনো দেশি রূপকথার গল্প, কখনো বিদেশী নানা রূপকথার গল্প। এই করে করে খুব ছোটবেলাতেই মা আমার পাঠাভ্যাস তৈরি করে দিয়েছিলেন। তাছাড়া তিনি নিজে এমন বিভোর হয়ে তিনি বই পড়তেন, আমার ধারণা ছিল ঐসব বই ভরা নিশ্চিত এমন সব মজার গল্প আমি যেগুলো পড়ি তারচেয়েও সেগুলো মজাদার তা না হলে মা কেন একটু সময় পেলেই বই নিয়ে বসেন। বইগুলো কত মোটা আর ভারি ভারি। আমার বইগুলো তো সব অল্পতেই শেষ হয়ে যায়। আমার ছোট্ট মনে তখন রাক্ষস পরি দেও দানো এসব নিয়ে খুব আগ্রহ। আর সারাক্ষণ ভীষণ উৎকন্ঠিত থাকি কখন মার মত মোটা মোটা আর ভারি ভারি বই পড়বো। এমনি সময় স্কুলে যাবার পথে ফুল বাবার অফিসের ফুলবাগান থেকে ফুল চুরি করে ঘাসের বিছানায় লুকিয়ে রেখে রাস্তা পার হবার সময় পাখির বাইকের ধাক্কায় আমি ছিটকে পড়ি দূরে। নাক দিয়ে গলগল করে রক্তছোটে। আর পাখি আমাকে বাঁচানোর চেষ্টায় র্হাড ব্রেক করতে গিয়ে উল্টে পড়ে রাস্তার পাশে স্তুপীকৃত ইটের খোঁয়ায়। বেচারার হাঁটুতে ইটের খোঁয়ার কণা ঢুকে পড়ে। বেশ কিছুদিন পর সুস্থ হয়ে সে আমাকে দেখতে আসে। আমি তখন একেবারে বিছানায়। শুয়ে শুয়ে বই পড়ি। ক্লাস ফোর তখন আমার। মা আমাকে ধরিয়ে দিলেন – দ্য প্রিন্স এন্ড দ্য পপার-আ টেল অব টু সিটিজ – শীত বসন্ত, ঠাকুমার ঝুলির পর একটু অন্যরকম বিদেশী গল্প। এমনি করে দিন কাটে আমার। সপ্তাহ দুই এর মধ্যে ভালো হয়েই বিছানা ছাড়ি। আবার স্কুল। বনে গাছ বাওয়া। বড় ভাই এর সাথে পুকুরে-উঁচু থেকে ডাইভ, বাটার ফ্লাই আর ব্যাক স্ট্রোক প্র্যাকটিস। পুকুর পাড়ি দেওয়া – নিত্য দিনের চর্চা আবার শুরু। বই এর তৃষ্ণাও বাড়ে সাথে সাথে আরও। বড় হতে থাকি। পড়ি ‘তিন গোয়েন্দা’, মনে তখন লাগাম ছাড়া ক্ষ্যাপা ঘোড়ার মত বই এর নেশা। বই পেলেই পড়ি, পরীক্ষা থাকলে লুকিয়ে পড়ি। বাথরুমে গোসলের নামে প্রায় ঘন্টা খানেক ব্যয় করি। বই পড়ি শাওয়ারটা ছেড়ে দিয়ে। শেষে জোরচিৎকার শুরু হলে কোনমতে গোসল সেরে বের হয়ে আসি। ক্লাসরুমে পাঠ্য বই এর নিচে রেখে বই পড়ি আর স্যার আমার দিকে তাকালেই এমন ভাব করি যে, আমার মত সুবোধ ছাত্রিটি আর নেই।
এরই মাঝে আমি পেয়ে গেলাম বই পড়ার আইনগত সুযোগ। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র প্রথমবারের মত আয়োজন করেছে ‘বই পড়া প্রতিযোগিতা’- আমার তখন ক্লাস সেভেন। একের পর এক পড়ে ফেললাম মার্চেন্ট অব ভেনিস, টলষ্টয়ের সেরা গল্প, রবিনসব ক্রুশো, অদৃশ্য মানব ইত্যাদি বই। আমি তখন দিগ্বিজয়ের স্বপ্নে বিভোর। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বেলজিয়ামের এক নারী কি অসামান্য ক্ষিপ্রতায় আর বুদ্ধিতে একের পর এক শত্রুর হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করে দেশের জন্য গুপ্তচরের কাজ করে যাচ্ছেন, কী অদ্ভুত দৃঢ়তায় নির্জন মানব বাস অযোগ্য স্থানে দিনের পর দিন বেঁচে আছেন রবিনসন ক্রুশো আমি এসব ভাবতে ভাবতে অবাক হই। আর নিজেকেও ও রকম ভাবতে ভাবতে হারিয়ে যাই কোন সুদূর অরণ্যে। তারপর একসময়ে জেগে উঠি স্বপ্নহরণের যাতনা নিয়ে।
এমন সময় বই পড়ার পথ বাঁক নিল। এক বন্ধু হাতে ধরিয়ে দিল ‘মাসুদ রানা’। আমার মা আর আমি পাল্লা দিয়ে পড়ি সিরিজ ‘দস্যু বনহুর ‘ (রোমেনা আফাজ)। এই সিরিয়ালের ভুত মাথা থেকে নামে না। একটা পর্ব প্রকাশিত হয় বই আকারে। তারও মাস খানেক পর মা বইয়ের দোকানে যান। সাথে আমি।
-পরের পর্বটি এসেছে?
-না আসে নি।
আমার মায়ের মন খারাপ। আমি তার মুখের দিকে তাকাই। বুঝি। এই সময়ে বইটি কিনতে না পারলে সরকারি চাকুরে স্বামীর সংসারে ছয়টি ছেলেমেয়ে নিচে সংসার চালিয়ে বইয়ের টাকাটা আর হাতে থাকবে না তার। খরচ হয়ে যাবে। তাই হয়। পরের মাসে মা আর পারেন না। তার পরের মাসে আবার বইয়ের দোকানে।
-দস্যু বনহুর পরের পর্বটি এসেছে?
-হুম।
-দিন দিন, আমাকে দিন।
মায়ের মুখ উজ্জ্বল। গোধুলির আলোর মতো নরম আর সুন্দর।
আমার মাথায় তখন খেলছে আরও আরও বই কি করে পাওয়া যায়। মাঝে মাঝে কারো কাছে থেকে বই এনে ফেরত দেবার ভদ্রতাটুকু ঝেড়ে ফেলি। বাড়িতে যে সব বই আছে ‘মানে আমার পড়ার, সেগুলো শেষ’। আমার নেশা মোটা ভারী বই – মা যেগুলো পড়েন। কিন্ত এসব ধরা নিষেধ। চুরি করে পড়তে হবে। আমি সুযোগ খুঁজতে থাকি। কখন মা বই এর নেশায় মাতাল হবেন। সুযোগ পাওয়া গেল একদিন। আমি আলমারি খুলে বের করি মোটা বই ‘সংশপ্তক’। তারপর একটা শব্দের অর্থ খুঁজতে গিয়ে বইটা কী করে নাগালের বাইরে গেল তা তো আগেই বলেছি। আমার মাথায় জেদ চেপে গেল। আমি ভাবি কি উপায়, কি উপায়। বই এর দোকানে ঢু মারি আর খুঁজে দেখি ইপ্সিত বই আড়চোখে – কারন সাথে মা না হয় কেউ না কউ কেউ থাকে। আমি তখন বুঝে গেছি নিষিদ্ধ বই এর নাম উচ্চারণ করে আর কোন লাভ নেই। মনে মনে ভাবি বড় হয়ে একটা বই এর দোকান দেব। আবার ভাবি কি করে একটা বুকষ্টলের সাথে খাতির করা যায়। ছোট্ট মাথায় আর কিছু আসে না। ধীরে ধীরে একদিন শংসপ্তক এর শোক ভুলে যেতে থাকি।
তখন ’কিশোর বাংলা’ পত্রিকা বের হচ্ছে। আমাদের বাসায় দৈনিক সংবাদ পত্র ‘ইত্তেফাকে’র সাথে প্রায় সবগুলো সাপ্তাহিক আসতো। বিচিত্রা, সচিত্র স্বদেশ, বেগম, কিশোর বাঙলা এমনকি সিনেমার পত্রিকা চিত্রালী, পূর্বাণী। আমার মা বুভুক্ষের মতো সবগুলো পত্রিকা পড়তেন। আমিও মা’র ধারা পেয়ে গেলাম। যদিও অন্য ভাইবোনরা কেউ মায়ের এই ধারায় মিশতে পারলোনা। যা হোক তখন কিশোর বাংলাতেই পড়লাম ‘দীপু নাম্বার টু’। বই এর আলমারিতে পেলাম অনেকদিনের একটা পুরানো বই – কপোট্রনিক সুখ দুঃখ (জাফর ইকবাল)। তখন ক্লাস এইট। আস্তে আস্তে পারমিশন পাচ্ছি আর একটু বড়দের বই পড়বার। মা পড়তে দিলেন ইন্দিরা নেহেরুর চিঠি ‘মা মনিকে বাবা’। পড়তে শুরু করলাম এরিক মারিয়া রে মার্কের – অল কোয়ায়েট অন দ্যা ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট – আনা কারেনিনা – ম্যাক্সিম গোর্কি (মা) – লাস্ট ডেস অব পম্পেই । এস এস সি তে চমৎকার রেজাল্ট করে স্কলারশিপ নিয়ে কলেজে ভর্তি হলাম। সব বই পড়ার অবাধ সুযোগ এল। মা বললেন ’পড়াশোনা আর রেজাল্ট ভালো চাই। দু’টোই ঠিক রেখে যে কোন বই পড় কোন অসুবিধে নেই।
পড়ে ফেললাম মার্থা মেকেনার (আমি গুপ্তচর-অনুবাদ) – আগাথা ক্রিশ্টির (অনন্ত রাত্রি – অনুবাদ)- এলেচি আমাদি (নিঃসঙ্গ-অনুবাদ)- ম্যাক্সিম গোর্কি (অনুবাদ-মা), নিকোলাই গোগল, বেশ খানিকটা সেক্সপিয়ার – দেবদাস – গৃহদাহ – পরিণীতা -শেষের পরিচয়-দেনাপাওনা-দত্তা আরও শরৎচন্দ্র যা যা হাতের কাছে পেয়েছি কিংবা মায়ের কালেকশনে ছিল। পড়েছি রবীন্দ্রনাথ-বিভূতিভূষন-বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়-মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় – নজরুল -জহির রায়হান – জাহানারা ঈমাম (একাত্তরের দিনগুলি) – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় (দূরবীন, মানবজমিন, পিদিমের আলো) -মহাশ্বেতা দেবী (অরন্যের অধিকার)- অনেক বই এর অনেক কিছুই তখন বুঝিনি কিন্তু পড়েছি। আবার কোন কোন বই তখন পড়েছি একরকম ভেবেছি, ৫/৭ বছর পর যখন পড়েছি তখন আবার অন্য রকম অনুভব। আরও কত কত বই। অনেক বই এর নাম এখন আর মনে নেই বা লেখকের নামও। এইচ এস সি তে আবারও দূর্দান্ত রেজাল্ট করে ঢাকা ইউনিভার্সিটি। চলে এলাম বিশাল এক উদার পরিবেশে। বাংলাদেশ কুয়েত মৈত্রী হল হলো দ্বিতীয় ঘর। প্রতিদিন সেখান থেকে বিকেলের দিকে চলে যাই টি এস সি তে। কবিতা আবৃত্তির গ্রুপ। চলে ঘন্টার পর ঘন্টার কবিতা আবৃত্তি রিহার্সেল। কত কত কবিতা যে পড়েছি তখন আর কত কত যে কবওতার ডিসেশন! একদিন এক বড় ভাই আড্ডায় বই পড়া নিয়ে কথা বলছেন,
– বই শুধু পড়লেই হবে না। তোমাকে চর্চা রাখতে হবে।
– মানে কি? এক বই বার বার পড়তে থাকবো?
– দূর বোকা, তা নয়। পড়া বই গুলো নিয়ে অন্যান্যদের সাথে আলোচনা করতে হবে। দেখবে একই ঘটনার কত রকম ব্যাখ্যা তুমি জানতে পারবে।
বুদ্ধিটা ভালোলাগলো। শুরু হলো চর্চা।
– আচ্ছা রুনা, অমুক বইটা কি তুই পড়েছিস?
– কী নাম বললি? এ নাম জীবনে শুনিনি।
আর একজনের সাথে
-পারু ঐ বইটাতো তোর পড়া, শোন..
-কি শুরু করলি তুই!
বিরক্ত হয় সকলেই। পড়া বই নিয়ে আলোচনা ফলপ্রসু হলো না। কার সাথে আলোচনা করবো?
বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় কোন ছুটিতে আমি বই সংক্রান্ত আলোচনায় ফিরে যাই পূনরায় মার কাছে। সরকারি চাকুরে বাবার চাকরির টাকা থেকে মাস শেষে কিছু জমলে যে মা গয়না নয়, কিনতে যেত বই, আমাকেই নিয়ে। মা খুব মজা পান আমার বই নিয়ে আলোচনায়। অনেক কিছু বুঝিয়ে দেন না বুঝলে। মায়ের সাথে আমার তখন নানা বই নিয়ে দারুণ আড্ডা গল্প আলোচনা পর্যালোচনা।
আর যখন ঢাকায় থাকি। কখনও টি এস সির প্রাচীর ঘিরে সালাম মামার চায়ের দোকান ঘেঁষে আড্ডা। তখন ওকাদার (বর্তমান সরকারের মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, তাকে আমরা এই নামেই ডাকতাম) সাথে দারুণ আড্ডা হতো। আড্ডায় থাকতেন, শ্রদ্ধেয় সদ্য প্রয়াত নিশাত আপা (ইশরাত নিশাত-দেশ নাটক) শিমুল মোস্তাফা (আবৃত্তিকার-বৈকুন্ঠ আবৃত্তি একাডেমী), মাহিদুল ইসলাম (আবৃত্তিকার-¯স্রোত আবৃত্তি সংসদ), হাসান আরিফ (আবৃত্তিকার – স্বরশ্রুতি), আহকাম ভাই (আবৃত্তিকার) পাপ্পুদা (আবৃত্তিকার) এমনকি শাকিল ভাইও ( প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব (প্রয়াত)- মাহবুব শাকিল)। নানারকম জম্পেস আড্ডা দিনে দিনে করেছে ঋদ্ধ। টি এস সি তে আড্ডার সুবাদে পরিচয় হল এক বই চোরের সাথে। একটু আগে থেকে বলি। যারা বই পড়েন এমন মানুষদের সাথে আমার বেশি বন্ধুত্ব হয় বরাবর। তাদের আমি খুব সম্মানও করি। বন্ধুত্বের পরিসরও হতে লাগলো ধীরে ধীরে বিস্তৃত। দশ জন বন্ধুর মধ্যে আমার ৫/৬ জন বন্ধুই পড়ুয়া, তারা যেমন পড়েন, আলোচনা করেন তেমনি উৎসাহও দেন প্রচুর। আমার একজন সিনিয়র বন্ধু ‘বইচোর’ – মিল্টন সুরঞ্জিত রত্ন। খুব রসিক মানুষ। সারা দিনের কাজ সেরে সবাই বিকেলে আমরা পৌঁছে যাই টি এস সি তে। একদিন জানতে পেলাম তিনি ছিলেন বিখ্যাত বইচোর।
– অমুক বইটা আমার খুব দরকার, এত দাম কিনতে পারছি না, দাদা।
– কিনবে কি করে, ছাত্রজীবন, এত দামী বই কেনার টাকা পাবে কোথায়। চুরি করে ফেল। (তার সোজা সমাধান)
-কি বলছেন মিল্টনদা। বইটা চুরি করে ফেলবো?
– ওমা কিনতে পারছ না, বইটা তোমার দরকার। চুরি করা ছাড়া কি করতে পার তুমি? আমি কত বই চুরি করেছি।
বিষ্ময়ে অবাক হয়ে আমি প্রশ্ন করি
– আপনি বই চুরি করতেন?
– হ্যা, বই চুরি করতাম।
আমি ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকি।
-এমন করে তাকিয়ে আছ কেন? আমি কি অপরাধপ্রবণ মন নিয়ে চুরি করতাম নাকি?
বই কিনতে পারিনা বলে বই চুরি করতাম।
– তাই বলে চুরি?
– কেন নয়, আমি তো কোন খারাপ কাজ করছি না। আমার টাকা নেই। কিন্তু বইটা দরকার। এর থেকে আমি একটা জ্ঞান অন্বেষনের জন্য করছি। কোন খারাপ কাজ নয়।
– কোন অপরাধ বোধ নেই এজন্য?
– না, তুমি জানোনা, ফুল আর বই চুরিতে কোন অপরাধ নেই ? ডঃ মোঃ শহীদুল্লাহকে একবার লাইব্রেরিয়ান অভিযোগ করেছিলেন ছাত্ররা বই চুরি করে নিয়ে যায়। কখনো বইয়ের পাতাও কেটে নিয়ে যায়। তিনি তখন সেই লাইব্রেরিয়ানের অভিযোগের উত্তরে বলেছিলেন
-‘করুকনা, চুরি করুক, তবু যদি বইগুলো পড়ে ছেলেমেয়েরা।’
মিল্টনদা আমাকে প্রশ্ন করলেন,
– তুমি কি মনে কর না বই এর পাতা কেটে নেবার চেয়ে সবটা বই চুরি করে নিয়ে যাওয়া অনেক ভালো? আমি তো তাদের তুলনায় ভালো।
অকাট্য যুক্তিকে আমি আর তুচ্ছ করতে পারি না। মাথা ঝাঁকাই;
– তা অবশ্য
-শোন একবার কি হল, আমার দরকার ‘এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা’। এ বই তখন আমার পক্ষে কেনা দুঃসাধ্য। আমি আমার চেয়ে অনেক বড় মাপের একটা পুলওভার কিনলাম। সেটা পরে এক শীতের দিনে ঢুকে গেলাম লাইব্রেরিতে আর অনায়াসে চুরি চারদিনে চারখন্ড চুরি করে বের হলাম ।
– যদি ধরা পড়তেন?
– রাগ হতো নিজের ওপর, চুরির কাজটাও ঠিকমত করতে পারিনি বলে। তবে এখন আমি বই কিনতে পারি, তাই আর চুরি করি না।
– কিছু কিছু মানুষের ঘরে দেখবে আভিজাত্যের জৌলুষ চোখ ধাঁধিয়ে দেয়, বই এর আলমারিকে তারা সেই জৌলুষ বাড়ানোর উপকরণ মনে করেন। যত বই আছে তাদের আলমারিতে তার কটা বই পড়েছেন তিনি নিজেও বলতে পারবেন না। তাদের আলমারি থেকেও বই চুরি করা জায়েজ মনে করি আমি।
বলে আকাশ বাতাস প্রকম্পিত করে হাসেন,
-হা হা হা।
যা হোক এরকম একজন বইচোর বন্ধু পেয়ে আমি মোটেও হতাশ নই।
আগেই লিখতাম কিছু কিছু। বই পড়তে পড়তে একসময় লেখার নেশা হয়ে উঠল প্রবল। দিন নেই রাত নেই লিখছি, বইও পড়ছি তার চেয়ে বেশি। একদিন ’পার্থিব’ পড়ছি – কৃষ্ণজীবনের ভাবনা এমন – যে নক্ষত্রগুলো আমরা এখন আকাশে দেখতে পাই তারা কয়েককোটি বছর আগেই মরে যাওয়া। আস্তে আস্তে আগ্রহ বাড়তে শুরু করে গ্রহ নক্ষত্রের প্রতি। মহাকাশ নিয়ে শুরু হয়ে গেছে নতুন বিস্ময়-অপরিচিত শব্দের অর্থ যেভাবে খুঁজতে শুরু করেছিলাম, চোখে দুরবীন লাগিয়ে তেমনি খুঁজে ফিরছি তখন আকাশের তারা তাদের গতি প্রকৃতি।

পাঠক, বই আর বইপড়া নিয়ে আছে আরও কত কত যে গল্প। জীবনের সত্যি। বাকি আর যা কিছু বলবো অন্য আরও কোন লেখায়।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত