| 20 এপ্রিল 2024
Categories
অনুবাদ অনুবাদিত গল্প

আফগানিস্তানের ছোটগল্প : পেশা । মোহাম্মদ আসেফ সোলতানজাদে

আনুমানিক পঠনকাল: 12 মিনিট

ঠিক সাতটা বেজে দশ মিনিট।

যুবকটি ঘড়ির উপর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আনে। প্রত্যেকদিন সকালের মতো আজো সে ধোপদুরস্ত পোশাক পড়েছে এবং তার হাতে ব্রিফকেস। অফিসে যাবার জন্য সে তৈরি হয়েছে। ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার আগে সে আরেকবার প্রশান্ত চোখে ঘরের চারপাশ দেখে নিল। এই ঘরটা তার কাছে সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয়। কিন্তু আচমকা সেই পুরনো চিন্তাটা তার মস্তিষ্কের ভেতর জেগে ওঠে। সে কি আবার ফিরে আসতে পারবে এই ঘরে? সঙ্গে সঙ্গে তার বুকের ভেতর দারুণ কষ্টের এক চিনচিনে ব্যথা মোচড় দিয়ে ওঠে। সাবধানে সে ঘরের দরজা বন্ধ করে এবং ধীর পায়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে থাকে। সেই সময় সে ভাবতে থাকে যদি কেউ জিজ্ঞেস করে তুমি কখন ঘর থেকে বেরিয়েছ, তখন সে কি বলবে?

আজ গেটের কাছে নির্দিষ্ট জায়গায় বুড়ো দারোয়ান নেই। কিন্তু গেটের কাছে চেয়ারে বসে বুড়োর বিড়ালটা আলস্যে আড়মোড়া ভাঙে। সিঁড়িতে পায়ের আওয়াজ পেয়ে বিড়ালটা ঘুম জড়ানো চোখ মেলে বিরক্তির সঙ্গে যুবকটির দিকে তাকায়।

প্যান্টের পকেটে যুবকটির হাত ঢোকানো। বিড়ালকে উদ্দেশ্য করে সে বললো, ‘আজ তোর জন্য কিছুই নেই।’

দেয়ালে ঝুলানো ঘড়িটা টিক টিক করে বেজে চলেছে। গেটের কাছে বুড়ো দারোয়ান নেই। তাই সে যুবকটিকে জিজ্ঞেস করতে পারছে না, এখন ক’টা বাজে। যাকগে, পরে বুড়ো দারোয়ান রাস্তার মোড়ের দোকানদারকে জিজ্ঞেস করে সময় জেনে নেবে।

যুবকটি যখন রাস্তায় পা রাখে, তখন তার মনে হল কেউ যেন আড়চোখে তাকিয়ে তাকে দেখছে এবং তখন সে নিজেকে রীতিমত বস্ত্রহীন ভাবল। দোকানের কাছে পৌঁছে সে শার্টের আস্তিনের ভেতর হাতঘড়ি আড়াল করে অন্য দিনের মতো উচ্চ কণ্ঠে দোকানীকে জিজ্ঞেস করলো, ‘এখন ক’টা বাজে?’

‘একটা ঘড়ি কিনে নিন,’ সন্দেহের দৃষ্টিতে দোকানী বিরক্তির সঙ্গে বিড়বিড় করে বললো।

‘আমি জানতে চাই আসলে কখন আমি ঘর থেকে বেরিয়েছি, যেন…’ কথাটা অসম্পূর্ণ রেখেই সে এক পলক হাসলো।

সতর্ক চোখে তাকিয়ে দোকানী বললো, ‘আপনি কখন ঘর থেকে বেরিয়েছেন, তাতে আমার কি?’

‘অফিসে যাচ্ছি। তাই জানতে চেয়েছি এখন সময় কত।’

‘সোয়া সাতটা বাজে।’

‘না, সাতটা বেজে তের মিনিট।’

‘আপনি যদি সময় জানেন, তাহলে অযথা জিজ্ঞেস করছেন কেন?’

‘মনে রাখার জন্য।’

দোকানীর প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য যুবকটি অপেক্ষা না করে অফিসের দিকে পা বাড়ায়। এখন সে কিছুটা ভারমুক্ত। তবুও সে মনে মনে ভাবতে থাকে যদি ওরা জিজ্ঞেস করে, কখন তুমি ঘর থেকে বেরিয়েছ? যাক, নিদেন হলেও একজন তো সাক্ষী থাকল। কিন্তু যদি কেউ জানতে চায়, দোকানীকে তুমি কি বলেছ? তাহলে সে কি বলবে? জবাবে সে বলবে, সে দোকানীকে সময় জিজ্ঞেস করেছে। তোমার কি কোন ঘড়ি নেই? তার হাতঘড়ি আছে, কিন্তু…। কিন্তু কি? হয়তো তুমি দোকানীর সঙ্গে অন্য বিষয়ে আলাপ করছিলে? ওর সঙ্গে তোমার কিসের সম্পর্ক?

সেই মুহূর্তে নিঃশব্দে যুবকটির মনের ভেতর একধরনের ভয় ঢোকে। তখন সে মাথার উপর হেলিকপ্টারের বিকট শব্দ শুনতে পেল। সে আকাশের দিকে মাথা তুলে হেলিকপ্টার দেখতে চাইল, কিন্তু কিছুই দেখতে পেল না। হয়তো ইতিমধ্যে ওটা চলে গেছে, নতুবা অদৃশ্য হয়ে যাবার পর শুধু ইথারে আওয়াজটাই রয়ে গেছে। একটা বাড়ির তিন তলার জানালায় তার দৃষ্টি আটকে যায়। জানালার পেছন থেকে কোন এক নারী কিংবা তরুণীর অদৃশ্য ছায়া রাস্তার দিকে পলকহীন তাকিয়ে আছে। মনে মনে যুবকটি ভাবল, অবশ্যই সে যুবতী এবং লাল পোশাকে তাকে অপূর্ব সুন্দর দেখাচ্ছে।

যদি কেউ তাকে জিজ্ঞেস করে, কেন তুমি জানালার দিকে তাকিয়েছিলে? তখন সে কি জবাব দেবে? অই নারী বা তরুণীর সঙ্গে তোমার কিসের সম্পর্ক? তুমি কি ওকে চেনো? ও কি করে?

যুবকটি জানালা থেকে দৃষ্টি সরিয়ে এনে মাথা নিচু করে চিন্তিত ভঙ্গিতে হাঁটতে শুরু করে। সে কেবল চলমান পথচারীদের পা দেখতে পাচ্ছিল। পথচারীদের জুতা এবং প্যান্ট দেখে সে অনায়াসে বলতে পারে কে পুরুষ বা কে মহিলা, কে যুবা কিংবা কে বুড়ো। এছাড়া পথচারীদের হাঁটার ভঙ্গি দেখে তাদের জীবিকা সম্পর্কে সে একটা স্বচ্ছ ধারণা করতে পারে। এমনকি তাদের নাম এবং কখন, কোথায়, কাকে দেখেছে, অনায়াসে তা-ও সে বলে দিতে পারে। সে জানে কোনোদিন কাদের দেখেনি। সেই নির্দিষ্ট দিনে কারোর সঙ্গে সাক্ষাত না হলে সে ভীষণ চিন্তিত হয়ে পড়ে। হয়তো কিছু একটা…

যুবকটি একসঙ্গে অনেক পায়ের শব্দ শুনতে পেল। কাছাকাছি শব্দ আসতেই একজনের এক পা তার দৃষ্টির সীমানায় এসে ধরা পড়ে। নিশ্চয় লোকটি যুদ্ধে আহত হয়েছে। কিন্তু কোথায়?

এখনই তরুণী আবার জানালার পাশে এসে দেখা দেবে। যুবকটি হাঁটার গতি মন্থর করে। সে শুনতে পাচ্ছে সুরেলা পদধ্বনি ক্রমশ তার দিকে এগিয়ে আসছে। পায়ের শব্দে তার উৎকণ্ঠার পারদ একবার বাড়ছে, আবার পরমুহূর্তে নেমে যাচ্ছে। যখন তারা খুব কাছাকাছি চলে এসেছে, তখন যুবকটি এক জোড়া পা দেখতে পেল। তার বুকের ভেতর ধুকপুকানি বেড়ে যায়। যেই হোক না কেন, তাতে তার কিছু যায় আসে না। মেয়েটি হয়তো তার দিকে তাকিয়ে আছে। যদি ওরা জিজ্ঞেস করে… ঠিক আছে, ওরা যা খুশি জিজ্ঞেস করুক। মেয়েটির কাছে সে অনেক কিছু। তাই মেয়েটির দিকে তাকানোর তার অধিকার আছে এবং সে মাথা উপরে তুলে তাকায়। এই সেই আকাঙ্ক্ষিত নারী। তাদের যখন দৃষ্টি বিনিময় হয়, তখন মেয়েটি শব্দহীন হাসির পরাগ ছড়িয়ে দেয় তার ঠোঁটের ফাঁকে। যুবকটির ঠোঁট আলতো করে সামান্য কেঁপে ওঠে। তার পাশ কেটে মেয়েটি রাস্তার শেষ সীমানায় চলে যায়। মেয়েটি চলে যাওয়ার পরও চারপাশের বাতাসে মৌ মৌ করছিল পারফিউমের সুগন্ধি ।

যদি ওরা জানতে চায়, তোমার সঙ্গে কি মেয়েটির পরিচয় হয়েছিল? জবাবে সে কি বলবে? না, মেয়েটির সঙ্গে আমার কোন পরিচয় হয়নি। তাহলে মেয়েটি কেন হেসেছিল? আমি জানি না। তবে মেয়েটির সঙ্গে পরিচিত হবার ইচ্ছে ছিল। না, ওরা তা দেখতে পাবে না।

যত চেষ্টাই করুক না কেন, যুবকটি মাথা তুলে সরাসরি তাকাতে পারেনি। মেয়েটি তার সামনে দিয়ে চলে যাবার পরেও পারফিউমের আকুল করা সুগন্ধ রাস্তার আশেপাশের বাতাসে ভেসে বেড়ায়। যদিও ভিন্ন পথে যেতে চেয়েছিল, কিন্তু সে সোজা পথ ধরে হাঁটতে থাকে। ঘরবাড়ির পাশ কেটে আঁকাবাঁকা সরু পথে যেতে পারতো। এসব সরু পথ অনেকটা ছোট নালার মতো, যা একসময় বড় রাস্তার সঙ্গে মিশেছে। বড় রাস্তায় অসংখ্য গাড়ির বহর এবং চলমান মানুষের কোলাহল। ভিড়ের মাঝে নিজেকে অপরিচিত ভাবার এক অলৌকিক আনন্দ তাকে সম্পূর্ণ আচ্ছন্ন করে রাখে। এখানে কেউ তাকে অনুসরণ করছে না। এখন সে মুক্ত।

কিন্তু ওরা যদি জিজ্ঞেস করে, কেন তুমি ওখানে গিয়েছিলে? তখন সে কি বলবে? ওখানে হয়তো কেউ ছিল যাকে তুমি চেনো? তার পরিচয় কি?

যুবকটি বড় রাস্তায় এসে দুপাশে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। আশেপাশের আওয়াজ শুনে সে বুঝতে পারে তাকে ডান দিকে ঘুরে কয়েকশ’ মিটার হেঁটে বাস স্টপে পৌঁছতে হবে। থেমে সে বাম দিকে তাকায়।

কোনোদিন সে লক্ষ্য করেনি এই রাস্তাটা কোথায় শুরু হয়েছে এবং কোথায় গিয়ে শেষ হয়েছে। যদিও বাড়িতে টেবিলের দেরাজে শহরের একটা মানচিত্র রয়েছে এবং সেই মানচিত্র দেখে রাস্তার খুঁটিনাটি সব জানে, কিন্তু বাস্তবে রাস্তা সম্পর্কে তার তেমন কোন অভিজ্ঞতা নেই। অফিস থেকে সন্ধ্যাবেলা বাড়ি পৌঁছে সে প্রায় প্রতিদিনই মানচিত্র নিয়ে বসে। টেবিল ল্যাম্পের আলোর নিচে মানচিত্র খুলে সে মনে মনে শহরের বিভিন্ন সড়ক পথে হাঁটাহাঁটি করে। এক রাস্তা থেকে আরেক রাস্তায় যায় এবং অবশেষে সে চৌরাস্তার মোড়ে এসে থামে। কখনো সে সিনেমা কিংবা নাটক দেখে এবং অন্য সময় লাইব্রেরিতে ঢুকে পত্রপত্রিকা পড়ে। ফেরার পথে পানশালায় ঢোকে। অবশেষে সে অবসন্ন শরীর নিয়ে ঘরে প্রবেশ করে। তখন তার খাওয়ার কোন রুচি থাকে না। সে ক্লান্ত শরীরটাকে সোফার উপর এলিয়ে দেয়। অফিস শেষে ঘরে ফেরার পথে আজ সে দোকান থেকে একটা ঠাণ্ডা স্যান্ডউইচ কিনে এনেছে, কিন্তু এখন সেটা খাওয়ার কোন ইচ্ছে তার নেই। কাল সকালে বাসি স্যান্ডউইচ বুড়ো দারোয়ানের বিড়ালকে খাওয়াবে। তখন বিড়ালটা কৃতজ্ঞতায় একবার আড়চোখে তাকাবে। এসব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে সে না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।

বাম দিকে কেন তুমি তাকিয়েছিলে? যদি ওরা জিজ্ঞেস করে, তবে উত্তরে সে কি বলবে? ঠিক আছে, সে বলবে দম নেয়ার জন্য বাম দিকে তাকিয়েছিল। ইদানিং তার শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে বেশ কষ্ট হচ্ছে। মাঝেমধ্যে বুকের ভেতর নিঃশ্বাস আটকে যায়। তার কারণ হয়তোবা রাস্তার যানবাহনের দূষণ কিংবা ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া হজম হচ্ছে না। হয়তো তুমি কারোর জন্য অপেক্ষা করছিলে? না, আমি কারোর জন্য অপেক্ষা করিনি।

চটজলদি যুবকটি ডান দিকে মোড় নেয়। পুনরায় সে মাথা নিচু করে, যাতে রাস্তায় চলমান কারোর চোখাচোখি না হয়। ওদের দিকে তাকাচ্ছ কেন? হয়তো তুমি ওদের চেনো? আমি ওদের দিকে তাকাইনি এবং কাউকেই আমি চিনি না।

বাস স্টপে অনেক মানুষ অপেক্ষা করছে। প্রত্যেকেই নিজের চিন্তায় মশগুল। কেউ কারোর সঙ্গে কোন কথা বলছে না। মনে হয় আলাপ করার মতো কোন বিষয় নেই। যুবকটি আবার হেলিকপ্টারের শব্দ শুনতে পেয়ে ধূসর আকাশের দিকে তাকিয়ে খুঁজতে থাকে। প্রত্যেক দিনের মতো আজও সে বাসের জন্য ঠিক চার মিনিট অপেক্ষা করে। বাস এসে থামলে কয়েকজন যাত্রী উঠানামা করে। বাস বোঝাই যাত্রী। তিল ধারণের জায়গা নেই। একজন আরেকজনের গায়ের সঙ্গে লেপ্টে আছে এবং একজনের পায়ের আঙুলে অন্যজনের পায়ের চাপ পড়ছে। কিন্তু কেউ কোন উচ্চবাচ্য করছে না। যুবকটি বাসের সিলিংয়ের রড ধরে দাঁড়িয়ে আছে। তার সামনের সিটে বসা এক গ্রাম্য বৃদ্ধলোক। লোকটির হাতে এক টুকরো কাগজ। তাতে ঠিকানা লেখা আছে। সে কাগজটি দেখিয়ে যাত্রীদের ঠিকানা জিজ্ঞেস করছে। যুবকটি ঠিকানাটা লক্ষ্য করে। ‘পোষ্টাফিস স্টপ, শাখা ৪৮।’

বুড়ো লোকটির পাশের যাত্রী শ্রাগ করে বললো, ‘দুঃখিত। আমি ঠিকানা জানি না।’ বলেই সে জানালার বাইরে রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকে।

লোকটির উন্নাসিক ব্যবহার যুবকটির কাছে কেমন যেন অসহ্য মনে হল। ‘আমি কি আপনাকে পথ দেখাতে পারি?’ সে বুড়ো লোকটিকে জিজ্ঞেস করে।

‘হ্যাঁ, তাহলে তো খুব উপকার হয়।’ কৃতজ্ঞতার মোলায়েম কণ্ঠস্বরে বুড়ো লোকটি বললো।

যুবকটির অফিসের দুই স্টপেজ পরেই পোষ্ট অফিস। প্রত্যেকটি বাস স্টপেজ সে খুব ভালো করেই চেনে। কেননা শহরের মানচিত্র দেখে এ সব বাস স্টপেজ সম্পর্কে সে একটা স্বচ্ছ ধারণা তৈরি করে নিয়েছে।

‘আমি নেমে যাওয়ার পর দুই স্টপেজ পরে নামবেন।’ বৃদ্ধলোকটিকে উদ্দেশ্য করে যুবকটি বললো।

কেমন করে তুমি জানো, ওটাই সঠিক বাস স্টপেজ? যদি কেউ জিজ্ঞেস করে, তাহলে সে কি বলবে? হয়তো তুমি ওখানে চিঠি পোষ্ট করতে গিয়েছিলে। না, আমি কাউকেই কোন চিঠি লিখিনি। কাকে চিঠি লিখেছ? সে কে? কোথায় থাকে? কি করে? তার সঙ্গে তোমার কি সম্পর্ক? অথবা হয়তো…।

যুবকটির মনে পড়লো বেশ কিছুক্ষণ আগে পোষ্ট অফিসে যাওয়ার রাস্তায় সশস্ত্র সৈনিকদের মধ্যে তুমুল বাক-বিতণ্ডা হয়েছিল। এখন তারা যে রাস্তায় আছে, তার সমান্তরাল সেই রাস্তাটা। চৌরাস্তার মোড়ে সেনাবাহিনীর একটা জিপ পাহারা দিচ্ছে। একজন অফিসার এবং দুজন সাধারণ সৈনিক মারা গেছে। সে সময় যুবকটি অফিসে ছিল এবং সে গুলির শব্দ শুনেছে। ঘটনাটি এখনো খবরের কাগজে প্রকাশিত হয়নি, এমনকি এ সম্পর্কে রেডিওতেও কোন সংবাদ প্রচারিত হয়নি। ঘরে ফেরার পথে দোকানে কয়েকজন লোকের ফিসফিসানিতে সে ব্যাপারটা শুনেছে।

একধরনের অদৃশ্য আতঙ্কে যুবকটির চোখমুখ ফেকাসে হয়ে যায়। হয়তো তুমি গোলাগুলিতে অংশগ্রহণ করেছিলে? না, তখন আমি অফিসে ছিলাম। কেমন করে তুমি নিশ্চিত হলে? হয়তো সেনাবাহিনীর জিপ আসার আগে তুমি ওখানে গিয়েছিলে এবং তোমার পরিকল্পনা ছিল… কার সঙ্গে তুমি পরিকল্পনা করেছিলে?

যুবকটির মস্তিষ্কের ভেতর ক্রমশ দুশ্চিন্তা এবং উৎকণ্ঠার কালো মেঘ এসে ঘনীভূত হতে থাকে। সে বুকের ভেতর একধরনের চিনচিন ব্যথা অনুভব করে। ব্যথাটা বুক থেকে নেমে পেটের মধ্যে পরিপাকতন্ত্রের দিকে যেতে থাকে। সে ভাবল, হয়তো না খাওয়ার জন্য তার এমন লাগছে। ইদানিং খাওয়ার প্রতি তার অনীহা বেড়ে গেছে। মনে মনে ঠিক করে, শীঘ্রই অফিস থেকে একটা চিঠি নিয়ে সে ডাক্তারের কাছে যাবে।

‘আপনি কি… অফিসের একজন কর্মচারী?’

ওভারকোট গায়ে একজন লোক পাশে দাঁড়িয়ে যুবকটির চোখের দিকে সরাসরি এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে। লোকটির তাকানোর ভঙ্গি যুবকটির কাছে মোটেও ভালো লাগল না। সে মাথা নিচু করে দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। কম্পিত গলায় সে বললো, ‘হ্যাঁ, কিন্তু আপনি কি করে জানেন?’

লোকটি এক ঝলক হাসলো। হাসি থামিয়ে সে বললো, ‘আপনিই তো বলেছেন আপনার অফিসের দুই স্টপেজ পরে পোষ্ট অফিস।’

‘হুম।’

‘আপনার সঙ্গে একটা বিষয়ে গোপন আলাপ করতে চাই।’

‘কোন বিষয়ে?’

‘আপনার অফিসে চলুন। ওখানে নিরিবিলিতে বলবো।’

যুবকটি পুনরায় পেটের ভেতর ব্যথা অনুভব করে। ক্রমশ ব্যথাটা পাকস্থলীর ভেতর কুণ্ডলীর মতো পেঁচাতে থাকে। এখন সে কি করবে? বাস এসে একটা স্টপেজে থামে। বাস থেকে সে নেমে যেতে উদ্যত হয়। ‘দয়া করে একটু পথ দিন…’ বলতে বলতে সে তাড়াতাড়ি বাসের দরজার কাছে যায়। গ্রাম্য বৃদ্ধলোকটি চিৎকার করে উঠে, ‘স্যার, আরো দুই স্টপেজ…?’

বুড়োলোকটির কথায় কান না দিয়ে যুবকটি দ্রুত বাস থেকে নেমে পড়ে। যদিও বাইরের খোলা হাওয়ায় তার খানিকটা ভালো লাগে, কিন্তু তখনো সে পেটের মধ্যে ব্যথাটা অনুভব করে। তাড়াতড়ি সে একটা সরু পথ ধরে হাঁটতে থাকে। কেউ যদি জিজ্ঞেস করে, কেন সে এখানে নেমেছে, তাহলে সে সোজাসুজি বলবে, তার পেট ব্যথা করছিল এবং তাকে টয়লেটে যেতে হবে। আসলেই সে পেটে প্রচণ্ড চাপ অনুভব করছে। রাস্তার আশেপাশে কিংবা শেষ মাথায় যদি কোন টয়লেট খুঁজে না পায়, তাহলে পরিস্থিতি আরো খারাপ হবে। সে না পারছিল দৌড়ুতে, না পারছিল সহজ ভঙ্গিতে হাঁটতে। যাহোক, অবশেষে সে টয়লেটের সন্ধান পেয়ে দ্রুত গতিতে হেঁটে প্রাকৃতিক ডাকে সাড়া দেয়। সে ভাবল, এই ডায়রিয়া তাকে নিশ্চয় কয়েকদিন ভোগাবে।

প্রাথমিক কাজ সমাধান করে যুবকটি চোখ মেলে সামনের দিকে তাকায়। দরোজার কাঠে কাঁচা হাতে আজেবাজে মন্তব্য লেখা এবং মানুষের নগ্ন ছবি আঁকা। লেখাগুলো পড়ার খুব ইচ্ছে হল তার। কিন্তু কেন? আপন মনে সে বললো, প্রাকৃতিক ডাকে সাড়া দেয়ার জন্য টয়লেটে ঢুকেছে, আজেবাজে লেখা পড়ার জন্য নয়। তবুও কৌতুহল চেপে রাখতে না পেরে সে লেখা পড়তে শুরু করে। অশ্রাব্য সব লেখা পড়ে তার মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে যায়। দরোজার একপাশে সুন্দর হাতের লেখায় কেউ একজন লিখেছে, ‘আর কতদিন এই স্বৈরাচারী শাসকদের দুঃশাসন সহ্য করতে হবে?’

হঠাৎ যুবকটির মাথা থেকে পা অবধি একটা অদৃশ্য বিদ্যুৎ তরঙ্গ খেলে গেল। সে ভয়ে এবং আতংকে প্রায় লাফিয়ে ওঠে। এটা কে লিখেছে? হয়তো কেউ। সে চারপাশে তাকিয়ে দেখে। না, কেউ নেই। সে একা। একসময় ভয়ার্ত দৃষ্টিতে উপরের দিকে তাকায়। কোথাও কেউ নেই, এমনকি কোথাও কোন গোপন ক্যামেরা নেই। কেউ তাকে দেখতে পারছে না। অবলীলায় তার চোখ ফিরে যায় লেখার বাকি অংশটুকুতে। ‘দুঃশাসনের বিরুদ্ধে কেন কেউ কোন প্রতিবাদ করে না? শুধুমাত্র গেরিলা যুদ্ধের সম্প্রসারণের মাধ্যমে এই দুঃশাসনের বিরুদ্ধে চাপ সৃষ্টি করা যেতে পারে।’

কেউ তাকে দেখে ফেলার ভয়টা যুবকটির সমস্ত মস্তিষ্ক জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে এবং কেন জানি তার ধারণা জন্মায় যে সে হয়তো লিখেছে। সত্যি সত্যি ওরা যদি জিজ্ঞেস করে, তুমি কি লিখেছ? তাহলে সে কি বলবে? সে লেখেনি। এটা তার হাতের লেখা নয়। হয়তো সে ইচ্ছে করে তার হাতের লেখা বদলে লিখেছে। না, এটা কিছুতেই সম্ভব নয়। লেখাটা হালকা নীল রঙের বলপয়েন্টে লেখা। যদিও তার কাছে একটা নীল রঙের এবং আরেকটা লাল রঙের বলপয়েন্ট রয়েছে, কিন্তু ওগুলো তার পকেটে ভীষণ ভারী মনে হল। এখন যদি সে দরজা খুলে বেরোয় এবং কেউ চট করে তার শার্টের কলার চেপে ধরে, তাহলে …? ঠিক সে সময় কেউ একজন দরজার কড়া নাড়ে। ভয়ে সে উঠে দাঁড়ায়। এখন কে কড়া নাড়ে? কড়া নাড়ার শব্দ শুনে বুঝা যায় তার টয়লেটে যাবার হয়তো প্রয়োজন নেই। তবে কি সে একজন গুপ্তচর? সম্ভবত সে লেখাটা নষ্ট করে ফেলবে। এলোমেলো ভাবতে ভাবতে যুবকটি তার কোটের পকেট থেকে বলপয়েন্ট বের করে। কোথায় সে নীল রঙের কলমটা লুকাবে? না স্যার, আমার নীল রঙের কোন কলম নেই। এই যে পকেট দেখুন। টয়লেটের ভেতর এমন কোন গোপন জায়গা নেই যেখানে সে কলমটা অনায়াসে লুকোতে পারে। সে যদি পানির ট্যাঙ্কের উপর লুকিয়ে রাখে, তাহলে ওরা অবশ্যই ওটা খুঁজে পাবে। যাহোক, কলমের গায়ে তার আঙুলের ছাপ আছে। তাতে ব্যাপারটা আরো বেশি খারাপ হবে। সে যদি… না, কিছুতেই সে কলমটা গিলতে পারবে না। সে যদি কলমটা কমোডের ভেতর ফেলে দেয়, তাহলে…। তাহলে কলমটা কমোডের ভেতর আটকে যাবে এবং তাতে পরিস্থিতি আরো বেশি খারাপ হবে। আবারো সে দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ শুনতে পেল।

‘অপেক্ষা করুন। এই তো বের হচ্ছি। এক মিনিট…।’

যুবকটি কমোড থেকে উঠে দাঁড়িয়ে প্যান্টের জিপার টানতে টানতে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে চারপাশে তাকায়। ভেবে পায় না এখন সে কি করবে। পুনরায় কড়া নাড়ার শব্দে সে কলমটা ছুঁড়ে ফেলে দেয়। প্রথমে দেয়ালের গায়ে ধাক্কা লেগে শব্দ হয় এবং পরে মেঝেতে পড়ার সময় আরেকবার শব্দ হয়। তখনই পাশের টয়লেটে কেউ একজন ঢোকে। সে দরোজা খুলে বেরিয়ে আসে। একজন লোক চোখেমুখে রাগের চিহ্ন ফুটিয়ে তার দিকে তাকিয়ে টয়লেটে প্রবেশ করে।

যে কোন মুহূর্তে নিশ্চয় লোকটি লেখাটা দেখতে পাবে। যুবকটি হাত না ধুয়ে তাড়াতাড়ি টয়লেট থেকে বেরিয়ে আসে। আরেকজন লোকের সঙ্গে তার প্রায় ধাক্কা লেগে যাচ্ছিল। কোনরকম ক্ষমা চাওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব না করে সে নিঃশ্বাস বন্ধ করে এক দৌড়ে সরু রাস্তার শেষ মাথায় এসে থামে। লোকটা যদি তাকে অনুসরণ করে, তাহলে…? সে ঘাড় ঘুরিয়ে পেছন দিকে তাকায়। না, কেউ তাকে অনুসরণ করছে না। বড় রাস্তায় এসে সে ডান দিকে মোড় নিয়ে তার অফিসের দিকে হাঁটতে থাকে। অফিসে পৌঁছানোর এই বিলম্বের কি কৈফিয়ত সে দেবে? সে তার হাতঘড়ির দিকে তাকায়। পৌনে আটটা বাজে। ইতিমধ্যে অফিসে পৌঁছানোর কথা। কিন্তু অফিসে পৌঁছতে তার আরো পনের মিনিট লাগবে। যদি সে একটা ট্যাক্সি করে যায়, তাহলে হয়তো কিছুটা সময় আগে যেতে পারবে। কিন্তু তাতে সময়ের খুব বেশি তফাৎ হবে না। দেরি মানেই দেরি। অল্প সময় কিংবা বেশি সময় দেরি করার মধ্যে তেমন কোন ফারাক নেই। আসল কথা হচ্ছে, অফিসে যেতে তার দেরি হয়ে গেছে। এতক্ষণ তুমি কোথায় ছিলে এবং সঙ্গে কে ছিল?

যুবকটির কাছে মনে হয় তার এ জীবন অভিশপ্ত। আক্ষেপের সুরে সে আপন মনে বললো, এই অভিশপ্ত জীবনে কিছুই হবে না। বলতে বলতে সে অফিস পেরিয়ে বাম দিকে ঘুরে সজোরে হাঁটতে থাকে। রাস্তায় কালো পিচের উপর ট্যাংকের চেইনের দাগগুলোর উপর দিয়ে সে রীতিমত লাফিয়ে লাফিয়ে অতিক্রম করার চেষ্টা করে। একটা চলন্ত মোটরবাইকের সঙ্গে প্রায় ধাক্কা লেগে যাচ্ছিল। কোনরকম নিজেকে রক্ষা করে সে অন্য রাস্তা ধরে দ্রুত দৌড়ুতে থাকে।

‘এত তাড়াহুড়া কিসের ?’

একজন পথচারী যুবকটির ঘাড় চেপে ধরে প্রচণ্ড ঝাকুনি দেয়। পথচারীকে স্বাভাবিক মনে হল না। তার পরনে ওভারকোট এবং মাথায় টুপি। চোখ দুটি জ্বলজ্বল করছে এবং সে একটা কিছু খুঁজছে। হয়তো সে একজন গুপ্তচর।

‘তোমাকে সন্দেহজনক লাগছে।’

‘আমি কিছুই করিনি।’

‘কে জানে…?’

পথচারী লোকটি ব্যঙ্গাত্মক ভঙ্গিতে হেসে বললো। সে সময় তার চোখেমুখে বিদ্বেষের ছবি ফুটে উঠে। যুবকটি চোখেমুখে হাসি ফোঁটানোর চেষ্টা করে। সে খুব আস্তে কথা বলে যেন আশেপাশের কেউ শুনতে না পায়। তারা পাশাপাশি হাঁটতে থাকে।

‘তাহলে তুমি কি করেছ ?’

‘ওটা আমি লিখিনি।’

‘অবশ্যই তুমি ওটা লিখেছ। ওটা তোমার হাতের লেখা।’ যুবকটির মুখের উপর হাসতে হাসতে লোকটি বললো।

চট জলদি যুবকটি ভাবল, কেন সে অযথা জীবনটা খোয়াবে।

হঠাৎ যুবকটি দৌড়ুতে শুরু করে। সে কিছুতেই বলতে পারবে না লোকটি কি আদৌ তাকে অনুসরণ করছিল। চৌরাস্তার মোড়ে এসে সে একটা ট্যাঙ্কের আড়ালে লুকায়। সে জানে একশ ফুট দূরে কাছাকাছি কোথাও নদী আছে। মানচিত্রে সে অনেকবার এই নদী পেরিয়েছে। অনেক সময় সে নদীর পাড়ে নেমে পাথরের উপর বসে মাছ ধরেছে। যে মেয়েটিকে সে প্রতিদিন জানালার পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছে, সে-ও ওখানে আসে। বহুবার তারা বাজি ধরেছে, যে আগে মাছ ধরতে পারবে, সে অন্যজনকে সিনেমা দেখাবে।

যুবকটি নদীর ধারে এসে পৌঁছায়। আশেপাশের সবকিছু দেখতে এমন যেন সে মনে মনে আগেই ভেবেছিল এ রকম দৃশ্য সে দেখতে পাবে। ব্যতিক্রম শুধু নদীর পানি নীল রঙের নয়। পানির রঙ ভয়ংকর ঘোলাটে, যা তার মনের মধ্যে প্রচণ্ড ভয় তৈরি করে। এ পানিতে ডুবে মরা খুবই কষ্টদায়ক। পুলের রেলিং ধরে সে নিচের দিকে তাকিয়ে নদীর গভীরতা পরখ করে। পানির উপর হলুদ রঙের একধরনের ফেনা ভাসছে এবং স্রোতের সঙ্গে শেওলার মতো ময়লা ভেসে যাচ্ছে। সে কি ঝাঁপ দিবে, নাকি দেবে না ? এ দোটানায় সে দুলতে থাকে। একসময় যুবকটি ঝাঁপ দেওয়াই সঙ্গত বলে মনে করলো। তার এই ক্ষুদ্র জীবনের কিই-বা দাম। মরে যাওয়াই ভালো। তাহলে সে নিষ্কৃতি পাবে, মুক্তি পাবে। ওরা কি জিজ্ঞেস করবে না, কেন সে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে ? ওরা জিজ্ঞেস করুক। তাতে তার কিছু যায় আসে না। কেননা মৃত মানুষকে জিজ্ঞাসাবাদ করা যায় না। মনে মনে সে সামান্য খুশি হল। কিন্তু ঝাঁপ দেওয়ার পর যদি সে মারা না যায়, তাহলে কি হবে? না, অবশ্যই সে মারা যাবে। অন্যদের মুখে শুনেছে অনেকেই এ নদীতে ঝাঁপ দিয়ে অতলে ডুবে গেছে। কিন্তু সে যদি মারা না যায়, তখন কি হবে? যদি লোকেরা তাকে উদ্ধার করে এবং জানতে চায়, কেন তুমি আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলে? প্রত্যেকেরই বেঁচে থাকা কিংবা আত্মহননের অধিকার আছে। তাতে অন্যের নাক গলানোর কি দরকার? যুবকটি নিজেকে বললো, এখন তোমার জীবন তোমার হাতের মুঠোয়। কিন্তু তুমি এমন কি কাজ করেছ যে তা থেকে পরিত্রাণ পেতে চাও? কিছুই না। কিছু না হলে কেউ কখনো আত্মহত্যা করে না। সত্যি করে বলো। মিথ্যা বললে কোন লাভ হবে না। অবশ্যই এমন কিছু করেছ, যার হাত থেকে মুক্তি পেতে তুমি আত্মহত্যা করতে চাও। আসলে এটা তার অসহায়ত্ব, একধরনের নিরাশা। নিরাশা? কিন্তু কেন তোমার মনে নিরাশা? তাহলে কি তুমি বলতে চাও, তোমার কোন আশা নেই? তার কোন আশা নেই। কিন্তু কেন নেই? এমন কি হয়েছে যে তার আশার আলো নিভে গেছে? কোন কিছুতেই কি তার কোন আশা নেই? হ্যা, আছে এবং সবকিছুতেই তার আশা আছে।

যাহোক, শেষপর্যন্ত যুবকটি মত পরিবর্তন করে পিছন ফিরে রেলিংয়ের সঙ্গে ঠেস দিয়ে দাঁড়ায়। একসময় সে চোখ বন্ধ করে। তার প্রতি কোনরকম ভ্রুক্ষেপ না করে পথচারীরা পাশ কেটে যে যার মতো চলে যাচ্ছে। কেন সে আত্মহত্যা করবে? কেন সে নিজের জীবন ধ্বংস করবে? বেঁচে থাকা কি অর্থপূর্ণ নয়?

কিছুক্ষণ বাদে যুবকটি মন্থর গতিতে চৌরাস্তার মোড়ে এসে দাঁড়ায়। তখনও সেখানে আর্মির ট্যাংক থেমে আছে। একজন সৈনিক ট্যাংকের পাশে দাঁড়িয়ে পাহারা দিচ্ছে এবং চলমান মানুষের দিকে তাকিয়ে হাসছে। যুবকটি সরাসরি সৈনিকের কাছে যায় এবং প্রচণ্ড ঘৃণায় তার চোখের দিকে তাকিয়ে কলার চেপে ধরে। সে চিৎকার করে জিজ্ঞেস করে, ‘আমাদের কাছে কি চাও?’

সৈনিকের বন্দুক থেকে বিকট শব্দে বুলেট বেরোনোর ঠিক আগের মুহূ্র্তে যুবকটি প্রচণ্ড রাগে এবং ক্ষোভে কাঁদতে কাঁদতে চিৎকার করে বললো, ‘শালারা, এখান থেকে তোরা চলে যাস না কেন?’

মূল: মোহাম্মদ আসেফ সোলতানজাদে

অনুবাদ: ফজল হাসান

[লেখক পরিচিতি: আধুনিক আফগান কথা সাহিত্যে যে সব অভিবাসী আফগান লেখক সাহিত্যাঙ্গনে নিজেদের আসন পাকাপোক্ত করতে পেরেছেন, তাদের মধ্যে মোহাম্মদ আসেফ সুলতানজাদে অন্যতম। ১৯৬৪ সালে আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। মাত্র দু’বছর তিনি কাবুল বিশ্ববিদ্যালয়ে ফার্মেসিতে পড়াশুনা করেন। সোভিয়েত আগ্রাসনের সময়ে ধরা পড়ার ভয়ে ডিগ্রী শেষ না করেই তিনি ১৯৮৫ সালে পাকিস্তানে পালিয়ে যান। পরের বছর তিনি ইরানের অভিবাসী হন। পরবর্তীতে ২০০২ সালে ইরান সরকার আফগানদের উচ্ছেদ করলে তিনি স্থায়ীভাবে বসবাস করার জন্য ডেনমার্কে গমন করেন। তিনি ছোটগল্প এবং উপন্যাস ছাড়াও বেশ কিছু নাটক রচনা করেন। তার প্রকাশিত ছোটগল্প সংকলনের মধ্যে ‘উই ডিসঅ্যাপিয়্যার ইন ফ্লাইট’, ‘নিউইয়ার্স ডে ইজ ডিলাইটফুল অনলি ইন কাবুল’, ‘দিস ইজ ডেনমার্ক’ এবং ‘দ্য ডেজার্টার’ উল্লেখযোগ্য। ‘উই ডিসঅ্যাপিয়্যার ইন ফ্লাইট’ এবং ‘দ্য ডেজার্টার’ গল্প সংকলনের জন্য তিনি যথাক্রমে ২০০১ এবং ২০০৭ সালে ইরানের সম্মানিত ‘গলশিরি অ্যাওয়ার্ড’ লাভ করেন। তার গল্প আরবি সহ ইউরোপের বিভিন্ন ভাষায় অনুদিত হয়েছে। ‘পেশা’ গল্পটি মোহাম্মদ আসেফ সুলতানজাদের ‘অকিউপেশন’ গল্পের অনুবাদ। ‘ফার্সি’ থেকে ইংরেজিতে গল্পটি অনুবাদ করেন সিমা নাহান। ইংরেজিতে গল্পটি ২০০৯ সালে ‘ইরানিয়ান.কম’-এ প্রকাশিত হয়।]

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত